পটাসদার ভূত দেখা

পটাসদার ভূত দেখা

পটাসদাকে মনে আছে? ওহ্! মনে থাকবে কি করে? দোষটা আমারই। তিন চারমাসে একবার যদি তার গল্প নিয়ে হাজির হই, মনে না থাকাই স্বাভাবিক!

তো পটাসদা হচ্ছে সেই বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট, অ্যাস্ট্রোলজার, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, ফটোগ্রাফার, ম্যাজিশিয়ান….আরও কি না কি! নানা, অত ঘাবড়ে যাওয়ার কিছুই নেই! পটাসদা আমাদের প্রবাদপ্রতিম মানুষ, অগুনতি কীর্তিতে অলঙ্কৃত! শুনেছি নোবেলও পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কপালদোষে ফসকে গেছে! যাই হোক, সে অন্য কাহিনি!

তো সেই পটাসদা প্রতি শনি কিংবা রবিবার তার হাতিবাগানের বাড়িতে বসে আমাদের সেইসব কীর্তির গল্প শোনায়। আমাদের মানে আমি আর আমার বন্ধু রৌণক, সালিম, সৌম্য, রূপচন্দ্রা আর অস্মিতা। ফুলুরি-মুড়ি-সিঙারা-পকোড়া-বেগুনি সহযোগে চায়ের আসর বসে, আর আমরা গোগ্রাসে পটাসদার ঢপের চপ গিলি!
আজও তেমনি এক আসর বসেছে। পটাসদা যথারীতি (বদ)অভ্যাসবসত সিলিঙের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কি জানি আকাশপাতাল ভাবছে। আর রৌনক বসে বসে অধৈর্য হয়ে উঠছে।

দুটো সিঙারা গলাধঃকরণ করে নিয়েই তৃতীয়বার হাঁক দিল,”কি গো দাদা? আজ কি ভূতের গল্প শোনাবে বলছিলে যে? তুমিই শোনাবে নাকি কোনও ভূতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছ আসবার জন্য??”

যেই না বলা অমনি আমাদের অস্মি ম্যাডাম, যে কিনা নিজেকে দুনিয়ার অন্যতম সাহসী মহিলা হিসেবে দাবি করে, হাতের মুড়ির বাটিটা ঠক করে নামিয়ে রেখে লম্বাটে মুণ্ডুটা বার ছয়েক ঘুরিয়ে গোটা ঘরটায় একবার নজর বুলিয়ে নিল। টিকটিকির নজর আর কি!

পটাসদা সবার আরও অনেকটা ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে অবশেষে বলতে শুরু করল,”আচ্ছা, বল তো….বসন্তে কি হয়?”
“বাড়িতে সজনে ডাঁটার পাহাড় আসে”, খুব বুদ্ধিদীপ্ত একটা উত্তর দিয়েছে এমন ভান করে তাকাল সৌম্য।
আমরা প্রথমত কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেও তার বক্তব্যকে অস্বীকার করতে পারলাম না। গত প্রায় একমাস ধরে যেভাবে পাতে ভাতের চেয়ের ডাঁটা বেশি পড়ছে তাতে সেগুলো চিবিয়ে ফেলার জায়গাটাকে পাহাড় না হোক, একটা ছোটখাটো টিলা বলাই যায়!

“হ্যাঁ ইয়ে….তা ঠিক! উহহম্…..” একটা গলাখাঁকারী দিয়ে বলতে শুরু করল পটাসদা। “তবে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে প্রকৃতিতে এক অসামান্য পরিবর্তন আসে। নতুন পাতা জন্মায়, গাছে গাছে ফুল ফুটে জগত আলো করে রাখে….”
“মনে প্রেমের জোয়ার আসে, কবিদের মাথায় নিত্যনতুন প্যাঁচালো কবিতার উদয় ঘটে!” বত্রিশটি দাঁত ফুল আউট করে বলেই ফেললাম কথাটা। আর চেপে রাখতে পারছিলাম না!

সবাই ট্যারা চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পটাসদা হাঁ করা অবস্থায় হাতের খালি চায়ের গ্লাসটা থেকে চা মুখে ঢালবার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। গ্লাসটা খালি খেয়াল হতেই হাঁ-টা বন্ধ করে একটা ছোট্ট ঢোক গিলে বলতে লাগল,”হ্যাঁ…ত্-তাও হয়! তবে গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রকৃতি। প্রকৃতি ঠিকঠাক সাথ না দিলে বস প্রেমও জমবেনা!
তো যাই হোক, ঘঠনাটা বেশ কয়েক বছর আগের। তখন আমি সদ্য মাস চারেক হল চাকরি পেয়েছি। ভাবলাম, গ্রামের বাড়িটা একবার ঘুরে আসি। ট্রেনে চেপে বসলাম। কীর্ণাহার স্টেশন থেকে কয়েক মাইল ভেতরে গেলে একটা ছোট্ট গ্রাম পড়ে, পটাশপুর। হেঁহেঁ, আমার ডাকনামটার সাথে কেমন মিলে যায় না?!” বলে একটা এমন বিজয়ীর হাসি হাসল পটাসদা, যেন তার নামেই গ্রামের নাম রাখা হয়েছে!

হেসেটেসে না থাকা গোঁফটায় একবার তা দিয়ে আবার বলতে শুরু করল,”তো স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে পটাশপুর স্ট্যান্ড অবধি গেলাম। আমার বাড়ি আরও কিছুটা ভেতরে। হাঁটা লাগালাম। রিক্সাস্ট্যান্ড, বাজার, শম্শানঘাট সব পেরিয়ে চললাম খেত আর মাঝেমাঝে কিছু বাড়ি আর বাগানের পাশ দিয়ে। হঠাৎই ”

জানেন একজন ভালো শরীরচর্চা করা মানুষ আর একজন ভালো গল্প-বলিয়ের মধ্যে মিল কোথায়? দুজনেই জানে, কোথায় থামতে হবে! নিয়ন্ত্রণ। একজন নিজের শরীর মেইনটেইন করতে খাওয়াদাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ আনে, আরেকজন নিজের ভাও মেইনটেইন করতে গল্পের ঠিক মোক্ষম জায়গায় এসে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়! আর শ্রোতারা অধৈর্য হয়ে দেওয়ালের টিকটিকিটা ১৩ সেকেন্ডে ৫বার লেজ বাঁকালে ১ মিনিটে মোট কতবার লেজ বাঁকাবে তার হিসেব কষতে থাকে।

হিসেবটা যখন প্রায় আয়ত্তের মধ্যে চলে আসে তখনই সমস্ত হিসেব ভন্ডুল করে দিয়ে আবার গল্প (আমাদের ভাষায় গুলগল্প!) শুরু হয়ে যায়,”হঠাৎই দেখলাম, একটা আমবাগানের আমগাছগুলোতে থোকা থোকা পাকা আম ঝুলছে। তখন সময়টা এরকমই ছিল বুঝলি? মার্চের শেষ কিংবা এপ্রিলের শুরু। বছরের এইসময় গাছভর্তি পাকা আম কি করে গজাল ভাবতে ভাবতেই একটু এগিয়ে গেলাম। বাগানের গেট খোলা আছে দেখেই মাথায় বাচ্চা বয়সের দুষ্টবুদ্ধি চেপে বসল। ভাবলাম, কয়েকটা আম পেড়েই নিই না! এত্তো তো আম!

তো যেমন ভাবা তেমনি কাজ। খোলা গেট দিয়ে ঢুকেই…. ভাব একবার! এত্তো বড় আমবাগান, অথচ গেট একদম হাটখোলা! কেউ নেইও বাগানে! অথচ একটা কচিকাঁচাও আম চুরি করতে আসেনি! মনে মনে তখন ধিক্কার দিচ্ছিলাম গ্রামের ছেলেপুলেগুলোকে। ছিঃছিঃ! আমাদের প্রপিতামহের সময় থেকে চলে আসা সংস্কৃতি একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে এরা!”

আমরা সবাই একমনে শুনছিলাম। আজ ঠিক করেই এসেছিলাম, দাদাকে কেউ ডিস্টার্ব করব না, মাঝপথে বাগড়া দেবো না। কিন্তু স্বভাব যে যায়না! সৌম্য এতক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎই এইসময় বলে উঠল,”ইয়ে দাদা….আর কি কি সংস্কৃতি আছে আমাদের প্রপিতামহের সময়কার?”

সবাই প্রমাদ গুনলাম। আড্ডা ভন্ডুল না হয়ে যায়! পটাসদা কিছু বলবার আগেই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামল রূপা, অর্থাৎ রূপচন্দ্রা। “উউফ্! পরে একটা লিস্টি করে দেবে দাদা! এবার চুপ করে শোন তো। হ্যাঁ তো দাদা….তারপর কি হল? আম চুরি করে সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করতে পারলে?”

“এরকম ভয়ংকর ড্যামেজ কন্ট্রোল কেন করতে যায় এরা?!” মনে মনে গাল দিতে লাগলাম আমি।
পটাসদা তখন একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করেছে,”না সে আর হল কই!”

“এমা সেকি! বাগান মালিক লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল??” অস্মিতার নিরীহ প্রশ্ন! সালিমকে দেখি পেছনে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে। আমাকে কানে কানে বলল,”আবে ক্যালানি খাওয়াবে এরা! চুপ করতে বল।”

পটাসদা কিছুক্ষণ অস্মির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপর একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”আরে না না! সামান্য একটা মানুষের অত ক্ষমতা?! কাবু তো করল একটা ভূত।”
“ভূত???” এবার আমরা প্রত্যেকেই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলাম।

পটাসদা কিছুক্ষণ আমাদের নকল উৎসাহিত মুখগুলো একবার জরিপ করে নিয়ে বলল,”হ্যাঁ, ভূত! আসলে….পেত্নি! যে কিনা ভূতের দুনিয়ার কোনও ব্যাকরণ মানে না!”

সামনের প্লেটে রাখা পেঁয়াজির একটা তুলে নিয়ে আয়েশ করে একটা কামড় বসাল পটাসদা। তারপর আবার কিছুক্ষণ আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে বলা শুরু করল,”তো ওই বাগানে যেই আমি একটা আমগাছের কাছে গেলাম একদম নীচেই ঝুলে থাকা একথোকা আমের দিকে হাত বাড়াতে, ওমনি গাছের ভেতর থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এসে আমাকে ভেতরে টেনে নিল!”

ঘরে পিন পড়লে আওয়াজ হবে। অস্মির হাত থেকে আধখাওয়া সিঙারা তার আরেক হাতে পড়ে গড়িয়ে রূপার কোলে গিয়ে পড়ল! রৌণক এতক্ষণ নখ দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল, এইটা শোনার পর নখটা দাঁত দিয়ে কেটেই গিলে ফেলল! সৌম্য আর আমি হাঁ করে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলাম। আর সেলিম গুগলে “Petni inside mango tree” লিখে সার্চ করতে লাগল!

পটাসদার অবশ্য এসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এখন নিজের মনের খেয়ালে বলে চলেছে, ভাও খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে! আসলে পটাসদার এই একটা দোষ। যখন আমরা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকব, তখন ইচ্ছে করে থেমে গিয়ে ভাও নেয়, আর যখন আমাদের ধাতস্থ হওয়ার জন্য একটু সময়ের দরকার পড়ে, তখন দ্রুত টেনে নিয়ে যায়! এতটা নিষ্ঠুর আচরণ তো আমাদের ক্রাশরাও করেনা!

“আমি তো তখন যাকে বলে পুরো বাওলে গেছি! (এটার মানে কি অনেকবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি!) ভয় যত না করছে, তার থেকে বেশি অবাক হচ্ছি! আমগাছের ভেতর আমি! এও কি সম্ভব?! যদিও তখন অতকিছু ভাববার অবকাশ ছিল না! কারণ হঠাৎই দেখি সামনে ওই একই দুনিয়া যেন আবার খুলে গেছে! সেই আমবাগান, প্রচুর আমগাছ, তাতে অগুনতি পাকা আম ঝুলছে। আর একটা খুব সুন্দরী, স্নিগ্ধ গ্রাম্য বালিকা সেই থোকা থোকা আমগুলো মনের সুখে পাড়ছে। হাত দিয়েই পাড়ছে। খুবই সুখকর, মিষ্টি দৃশ্য।

কিন্তু ঘাবড়ানোর বিষয় হল একদম ওপরের ডালের আমগুলোও সে হাত দিয়েই পাড়ছে। আর যখন পাড়ছে, তখন তার হাত না হলেও ৬ ফুটের তো হবেই! আর পেড়েই প্রায় ডজনখানেক আম একসাথে মুখে পুরে নিচ্ছে! আমি তো দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাই আর কি!”

“ওমা! দাদা তুমিও ভয় পাও??” অস্মি এত নিষ্পাপ মেয়ে যে কি বলব! কি অক্লেশে সহজ সরল কিছু প্রশ্ন করে বসে!
পটাসদা তার আধখাওয়া সিঙারাটা মুখে পুরে নিয়ে বলল,”হুমম্, পেয়েছিলুম। আরও ভয় পেয়েছিলাম যখন সেই সুন্দরী ভূত পেত্নি যাই হোক….আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়াল সে। তারপর আমার কপালের মাঝবরাবর হাত রেখে বলল,”পটানন্দ দাস?”

চমকে গেলাম। এ তো আমার নামও জানে! ভয় কাঁপতে কাঁপতে বললাম,”ক্-ক্-কে তুমি?? কিক্-কি চাই?”
সে একটা মিষ্টি হাসি হেসে তার ডানহাতটা আমার গলার বামদিক দিয়ে ঘুরিয়ে পিছনে নিয়ে গিয়ে ডানদিক দিয়ে সামনে এনে জামার বুকপকেট থেকে ট্রেনের টিকিটটা বের করে নিয়ে বলল,”এখন তো শহরে থাকো। গ্রামের কোনও খোঁজখবর রাখো? হুমম্?”

ঘাবড়ে গেলাম। সত্যি বলতে, গ্রামে আসা তখন অনেক কমে গেছে। মাকে অনেকবার বলেছি শহরে চলো আমার সাথে থাকবে, কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রেতাত্মার মতন সবকিছু আগলে পড়ে রয়েছে এখানে! আমারও কাজের চাপে আর তেমন আসা হয়না, আর গ্রামে কোথায় কি হচ্ছে খোঁজও নেওয়া হয়না! কোনওরকম ঢোক গিলে বললাম,”ইয়ে না মানে….সেরকম তো….”

এবার মেয়েটা তার হাতটা আমার গলার চারিদিকে আর এক প্যাঁচ ঘুরিয়ে এনে হিসহিসে গলায় বলল,”জানি তো! কোনও কম্মের নয়! তুমি তো এখন শহুরে বাবু! গ্রামের খোঁজ রাখবে কেন??” ঠিক তারপরই মুড বদলে গলাটা চেপে ধরে রীতিমতো শাসানোর সুরে বলল,”শোন রে হতভাগা! তোকে একটা কাজ দিচ্ছি। সেটা করবি। না করলে তোর এই জলের বোতল সাইজের গলাটা না এমন চেপে ধরবো….” বলতে বলতেই তার সরু লিকলিকে আঙুলগুলো আমার গলাটা আরও আঁকড়ে ধরল। যন্ত্রণায় “আঁআঁ…আঁআঁআঁ” করে উঠলাম।

সে তখন গলার রাশ একটু আলগা করে বলল,”চুপ কর! পেত্নি আমি আর নাকি সুর বের করছেন ইনি! ন্যাকা! যেটা বলছি মন দিয়ে শোন।”

বলেই সে যা বলল তাতে আমার চক্ষু আমগাছ!”
“অবজেকশন! ওটা চড়কগাছ হবে!” জমজমাট গল্পের মাঝে একটা আস্ত ইঁট পড়ল!
এই সবজান্তা সৌম্যকে নিয়ে এই এক জ্বালা! ইমপ্রোভাইজেশন বোঝেনা, শুধু কেতাবি জ্ঞান ঝাড়া!
পটাসদা গল্পের মাঝে বাঁধা পেয়ে যথারীতি ক্ষুণ্ণ। চিবিয়ে চিবেয়ে বলল,”তখন আমগাছ ছাড়া ওখানে আর কোনও গাছ ছিল না!”

“ওওহ্….বেশ!” সৌম্য দাদার উত্তরে সন্তুষ্ট হল নাকি বলার ভঙ্গিতে ঘাবড়ে চুপ করে গেল বোঝা গেল না! তবে আবার শান্তিতে গল্প শোনা যাবে এই আসায় আমরা কান খাড়া করলাম।

পটাসদা ট্র্যাকে ফিরেছে,”হ্যাঁ তো তার কথা শুনে আমি তো যারপরনাই অবাক! তার বক্তব্য, আমার বাড়ির পেছন দিকে যে একটা পুকুর আছে, সেই পুকুরের তলায় নাকি তার দাদুর মেসোমশাইয়ের লুকানো গুপ্তধন পোঁতা আছে! একটা ছ’ফুট বাই তিন ফুট বাক্সে! সেটা আমাকে খুঁজে তুলে আনতে হবে, তারপর আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকের পেঁপে গাছের নীচে রাখতে হবে!

আমি শুনে হাসবো, কাঁদবো নাকি ভয় পাবো গুলিয়ে ফেললাম। এতবছর হয়ে গেল, আজ অবধি আমাদের পুকুরের নীচে গুপ্তধন আছে, এমন অদ্ভুত কথা কখনও শুনিনি। কিন্তু যতই হোক, ভূতপ্রেতের কথা তো নেহাত ফেলে দেওয়া যায়না! মানসিকভাবে প্রচন্ড দোনামনায় ভুগছি বুঝে সে আবার একহাতে গলাটা জোরসে পেঁচিয়ে ধরল। আর একটা হাত আমার পেটের তলার অংশে চেপে ধরে বলল,”বেশি ভাবিস না, বুঝলি? যদি এক সপ্তাহের মধ্যে ওই

গুপ্তধন না পেয়েছি, তো তোর মাথাটা ওই আমগুলোর মতোই গিলে খাবো! বুঝেছিস?”
শেষের ‘বুঝেছিস’টা এত জোরে চেঁচিয়ে বলল যে না বুঝে উপায় ছিল না! বাধ্য ছেলের মতন ঘাড় নেড়ে দিলাম। আবার একটা মন ভোলানো হাসি হেসে সে আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে আমগাছের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে পড়ে রইলাম। তারপর সম্বিৎ ফিরতেই উঠে দাঁড়িয়ে দে দৌড়! কিছুটা দৌড়ে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম। দেখি আমগাছ ঠিকঠাকই আছে, কিন্তু পাকা আম তো দূর অস্ত, কাঁচা আমেরও কোনও অস্তিত্ব নেই গাছটাতে!!”

আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। পটাসদা আবার অভ্যাসবশত সিলিঙের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। দেওয়ালের টিকটিকিটাও হয়তো গল্পের টানে নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে! মোক্ষম মুহূর্তে এসে চারিদিক নিস্তব্ধ।

এবার আমিই আর ধৈর্য রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,”তারপর? তারপর কি?? গুপ্তধন পেলে??”
সবাই ক্রিকেট বলের মতন চোখ করে দাদার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অস্মিতা রূপার একটা হাত জোরসে চেপে ধরেছে। রৌনক “আর কত গুল দেবে!” মন নিয়ে অনেক কষ্টে নিজের উৎসাহ দেখাচ্ছে।
পটাসদা যথারীতি নির্বিকার। ঘটুকদাকে আরও এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে তিন চারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব ধীরেসুস্থে বলা শুরু করল,”প্রথমে বেকার কথা ভেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েও কি যে মনে হল! পরেরদিনই কাজ শুরু করে দিলাম। পুকুরে জল এমনিতেই কম ছিল। সব জল মেশিন দিয়ে অন্য একটা পুকুরে বের করে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করলাম। টানা সাতদিন এসব চলল। পুরো পুকুর লোককে দিয়ে খোঁড়ালাম, নিজেও খুঁড়ে ফেললাম। কিন্তু নাহ্! কিচ্ছুটি মিলল না!

লোকে আমাকে পাগল ভাবতে লাগল। মা তো আমায় তাজ্যপুত্র করে প্রায়! বলে পাগল ছেলেকে সে মেনে নেবে না! তার উপর আমারও ধারণা হতে শুরু করল যে ওইদিনের ঘটনাটা স্রেফ একটা বাজে স্বপ্ন।

সাতদিন পেরিয়ে গেল। কিছুই ঘটল না। আমার আরও রাগ হতে লাগল। যেন কিছু অঘটন ঘটলেই ভালো হত!

এতদিনের বেকার খাটনিটা, রাত জেগে পাহারা দেওয়া, তার উপর লোকজনের কথা শোনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না!

কিন্তু কি আর করার। ততদিনের ফেরার সময় হয়ে এসছে। ব্যাগপত্তর গোছাতে আরম্ভ করলাম। পরেরদিনই শহরে ফিরব।

শুধু দুপুরে খাওয়ার পর একবার ভাবলাম সেই আমবাগানটায় ঘুরে আসি। এই হুজ্জুতির একটা কিনারা করতেই হবে!
ভাবামাত্রই বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু অনেক ঘোরাঘুরির পরেও সেই আমবাগানটা আর কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। আন্দাজ মতন যে জায়গাটায় আগেরদিন বাগানটা দেখেছিলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে একটা লোককে জিজ্ঞেস করলাম,”আচ্ছা এই জায়গাটায় একটা আমবাগান ছিল না? সেটা কোথায় গেল বলুন তো??”

লোকটা আপাদমস্তক আমাকে একবার জরিপ করে নিয়ে বলল,”তোমার কি হয়েছে বলো তো ভায়া? যেদিন থেকে এসছ কিসব ভুলভাল কাজ করে চলেছ! আজেবাজে স্বপ্ন কিছু দেখেছ নাকি?? এখানে আবার কবে আমবাগান ছিল? আগে তো কবরস্থান ছিল। সেটাও তা প্রায় বছর পনেরো হল বন্ধ হয়ে গেছে! এসব খোঁজ রাখো? শহুরে পাগল যত্তসব!” বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল লোকটা।

আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। ঠিক করলাম, পরেরদিন ভোরের ট্রেনেই বিদায় নেবো। নাহলে হয়তো সত্যিই পাগল হয়ে যাবো!
বাড়িতে ঢুকতে যাবো, এমন সময় বাড়ির সামনের কলে দেখি একটা অল্পবয়সী মেয়ে বাসন মাজছে। আশ্চর্য! একে তো আগে কখনও দেখিনি! মা আবার কাজের ঝি রাখল নাকি?
কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ডাক দিলাম,”এই যে শুনছেন? এই যে….”

মেয়েটি বাসন মাজা থামাল। তারপর ধীরেসুস্থে মুন্ডুটা, হ্যাঁ শুধুই মুন্ডুটা আমার দিকে ঘোরাল, শরীরের বাকি অংশ একচুলও নড়ল না!

ওকে দেখেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। আরে, এ তো সেই মেয়েটা! এ-এ-এ এখানে কি করছে??
এবার আর মিষ্টি করে নয়, মুণ্ডুটা এদিকে ঘুরিয়ে একটা ভয় ধরানো বিচ্ছিরি হাসি হেসে টিপিক্যাল ভূতুড়ে গলায় বলল,”কিঁ রেঁ? কেঁমঁন এঁপ্রিঁল ফুঁল বাঁনাঁলাঁম?! ইঁহিঁহিঁহিঁ….”

আমার পা টলে উঠল। এক পা দু’পা আগেপিছে করতে করতে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। শুধু জ্ঞান হারাবার আগে মনে পড়ল, আমগাছের ঘটনার সেই দিনটা ছিল ১লা এপ্রিল!”

 

গতকাল পটাসদার বাড়ির আড্ডা সেখানেই থেমে গিয়েছিল। দাদা অজ্ঞান হওয়ার পর কি হয়েছিল তা বলবার আগেই একটা ফোন আসে, দাদাও তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে যায়। গল্পটা শেষ করার কোনও চেষ্টাও করেনা!
আজ আমরা ছ’জন আমার পাড়ার একটা চায়ের দোকানে বসে এতক্ষণ আড্ডা দিচ্ছিলাম। এখন দল বেঁধে বেরিয়েছি একটা চক্কর লাগাতে।

আলোচনা চলছে অবশ্য সেই পটাসদার গল্প নিয়েই। অস্মি ভূতের কথা শুরু হতেই রূপার সাথে চিপকে গেছে। আর ক্ষণে ক্ষণে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সৌম্য দাঁত খিঁচিয়ে বলল,”আবে ওও….মিস সাহসী! কোন অজ পাড়াগ্রামের পেত্নি ওটা! এখানে আসবে না। নাটক!”

“আরে তোরাই সত্যিই! একটা লোক দিনের পর দিন গুল মেরে যাচ্ছে আর তোরাও তার গল্প শোনার জন্য প্রতি সপ্তাহে আড্ডা জমাচ্ছিস!” রৌণক প্রতিবারের মতো একই কথা আবার রিপিট করল।

রূপা দাঁত বের করে বলল,”দ্যাখ, গুল হোক বা গল্প, কিংবা পটাসদার ভাষায় ‘অভিজ্ঞতা’, দ্যাট ইজ নট ইম্পর্টেন্ট! গুরুত্বপূর্ণ হল ফ্রিতে ঢালাও চপ-পকোড়া-চা খাওয়া!”

“সেই! এখন তো”, সেলিম কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎই অস্মি যেন আমেরিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন মুখ করে বলল,”আচ্ছা আজ সোমবার তো? ডেটটা দেখেছিস?? পটাসদাও আমাদের একদিন আগে আগাম এপ্রিল ফুল বানায়নি তো?!”

আমরা সবাই থমকে গেলাম। এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। তারপর একাধিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। মাঝে রৌণক খিঁচিয়ে উঠল,”আবে তো এতক্ষণ কি জার্মান ভাষায় কথা বলছিলাম?!”
যেতে যেতে সৌম্য বলতে লাগল,”দ্যাখ, ওসব ভূতপূত বলে কিছু নেই। সব শুধু…..”

আমরা তখন একপাশে ছোট্ট একটা মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আর আরেকপাশে একটা ডোবা। হঠাৎই পায়ের কাছে একটা টুসটুসে টাটকা পাকা আম এসে পড়ল। যেন গাছপাকা একটা আম এইমাত্র কেউ পেড়ে এনেছে!
আমরা এর ওর মুখের দিকে তাকালাম। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক চাইলাম। জায়গাটা একটু নির্জন। নাহ্, কেউ কোত্থাও নেই! আশেপাশে কোনও আমগাছেরও দেখা নেই! আমি কিছুক্ষণ এদিক ওদিক চেয়ে আমটা কুড়িয়ে নিতে গেলাম….

(পুরো ব্যাপারটা কি সত্যিই শুধু একটা ‘এপ্রিল ফুল’ গিমিক? নাকি সত্যিই কোনও রহস্য আছে? আমটা কোথা থেকে পড়ল? পটাসদার দেখা সেই মহিলা আসলে কে? পুকুরের নীচে কি সত্যিই গুপ্তধন ছিল? থাকলে সেটা গেল কোথায়? আর যদি থেকেই থাকত তাহলে সেই মহিলা “কেমন এপ্রিল ফুল বানালাম?” কেন বলল? পটাসদা অজ্ঞান হওয়ার পর কি হয়েছিল? এ বিষয়ে পরেরদিন কি সে মুখ খুলবে? নাকি রৌণকই ঠিক? ঠিক কাটিয়ে চেপে যাবে পুরোটা?!)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত