অতনুর ঘুম ভাঙতে দেখল আজও আকাশের মুখ ভার। শীতের শেষ তবু একটা ঠান্ডা ভাব রয়ে গেছে। যাব যাব করেও শীতবুড়ি এখনো পুরোপুরি পাততাড়ি গুটোয় নি। তার ওপর শুরু হয়েছে এই এক ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। মাঝরাতে একবার ঘুম ভাঙতে ঝমঝম করে বৃষ্টির শব্দ শুনেছে সে। সাথে বাজ পড়ার আওয়াজ। তখন মনে হচ্ছিল আহা! এখন যদি কেউ পাশে থাকতো ওর।
বন্ধুবান্ধব দের মধ্যে দু’একজন ছাড়া সবার বিয়ে হয়ে গেছে। কয়েকজনের ছেলে মেয়ে তো বড়ই হয়ে গেল। অতনুর মনে মনে বিয়ের শখ ষোল আনা হলে কি হবে, রোজগার পাতি বেশ কম। টিউশনি আর দুটো কোচিং এ ক্লাস করিয়ে আগের থেকে অবশ্য ইনকাম বেড়েছে। কতজন ওর থেকে কম রোজগার করেও বিয়ে করে, আর ওর তো তেমন খারাপ অবস্থা নয়। তার ওপর বন্ধুদের থেকে আড্ডার আসরে যখন বিবাহিত জীবনের গল্প শোনে, মনটা তখন আনচান করে অতনুর। হায়রে ওর যদি একটা বউ থাকতো।
প্রেম করার বয়স মোটামুটি পেরিয়ে এসেছে। তাই একবারে বিয়ের কথাই চিন্তা করে। সমস্যা হল ওর দাদা অমলকে নিয়ে। তার এক গোঁ। আরও কটা দিন যাক তারপর বিয়ে করব। না করলেও ক্ষতি নেই। আরে বাবা তুই নয় সমাজসেবা, রাজনীতি করে বেড়াস। কোন নারীর প্রতি অত টান নেই। তা বলে ভাইয়ের বিয়ের সাধ হয়না! বাড়ির লোকও গোঁ ধরে আছে অমলের বিয়ে দেবেই। মাঝপথে তাই অতনুর কথা কেউ চিন্তা করে না।
বৃষ্টি ভেজা সকালে আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়ানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু উপায় নেই। সামনেই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা আসছে। নটার মধ্যে উল্টোডাঙ্গা ঢুকতেই হবে। দুটো ক্লাস নেওয়ার আছে পরপর। আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসে, পাশের টেবিল থেকে চশমা টা তুলে নিল। চোখের সমস্যা ভালই। আজ ফেরার পথে একবার চোখের ডাক্তারের কাছেও যেতে হবে। ছাতা নিয়ে বেরনো একেবারে পছন্দ নয় অতনুর। কিন্তু আজ সারাদিন এই টিপ টিপ বৃষ্টিতে রাস্তায় কাটাতে হবে। আর সঙ্গী হবে ছাতা! ভেবেই মনে মনে বিরক্ত হলো অতনু। তারপরে একটা কথা মনে পড়তে লাফ মেরে খাট থেকে নামল।
আজ বুধবার তো! ঠিক আটটা দশ নাগাদ যদি ওই রুটের প্রাইভেট বাসটা ধরতে পারে, সেই মেয়েটার সাথে দেখা হবার প্রবল সম্ভাবনা। গত তিনটে বুধবার এমন হয়েছে। ওই সময় বাস ধরলে অতনু দেখেছে, ডান দিকে ঠিক জানলার পাশে বসে একটা মেয়ে। এমন কিছু সুন্দরী নয়, তবে চটক আছে। মুখশ্রীটা বেশ। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ থাকে। অতনুর নামার আগে স্টপেজে নেমে যায়। কলেজ ছাত্রী তো নয়, তার থেকে বয়স বেশি। তবে বয়সটা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারে না অতনু। শুধু ওর খুব ভালো লাগে তাকিয়ে থাকতে। আজও দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তাই অতনু কাজ সারে কোন রকমে। জলখাবার খেতে বসে। মা আজ পরোটার সাথে সাদা আলু চচ্চড়ি করেছে। অন্য দিন হলে তারিয়ে তারিয়ে খায়। কিন্তু আজ ওর হাতে সময় কম, দেরি হলে সেই মেয়েটার সাথে যদি দেখা না হয়! যদিও কোন কথা তো দূর অস্ত সরাসরি চোখাচোখিও তেমন হয়নি। তবে অতনু দেখেছে মেয়েটাও মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অতনুর তাড়াহুড়ো দেখে মা বিরক্ত,
” আরে বাবা যাবি যাবি! দশ মিনিট দেরিতে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।” “না মা, জানো না এখন সব টাইম অনুযায়ী। পরপর কোচিং থাকে ছেলে মেয়েদের। একটা দেরি হয়ে গেলে মুশকিল। ”
মা যে কি মুশকিল বুঝলো কে জানে ? অতনুর মুশকিল যে অন্য জায়গায়!
না আজও বিফল হলো না বাসে উঠে। অতনু দেখল মেয়েটা আজও সেই সিটিটা দখল করে বসে আছে। চোখে চোখ পরতে একটু হাসলো। আজ অতনুর ভাগ্য তো ভালো!
বিকালে চোখের ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে বসে অতনু। সেখানে বসে সেই বাসের মেয়েটা। কি করবে ভেবে পায়না অতনু। ওর পাশেই একটা জায়গায় বসে পড়ে। মেয়েটাই প্রথমে আলাপ করল।
“ওমা আপনি এখানে! ”
“হ্যাঁ। চোখ দেখাবো।”
” চোখের ডাক্তারের চেম্বারে বসে যখন, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।”
“তাই না ? আর আপনি? আপনার চোখে তো চশমা নেই। আপনারও কি চোখ খারাপ। ”
অকারণে তোতলায় অতনু। হেসে ফেলে মেয়েটি। আমার চোখে লেন্স আছে। আমিও চোখ দেখাতে এসেছি এখানে।”
এইভাবে আলাপ জমে। অতনু জানতে পারে মেয়েটার নাম কাকলি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। এই শুরু, এরপর প্রত্যেক বুধবার শুধু না শনিবারও দুজনে দেখা হতে থাকে। কাকলি রোজ একই সময় বাসে চাপে। অতনু ওই দিকেই একটা টিউশনি নেওয়ায় সপ্তাহে দুদিন দুজনে দেখা হচ্ছে। আলাপ থেকে ধীরে ধীরে প্রেমের জন্ম হয়। বাসেই একে অপরকে ভালো লাগার কথা জানিয়েছে। এক-দু’দিন বাইরেও দেখা করলো দুজন। অতনু ভাবে বিয়ের কথা বলে। তারপর নিজেই চেপে যায়। মনে পড়ে যায় দাদার কথা। বাড়িতে জানাবে কিভাবে! কি জ্বালা!
একদিন রাতে খাবার সময় মা বলল অমলের এক পাত্রী দেখতে যাবে পরদিন। এক পিসতুতো বৌদি খবর এনেছে। মেয়েটার বয়স একটু বেশি আর ছোটখাটো কাজ করে। তাই অমলের সাথে ভালো মানাবে। অমল তো যেতে রাজি নয়। বলে কি, মা তোমরা ভাইকে নিয়ে যাও। ও দেখলেই হবে আমার আর কি দেখার আছে। অতনু এক কথায় রাজি। আরে বাবা মেয়ে যেমনই হোক, দাদার বিয়ে দেওয়া যে বড় দরকার। না হলে ওর রাস্তা যে পরিষ্কার হচ্ছে না।
পরদিন মা আর দিদির সাথে অতনু গেল। কিন্তু একি! পাত্রী হিসেবে যে এসে দাঁড়ালো সামনে সে তো কাকলি। দুজনেই দুজনকে দেখে চমকে উঠেছে। কাকলি প্রথম নিজেকে সামলে বলে,
” তুমি? ”
সবাইকে তারা জানালো বাসের মধ্যে দুজনের আলাপ এর কথা। এদিকে অতনুর গা জ্বলছে। তাকে কি করে ঠকায়!
কিছুক্ষন পর দুজনেই ঘরে একা থাকার সুযোগ পায়।অতনুর মা আর দিদি ভেতরে ঘর দোর দেখতে গেছে। অতনু বলে,
” এসব কি? তুমি আমায় ঠকিয়ে, আমার দাদাকেই বিয়ে করতে যাচ্ছ!”
“কি করে জানব বলো, হবু পাত্র তোমারই দাদা! তাছাড়া আমায় কখনো বলেছ নাকি, যে বিয়ে করবে! ”
“তুমি শুধু রাজি কিনা বল। আমার দাদা এমনিতেই তেমন বিয়েতে রাজি হচ্ছে না। বাড়ি গিয়ে আমি সবাইকে জানাব, আমি তোমাকে ভালবাসি। বিয়ে করব তোমাকেই। আর রাজিও করাব সবাইকে। ”
কাকলি আস্তে বলে,
” ওরে আমার বীর পুরুষ! আমি তো রাজি। তবে এটা কি জান, আমি তোমার থেকে প্রায় বছর পাঁচেক বড় হই।” অতনু দাঁত বের করে বলে, “সেটা বাসে তোমার মাধ্যমিকের সাল শুনেই বুঝেছি। তবে বলিনি কখনো।”
কাকলি অবাক,
“আমি আজ তোমার মায়ের মুখে তোমার দাদার বয়স শুনে আন্দাজ করলাম। ”
আর কথা বলার সুযোগ নেই ঘরে অন্য লোকজন এল।
এরপর মাসখানেক পর একদিন রান্না ঘরে অতনুর মা, তার ছোট ছেলের বউ কাকলিকে বলেন,
” প্রথমে তোমার বয়স শুনে আপত্তি করেছিলুম মা। কিন্তু এখন ভালো করেই বুঝছি, তোমার মত এক বোঝদার মেয়ে এ বাড়িতে দরকার ছিল। ভাসুর তোমার ভবঘুরে আর স্বামী তোমার ছেলে মানুষী বুদ্ধিতে চলে। এদের তুমি ছাড়া সামলাবে কে।”
লজ্জায় মাথা নামায় কাকলি।
সমাপ্ত