পশ্চিমটা লাল হয়ে উঠল, যেদিন কৃষ্ণচূড়ার বনে হাঁটছিলাম সেদিনের মতো। কেউ আগুন লাগায়নি, তবু প্রস্ফুটিত পুষ্পের মধ্যে অগ্নিশিখা ছিল। তাই দেখে দূর থেকে ভাবছিলাম, সামনে বুঝি বা দাবানল।
চোখ তুলে চেয়ে দেখি, রবি ডুবছে কিন্তু আকাশের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল। আমাদের পথ কি এখনো শেষ হয়নি, ঠাকুর?
সত্তরোর্ধ্ব রাজেন্দ্র ঠাকুর মোটা আসামি বেতের লাঠি ভর দিয়ে আগে, আগে পশ্চাতে দোভাঁজ করা পুরনো শাড়িতে বাঁধা গাঁটরি হাতে সাবিত্রী। পুঁটলিটির মধ্যে উভয়ের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি, বাড়তি বস্ত্র, রন্ধনের তৈজসপত্র, গাড়ু ইত্যাদি। বয়সের ভারে কিঞ্চিৎ কুঁজো সাবিত্রী অগ্রগামীকে অনুসরণ করছিল। ওরা প্রভাতে যাত্রা শুরু করেছে। সাবিত্রী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে কিছু মেঘ করেছিল। তাতে সূর্যালোক পড়ে আকাশ অগ্নিবর্ণ হয়েছিল। সাবিত্রী সেদিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। এবং অগ্রযাত্রীকে প্রশ্ন করে: পথ কি এখনো শেষ হয়নি, ঠাকুর?
না সাবিত্রী, আমাদের আরো আরো অনেক পথ চলতে হবে। রাজেন ঠাকুর উত্তর দেয়।
আর কত দূর?
তুমি কি চৈতার বউ হলে সাবিত্রী?
চৈতার বউ! সেটা কী ঠাকুর?
দেখোনি কোনোদিন?
না তো।
তোমার দেশে বুঝি নেই ও পাখি?
পাখির নাম চৈতার বউ, তাই বলো। কী করে সে?
ফাগুনের দুপুরে আকাশে একা একা ওড়ে এবং ডাকে: আর কত দূর? ও চৈতার বউ, আর কত দূর?
ও বুঝেছি, বউ কথা কও পাখির কথা বলছ?
তোমাদের দেশে ওই বুঝি ওর নাম?
হ্যাঁ, পাখিটা বউ কথা কও, বউ কথা কও বলে কিনা, তাই।
একই কথা সাবিত্রী, আর কত দূর বলাও যা, বই কথা কও বলাও তাই।
কেমন করে, বুঝিয়ে বলো না ঠাকুর।
দূর থেকে প্রিয়ার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। সে যেন বলছে, এসো, এসো! বিরহী পাখি সে কণ্ঠস্বরের পশ্চাতে ছুটছে আর শুধোচ্ছে: আর কত দূর? আর কত দূর? বউ মান করে নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে, পাখি বারবার অনুরোধ করছে, বউ কথা কও। কুহকিনী আশা বেগ প্রদান করছে পাখির পাখায়। তবু সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই জিজ্ঞাসা করছে, আর কত দূর? আর কত দূর প্রিয়ে?
আমিও যে বড্ড ক্লান্ত ঠাকুর। আর পারছি না। ওখানে ওই বিটপীর ছায়ায় একটু বসবে? উহ! কী গরম! আকাশটা কড়াই, দিনটা চুলো, রবিদের ইন্ধন। ঝিম মেরে নিঃশব্দে লোহা গলাচ্ছিল, কিন্তু আমরা ও লোহা নই ঠাকুর, তার আগেই যে গলে গেলাম। বসো ঠাকুর, বিটপীর ছায়ায় একটু বসো। কারা যেন ঝেড়ে মুছে লেপে সিঁদুর লাগিয়ে গেছে মূলে। কিন্তু নৈবেদ্যের পুষ্প, অনির্দিষ্ট দেবতাকে উৎসর্গীকৃত ভোগের কিছু ভুক্তাবশেষ এখনো পড়ে আছে। আহা, কারা না জানি কী মনস্কামনা নিয়ে এসেছিল এখানে, এই বৃক্ষমূলে! সাবিত্রী কতকটা যেন নিজেকেই নিজে বলতে থাকে।
সংসারী মানুষের হরেক রকমের মনস্কামনা থাকে সাবিত্রী। কী কামনা নিয়ে এসেছিল কে জানে? রাজেন ঠাকুর উদাসভাবে উত্তর দেয়।
ধন মান যশ ক্ষমতা পুত্রসন্তান বিপন্মুক্তি সাফল্য এবং পরিশেষে স্বর্গ; এ কয়টিই তো সংসারী মানুষের কাম্য, তাই না ঠাকুর? তুমি রকমারি বলছ কেন? বসো লক্ষ্মীটি, একটু বসো, জিরিয়ে নি-ই। সমাগত সন্ধ্যার নির্জনতায় বড্ড ভালো লাগছে স্থানটা। ঐ ঐ দেখো রাখাল ধেনুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাছুররা মায়ের পিছু পিছু নেচে নেচে ছুটছে। প্রকৃতির মধুর সম্ভাষণে বলছে: আর নয়, আর নয়, এবার বিশ্রামের সময় হয়েছে। আমাদের কি এখনো সময় হয়নি, ঠাকুর?
পুঁটলিটা বিটপীমূলে রক্ষা করে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে সাবিত্রী। রাজেন ঠাকুরের সম্মতির অপেক্ষা করে না। পরমাত্মীয়ের মতো মনে হয় বটের নিচের ধুলোবালি। অগত্যা রাজেন ঠাকুরও পাশের উঁচু শিকড়টার ওপরে দেহের ভার স্থাপন করে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
বড্ড একা একা লাগছে ঠাকুর, বড্ড নিঃসঙ্গ। সাবিত্রী দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে সহসা মন্তব্য করে। নিঃসারিত শ্বাসের উষ্ণ বায়ু ঠাকুরের গালে এসে ছ্যাঁৎ করে লাগে। ঠাকুর চমকে ওঠে। নিঃসহায় চোখ দুটো পল্লব প্রসারিত করে তাকায়।
নিঃসঙ্গ একা! কী বলছ সাবিত্রী? আমরা দুজন। দুজন তো একা হয় না; একা মানে একা, কখনো দুজন নয়। রাজেন ঠাকুর বোঝাতে চেষ্টা করে।
সাবিত্রী প্রবোধ মানে না। বরং পাল্টা প্রশ্ন করে: দুজন কি কখনো একা হয় না ঠাকুর? এমনকি একটা জনতাও?
হেঁয়ালি! হেঁয়ালি রাখো প্রিয়ে, কী বলতে চাও খুলে বলো।
দুজন একা হওয়ার কথাই বলছি। কিছুই কি বোঝে না ঠাকুর? ন্যায়শাস্ত্রে নাকি তোমার অগাধ জ্ঞান!
দুজন কেমন করে একা হয়, এমনকি একটা জনতাও, ন্যায়শাস্ত্রে তার ব্যাখ্যা নেই সাবিত্রী। তুমিই বরং বলো। ঐ দ্যাখো, বকগুলো কেমন ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। কে জানে কোথায় ওদের রাত্রির আশ্রয়স্থল! অনেক অনেক দূরে বোধ করি। দ্যাখ কেমন গতিসামঞ্জস্য রক্ষা করে উড়ছে। ওরা তো একা নয় সাবিত্রী।
হয়তো, হয়তো নয়। কিন্তু পাখির কি হৃদয় আছে ঠাকুর? কিংবা ভাবনা? কিংবা কল্পনা? এমন কল্পনা যা হাজার লোকের মাঝেও মানুষকে একা এবং নিঃসহায় করে? এমনকি হাজার লোকের প্রত্যেকটি লোক নিজেকে বোধ করে একা? পাখির কি সমান্তরাল দুটি চিত্তপ্রবাহ আছে, যার একটি কথা বলায় অন্যটি হৃদয়ে নানা বিচিত্র এলোমেলো ভাবনার জাল বুনে যায়? মুখ বলে কান শোনে না, কান শোনে তো মুখ বলে না? এমনকি কখনো হয় পাখির জীবনে যে, সে পাশের পাখির সংগীত আদৌ শুনতে পায় না, অন্তঃশিলা ভাবনাস্রোত তার কানকে বধির করে দেয়? হয় কখনো পাখির জীবনে এমন? বলো না ঠাকুর।
কীসব কথা যে আজ বলছ সাবিত্রী, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। পাখির মনমেজাজ কেমন করে জানব, পাখি তো মানুষ নয়, তার ভাষাও বুঝি না। তার কূজন ভাষা কি না, তাও জানি না। ধ্বনিবৈচিত্র্য নেই তার কুহরণে।
কিন্তু মানুষ! মানুষকেও কি বোঝো না ঠাকুর?
বুঝি বৈকি! সেদিন তোমার মনের কথাটি বুঝতে পেরেছিলাম বলেই তো তোমাকে আহ্বান করেছিলাম। সেদিন কি দোহে এক হইনি সাবিত্রী? দুজনে মিলে এক কিন্তু একা তো ছিলাম না। তখনো ছিলাম দুজন আজও দুজন। দুজনে মিলে এক ও অভিন্ন, কিন্তু কখনো একা নই।
তুমি রোজ বিকেলে আমাদের বাড়ি আসতে। পাস করে বেকার ছিলে। পূজারী গুরু ব্রাহ্মণের বংশ। তুমি আমাকে গান শেখাতে ভজন, কীর্তন; বিদ্যাপতি কহে কয়ছে হরি বিনে কাটাই দিন রাতিয়া; বাবা-মা ভক্তি গদগদ হয়ে চোখ বুঝে শুনতেন।
সে তো অনেক অনেক দিন আগের কথা ঠাকুর। আমি বাল্যে বিধবা হয়েছিলাম কিন্তু যৌবন আমাকে ত্যাগ করেনি। প্রকৃতির কী আশ্চর্য শক্তি! সে লোহার ন্যায় শক্ত সামাজিক বিধানও মানে না। তাই বুঝি মানুষও বিধান উপেক্ষা করে, তাই না ঠাকুর? প্রকৃতি ও মানুষের ধর্ম তাহলে এক ও অভিন্ন, কী বলো? কিন্তু সে যে বহুকালের কথা, তখন তোমার স্ত্রী ছিল।
কিন্তু তাকে আমি ভালোবাসিনি সাবিত্রী। তোমাকে দেখার পর শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।
আমি ব্রাহ্মণী ছিলাম না।
আমি তোমাকে ব্রাহ্মণ করে নিলাম। মিলিয়ে দিলাম উচ্চবর্ণের সাথে নিম্নবর্ণ। দুধ এবং আলতায় মিলে দুধে-আলতা হলো। নীচ আর নীচে রইল না।
তোমার স্ত্রী তোমাকে সন্তান দিয়েছিল।
একটু আগে তুমিই না বললে প্রকৃতির ধর্মের কথা। সে ধর্ম পালন করেছিলাম, কিন্তু নিস্তারিণীকে ভালোবাসিনি। সন্তানদেরও নয়। তারা কর্মফল মাত্র, মানুষ কর্ম করতেই ভালোবাসে, কর্মফল ভালোবাসে না। নিষ্পন্ন কাজ অতীত। নির্মিত দ্রব্যও অতীত, তার দিকে নির্মাতা ফিরেও তাকায় না। ছেঁড়া বস্ত্রের ন্যায় ত্যাগ করে সে ওটা। অতীতকে পশ্চাতে ফেলে সে নিত্যনতুন সৃজনের মোহে সামনে এগিয়ে যায়। আমি একমাত্র তোমাকেই ভালোবেসেছি সাবিত্রী।
হবেও বা, কিন্তু সে যে অনেক পুরনো কাহিনী। সে-অতীতকে পশ্চাতে ফেলে এসেছি, নির্মাণের ক্ষমতাও হারিয়েছি। ঐ দ্যাখো পূর্ব আকাশে চাঁদটা কেমন রুপোর গোল থালা, কিন্তু ক্রমে তার আকৃতি সংকুচিত হতে থাকবে, কৃষ্ণাচতুর্দশীতে রেখাটিও থাকবে না। তুমি ঐ পূর্ণ চাঁদটাকেই ভালোবেসেছিলে, কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাতটাকে নয়।
ভুল সাবিত্রী, এ তোমার ভুল। চাঁদ লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে বটে, কিন্তু চাঁদ অক্ষয়, সদাজাগ্রত। প্রেমও চাঁদের ন্যায় চিরন্তন অক্ষয়।
রাজেন ঠাকুর জোরের সাথে উত্তর দেয় বটে, কিন্তু অন্তরে অনুভব করে, সে যেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে।
শব্দের মায়াকে বাস্তব বস্তুরূপে চালিয়ে মিথ্যা সান্ত্বনা কেন পেতে চাও ঠাকুর? দৃষ্ট চাঁদকেই লোকে ভালোবাসে। চাঁদ যখন অদৃশ্য থাকে, তখন অমাবস্যার অন্ধকারই শুধু দেখা যায়। কী বললাম? দেখা যায়? ঠিক নয়, অন্ধকার এমন বস্তু যা দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আমি অন্ধ। বেশ বলেছি, তাই না ঠাকুর? সাবিত্রীর কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি, চোখে পাণ্ডুর শূন্যতা।
কিন্তু চাঁদকে তো ভোলা যায় না সাবিত্রী, সে যে চিত্তে বিচিত্র থাকে। কখনো ভুলতে পারবে সে রাত্রির কথা, যে রাত্রিতে তুমি আমি প্রথম মিলিত হলাম, দুই দেহ হলো এক, দুই আত্মা হলো একাত্মা। বিনিদ্র সে রজনীটি কি এখনো তুমি স্পষ্ট দেখতে পাও না? আমি তো চোখ বুজলেই দেখতে পাই সাবিত্রী। নিমীলিত চোখের দেখাই হলো আসল দেখা। রাজেন ঠাকুর তবু হার মানে না।
স্বপ্ন ঠাকুর, স্বপ্ন! স্বপ্ন অচেতন অবস্থায় পুনর্জাগরিত কুয়াশাচ্ছন্ন অতীত এবং কল্পিত ভবিষ্যতের বিকৃত ছায়াছবি। জাগ্রত লোকের কাছে স্বপ্ন মূল্যহীন। সে স্বপ্ন দ্বারা চালিত হয় না। রাত সমাগত। অদূরের বনানী ঘেরা বস্তি রূপালি আলোয় ঝলমল। সে-রাতটিও শুক্লা তিথির রাত ছিল। কিন্তু আজ কি সে রাতের ঘটনাগুলো হুবহু ঘটাতে পারো? পারো না। সম্ভব নয়। তুমিও ক্লান্ত। ধমনিতে রক্ত এখন আর নাচে না: মরা নদী: স্রোতহীন বদ্ধ জল: এখন নতুন কোনো ঘটনা নয়, ঘটানো যাবেও না। এখন একটিমাত্র একটানা ঘটনা সত্য, বিশ্রাম, শুধু বিশ্রাম। আমাকে বিশ্রাম করতে দাও ঠাকুর। সাবিত্রী ক্লিষ্ট ক্লান্ত স্বরে বলে।
বিশ্রাম! নাকি বিদায়? কোনটা? রাজেন ঠাকুর সহসা হাসতে থাকে। আবছা আলোতে তার দাঁতগুলো দেখা যায়।
আশ্চর্য দীর্ঘায়ু তোমার দাঁত ঠাকুর, একটাও পড়েনি। পড়াই কিন্তু ভালো ছিল, বড় দুর্গন্ধ ঠাকুর, আর কথা বোলো না। কিন্তু সেদিন তো দুর্গন্ধ ছিল না; হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই শুক্লা চতুর্দশীর রাত দশটা এগারোটায় যখন কুলে কালি দিয়ে, কী না ঠাকুর কীর্তনের সে পদটা মনে কয় মনে কয় কুলে কালি দিয়া বাহিরিয়া যাই।
হ্যাঁ। মনে পড়ছে, মনে কয় কুলে কালি দিয়া বাহিরিয়া যাই, কিন্তু পূর্বাপর মনে পড়ছে না তো, সব ভুলে গেছি। অথচ দিনরাত গেয়েছি ও গীত। স্মরণশক্তি গেছে, তবু রাতটা স্মরণ করতে পারছি, আগের কিছু কিছু ঘটনাও। তুমি রোজ বিকেলে আমাদের বাড়ি আসতে। পাস করে বেকার ছিলে। পূজারী গুরু ব্রাহ্মণের বংশ। তুমি আমাকে গান শেখাতে ভজন, কীর্তন; বিদ্যাপতি কহে কয়ছে হরি বিনে কাটাই দিন রাতিয়া; বাবা-মা ভক্তি গদগদ হয়ে চোখ বুঝে শুনতেন। কিন্তু আমরা! প্রথমে কথা হতো চোখে চোখে পরে পা’এ পা’এ। এক দিন গাইতে গাইতে তুমি আমার গায়ে ঢলে পড়লে, পরদিন আমি ঢলে পড়লাম। হ্যাঁ! হ্যাঁ! আচ্ছা ঠাকুর আমরা সেদিন কাকে ফাঁকি দিয়েছিলাম বলতে পারো?
ফাঁকি! না ফাঁকি দেইনি তো। যা বলার মুখে না বলে অঙ্গে অঙ্গে বলেছিলাম মাত্র। জানো সাবিত্রী, মুখের ভাষার চেয়ে ইঙ্গিত ও অঙ্গের ভাষা অনেক বেশি ভাববাহী। রাজেন ঠাকুর নিশ্চয়তা দেয়। চোখ দুটোও মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে। ঐ সময়টুকুর মধ্যেই সেদিনের ঘটনাগুলো। তার সামনে একপাল হরিণশিশুর ন্যায় বিচরণ করতে থাকে। কিন্তু বাধা পায়।
সাবিত্রী বিরক্তি ও ঘৃণার সাথে বলে: ছি! আবার সেই দুর্গন্ধ ছড়ালে! ওয়াক থু! তুমি কথা বোলো না-তো। যা বলার আমি বলব। আমার দাঁত নেই: সারা দিন অভুক্ত আমি। আমার পেটে পচনশীল খাদ্য নেই, নিঃশেষে নিঃসৃত সবকিছু : বহুবার বমি করেছি সে তো জানই, যা-কিছু পেয়েছিলাম সব তুমি খেয়েছ, আমি খাইনি। তোমার ঐ গহ্বরে পচনশীল কর্দম। হাহ্! হাহ্! পাচ্ছ কিছু দুর্গন্ধ? পাবে না। কেননা তোমার দাঁত আছে আমার একটি দাঁতও নেই এবং বড় কথা কিছু খাইনি। হ্যাঁ, কী বললে? অঙ্গে অঙ্গে কথা হয়েছিল। ভজন কীর্তন সব ছিল তাহলে ধোঁকাবাজি। ধোঁকাবাজি নয়তো কী? হিংস্র কামনার ওপর পোশাক, কৃমিকীটের সজ্জা, পিতলের ওপর রাং, মাটির মূর্তির গায়ে জড়োয়া গহনা-বেনারসি জরি শাড়ি! মেকি, সব মেকি! কিন্তু কেন? কেন মেকির পিছু ছুটলাম ঠাকুর।
সাবিত্রীর কণ্ঠস্বর ভারী হয়। রোরুদ্যমানা সাবিত্রী বিলাপবিলাসি হয়ে ওঠে।
আহা, থামো! আবোলতাবোল কীসব যে বকছ সাবিত্রী! তোমার দেহ আমার দেহ, এর মধ্যে মেকি কী দেখছ? আদি ও অকৃত্রিম মানবদেহ; যা কিছু করেছি, সবই বাস্তব ঘটনা; সার্থক তোমার-আমার জীবন। নয় কি সাবিত্রী? যাকে তুমি পোশাক বলছ সে যে পোশাক নয় সাবিত্রী; আভরণ, অলংকার। অলংকার রূপ বৃদ্ধি করে। অলংকার পরা অন্যায় নয় সাবিত্রী।
অলংকারের প্রয়োজন সম্বন্ধে রাজেন ঠাকুর আরো কী বলতে চায়, কিন্তু সাবিত্রী তাকে কিছুটা ধমকের সুরে থামায়: আবার বকছ? ঐ গন্ধটা আমার পেটের নাড়িভুঁড়ি ঠেলে বাইরে নিয়ে আসছে। চুপ করো, ঈশ্বরের দোহাই, চুপ করো। কিছু ভালো লাগছে না, আমার কথা আমাকে বলতে দাও। কী বলেছিলে তুমি! ঘটনা! হাহ্! হাহ্! বুদ্বুদকে ঘটনা নাম দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাও? সব ভুলে গেছি, সব…ভুলে…গেছি ঠাকুর। কৈ একটি উষ্ণ আশ্লেষের কথাও তো মনে পড়ে না। সব কল্পনা; মিথ্যা! মিথ্যা! সেদিনের একটি ঘটনা এখন ঘটাও তো দেখি ঠাকুর? পারছ না, পারবেও না। রাধাকৃষ্ণ এক শুধু মানসলোকে। রাধা এবং কৃষ্ণ আজন্ম আলাদা; মৃত্যুতেও আলাদা। যার সেতু নেই সে নদীর দু-তীরের মধ্যে যোগসূত্রও নেই। না কি আছে? বলো। কৈ সে সেতু, সাঁকো? সেতু কৈ?
সেতু? কিসের সেতু? তুমি কি পাগল হলে সাবিত্রী?
আবার কথা বলে কেন পচা গন্ধটা ছড়াচ্ছ? ঘৃণ্য আবর্জনা, আঁস্তাকুড়। হতে পারতে; অনায়াসেই একটি পুষ্প হতে পারতে যদি সেতু থাকত, যদি তোমার আমার মাঝে সেতু থাকত। যদি সেতু থাকত। কিন্তু সুযোগ হারিয়েছি, কুলে কালি দিয়েও কুল রক্ষা করতে গিয়ে সেতু নির্মাণ করিনি, তুমি আমাকে বিরত করেছ, তুমি বারবার আমার মাধ্যমে পিতৃত্ব অস্বীকার করেছ। তুমি তোমার কুল রক্ষা করেছ, ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করেছ, যজমান রক্ষা করেছ, উত্তরাধিকারী রক্ষা করেছ, আমি তোমাকে ভ্রমর হওয়ার সুযোগ দিয়েছি আমার পুষ্পোদ্যানে। তুমি বর্গী, দস্যু, চোর, যাযাবর, লুটেরা। তুমি নির্মম, পাষণ্ড, কাপুরুষ। তুমি ঘৃণ্য, তুমি ক্লীব, তুমি তুমি।…উত্তেজনায় সাবিত্রী উপযুক্ত আর কোনো শব্দ খুঁজে পায় না।
এই সুযোগে রাজেন ঠাকুর প্রতিবাদ করে:
চোর! কী বলছ সাবিত্রী! তুমি কি সংবিৎ হারালে? আমি চোর! চোর কি কখনো চোরাই মাল দিবালোকে কাঁধে নিয়ে বেড়ায়? তোমাকে কি আমি অন্ধকার থেকে দিবালোকে তুলে আনিনি? অর্থহীন বিলুপ্তির বিবর থেকে উদ্ধার করে জীবন দান করিনি? তোমার জন্য ত্যাগ করিনি কি সংসার? হ্যাঁ, ঠিক বলেছ আমি যাযাবর। কিন্তু জীবন থেকে যাযাবরত্ব বাদ দিলে তার থাকে কী? কিছু না কিছু না… প্রকৃতিস্থ হও সাবিত্রী।
ছি! ছি! আবার সেই বিশ্রী দুর্গন্ধটা ছড়াচ্ছ। কথা নয় ঠাকুর, আমাকে ঘুমোতে দাও। আমি ঘুমোব। কিছু স্মরণ করতে পারছি না। কোথায় বা মধু, কোথায় বা মক্ষিকা। শূন্য ভাণ্ড, মক্ষিকা মৃত। তুমি মৃত ঠাকুর; আমি বলছি তুমি মৃত। ডাকো, লোকজন ডাকো, তোমার শবটা শ্মশানে নিয়ে যাবে। আমাকে ঘুমোতে দাও। সাবিত্রী কোনো কথা শোনে না, নিজের মতো বকে চলে।
তোমার কি অসুখ করেছে সাবিত্রী? রাজেন ঠাকুর প্রসঙ্গান্তরে যেতে চায়।
রাজেন ঠাকুর কমণ্ডলু কাত করে দেয় সাবিত্রীর মুখে। জলের ধারা ওষ্ঠসন্ধি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সাবিত্রী তার যাত্রাপথ শেষ করেছে। সাবিত্রী বিশ্রাম নিচ্ছে। সে এখন আর জল খাবে না।
অসুখ! কই, না তো। বেশ ভালো আছি। সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। প্রতিটি রাত দেখতে পাচ্ছি_বুদ্বুদের মতো আলিঙ্গনগুলো, ওষ্ঠচুম্বনগুলো…এবং…পরবর্তী অত্যাবশ্যিক ক্রিয়া এবং পরিশেষে ঘুম, প্রশান্তি ও তৃপ্তির নিদ্রা। সব এক সাথে ভিড় করে জাগছে আবার সাথে সাথেই ডুবছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই…এই তো সব ডুবে গেল ঠাকুর, স্বখাত সলিলে ডুবে গেল, কিছু অবশিষ্ট থাকল না, একটি ছত্রাকও নয়, ব্যাঙের ছাতাও নয়: সবকিছু শূন্য, আবছায়া। না, আবছায়াও নয় অন্ধকার, শুধু অন্ধকার। সমস্ত অতীত মসিলিপ্ত আদি অন্তহীন একটা কালো পর্দা, পর্দাও নয় শুধু কালো, স্পর্শগ্রাহ্য বস্তু নয়, একটা অস্তিত্বহীন অস্তিত্ব, হাতড়ালে কিছু ধরা যায় না, তবু হাতড়াতে ইচ্ছে করে। এই বিরাট কালোর মধ্যে স্পষ্ট দেখা যায় শুধু উত্তেজিত স্নায়ুর আকর্ষণে বিকৃত মুখভঙ্গিগুলো। ছি! ছি! ডাকো ঠাকুর, তোমার বংশধর ডাকো, পাড়া-প্রতিবেশীদের ডাকো, তোমার শবটা শ্মশানে নিয়ে যাক : আগুন জ্বালুক, চন্দনে ঘি ঢেলে আগুন জ্বালুক, তুমি তার মধ্যে দগ্ধ হও; তোমার মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যাক, আমি চন্দন-গন্ধ গ্রহণ করি।
বিকারগ্রস্ত রোগী! উহ্! সাবিত্রী, ঐ দ্যাখো এখনো দেখা যাচ্ছে লোকালয়। ঘরে ঘরে জ্বলছে সন্ধ্যার প্রদীপ। প্রদীপের কাছে চলো। ওঠো তোমার চিকিৎসা আবশ্যক। পল্লীতে নিশ্চয়ই চিকিৎসক পাওয়া যাবে। রাজেন ঠাকুর মিনতির সুরে অনুরোধ জানায়।
কী বললে ঠাকুর! কত মানা করলাম তবু মুখ বন্ধ করলে না? কে রোগী? কার চিকিৎসা? পোড়ালেই শুধু ব্যাধিমুক্ত হবে ঠাকুর। ডাকো, ওদের ডাকো, আগুন জ্বালুক। ঐ তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আগুন জ্বলছে, তুমি দগ্ধ হচ্ছ। গৃধিনীরা অপেক্ষা করছে। অগি্নদহনে তোমার শিরা-উপশিরা ফুলে উঠছে। দণ্ডায়মান, ঋজু উলঙ্গ…আহা, কি চমৎকার দগ্ধ হচ্ছ তুমি। শত শত পুষ্পে মুকুলিত হচ্ছে অগি্নশিখাগুলো। হে ঈশ্বর, শিখাগুলোকে আরো আরো ঊর্ধ্বগতি দাও, শিখার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মহাদিগন্তে বিলীন হয়ে যাক আমাদের অস্তিত্বের বুদ্বুদগুলো, ঠাকুর তুমি দগ্ধ হও। আমাকে নিরীক্ষণ করতে দাও সে অগি্নশিখা-আমার গাঁটরি ওর মধ্যে নিক্ষেপ করেছি, পুড়ে গেছে, মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কোনো চিহ্ন নেই। আমি গ্রন্থিমুক্ত হয়েছি। সেতুর বন্ধন ছিল না, পুঁটলিটা ছিল তাও নিঃশেষ করেছি। ঠাকুর চুপ করো। আমাকে বিশ্রাম করতে দাও। আমি শ্রান্ত, আমাকে ঘুমোতে দাও; দেবালয়ে নয়, লোকালয়ে নয়, প্রদীপের আলোতেও নয়; এখানে এই বিটপীতলে; আমাকে বিশ্রাম করতে দাও। মনে আছে ঠাকুর সেদিনের কথা, শ্মশানঘাটের অশ্বত্থতলায় এমনি এক জোছনালোকিত রজনীতে যেদিন আমাদের প্রথম মিলন হলো? গায়ে অসংখ্য আঁচড় লেগেছিল কিন্তু ব্যথা পাইনি; তোমার হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল, কিন্তু যন্ত্রণা বোধ করোনি: তাই না ঠাকুর? সাবিত্রী হাঁপাতে থাকে।
হ্যাঁ! হ্যাঁ! ঠিক বলেছ সাবিত্রী, যথার্থ বলেছ। এই তো প্রকৃতিস্থ হয়েছ। কিছুই মিলিয়ে যায়নি সাবিত্রী, স্মৃতির মধ্যে সব বেঁচে আছে। স্মৃতিই জীবন। স্মৃতি শান্তি। বলবে জাবর কাটা। জাবর কাটা-ই যে প্রশান্তি সাবিত্রী। তুমি সুস্থ হয়ে গেছ, ওঠো আবার পথ চলি।
জল! একটু জল! কোথায় জল! সারা পৃথিবী ঘুরে এলাম কোথাও একবিন্দু জল দেখলাম না। এ কোথায় এলাম আমরা ঠাকুর? তৃষ্ণার্ত সাবিত্রী চোখ বিস্ফোরিত করে।
জল খাবে সাবিত্রী? কমণ্ডলু ভরা জল থাকতে জল নেই বলছ কেন? এই নাও, জল খাও।
রাজেন ঠাকুর কমণ্ডলু কাত করে দেয় সাবিত্রীর মুখে। জলের ধারা ওষ্ঠসন্ধি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সাবিত্রী তার যাত্রাপথ শেষ করেছে। সাবিত্রী বিশ্রাম নিচ্ছে। সে এখন আর জল খাবে না।
রাজেন ভট্টাজ কয়েকবার চেষ্টা করে সাবিত্রীর ঘুম ভাঙাতে। কিন্তু সাবিত্রীর ঘুম ভাঙে না। সহসা একটা ভয়ানক ভীতি পাথর হয়ে চেপে বসতে চায় রাজেন ঠাকুরের দেহের ওপর। সে দ্রুত প্রদীপ দীপ্তি লোকালয়ের দিকে পথ ধরে। পশ্চাৎ দিকে ফিরেও তাকায় না।
সাবিত্রী ঠিকই বলেছিল, সেতু নেই। মনে মনে সেতুর কথা ভাবতে ভাবতে সে লাঠি ঠুকে পথ ধরে। পুঁটলিটা পড়ে থাকে সাবিত্রীর শিথানে।