অন্তর দহন

অন্তর দহন

ছোটোর ঘরে সন্ধ্যাবাতি দিতে এসে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো বিজয়ার। ঘোষাল বাড়িটা আজ বড় নিষ্প্রাণ লাগে তার।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পূজো দিতে গিয়েছিলেন একবার ঘোষাল দম্পতি, সে বহুদিন আগের কথা।পূজো দিয়ে গরমে শরীর খারাপ লাগতে থাকে শোভনা দেবীর, স্বামীকে বলেন- চল কোথাও একটু গিয়ে বসি, মাথায় কেমন যেন ঘুরছে, চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসছে। প্রমাদ গুনলেন হরিহর ঘোষাল, গিন্নি নাকি স্বপ্ন দেখেছেন মা পূজো চাইছেন তার কাছে। গিন্নির কথা রাখতেই এই গরমে এখানে আসা। ভারী শরীর নিয়ে যেন বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে গিন্নি। কোনোমতে তাকে ধরে নিয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকালেন ঘোষাল মশায়। যদি একটা ডাব বা একটু জল দিতে পারতেন গিন্নিকে। কাউকে আশেপাশে না দেখে বললেন- একটু এখানে জিরোও, আমি দেখি কোথাও একটু জল পাই নাকি! জলের ঘটি নিলেন সাথে।

এদিক ওদিক ঘুরে যখন জল নিয়ে এলেন দেখলেন গাছের নিচে ছোটো মতো একটা ভীড় জমে গেছে, ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। কোনোমতে সেখানে গিয়ে দেখলেন, কাপড় কোমর বেঁধে গায়ে ভেজা গামছা পরিহিতা একটা পনেরো, ষোলো বছরের মেয়ে পরম মমতায় শোভনার মাথা ধুইয়ে দিচ্ছে, আর একটা ঐ বয়েসের মেয়ে কলসী করে জল ঢালছে, আরেকজন পাখা দিয়ে বাতাস করছে, দুএক জন দেখছে দাঁড়িয়ে।
এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন- শোভনা, শোভনা কি হয়েছে তোমার! বেশী শরীর খারাপ করছে?

মেয়েটি চোখ তুলে তাকিয়ে বললো- কেমন লোক আপনি? একটা অসুস্থ মানুষকে গাছের নিচে রেখে চলে গেছেন? ঘোষাল মশাই কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে বললো, একটা রিকশা ডেকে আনুন, পাশেই আমার বাড়ি, আমার বাবা নামি কবিরাজ, একটু ওষুধ খেলেই উনি সুস্থ হয়ে যাবেন। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো- কি হলো যান রিকশা ডেকে আনুন! কি যেন ছিল তার বলার ধরণে, রিকশা আনতে চলে গেলেন তিনি।

রিকশা বাড়ির সামনে থামতেই তাকে নামিয়ে ভেতরে নিতে নিতে মেয়েটি ডাকলো -বাবা ও বাবা!

ভট্টাচার্যি মশাই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে একসাথে অনেককে দেখে বললেন -আজ আবার কার সাথে ঝগড়া করে এলি বিজু? বিজুর মা বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে।

বিজু বলে -দেখোতো বাবা, ইনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই বাড়ি নিয়ে এলাম, ওষুধ দাও তো বাবা।
আরে আসুন ভেতরে, কইগো একঘটি জল দাও দেখি। বিজুর মা জল এগিয়ে দিলেন।

ওষুধ খেয়ে খানিক সুস্থ হয়ে যেতে চাইলে, বিজু বললো- রোদ না পড়লে যেতে পারবেন না, এই বলে রাখলুম।
ভট্টাচার্যি দম্পতি তাদের আটকে দিলেন। গল্পে গল্পে জানতে পারলেন মেয়েটির নাম বিজয়া।
ঘোষাল দম্পতি ফেরার আগে বড় ছেলের বউ হিসেবে বিজয়া কে আশীর্বাদ করে গেলেন।

সার্থকের সাথে বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে বিজয়ার। সৃজন তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে।ছোট ছেলে বলে সবার খুব আদরের। সার্থক চাকরি করে দিল্লীতে। বিজয়াকে নিয়ে গেছিলো সেখানে বিয়ের মাস খানিক বাদে। সেখানে সারাদিন একা একা থাকতে তার ভালো লাগতো না। সার্থক বুঝতে পারতো সে কথা। বাবা মা সেখানে বেড়াতে এলে বিজয়াকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিলো।

শ্বশুর বাড়ি এসে প্রাণ ফিরে পায় যেন বিজয়া। সারাদিন শ্বশুর, শাশুড়ী, দেওর, কাজের লোকজন নিয়ে ভালোই কেটে যায়। সার্থক আসে ছুটি ছাটায়, মাঝে মধ্যে বউকে নিজের কাছে নিজে যায়।

সৃজনের সাথে খুব ভাব তার, সময় পেলে তার থেকে কলেজের গল্প শোনে, নিজের গল্প শোনায়, খুনসুটি উপভোগ করে।

বিয়ের তিন বছরের মাথায় শাশুড়ী মারা গেলে বাড়ির কর্তী হয়ে ওঠে বিজয়া। সবাই বলে অনেকদিন তো হলো বিয়ে হয়েছে, এবার একটা বাচ্চা আসুক বাড়িতে। শ্বশুর মশাইয়ের স্বাস্থ্য ভাঙছে ক্রমশ।

বাচ্চা চাইলেই কি সহজে হয়, বাচ্চা হলোনা বিজয়ার। আড়ালে,আবডালে লোকজন বাঁজা, অপয়া বলে। অনেক চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হলোনা।

সৃজন ততোদিনে চাকরী পেয়েছে।শ্বশুর মশাইয়ের ইচ্ছা বেঁচে থাকতে থাকতে ছেলেটাকে সংসারী করে যাবেন। মেয়ে দেখা চলছে,সৃজনকে মেয়ে দেখতে বললে- সে বলে বৌদি পছন্দ করলেই হবে, আমি আবার কি দেখবো!
অনেক দেখেশুনে বিজয়া দেওরের জন্য চৈতী কে পছন্দ করলো। মিষ্টি মুখের, ছিপছিপে, শ্যামবর্ণা এক মেয়ে।
সবাই বললো বড় বৌয়ের রূপের কাছে এ বৌ কিছুই না।এসব শুনে বিজয়া মনে মনে খুশি হলেও বলে রূপ দিয়ে কি হবে? চৈতীর মতো ভালো মেয়ে অনেক সাধ্য সাধনা করে খুঁজে এনেছি।

চৈতী নিজের গুনে বাড়ির সকল মানুষকে আপন করে নিয়েছে। শ্বশুর মশাই খুব খুশি, বাড়ির কাজের লোকেরা ও ছোটো বৌদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এসব শুনে গায়ে জ্বালা ধরা শুরু হয়ে যায় বিজয়ার। কালো বৌয়ের এতো আদর! ভাবলেই রাগ হয় তার। সৃজনকেও ঐ বৌ হাত করে নিয়েছে কয়েক মাসের মধ্যেই। অফিস যাবে বলে সাত সকালে উঠে রান্না করে। টিফিন গুছিয়ে দেয়।

বিজয়া কয়েকবার বলেছে- এই তো সবে বিয়ে হয়ে এলি ছোটো, এখনি সংসারের হাল ধরা কেন? খাবি দাবি থাকবি, ঘুরে বেড়াবি ইচ্ছে মতো। আর সৃজন তো আমার হাতের রান্না খেতে অভ্যস্ত, ও কি ভালোবাসে না বাসে এসব তুই জানবি কি করে?

চৈতী হেসে বলে -তাইতো সব তোমার থেকে শিখে নিচ্ছি দিদি, তুমি হলে এ সংসারের কর্তী, অনেক দিন তো করলে তুমি, এবার একটু আরাম কর।

আমায় শিখিয়ে পড়িয়ে নাও, তোমার মতো করে!
কথা জানে বেশ বউটা, ঠিক কথার জালে আটকে আগ বাড়িয়ে সব সময় মতো সেরে ফেলে।
সৃজনটাও হয়েছে তেমনি, অফিস থেকে ফিরে আর বেরোতেই চায়না, সারাদিন বৌয়ের সাথে গুজগুজ করে। বিজয়ার সাথে সময় কাটাতে তো ভুলেই গেছে যেন।

রাগ অভিমান করে থাকলেও সে বোঝোনা, বৌদিকে না দেখতে পেলেও খোঁজ করেনা। কালো বৌ নিয়ে আদিখ্যেতা দেখলে রাগে গা জ্বলে তার।

বৌ নিয়ে সাতদিন সমুদ্রে ঘুরতে চলেগেলো। মন রাখতে ছোটো কয়েকবার বলেছিলো তুমি ও চলনা দিদি ঘুরে আসবে! ওসব ন্যাকামো সব বোঝে সে। আর তার খাস কাজের ঝি, সেদিন তো বলেই দিলো- বেছে বেছে কালো মেয়ে এনে কি লাভ হলো বলতো? ও মেয়েতো ঠিক নিজের আঁচলে বরের মন বেঁধে নিয়েছে। রাগ হলেও নিজেকে সামলে নেয় বিজয়া।

সার্থক সব ব্যাপারেই উদাসীন, ঘরে কোথায় কি হচ্ছে সে তার কি জানে!বাচ্চা হয়নি বলে কোনোদিন বিজয়াকে কোনো দোষারোপ করে নি কখনো।

যেদিন জানলো চৈতীর বাচ্চা হবে, বিজয়ার হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ছোটো তাকে হারিয়ে দিলো সেখানেই। শ্বশুর মশাই আনন্দে আটখানা, বংশের কেউ একজন আসতে চলেছে। সৃজনের বৌয়ের প্রতি যত্ন, তাকে কষ্ট দেয় খুব। তাছাড়া আত্মীয় স্বজনের কথা গুলো কানে আসছে, যাক এই বৌ ঘোষাল বাড়ির খুশির খবর এনেছে। এতোদিনে শ্বাশুড়ীর আত্মা শান্তি পাবে।

মাস দুয়েক পর হঠাৎ ঘটে গেলো অঘটন, চৈতী ঘুম থেকে উঠে দোতালা থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লো নীচে।

ব্যাস আর কি! পেটের বাচ্চা মরে গেলেও চৈতী নিজে পঙ্গু হয়ে পড়ে রইলো বিছানায়। তার মেরুদণ্ড ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছিলো। ডাক্তার জানালো সে যে ক’দিন বাঁচবে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে।

বিজয়া ছাড়িয়ে দিলো একজন পুরোনো কাজের লোককে, সে নাকি সিঁড়িটা জলজলে করে মুছে ছিলো নিজের কৃতকর্ম আড়াল করতে।

এতো বড় শোক শ্বশুর মশাই নিতে পারলেন না। একদিন সকালে চা দিতে গিয়ে বিজয়া দেখে তিনি সব মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ভোরের আলো ফোটার আগেই।

আর সৃজন! বৌকে যে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলো। চাকরি ছেড়ে দিনরাত চৈতীর মুখের সামনে বসে থাকতো। কষ্টের ভাগ নিতে পারতোনা বলে মরমে মরে যেতো। চৈতী বুঝে গেছিলো সে এভাবে বেঁচে থাকলে সৃজন হয়তো সুস্থ থাকতে পারবেনা। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো একসময়ে।

বিজয়া তার খাওয়া দাওয়াটা দেখতো, একদিন খাওয়াতে এলে সে বললো -আমার এতো বড় ক্ষতি কেন করলে দিদি? তুমি তো আমায় পছন্দ করে এনেছিলে এ বাড়িতে? তবে কেন করলে এমন?

পালিয়ে এসে বেঁচেছিলো বিজয়া তার সামনে থেকে, উত্তর দিতে পারে নি সে।
যন্ত্রণায় কাতরে কাতরে হেরে গেছিল চৈতী একসময়ে।

সৃজন বোবা হয়ে গেছিলো যেন, চৈতীকে দাহ করে এসে নিজের ঘরে দোর দিয়েছিলো সে। সকালে তার ঘরে গিয়ে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিজয়া থেকে গেছিল ঘোষাল বাড়িটা আগলে, যেতে পারে নি কোথাও। পাপ! পাপ তাকে ছেড়ে দেয়নি হয়তো!
এতো সব কিছু করে কি পেল সে! শুধু কর্তী হয়ে রয়ে গেল। তার সাথে কথা বলার মতো কেউ রইলো না। দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার করে সারা বাড়িটা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত