আজও দাঁড়িয়ে ছিল পলাশ কোচিন সেন্টারের আগের মোড়টাতে। প্রিয়া আর ওর তিন বন্ধু, একটু আগেই ওই বাসস্ট্যান্ড থেকে রোজ বাস না হলে অটো নেয় যে যার গন্তব্যে যাওয়ার, গত একবছর ধরে সপ্তাহে তিনদিন এই রুটিন চলছে, আর রোজ দু ঘন্টা সময় এখানে এইভাবে আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাটা এক অভ্যাস হয়ে গেছে পলাশের, মনে একটা উঁকিঝুঁকি দেওয়া টিমটিমে নড়বড়ে আশা
–যদি কখোন একা পায় , যদি সিনেমার হিরোর মত ও একদিন সব দ্বিধা কাটিয়ে বলতে পারে মনের গোপনে রাখা সেই বিশেষ অনুভূতির কথা ‘ভালোবাসি’, কিন্তু….
হ্যাঁ এটা সত্যি যে ও খুব ভালোবাসে প্রিয়াকে , কিন্তু শুধু একটা ঠিকঠাক চেহারা, সাদামাটা পড়াশোনা, সাধারণ গ্রাজুয়েট…মধ্যবিত্ত পরিবার, চাকরির চেষ্টারত মাত্র এই যোগ্যতার জোরে প্রিয়ার মত মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কি ভালবাসার বড়াই করা যায় ? উত্তর তো সেই মিলবে প্রত্যাখ্যান, অপমান কিংবা নিদেন তিরস্কার তাই বলা হয়ে ওঠে না তিনটে শব্দ, দ্বিধায়, সংকোচে… .বললে যদি বদলে যায় এই ক্ষনিকের দেখতে পাওয়ার আনন্দ টুকুও …যদি বদলে যায় ওর আসা যাওয়ার সময়টুকু, যদি ছেড়েই দেয় ও কোচিনে আসা…না না কাজ নেই বলে তার চেয়ে এই আড়াল থেকে মুগ্ধ হয়ে দ্যাখাই ভালো…তবু এটুকু সুখই না হয় থাকলো ওর ভাগে একটা মিষ্টি স্বপ্নের মত।
ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া মেধাবী ছাত্রী প্রিয়া, অবস্থাপন্ন পরিবার…নজরকাড়া সুন্দরীও, ভিড়ের মধ্যেও চোখ আটকে যাওয়া চেহারা.. ছিপছিপে, তন্বী, একঢাল চুল, মাখনের মত গায়ের রঙ, পানপাতার মত মুখ, নিটোল চিবুক, গভীর দুটো চোখ। মুগ্ধ চোখে দ্যাখে ওকে পলাশ, যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয়। এক মুগ্ধ প্রেমিকের দৃষ্টি নজর এড়ায় না প্রিয়ারও, প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও এখন বেশ উপভোগ করে ও ব্যাপারটা, মনে মনে হয়ত কোথাও একটু দুর্বলতাও জন্মেছে। কিন্তু তবুও ধরা দেওয়ার সময় বোধহয় এখনো আসে নি।
“ওই দ্যাখ আজও দাঁড়িয়ে আছে রে তোর কেষ্ট ঠাকুর ,বাব্বা কি প্রেম…এক বছরে এক দিনও মিস হয়নি, আর কত অপেক্ষা করাবি, এবার তো হ্যাঁ বলে দে!”
“ধুর, চলতো, তোরাও পারিস কিছু…”
হাসতে হাসতেই এগিয়ে যায় চারজন, পলাশের চোখের সামনে দিয়েই। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিনজনেই বাস, অটো ধরে নেয় যে যার মত,শুধু প্রিয়াই একা অটোর অপেক্ষায়,এগিয়ে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পলাশ শুনতে পায় একটা প্রচন্ড আর্তনাদ “উফফ, মাগো ” মুখ ঢেকে রাস্তায় বসে পরেছে প্রিয়া, আড়াল থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে ওর কাছে যায় পলাশ…
ইশ…কয়েক মিনিট আগের দ্যাখা ওই সুন্দর মায়াবী মুখটার একি বীভৎস হাল! চামড়া গুলো কুঁচকে দগদগে লাল হয়ে গেছে, ডান দিকের কানের পাশে গর্তমত হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে এক খাবলা মাংস যেন উবড়ে নিয়েছে কেউ। রাস্তায় পরে আছে ভাঙা কাঁচের টুকরো আর খানিকটা ফেনা ওঠা নীল নীল জল। যন্ত্রনায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখে কথা বলার ক্ষমতা থাকে না প্রিয়ার, শুধু আঙুলের ইশারাতে কোনোমতে দেখায় তীব্র বেগে হাওয়াতে মিলিয়ে যাওয়া দুই বাইক আরোহীকে, নাম্বারটাও পড়া হয়ে ওঠে না তাড়াতাড়িতে।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে একটা চালু অটোকে দাঁড় করায় পলাশ, প্রায় অচৈতন্য প্রিয়াকে নিয়ে পৌঁছোয় হসপিটালে, ভর্তি করায় এমার্জেন্সিতে, ব্যাগ থেকে নাম্বার খুঁজে ফোন করে জানিয়ে দেয় খবরটা ওদের বাড়িতে।
বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে ইতিমধ্যে, এক একটা মুহূর্তও যেন এক একটা যুগ মনে হচ্ছে ওর কাছে .. ICU তে বন্ধ দরজার ওপারে কি করছে ডাক্তারেরা! কেমন আছে প্রিয়া! ভীষন অস্থির অসহায় মনে হয় ওর নিজেকে। এভাবে চোখের সামনে মুহূর্তে বিকৃত হয়ে যাওয়া একটা সুন্দর চেহারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও, মেনে নিতে পারছে না ওর স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া দুঃস্বপ্নটাও..
খবর পেয়ে এসে পরে প্রিয়ার বাড়ির লোকজন, ওর বাবা, মা, আর ওর ছোট ভাই। পলাশ কে দেখে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে প্রিয়ার বাবা
” তুমিই নিয়ে এসেছো প্রিয়াকে? কি বলে যে ধন্যবাদ জানাই তোমাকে!”
“না না কাকাবাবু এ কি বলছেন, এমন বিপদে তো মানুষ মানুষকে এটুকু করেই থাকে, দুঃখ শুধু এটুকু যে দেখতে পেলাম না বাইকের নাম্বারটা, আমি একটু দূরে ছিলাম তো, কাছাকাছি এসে দেখতে দেখতেই যেন হাওয়াতে মিলিয়ে যায় বাইকটা… শুধু ওই রেড ফ্ল্যাগের মত একটা সাইন আঁকা ছিল পেছনে, ওটাই দেখতে পেয়েছি!!..”
প্রায় চার ঘন্টা পর ICU এর কাঁচের দরজার ওপর লাল আলোটা বন্ধ হয়ে যায় হন্তদন্ত বেরিয়ে আসা নার্স কে দেখে এগিয়ে যায় প্রিয়ার বাবা
“সিস্টার কেমন আছে পেশেন্ট! একবারটি দেখতে পাওয়া যাবে!”
“না না এখন একদম না… সিভিয়ার বার্নড… এখন আগামী 48 ঘন্টা না কাটলে বিপদ কতটা তা বলা যাবে না, আপনারা ডাক্তারের সাথে কথা বলুন …”
কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রিয়ার মা “হ্যাঁ গো আমাদের মেয়েটা বাঁচবে তো ও আবার আগের মত হয়ে যাবে তো, কে ওর এত বড় ক্ষতি টা করলো বলো দিকি ”
“সব ঠিক হযে যাবে কাকিমা, আপনারা একটু শান্ত থাকুন, ভগবানকে ডাকুন, উনি নিশ্চয়ই ভাল করে দেবেন আপনাদের মেয়েকে!”
মুখে কথাগুলো বললেও দুশ্চিন্তায় গলা বুঁজে আসে ওর, অসহায়তায় কড় কড় করতে থাকে চোখ দুটো…সেটাকে আড়াল করতে দ্রুত পায়ে নেমে আসে ও গ্রাউন্ড ফ্লোরে, মস্ত বড় গণপতির মূর্তিটার সামনে খালি পায়ে, হাত জোর করে দাঁড়ায়..চোখ বুঁজে অস্ফুটেই বিড়বিড় করে– “হে ঈশ্বর, ভাল করে দাও প্রিয়াকে, ওকে ঠিক করে দাও…”
“তুমি দিদিকে চিনতে আগে থেকে? ”
চমকে ওঠে পলাশ, সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুদ্ধিদীপ্ত মুখের এক কিশোর, প্রিয়ার ভাই।
“না মানে চিনতাম না ঠিক আসলে…” কি বলবে বুঝে ওঠার আগেই সে বলে ওঠে
“আমি বাবান, তোমার নাম টা?”
“আমি পলাশ…”
“তুমিই তো রোজ দাঁড়িয়ে থাকতে বাসস্ট্যান্ডে দিদিকে দেখার জন্য তাই না, দিদি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, বলেছে আমায় তোমার কথা …”
“তাই ! আর কি বলেছে দিদি তোমায় আমার কথা…” খুব অবাক হয়ে জিজ্জেস করে পলাশ
“বলেছে তুমি রোজ দাঁড়িয়ে থাকো, কিন্তু আজ অবধি একটা কথাও বলো নি কখনো! এমনকি সামনেও আসোনি কখনো…আচ্ছা তুমি এতদিনেও কিছু কথা বলোনি কেন কখনো ?”
“পরে বলব সব বাবান, এখন চলো তো আমরা ওপরে যাই, বাবা মাকে বলে আসোনি তো, ওরা চিন্তা করছে হবে…”
48 ঘন্টা কেটে যায় এই ভাবে, এই ক ঘন্টায় পলাশ সমানে পাশে থাকে প্রিয়ার বাবা মার, ভরসা দেয় ওদের বাবানের সাথেও ওর বেশ ভাব হয়ে গেছে একটা দায়িত্ববোধ এসেছে আপনা থেকেই…কয়েক ঘন্টা আগের এই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষগুলো বড় নিজের লাগে এই সময়ে ওদের অবলম্বন হতে পেরে নিজের মনে লুকিয়ে থাকা দ্বিধা, সঙ্কোচটাও দূর হয়ে যায় তাই, সুচারুভাবেই সামলায় সব দিকটা ও, সামলায় পুলিশি জিজ্ঞাসার প্রাথমিক পর্ব
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে– মৃত্যর আশংকা নেই হয়ত কিন্তু প্রচন্ত সকে পেশেন্ট ট্রমায় রয়েছে রিফিউসাল সিনড্রোম…
কারোর সাথেই দেখা করতে, কথা বলতে চাইছে না, শুধু ভাইকে কিছু বলতে চায় ..
“ওকে বল চলে যেতে, আমার এই চেহারার পিছনে অযথা সময় নষ্ট না করে ..”
লিখে জানায় ভাইকে প্রিয়া, গলায় এখনো প্রচণ্ড ইনফেকশন, আওয়াজ বেরোয় না তাই গলা দিয়ে। অনেকক্ষণ ধরে দিদিকে বোঝায় বাবান, অবশেষে পলাশদার সাথে একবার দ্যাখা করতে রাজি করায় অনেক কষ্টে।
“প্রিয়া শোনো, এতদিন তো আড়ালেই ছিলাম , কখনো সামনেও আসিনি, কিছু বলি নি, কিন্তু আজ আমি কিছু বলব, আর তুমি শুনবে চুপ করে একদম লক্ষী মেয়ের মত …তোমাকে খুব ভালবাসি, তোমার এই চেহারাটাই শুধু তো তুমি নও, তাই চেহারার আড়ালে থাকা তোমার মনটাকেও ভালবাসতে চাই এতটাই …জানি আমি খুব সাধারণ, তেমন বিশেষ কিছু নয়, হয়ত হতেও পারব না কখনো, কিন্তু ভালবাসব তোমায় পাগলের মত, আগে যতটা বাসতাম, আজ তার চেয়েও বেশি ভালবাসি, কাল আরো বেশি ভালোবাসব! চেহারার ক্ষত সেরে যাবে একদিন, গ্রাফটিং করে ঠিক হয়ে যাবে পুড়ে যাওয়া কোঁচকানো কালো চামড়া, সব ঠিক হয়ে যাবে ধীরে ধীরে…কিন্তু তোমার মনে যারা এরকম ক্ষত করেছে তাদের ছেড়ে দেব না কিছুতেই, কথা দিচ্ছি…তাই এখন আমায় সহ্য করে নাও প্লিজ, তারপর সব ঠিক করে আবার না হয় আড়াল হয়ে যাবো, যদি তুমি চাও…ততদিন তোমায় প্রানভরে ভালোবাসতে দাও আমায়!”
চলতে থাকে চিকিৎসা, চলতে থাকে পুলিশি তল্লাশি অপরাধীদের খুঁজে বার…কেটে যায় কয়েক মাস এই ভাবে… এর মধ্যে পুলিশের অসম্ভব দক্ষতায়, পলাশের দেওয়া বর্ণনা আর রাস্তার সিসিটিভির ফুটেজ থেকে সনাক্ত করা হয় বাইক, সন্ধান মেলে মালিকের, গা ঢাকা দিয়ে বাঁচতে পারে না ভাড়াটে অপরাধীরাও, থার্ড ডিগ্রির জেরে স্বীকার করে এই কান্ডের আসল অপরাধীর নাম কলেজের গুন্ডা গ্যাং এর লিডার, এলাকার এমএলএ র ছেলে সিড ওরফে সিদ্ধেশ…নানাভাবে উত্তক্ত করেও প্রিয়াকে নিজের বাগে আনতে না পেরে অবশেষে এই কান্ড… ধরা পড়েও ক্ষমতার জোর দেখাতে চেষ্টা করলে পলাশ মিডিয়ার সাহায্য নেয়, ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে সমস্ত টা খুলে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন পরে যায় ব্যাপারটা, শেষবেশ গ্রেফতার হয় সিড।
প্রিয়া এখন অনেকটাই সহজ ..হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে ওকে, শুধু মাঝে মাঝে সার্জারির জন্য নিয়ে যেতে হয় ওকে, ডাক্তারদের দক্ষতায় চেহারার ক্ষত গুলো সারার মুখে, আজকাল আয়না দেখতেও ভয় লাগে না ওর …নিজেকে দেখে আর চেঁচিয়ে ওঠে না বরং সহজ ভাবেই আড্ডা গল্প করে ভাই আর পলাশের সাথে মা বাবাকে জানায় পরীক্ষাতে বসতে চায় .. আলোচনা করে ভবিষ্যতের, মেয়ের এই আত্মপ্রত্যয় দেখে ওর বাবামাও বেশ নিশ্চিন্ত হয়…
“ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে মেয়েটা, বলো !”
“হ্যাঁ, তবে ক্রেডিট কিন্তু পুরোপুরি ওই পলাশের, ও না থাকলে….”
সন্তানের বিপদে বিপর্যস্ত মাবাবা শান্তি পায়, আশ্বস্ত হয় পলাশের মত কেউ ওদের মেয়ের পাশে ছায়া হয়ে আছে এই ভেবে।
হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ে ওর চেহারার সাথে মনটাও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছিল, নড়বড়ে হয়ে গেছিলো আত্মবিশ্বাসের ভিত। পলাশের সঙ্গ, সাহচর্য, সহমর্মিতা, আর নিঃশর্ত ভালোবাসা ওকে ফিরিয়ে দেয় এই মনের জোর। পলাশ ই ওকে বোঝায়, জীবনটা অনেক সুন্দর, একটা ঘটনা/দুর্ঘটনা তাকে শেষ করতে পারে না কিছুতেই..ওকে ঠিক হতে হবে আগের মত, এটা ওর আত্মবিশ্বাসের লড়াই, আর এই লড়াই এ ওর ঢাল হয়ে থাকবে পলাশ। আড়ালে অপেক্ষা করা সেই মুগ্ধ প্রেমিক কে জীবনের সবথেকে কষ্টকর দিনগুলোতে সবসময় পাশে পেয়ে খুব দ্রুতই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে প্রিয়া।
“তাহলে ম্যাডাম, আমার জন্য এবার কি আদেশ, পাশে থাকার অনুমতি মঞ্জুর হল নাকি আবার আড়ালেই ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করব আরো দু দশটা বছর!
“এক মিনিটও চোখের আড়াল করতে পারবে না আমায় কিন্তু, আর ভালবাসতে হবে রোজ আগের দিনের থেকে বেশি, কি পারবে তো!”
আজ শেষ বারের মত যেতে হবে ওকে গ্রাফটিং করতে…
“প্রিয়া হয়েছে তোর, আমরা কিন্তু রেডি সবাই!”
আয়নায় নিজের কপালে লাল টিপটা লাগিয়ে নিজেকে একবার দ্যাখে প্রিয়া, একটা ভালোলাগায় ভরে যায় মন… তাড়াতাড়ি ওদের কাছে গিয়ে বলে
“এই তো আমিও রেডি!