বাজারের থলে হাতে মাঠের পাশ দিয়ে যেতেই রফিক ভাইয়ের ডাক দিয়ে বসলো আমাকে৷ শুনেও না শুনার ভান করে হেঁটে যাচ্ছি৷
মনে মনে চাচ্ছিলাম আর যেন ডাক না দেয়৷ কিন্তু রফিক ভাই আবার ডাক দিলেন৷ আমি আমার মতোই হাঁটছি৷
রফিক ভাইয়ের পাশে বসা শরীফ ভাই তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠে বলে বসল,
-শুনলাম আবার ফেইল মেরেছে৷ চাচাজান যা রাগী৷ সম্ভবত চড় দিয়ে বধির বানিয়ে দিয়েছে৷”
কথাটা আমার ভেতরে গিয়ে লাগলো৷ রাগে-ক্ষোভে ইচ্ছে করছিল শরীফ ভাইয়ের গালটা লাল করে দিই৷
পরক্ষণেই নিজের অবস্থানটা মনে পরে৷ বাজারের পথে হাঁটা ধরলাম আবার৷
শুক্রবারের সকালটা আমার কাছে অসহ্য লাগে৷ মাঠ,ঘাট ভর্তি মানুষ থাকে৷
দেখলেই পড়ালেখার কথা জিজ্ঞেস করে বসবে৷ অনেকে জেনেও আবার জিজ্ঞেস করে৷
আমি চুপ করে থাকি৷ আর প্রতি শুক্রবারের সকালে আমাকে বাজারে পাঠিয়ে বাবা আনন্দ পায়৷
অবশ্য বাবার কথাই বা কি বলি আমি! আমার নিজেরই নিজের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়৷
এই নিয়ে তিনবার ফেইল মেরেছি উচ্চ মাধ্যমিকের নির্বাচনী পরীক্ষায়৷ স্যারেরা কিছুতেই তুলতে রাজি না৷
বোর্ড পরীক্ষায় যেতে পারলে মান কিছুটা বাঁচতো৷
সেটাও হলো না৷
ছোট বোনটা এবার ক্লাসমেট হয়ে পরেছে৷
আজকাল ভাইয়া বলে ডাকে না আমাকে৷ নাম ধরে ডাকা শুরু করেছে৷
সেদিন সকালে নাস্তার টেবিলে হুট করে যখন নাম ধরে ডাকলো৷ আমি অনেকখানি অবাক হলাম৷
বাবার দিকে তাকালাম একবার৷ বাবার মুখে স্বভাবসূলভ গম্ভীরতা৷
মা টুপ করে সরে পরে চেয়ার ছেড়ে৷
বুঝলাম বাবার পরামর্শেই ছোট বোন নাম ধরে ডাকা শুরু করেছে৷
মাঝে মাঝে ছোট বোনের সাথে ঝগড়া লাগে আমার৷ ঝগড়া না অবশ্য৷ আমি খুনঁসুটি মনে করি৷ কিন্তু ছোট বোন সেটা মানতে নারাজ৷ একটু এদিক ওদিক হলেই তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলে৷
অগত্যা আমি চুপ করে থাকি৷
কখনো বাবার ভয়ে৷ আবার কখনো “ফেল্টুস কোথাকার” নামক খোঁটা শোনার ভয়ে৷
ছোট বোনের কথা বাদ দিলাম৷ বড় আপার সদ্য কথা বলতে শেখা মেয়েটা যখন বাসায় আসে৷ আমি তখন “মা” বলে হাত বাড়িয়ে দিই৷
পিচ্চিটাও আজকাল আসে না আমার কোলে৷ মেয়েটা অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“তুমি পতা! তুমি ফেল্তু”
ঘরে তখন হাসির রোল পরে৷ তাদের সাথে আমিও বেক্কলের মতো হাসি ঝুলিয়ে রাখি মুখে৷
আমার লজ্জা লাগে খুব৷ বালিশ জড়ানো কান্না শেষে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করি, এবার পাশ করবোই আমি৷
সবকিছু ঝেড়ে পড়তে বসি আবারো৷ মন লাগিয়ে পড়ি৷ কিছুক্ষণ পর পেটে টান লাগে৷
খুব ইচ্ছে করে চিৎকার করে মাকে বলতে,
মা পড়তে পড়তে ক্ষুধা লেগেছে! ভাত দাওতো৷”
পরক্ষণেই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে ফেলি৷
বেসময়ে খাবার খাওয়া যাবে না একদম৷ আব্বা বলে দিয়েছে, মেপে মেপে খেতে হবে৷ যতদিন না পাশ করি৷
পেটে ক্ষুদা নিয়ে পড়তে থাকি আবারো৷
বোনের বান্ধবীগুলো আসে মাঝে মাঝে৷ ওরাও দেখি আজকাল নাম ধরে ডাকা শুরু করেছে৷ আমি চুপচাপ থাকি৷
প্রতিবাদ করার মুখ নেই আমার৷
যে যায় বলুক না কেন৷
আমার প্রতিবাদ করা চলবেনা৷ সব মুখবুজে সহ্য করে যাবে৷ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখবে৷
দিন কয়েক ফারিয়া আপুর বিয়ে হয়েছে৷ আমার খালাতো বোন৷ আমাকে ভালোবাসতো অনেক৷ আপুর বিয়েতে যাওয়া হয়নি৷
খুব ইচ্ছে ছিল আপুকে বৌ এর সাজে দেখবো৷ আপুকে আমি প্রায়ই বলতাম,
তোমার পাশে বসে অনেকগুলো ছবি তুলবো তোমার বিয়েতে৷”
আমার সেই ইচ্ছেটা আর পূরণ হয়নি৷
আমি ইচ্ছে করেই যাইনি অবশ্য৷
গেলেইতো সবার কাছে ফেইল করার কৈফিয়ত দিতে দিতেই বিয়ে শেষ হয়ে যাবে৷
টিভির সামনে অনেকদিন বসা হয় না৷ আগে মাঝে মাঝে বাবার পাশে বসে খবর দেখতাম৷ এখন সেটাও হয় না৷
টিভিতে সাধারণ কিছু দেখলেই আমার সাথে তুলনা দিয়ে বসাটা বাবার পছন্দের হয়েছে আজকাল৷
কলেজ আর যাওয়া হয় না৷ ঘরে বসেই দিনগুলো কাটছে৷
আগের জামাটা পুরনো হয়েছে৷ টেনেটুনে পরেছি অনেকদিন৷ গত সপ্তাহে যখন জামার আবদার উঠালাম৷
বাবা গম্ভীর গলায় বলল,
কলেজ যাওয়ার দরকার নেই তোর৷ নিজে তো লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছিস৷ এবার আমার মেয়েটাকেও লজ্জায় ফেলবি৷”
বাবার কথাটা ঝাজালো হলেও আমার লাগেনি অতোটা৷ ভালোইতো বলেছে৷ ছোট বোন টা লজ্জায় পরবে৷ তার ৩বছরের বড় ভাই ফেইল মেরে ছোটবোনের ক্লাসমেট! ছিঃ ছিঃ!
একদম কলেজ যাওয়া যাবে না৷
রান্নার কাজে মাকে ছোটখাটো সাহায্য করার দায়িত্বটা আমার কাঁধে পরেছে৷ আম্মা অবশ্য কিছু করতে দেয় না আমাকে৷
পাশে বসিয়ে বলে,
তুই আমাকে দেখে থাক আব্বা৷ তোর চেহারাটা দেখলে আমার শান্তি লাগে৷”
আম্মার সাথে আমার ভালোই সময় কাটে৷
রাতে আমার প্রায়ই ঘুম আসে না৷ কষ্টগুলো আপন মনে হয়৷ রাতটা একান্তই আমার৷ চোখের কোণা বেয়ে পরা জলগুলো আমার বিষণ্ণতা ভরা বুকটাকে হালকা করে দেয়৷
আগে বাবার সামনে মেপে কথা বলতাম৷ অখন ছোটবোনের সামনেও মেপে কথা বলা লাগে৷ একটু এদিক ওদিক হলেই দু’এক কথা শুনে ফেলি আমি৷
মাঝে মধ্য ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে চলে যাই৷ কিন্তু আপন মানুষগুলো মুখটা হুট করে ভেসে উঠে চোখের সামনে৷
বাজার থলে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম,বড় আপা দুলাভাইকে নিয়ে উপস্থিত৷
সাথে রিমিও এসেছে৷
রিমি বড় আপুর ননদ৷ এবার সেও ক্লাসমেট হয়েছে আমার৷ যদিও জায়গা ভিন্ন৷
চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেলে মেয়েটা৷
দুলাভাই এর সাথে কোলাকুলি করে রিমির দিকে তাকালাম৷ মেয়েটা তাকালোনা আমার দিকে৷
মাঝেমাঝে ফোন দিতো আমাকে৷ কারণ জিজ্ঞেস করলেই বলতো, আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে তার৷
আমারও ভালো লাগতো অবশ্য৷ খুব যত্ন করে কথা বলে মেয়েটা৷ আমারও খুব ইচ্ছে করে কথা বলে সারারাত পার করে দিই৷
কিন্তু পরক্ষণেই নিজের অবস্থানটা মনে পরে৷
গত কিছুদিন ফোন দেয়নি মেয়েটা৷ হয়তো আমার ফোনের আশায় ছিল৷ আচ্ছা মেয়েটা কি জানে?
সে যার ফোনের আশায় থাকে প্রতিরাত৷ সেই মানুষটার চুল কাটার টাকা নিতেও বাবার সামনে অাধঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা লাগে!
মিছে মিছে অভিমান করে মেয়েটা৷ অভিমান ভাঙানোর মুরদ কি আমার আছে আর!
বাসায় বিরিয়ানী রান্না হয়েছে৷ আমার অবশ্য টেবিলে বসে খাওয়া হয়নি৷ বসলেও দুলাভাই নিশ্চিত জানতে চাইবে লেখাপড়ার অবস্থা৷
রিমির সামনে কি জবাব দিবো আমি৷
যদিওবা মেয়েটা জানে৷
আম্মা আলাদা করে রেখেছিল আমার জন্য৷ সেগুলো খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলাম আয়োজনের কারণ৷
দুলাভাই দেশের বাইরে যাবেন৷ সেই উপলক্ষ্যে আয়োজন৷
সবশেষে বড় আপারা যাওয়ার পথ ধরে৷ রিমি মেয়েটার দিকে আমি বারকয়েক তাকিয়েছি৷ আমার দিকে তাকাইনি একবারও৷
আমার মন খারাপ হয় একটু৷
রুমে এসে বালিশটা নাড়া দিতে ছোট্ট কাগজটা চোখে পরে৷
কাগজটাতে খুব যত্ন করে লিখা আছে,
“সমাজের মুখে শান্তনা আজ আর নেই!
আছে বরং লান্ঞ্ছনা৷”