শুধু তোমারই জন্য

শুধু তোমারই জন্য

অর্পিতা যখন গাড়িটা নিয়ে ফ্লাইওভারের ওপর উঠল,বৃষ্টি তখনও ঝির ঝির করে ঝড়েই চলেছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত্রি আটটা আর গাড়ির ভেতর এফ এম এ ওর প্রিয় অনুষ্ঠান “গল্পগুচ্ছ”। কাহিনী পাঠে অনিক।এই প্রোগ্রাম টা বরাবরের খুব পছন্দের অর্পিতার ।এটার একটা এপিসোডও মিস করেনি আজ পর্যন্ত।কত নতুন নতুন লেখকের সুন্দর সুন্দর গল্প পড়ে শোনানো হয়,আর অনিক এতো সুন্দর ভাবে বলে,মনে হয় যেন চোখের সামনে ঘটনা গুলো ঘটে চলেছে ছবির মতো।

এফ এম এর অন্যপ্রান্তে অনিক নিজের দরাজ গলায় বলে উঠলো:
“বন্ধুরা আজকে আপনাদের শোনাতে চলেছি অভিরূপ দাসের লেখা গল্প ” শুধু তোমারই জন্য”।
নিজের মোবাইলে বাকি রাস্তার রুটটা দেখতে দেখতে সাউন্ড টা একটু বাড়িয়ে দিল অর্পিতা।
অনিক বলতে শুরু করল:

“বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি আর দমকা হওয়া… আর মাঝে মাঝে কানফাটা বিদ্যুতের গর্জন।কলকাতার বস্তির এককামরার ঘরে ,দরজা জানলা বন্ধ করে আটমাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘরের কোনের হ্যারিকেনের আলোটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উমা।মাত্র তিনদিনের জ্বরে আজ দশ দিন হল তার স্বামী মারা গেছে।কারখানায় কাজ করে কিছুই রেখে যেতে পারেনি উমার জন্য।শুধু রেখে গেছে তার এই আটমাসের ছেলেকে।দুকূলে কেউ নেই ওর পাশে দাঁড়ানোর মতো।এই দশ দিন কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল ও শুকিয়ে গেছে উমার।স্বামী হারানোর ব্যথার জায়গায় এখন মনের মধ্যে ভিড় করেছে একরাশ চিন্তা। চিন্তা আগামী অনিশ্চিত দিনগুলোর কথা ভেবে চিন্তা এই একরত্তি ছেলেকে মানুষ করার।

হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে কে যেন কড়া নাড়লো: ঠক ঠক ঠক অন্যমনস্কতা ভেঙে উমা বলে উঠল

“কে?
বাইরে থেকে এক চাপা গলায় আওয়াজ এল
“বৌদি আমি রতন,একবার দরজাটা খোলো…কথা আছে”
উমা আবার বলে উঠল
“এত রাতে কিসের কথা?
“আরে বাবা.. খোলই না একবার,বাইরে ভিজে যাচ্ছি বৃষ্টিতে”
বাচ্চাটাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে দরজাটা খুলতেই রতন তড়িঘড়ি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল।
উমা ভূরু কুঁচকে রতনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“এত রাতে কি হয়েছে? কি বলবে?
রতন বিছানার ওপর ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল

“বৌদি ওই বলেছিলাম না তোমায়, কাজটার কথা পার্টি রাজী আছে তুমি শুধু একবার হ্যাঁ কর বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি মোটা পার্টি মাত্র ২ ঘন্টা পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি কাজ পছন্দ হলে ঘন ঘন ডাক পাবে আর”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই উমা ঘরের কোনে রাখা রান্না করার বঁটি টা তুলে, রতনের দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে বলল

“আর কক্ষনো যদি এইসব নোংরা কথা বলিস গলা কেটে দেব তোর দাদা তোকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখতো লজ্জা হয়না বৌদিকে নিয়ে দালালি করতে বেরিয়ে যা এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা আর কখনো যদি এই বাড়ির ত্রিসীমানায় পা দিয়েছিস পা খোঁড়া করে দেব”।

উমার এই ঝাঁজালো চন্ডীরূপ দেখে ভয়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে গেল রতন।খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে উমার চোখ মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে….।রাগে,দুঃখে,ঘেন্নায় ফুঁসতে ফুঁসতে উমার চোখ স্থির হল দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোটার দিকে। আলোটা এই দুর্যোগের মধ্যেও যেন নিজের কোমল হাসি হেসে দূরের রাস্তাটাকে আলোকিত করে চলেছে…

ঘটনাটার পর প্রায় মাস তিনেক সময় কেটে গেছে,উমা এখন এই পাড়ারই চারটে ঘরে কাজ ধরেছে,সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে যায়, ফেরে প্রায় দুপুর বারোটা নাগাদ তারপর ওর ছোট্ট রিক কে খাইয়ে,ঘুম পাড়ায়।বিকেল হতে না হতেই আবার বেরিয়ে পরে কাজে।রাতের বেলা বাড়ি ফিরে আবার বাচ্চাকে খাইয়ে ঘুম পাড়ায়।তারপর বসে পরে ভাড়া নেওয়া একটা সেলাই মেশিন নিয়ে প্রায় ভোররাত অবধি কাজ করে ওতে। যতক্ষন বাড়ির বাইরে থাকে, রিককে দিয়ে যায় পাশের বাড়ির মালতির কাছে।মালতি নিজের বাচ্চাটার সাথে রিকের ও খেয়াল রাখে সমান ভাবে।মাস গেলে কিছু টাকা দিয়ে দেয় মালতিকে…

রিক এখন চার বছরের।এই কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসার টা জোড়া তালি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে উমা।একদিন দুপুর বেলা ফিরতি পথে হঠাৎ দেখা আশা দির সাথে।এই আশা ই ওকে প্রথম বাড়ির কাজটা ঠিক করে দিয়েছিল।ও নিজেও বেশ কয়েক বাড়ি কাজ করতো।আগে সময় পেলেই দুপুর বেলা চলে আসত গল্প করতে,রিককে দেখতে।বেশ কিছুদিন ধরে আর দেখা হয়নি ওদের।আশাকে দেখতে পেয়েই উমা ডেকে উঠল

“আশা দি ও আশা দি!”
আশা পিছন ঘুরে উমাকে দেখতে পেয়েই হাসিমুখে ওর কাছে এসে বলল
“কেমন আছিস উমা?রিক ভালো আছে তো?”
“হ্যাঁ দিদি ভালো আছে,তোমায় এখন আর বেশি দেখতে পায়না, সব ঠিক আছে তো বাড়িতে?”
আশা হেসে বলল

“হ্যাঁরে বাবা,সবাই ভালো আছে,আসলে এখন এই দুপুরবেলায় সামনের স্কুলটার পাশে একটা ঠেলা গাড়িতে খাবার বিক্রি করছি,তোর দাদাও এসে হাত লাগাই  ভালোই চলে যাচ্ছে।তাই দুপুর বেলা আর আসা হয়ে ওঠেনা রে।”

“ঠেলা গাড়ি? কি কি খাবার বিক্রি করো?”
“ওই টুকটাক চা,ম্যাগি ডিম পাউরুটি এই সব আর কি।”
“কি রকম বিক্রি হয়?”

“ঠাকুরের আশীর্বাদে ভালোই চলেরে,সংসারে খরচা তো দিন দিন বাড়ছে,ঠেলা গাড়িটা দেয়ার পর থেকে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পাচ্ছি এই যা”

আশার আলোয় চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো উমার।আশাদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
“আচ্ছা আশা দি …আমাকেও এই রকম একটা ঠেলা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে, দুপুর বেলাটা তো ফাঁকাই থাকি..যদি দু এক পয়সা এই দুপুর বেলাগুলো থেকে আসে, রিকটাকে বছর দুয়েক পর একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করতে পারবো ”
“এত কিছু কি ভাবে সামলাবি?এই চার চারটে বাড়ির কাজ, রাতের বেলা সেলাই তার মাঝে আবার ঠেলা গাড়ি তাছাড়া রিক না না তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি!

উমা আশা দি র হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে
“কিচ্ছু হবেনা দিদি তুমি সবসময় পাশে দাড়িয়েছ,দেখোনা একবারটি যদি কিছু একটা করতে পারো?”
আশা ওর কাকুতি মিনতি মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল

“ঠিক আছে আজ রাতের বেলা কাজ সেড়ে চলে আয় আমার বাড়ি দেখি তোর দাদাকে বলে”

কাল প্রথম বার উমা ওর ঠেলা গাড়িটা নিয়ে কাছেই এক কলেজের সামনে বসেছিল।রেখেছিল ডিম পাউরুটি ম্যাগি আর চা এর সরঞ্জাম।সারাদিনে কয়েক কাপ চা বাদে কিছুই বিক্রি হয় নি, পাশের ভদ্রলোক ওকে বলেছিলেন
“এই সব কিছু কলেজ ক্যান্টিনে পাওয়া যায় মা কে এই দুপুর বেলা রোদে বেরিয়ে এসে এখান থেকে খেতে যাবে?

আজ তাই উমা রিক কে নিয়েই ওখানে বসেছে,যতটুকু বিক্রি হয় হবে আর বাদ বাকি সময়টা রিক এর সাথে থাকবে, ওকে পড়াবে।রিক টাও হয়েছে বড্ডো মা নেওটা সারাক্ষন তুরতুর করে মায়ের চারিদিকে ঘুড়ে বেড়াবে আর মা এর শাড়ী টা ধরে মায়ের আঁচলের তলায় ঢুকে পরবে।হঠাৎ দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল ওই কলেজেরই এক ছাত্রী।

“দিদি চা হবে?
“হ্যাঁ দিচ্ছি”
মেয়েটা রিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
“আপনার ছেলে বুঝি?? ভীষণ মিষ্টি দেখতে তো?
এই বলে মেয়েটা রিক কে কোলে নিয়ে গালটা টিপে জিগ্যেস করল
“কি নাম তোর?”
ঠোঁট ফুলিয়ে রিক হাত দুটো মায়ের দিকে বাড়িয়ে বললো
“মার কাছে যাবো”
একগাল হেসে রিক কে নামিয়ে দিয়ে মেয়েটা উমার দিকে তাকিয়ে বলল
“নতুন বসেছেন এখানে?আগে দেখিনি তো?
চা দিতে দিতে নিজের জীবনের ঘটনা সংক্ষেপে বলে উমা বলল

“এখানে ঠেলাটা দেওয়া এই রিকটার জন্যই …খুব ইচ্ছে ওকে ভালো স্কুলে দেওয়ার…ওর মাথাটাও বেশ পরিষ্কার আমি তো বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারিনি ও যদি ঠিক করে দাঁড়াতে পারে।কিন্তু পোড়া কপাল কাল থেকে এই নিয়ে শুধু চার কাপ চা বাদে কিছুই বিক্রি হয়নি।”

মেয়েটা চা এ চুমুক দিতে দিতে চুপ করে গেল।তারপর চা শেষ করে বলল
“কাল বসবেন তো?”
“হ্যাঁ বসবো।”
“ঠিক আছে” বলে চলে গেল মেয়েটা।

পরের দিন উমা যথা সময়ে ঠেলা টা নিয়ে আবার বসল।টিফিন টাইম এ হঠাৎ দোকানের সামনে যেন ভিড় উপচে পড়ল…

কেউ বলছে
“দিদি একটা ম্যাগি দিন”
কেউ বলছে

“একটা ডিম পাউরুটি”
একহাতে সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল উমার পক্ষে…কিন্তু এই উপচে পড়া ভিড়ের মাঝেই নিজের সপ্নকে যেন সত্যি হতে দেখছিল উমা মাঝে মাঝেই চোখদুটো নিজের থেকেই ছল ছল করে উঠছিল।

রিক মায়ের শাড়ির পিছনে আঁচলটা ধরে মাঝে মাঝে উকি মেরে ছেলে মেয়েগুলোর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল…

রিক এখন ক্লাস সিক্স এ উঠলো।বেশ কিছু টাকা রোজগার করে ছেলেকে মোটামুটি একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করেছে উমা।ওর পড়ার পিছনেই বেশিরভাগ টাকাটা খরচা হয়।রিক বাড়ি ফেরে প্রায় বিকেল ৫ টা নাগাদ।উমা কলেজের সামনে ঠেলার খাবার বিক্রি করে দু বাড়ি কাজ করে বাড়ি ফেরে প্রায় রাত আটটার সময়।এসে রান্না চাপায় উমা যখন রান্না করে, রিক মাঝে মাঝে এসে মা কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।মায়ের এই নুন হলুদ মাখা শাড়ীর আঁচলের গন্ধটা ওর খুব পছন্দের।রাতের খাওয়া শেষ করে উমা সেলাই এর কাজ নিয়ে বসে।আর ওর পাশেই রিক বসে পরে বই নিয়ে।মা কে শেখাতে হবে যে।আসলে রিক যখন ক্লাস ফাইভে পড়তো উমা তখন একদিন সেলাই করতে করতে বলেছিল

“আমায় একটু পড়া শেখাবি রিক?”
“হ্যাঁ শেখাবো”
“ঠিক আছে, এবার থেকে রোজ যা শিখে আসবি আমায় আমার মতো করে বোঝাস দেখিস মাকে যেন ভুল শেখাস না তোর কথাই আমার কাছে শেষ কথা।”

সেই দিন থেকেই শুরু।রিক সারাটাদিন খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করত,বুঝতে না পারলে স্কুলের স্যারদের বার বার জিজ্ঞেস করত বাড়িতে মা কে শেখাতে হবে যে।কোনোদিন রিক, উমা কে ইতিহাসের গল্প বলে ,কোনোদিন বা ভূগোলে পড়া নদ নদীর গল্প করে।

উমা জানে এভাবে হয়তো পড়া শেখা যায়না,তবু এই গল্প শোনার বাহানায় রিক টার পড়াটা আবার রিভিশন হয়ে যাই।আর সেটাই ছিল উমার আসল উদ্দেশ্য।মাঝে মাঝে সব কিছু শুনেও না শোনার ভান করে উমা রিক কে বলতো

“কি বললি আরেকবার বল ,শুনিনি ঠিক করে”
রিক ও অক্লান্ত ভাবে নতুন উৎসাহে আবার ওর মা কে বোঝাতে শুরু করতো।
এর ফলও মিলল হাতে নাতে।রিক নিজের ক্লাসে প্রথম হতে শুরু করল।স্কুলের স্যার রাও অবাক হয়ে যেত ওর পড়ার নিষ্ঠা আর জানার কৌতুহল দেখে
আজ ইউনিভারর্সিটির রেজাল্ট বেরিয়েছে।ইউনিভারর্সিটিতে প্রথম হয়েছে রিক।রেজাল্ট হাতে পাওয়া মাত্র একছুটে বাড়ি পৌঁছে মাকে জড়িয়ে ধরল রিক।উমা তখন ঠাকুরের সামনে বসে পুজো দিচ্ছে।রিকের রেসাল্ট বেরোবে বলে আজ আর কোথাও কাজে যায়নি।ধরা ধরা গলায় জোরে জোরে নিঃস্বাস নিতে নিতে রিক বলল

“মা তোমার ছেলে ইউনিভার্সিটি তে ফার্স্ট হয়েছে।”

নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না উমা। চশমার কাঁচ টা ঝাপসা হয়ে আসছে।তার শিবরাত্রি সলতে আজ যেন পূর্ণাঙ্গ ভাবে জ্বলে উঠেছে। ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে উমা বলল

“তুই আমার সাত রাজার ধন এক মানিক,আমি জানতাম তুই পারবি, কিন্তু এখনো অনেকটা পথ বাকি আছে রিক।যে কোর্সে র কথাটা বলেছিলি সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি এবার শুরু করে দে ” রিক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল

“মা সেতো অনেক খরচের ব্যাপার।ও আমি পরে সময় সুযোগ করে করবো খন এখন একটা চাকরী জোগাড় করে প্রথমে সংসারের হাল টা একটু ধরি কিছু টিউশন করবো অবসর সময়ে দিব্বি আমাদের মা ছেলের চলে যাবে এবার তুমি ছুটি নাও মা বাড়িতে বস সারাজীবন তো কষ্টই করে গেলে।”কথাগুলো বলতে বলতে চোখটা ছল ছল করে উঠলো রিকের।

ছেলের চোখের কোনে জল টা মুছিয়ে দিয়ে উমা বলল
“পাগল ছেলে আমার মা দের কখনো ছুটি হয়না যে আর পয়সার কথা তুই ভাবিস না।তুই শুধু পড়ে যা।একবার পড়া ছেড়ে কাজের মধ্যে ঢুকে গেলে আর পড়তে পারবি না।আর টিউশন অব্যশই করবি তবে এখন নয়।আগে নিজের শিক্ষা সম্পূর্ন কর তারপর।আর যখন পড়াবি তখন টাকার জন্য নয়,আমাদের মতো ঘরের বাচ্চারা যারা পড়াশোনা করার সুযোগ পাইনা তাদের বিনাপয়সায় শিক্ষিত করে তুলবি।তোকে না জানিয়েই শেষ দুমাস ধরে গাড়ি চালানো শিখছি।আমি উবের এ কথা বলেছি।ওরা রাজি আছে।কাল থেকেই রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে বেরুবো।ওরাই জোগাড় করেদেবে গাড়ি। এমনিতেই এখন খুব একটা সেলাইয়ের কাজ আজ কাল আর পাইনা।আবার রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমও আসতে চাইনা।এয়ারপোর্টে ওই সময় বেশ ভালো উবের গাড়ির চাহিদা থাকে।” রিক প্রায় হতবাক হয়ে বলল

“কি বলছো মা ?তুমি উবের চালাবে?মেয়ে হয়ে?তাও রাতের বেলা?
“জানিস সেদিন তোর অনিল মামার কাছে শুনলাম সুষমা মিডের কথা কলকাতার প্রথম মহিলা উবের ড্রাইভার।ও যদি পারে তাহলে তোর মা পারবেনা কেন শুনি?মাসগেলে হাজার খানেক টাকা ঠিক রোজগার করতে পারবো ।আর রাতের বেলার ভয়ের কথা বলছিস।আরে পাগল…যে সব পুরুষ মানুষদের ভয়ে রাতের বেলা বেরোতে বারণ করিস, তারাও শক্তির পুজো করার জন্য মা দুর্গার কাছেই হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে থাকে।রাস্তায় বেরোলে কুকুর ঘেউ ঘেউ করবেই তা বলে কি রাস্তায় বেরোনো বন্ধ করব?বাদ দে সেসব কথা তুই বরং অবসর সময়ে গল্প লেখ এত ভালো লিখিস তুই দেখিস আমার ছেলে একদিন যেমন বড় অফিসার হবে তেমনই বড় লেখক হবে। রিক নিজের মায়ের কথায় হেসে বলে

“সে কিকরে সম্ভব দুটো জিনিস কি একসাথে করা যায়?”
উমা ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলল
“নিশ্চয় সম্ভব ভুলে যাস না তুই উমার ছেলে,তোর মা দশভূজা আমি পেটে সামান্য বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে যদি এত কাজ করতে পারি, তোর মতো একজন শিক্ষিত ছেলে মাত্র দুটো কাজ করতে পারবিনা নিশ্চয় পারবি।যেদিন তোর লেখা ছাপা হবে দুই মলাটের বই বেরোবে সেদিন তোর মার বুকটা গর্বে ভরে উঠবে”

আর দুদিন পর মাদার্স ডে।সারা কলকাতায় ছেলে মেয়েরা দোকানে দোকানে ভিড় করেছে নিজেদের মায়ের জন্য গিফট কেনার জন্য।সকাল বেলা স্নান করে রিক নিজের হোস্টেলের জানালাটার ধারে বসে নিজের ডাইরীটা খুললো।প্রায় আধঘন্টা মার জীবন কাহিনী লেখার পর শেষ প্যারাগ্রাফ এ লিখল

“জানিনা লেখাটা যেখানে পাঠাচ্ছি সেখানে আদৌ এই লেখাটা পড়ে শোনান হবে কিনা এই প্রথম বার গল্পগুচ্ছ তে লেখা পাঠাচ্ছি।যদিও আমি মাদার্সডে মানি না,কারণ সব ছেলেমেয়ের কাছে জীবনের প্রতিটা দিনই মাদার্স ডে। তবু আজকের দিনে সব ছেলের কাছে, সব মায়ের কাছে আমার মায়ের জীবন সংগ্রামের গল্প যদি পৌঁছে দিতে পারি যে মহিলারা নিজেদের অসহায় মনে করেন তাদের কাছে এই গল্প পৌঁছে দিতে পারি আর তারা যদি এই গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হন মনে হবে একটু হলেও আমার মায়ের জীবন সংগ্রাম কে শ্রদ্ধা জানাতে পারবো।আমার মা এই শো টা সবসময় শোনেন তাই প্রথম পাঠানো গল্পটা তাকেই উৎসর্গ করে পাঠালাম।ইচ্ছে আছে মা কে নিয়ে লিখবো এক আকাশ।কথাগুলো কখনো তোমায় সামনা সামনি বলা হয়নি মা তাই লিখে ফেললাম এই কয়েক পাতা আমার জীবনবৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু শুধু তুমি ই মা তুমি সবসময় বলতে তুমি গর্বিত তোমার ছেলে রিককে নিয়ে আজ এই গল্প চিঠির মাধ্যমে সবাই কে জানাতে চাই

আমি গর্বিত মা তোমায় পেয়ে কলকাতার দ্বিতীয় মহিলা উবের ড্রাইভার আমার মা ‘উমা’মানে অর্পিতা দাস আই স্যালুট ইউ হ্যাপি মাদার্স ডে মা।

গল্পগুচ্ছে পাঠানো এই প্রথম লেখাটা তাই শুধু তোমায় নিয়ে শুধু তোমার ই জন্য।
ইতি
তোমার
ছোট্ট রিক/অভিরূপ ”
গল্পটা শেষ পর্যন্ত পড়তে পড়তে অনিকের গলাটাও একটু ধরে গেছিলো।

গাড়িটা এতক্ষণে সল্ট লেকের মোড়ের কাছে পৌঁছে গেছে।মোবাইলে দেখাচ্ছে ডেসটিনেশন রিচড।সামনের লাম্পপোস্ট এর আলো টা একবার জ্বলছে একবার নিভছে।

এতক্ষন অর্পিতার গাড়িটার পিছনে বসে থাকা মহিলা কাস্টমারটি ও মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে গল্পটা শুনছিলেন।নিজের মোবাইলে তার এই ট্রিপের মহিলা ড্রাইভারটির নাম আগেই দেখেছিলেন।গল্পটা শুনে আর গল্প শেষে অর্পিতার চোখে জল দেখে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি ওনার। গল্প শেষ হতেই মহিলাটি বলে উঠলেন

“এই নিন দিদি আমার ভিসিটিং কার্ড,আমি একটা ছোট ম্যাগাজিনের সম্পাদক।রিককে বলবেন আমায় লেখাটা পাঠাতে ,ইচ্চে রইলো আগামী সংখ্যায় লেখাটা ছাপানোর।আমি চাই আপনার এই জীবন সংগ্রামের গল্পটা আমাদের সব পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক।”

একটা দুহাজার টাকার নোট অর্পিতার হাতে দিয়ে বললেন” আর এই নিন ভাড়াটা বাকিটা রেখে দিন”
ধরা গলায় অর্পিতা বলে উঠল

“আমি ভিক্ষা নি না ম্যাডাম আজ অবধি কখনও নি ও নি….শুধু আশীর্বাদ করুন এই গল্পের লেখক যেন খুব ভালো মানুষ হতে পারে”।

মহিলাটি টাকাটা অর্পিতার হাতে গুঁজে বললেন
“আমরা মন্দিরে গিয়ে ভগবান কে কি ভিক্ষা দি? আমরা দি প্রনামি। এটাও আমার প্রনামি আপনার কাছে এক আদর্শ মায়ের কাছে শুধু একটা অনুরোধ’
অর্পিতা বলে উঠলো

“কি?”
মহিলাটি হেসে বললেন
“একটা সেলফি নিতে পারি আপনার সাথে?”
জীবনে এই প্রথম বার এতখানি সন্মান কেও তাকে দিল আর সেটা তার একরত্তি শিব রাত্রির সলতেটার জন্য।
চোখের জল যেন বাঁধ মানতে চাইছেনা।গর্বে বুক টা ভরে উঠেছে।ইচ্ছে করছে বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করে বলতে
“ও আমার ছেলে”
ভদ্রমহিলা টি চলে যাবার পর রিকের নম্বর টা ডায়াল করলো অর্পিতা।
ফোন তুলে রিক কান্না ভেজা গলায় বলল
“তুমি শুনেছো মা?”
অর্পিতা উত্তর দিলো না…

ফোনের দুই প্রান্তে তখন মা আর তার ছেলে মাঝখানে শুধুই নিস্তব্ধতার ভাষা দুজনের চোখেই ভিড় করেছে জলবিন্দু।

ঘন ঘন নিঃস্বাস ফোনের নিস্তব্ধতাকে যেন এক অব্যাক্ত ভাষা দিচ্ছে সে ভাষা মমতার,স্নেহের,গর্বের,ভালোবাসার। সে ভাষা এক ছেলের দেওয়া সম্মানের সে ভাষা মায়ের জীবন সংগ্রামের অন্যতম সেরা প্রাপ্তির। হঠাৎ লাম্প পোস্টের আলোটা স্থির হয়ে গিয়ে গাড়ির সামনের রাস্তাটাকে আলোকিত করে তুললো। বৃষ্টিটা এখন ছেড়ে গেছে।আকাশের কালো মেঘের আড়াল থেকে ঝিলমিল করে উঠলো শত শত তারা। গাড়ির ভেতরের নিস্তব্ধতা ভেঙে, সুনিধি চৌহানের মিষ্টি কণ্ঠে এফ এমে হঠাৎ বেজে উঠলো

“জনম… জনম… হো তুহি মেরে পাশ মা…
জনম …জনম …হো তুহি জমি আশমান!
ইয়ে হ্যায় খবর দিল মে কহি,রব রেহেতা হ্যায় মগর..
মেরে… দিল মে, রেহেতি…ভোলি ভালি… মেরি মা…”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত