ঘরের দেউড়িতে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশে সূর্যকে আড়াল করে থাকা পাঁজা পাঁজা তুলোর স্তূপসদৃশ অপসৃয়মাণ মেঘমালার দিকে তাকিয়ে দুলজান বিবি ভাবতে থাকেন, আজই কি তাঁর যাওয়া উচিত মোকসেদপুর। নাকি আরো দু-চার দিন অপেক্ষা করবেন তিনি। চৈত্রের শেষ দিকেই সাধারণত শিমুল তুলা সংগ্রহের আদর্শ মৌসুম। দু-এক দিন এদিক-সেদিক হলেই শিমুলগাছের তুলাগুলো ফেটে ফেটে ছড়িয়ে পড়বে বাতাসে। এমন পরিস্থিতিতে তুলা সংগ্রহ অতিশয় দুষ্কর। এবার কম করে হলেও দুটি বালিশ তাঁকে তৈরি করতেই হবে। একটি বালিশ দিতে হবে তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ জুলেখাকে আর অন্যটি পাবে তাঁর দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী হাতেমের বউ।
তারাকান্দা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে দুলজান বিবির ছোট্ট আবাস। এরপর ধু ধু অঞ্চলজুড়ে শুধু ফসলি জমির ক্ষেত। তারাকান্দা থেকে তাঁর বাবার বাড়ি মোকসেদপুর মাইল দুয়েকের পথ। কাউকে দিয়ে তুলার ফলগুলো পরিপক্ব হলো কি না সে খবর যে নেবেন, সেটাও অসম্ভব। তাঁর একমাত্র ছেলে হজরত আলী মায়ের এই খামখেয়ালি বিষয়গুলো একেবারেই প্রশ্রয় দেন না। ফলে তাঁকে দিয়ে খবর আনিয়ে নেওয়ার কথা চিন্তা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। হজরত পেশায় একজন প্রান্তিক চাষি। সকালে উঠে তিনি চলে যান মাঠে, ফেরেন সূর্যাস্তের আগে। আজকালকার বাজারে সংসার চালানো সোজা কথা নয়। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তবেই একটি পরিবার চালাতে হয়। তাঁর মাথায়ই ধরে না তাঁর মায়ের কেন এই উটকো খেয়াল। মায়ের অদ্ভুত এই আচরণটি অবশ্য বেশি দিনের পুরনো নয়। বছর চার-পাঁচেক ধরে কিভাবে যেন এই দুর্মতিটি গজিয়েছে তাঁর মগজে। হজরত আলীর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এটাই বলে যে তাঁর মায়ের সঙ্গে কারো একটু ঝগড়া-ফ্যাসাদ হলেই তাকে ধরে একটি বালিশ গছিয়ে দেন। আর সে জন্য তারাকান্দা গ্রামের অনেকেরই ধারণা, কোনো জাদুটোনা কিংবা ঝাড়-ফুঁক দেওয়া বালিশ এগুলো। সূর্য ডোবার আগে আগে মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে আসেন হজরত। ঘরের দাওয়ায় মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, খাওয়াদাওয়া কি কিছু আছে ঘরে মা। খুব খিদে পায়ছে। জুলেখা কনে?
—জুলেখা আর যাবি কনে। সারা দিন হাতেমের বউয়ের সঙ্গে গপ্পো, তা ছাড়া আর কী! এত গপ্পো যে কনতেন আসে বুঝবের পারিনে। বাবা তুই কলপাড়তিন লায়া (গোসল) আয়, আমি জুলেখাক ডাক দিচ্ছি। তোক পানি তুইলে দিবিনি। আমি তোর খাওয়ার ব্যবস্থা করতিছি।
ঘরের মেঝেতে চটের ফরাশ পেতে খাবার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দুলজান বিবি। স্নান সেরে ঘরে প্রবেশ করে ফরাশের ওপর সাজিয়ে রাখা অন্ন ও ব্যঞ্জনগুলোর দিকে দৃক্পাত করেই চেঁচিয়ে ওঠেন হজরত—একি মা, শুধু ভাত আর মিষ্টি কুমড়োর ভর্তা। মাছটাছ রাঁধো নাই কিছু। শুধু কুমড়োভর্তা দিয়ে কি আর ভাত খাওয়া যায়?
দুলজান বিবি ঈষৎ ম্লান কণ্ঠে বললেন, ভাত কনে দেখলি তুই। ওডা ভাত লয়, খিচুড়ি। আর খিচুড়ি তো শুধু পিঁয়েজ দিয়েই খাওয়া যায়। আইজ তো প্রভাতে বাজার করা হয়নি বাপজান। সকাল সকাল ঘুমতিন উঠেই সোজা তুই চইলে গেলি মাঠে। তো বাজার-সদাই করবি ডা কে বল তো দেখি। আজকের মতো খায়ে নে বাপ। কাল মাছ রাঁইধে দিবিনি জুলেখা।
হজরত মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, জুলেখা ক্যান। তুমি কনে যাবা। মাছ রাঁধলি তুমি রাঁধবা। জুলেখার মাছ রাঁধা আমি খাইবের পারিনে।
আমি ছাড়া মাছ রাঁধার মানুষ নাই। মা যাবি কাল মোকসেদপুর। কথাগুলো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন জুলেখা।
—মোকসেদপুর? বিস্ময়াবিভূত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকান হজরত।
—আমি কাল ইট্টু যাব তোর নানাবাড়ি।
—এই সময় আবার তোমার মোকসেদপুর যাওয়া লাগবি ক্যান।
—কাম আছে। অনেক দিন যাওয়া হচ্ছে না। ফুলজান বুবুক খুব দেখপের ইচ্ছে করতিছে। তোর নানারও তো বয়স হয়ছে। যেকোনো দিন মইরে যাবি বেচারা।
—তুমি নানাকও দেখপের যাচ্ছ না। ফুলজান খালাকও দেখপের যাচ্ছ না। তুমি বাপের বাড়ি যাচ্ছ তুলা আইনবির। আমি কিছু জানি না মনে করিছ। মা, তোমাক একটা কথা কই, কিছু মনে কইরো না। তুমি ক্যান যে নিজের খায়া বনের মইষ তাড়াবির যাও বুঝিনে। তুমি কী মনে করো, এই যে প্রতিবছর তোমার বাপের বাড়িত্তিন তুলা আইনে বালিশ বানায়া বানায়া মানষিক দেও। তোমার কি মনে হয় মানুষ সেই বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমায়! তুমি বোকার স্বর্গে বাস করতিছ। আমি রক্ত পানি কইরে ধান জম্মাই, আর সেই ধান তুমি চুরি কইরে গোপনে বিক্রি করো। ফেরিআলার কাছতিন ছিট কাপড় কিনে বালিশ বানায়া বানায়া গ্রামের মানষিক দেও। গাঁয়ের মানুষ বুঝি কিছুই বোঝে না মনে করিছ। তোমার দেওয়া মেম মদওয়া বালিশগুলোতে যে মোকসেদপুরের সাইদুল আলম বোগদাদি হুজুরের কালামি ফুঁ দেওয়া থাকে, সেডা গ্রামের সবাই জানে। ভালো কইরে খোঁজ নিয়ে দেখোগা। তোমার দেওয়া বালিশে কেউ মাথা লাগায় কি না। কথা বলতে বলতে বিষম খায় হযরত। কণ্ঠে খাবার আটকে খক্খক্ শব্দ করে বার কয়েক। একটু দূরে থাকা পানির গেলাসটির দিকে আঙুল নির্দেশ করে দুলজান বিবিকে উদ্দেশ করে বলে, তোমার সঙ্গে কথা বলতি বলতি মনে হয় ভাত আটকায়া গেল গলায়, পানির গিলাসডা একটু হাতে তুইলে দেও তো মা।
ঘরের চাতালের সঙ্গে ঝুলে থাকা ষাট পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতিটি ঘিরে উড়তে থাকা ঘূর্ণায়মান অসংখ্য মথ থেকে অন্ধকারপ্রিয় কিছু মথ নেমে আসে নিচের দিকে। দুলজান বিবির নাক-মুখ ঘিরে ধরে। বাঁ হাতের তালু দিয়ে দুলজান সাদা সাদা মথগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করে বার দুয়েক। পানিভর্তি গেলাসটি হযরতের হাতে তুলে দিতে দিতে দুলজান বিবি গভীর অনুধ্যানে ভাবতে থাকে—তার ছেলেটা কিভাবে যেন বদলে যাচ্ছে ক্রমে। দুই বছর আগে তখন অবশ্য জুলেখাকে ঘরে বউ করে আনেনি দুলজান বিবি। তখন হযরত তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে সাহস করত না। অথচ আজ চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা তো অতি সামান্য বিষয়। তার ওপর চোটপাট দেখাতেও সে এখন এতটুকু ইতস্তত বোধ করে না। তার মনে আজ এতটুকুও সন্দেহ নেই যে এর জন্য একমাত্র জুলেখাই দায়ী। এসব ভাবতে ভাবতে দুলজান বিবি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হযরতের পানি পানরত ঢক্ঢক্ শব্দ তোলা কণ্ঠনালির ছন্দবদ্ধ ওঠানামার দিকে।
তারাকান্দা থেকে মোকসেদপুরের দূরত্ব মাইল দুয়েকের মতো। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সেখানে যেতে ভাড়া লাগে দশ টাকা। তবে সমস্যা হলো, অটোরিকশায় যাওয়া যায় শুধু মোকসেদপুর বাজার পর্যন্ত। সেখান থেকে আবার বিশ-পঁচিশ মিনিটের হাঁটাপথ। দুলজান বিবির শরীরের যা অবস্থা, তাতে করে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই তার মাথা ঘোরে নাগরদোলার মতো। বুক ধড়ফড় করে। অটোরিকশা থেকে নেমে ছাইরঙা মেঘ মোড়ানো আকাশটার দিকে তাকিয়ে দুলজান বিবি ভাবতে থাকে, এখন যদি আচানক আবার বৃষ্টির উত্পাত শুরু হয়, তবে আজ হয়তো গাছ থেকে ফলগুলো আর সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে তাকে হয়তো অতিরিক্ত দু-এক দিন বেশি অবস্থান করতে হতে পারে পিতৃগৃহে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছার জন্য দ্রুতপদে হাঁটতে গিয়ে বাঁ পায়ের রূপসা স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে সেটা পদমুক্ত হয়ে ছিটকে পড়ে রাস্তার একপাশে। দুলজান বিবি তড়িঘড়ি করে ছেঁড়া স্যান্ডেলখানা কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করে পুনরায়। দুলজান বিবির পিতা নুরু মোল্লা এককালে পাটের ব্যবসা করে অঢেল অর্থের মালিক হয়েছিলেন। উপার্জিত সেই অর্থে জমি-জিরাতও করেছিলেন প্রচুর। কিন্তু সেই অর্থ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। কালক্রমে মাঠের অনেক কৃষিজমি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ আগে স্ত্রী আমেনা বিবি ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেছেন। উত্তরসূরি বলতে এখন মাত্র দুটি মেয়ে। ফুলজান আর দুলজান। ফুলজান অবশ্য দুলজানের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। ফুলজান বিবির স্বামী শেখ আব্দুল হাকিম পাঁচ-ছয় বছর ধরে নিরুদ্দেশ। অনেকের ধারণা, আবদুল হাকিম চাটগাঁওয়ে আর একটি দ্বার গ্রহণ করে সেখানেই দিন গুজরান করছে সুখে-শান্তিতে। কারণ বছর দেড়েক আগে তাকে নাকি দেখা গেছে চাটগাঁওয়ের কোনো এক রাস্তায়। গগনস্পর্শী অজস্র বৃক্ষ ও পাখপাখালির কোলাহলে মুখরিত দুলজান বিবির বিশাল পৈতৃক বাগানসমেত বাড়িটির প্রবেশমুখে তার সঙ্গে দেখা হয় বোনপো টুনুর। দুলজান বিবি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, বুবু বাড়িতে আছে নাকি রে টুনু।
টুনু নিরাসক্ত গলায় উত্তর দেয়, মা তো বাড়িতে নাই। কনে গেছে জানিনে।
—আব্বাজান আছে ঘরে?
—না, নেই। হাটে গেছে। টুনুর বয়স তেরো-চৌদ্দর মতো। সে পড়ে ক্লাস এইটে। টুনুর একটা বড় ভাই আছে, নাম বেল্লাল। বয়স প্রায় চল্লিশের কোঠায় পৌঁছলেও এখনো বিয়ে থা করেনি সে। চাঁদপুর নৌ-বন্দরে খালাসির কাজ করে বেল্লাল। বাগানবাড়ির সদর ফটক দিয়ে হন্হন্ করে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যায় টুনু। দুলজান বিবির ঠাওর করতে অসুবিধা হয় না—টুনু তাকে কেন এড়িয়ে চলে সব সময়। গাছে উঠে প্রতিনিয়ত তুলার ফলগুলো শিমুলগাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয় টুনুকেই। খালার অজাচিত ও উদ্ভট এই আবদারে টুনুর কোনো আগ্রহ নেই। শিমুলগাছের সরু শাখা-প্রশাখা বেয়ে ফলগুলো তুলে আনা নেহাত কম ক্লেশের কর্ম নয়।
এত বড় বাগান মানুষের পদচারণবিহীন খাঁ খাঁ করে। অথচ একসময় পরিবার-পরিজন, চাকর-বাকর, মা-ঝি নিয়ে সরগরম থাকত এই বাড়ি। দুলজান বিবি শান বাঁধানো পুকুরপাড়ে বসে এসব কথাই ভাবে। পুকুরের জলে স্থির তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। একটু দূরে সাপসদৃশ কি যেন একটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ঝোপঝাড়ের দিকে। দুলজান বিবি ভালো করে খেয়াল করে দেখে, আসলে ওটা সাপ নয়, সাপের খোলস মাত্র। একঝাঁক পিঁপড়ে ওটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুর্ভেদ্য কোনো স্থানে। পানির স্তরে স্তরে সবুজ শেওলা জমে পুকুরের সব পানি সবুজাভ রং ধারণ করেছে। অথচ একসময় এই পুকুরের পানি ছিল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। পুকুর থেকে আঁজলায় জল তুলে পান করা যেত নির্দ্বিধায়।
পুকুরের মাঝখানে ফুটে থাকত অজস্র বকের পালকের মতো সাদা শাপলা ও শালুক। এ ছাড়া নীল কমল, রক্তকমল হতো বিস্তর। নীল কমলগুলোর গোড়ায় সাধারণত শালুক জন্মে বেশি। দুলজান বিবির তখন ফ্রক পরার বয়স। এক ডুবে নীল শাপলার গোড়া থেকে আলুর মতো ঢাউস আকৃতির শালুক তুলে আনত সে অবলীলায়। তারপর দুই বোন মিলে কখনো সিদ্ধ করে কিংবা কখনো উনুনের তপ্ত কয়লায় পুড়িয়ে খেত সেই শালুক। অমৃতের মতো লাগত পোড়া শালুকগুলো। সে কথা মনে হলে আজও দুলজান বিবির খুব করে শালুক খেতে ইচ্ছা করে। বর্ষায় কিংবা ভাদ্র মাসে কাচের মতো স্বচ্ছ পানিতে ফুটে থাকা লাল-নীল-সাদা শাপলাগুলোর ওপর দিয়ে যখন আলতো নরম বাতাস বয়ে যেত, তখন স্বামীর সোহাগে আপ্লুত নবপরিণীতা বধূর মতো শাপলা ফুলের পাতাগুলোও কেঁপে কেঁপে উঠত। তাদের বাড়ির মজা এই পুকুরটার মতো বেশির ভাগ মানুষের জীবনও যেন আজকাল একেবারে মজে গেছে। শুকনো পাতার ভেতর খসখস শব্দ শুনে চকিত দুলজান বিবি আশপাশে তাকাতেই দেখতে পায় একটি গিরগিটি পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবুজ ঘাসের গালিচা থেকে ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে দানব আকৃতির একটি ছাতিমগাছ বেয়ে। সামনের অংশটুকু গাছের সঙ্গে লেপটে আছে বলে গিরগিটি ধূসর রং ধারণ করেছে। অথচ লেজসমেত পেছনের অংশটি তখনো সবুজ। ওপরের দিকে উঠে যেতেই ধীরে ধীরে একসময় গিরগিটির পুরো শরীর ধূসর রং ধারণ করল। মুহূতেই দুলজান বিবি যেন গিরগিটিটির মধ্যে তারাকান্দা গ্রামের অনেককেই দেখতে পেল। সন্ধ্যা নামার মুখে হাট থেকে ফিরে আসে নুরু মোল্লা। দুলজান বিবিকে দেখেই তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুই এবারও তুলা নিবির আইছিস দুলু, তাইনে? তোর হয়ছে কী বল তো? নিজের পকেটতিন টাকা খরচ কইরে মানুষের চরিত্র কি তুই বদলাবির পারবি?
দুলজান বিবির মুখে কোনো কথা ফুটে না। মাথা নিচু করে সে শুধু তার বাপজানের মুখের কথাগুলো শুনে যায়।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলজান পিতৃব্য নুরু মোল্লাকে উদ্দেশ করে বলে—দুলু না হয় প্রতিবছর দু-চার কেজি তুলাই নেয় আপনার কাছতিন। আপনি শুধু শুধু রাগ করতিছেন আব্বাজান।
আমি কি রাগ করি শুধু শুধু। তুলা নিয়ে দুলু যদি নিজের কাজে লাগাত তাও না হয় কথা ছিল। কিন্তু নিজের ক্ষেত পরের গরু দিয়ে খাওয়ানো—এটা আমি সহ্য কইরবের পারিনে। কাশিনাথপুরের দিয়াশলাই কম্পানির এক এজেন্ট মাসখানেক আগে শিমুলগাছটা দেখে গেছে। দাম কয়ছে পঞ্চাশ হাজার। ভাবতিছি গাছটা আমি বেচে ফেলব।
দুলজান বিবির ওপর নুরু মোল্লার উষ্মা কিংবা রাগ-অভিমান যা-ই হোক না কেন, সে ঠিকই টুনুকে দিয়ে গাছ থেকে তুলা সংগ্রহ করে নেয় দুটি বালিশ আন্দাজ। মোকসেদপুর বাজার থেকে ধুনট এনে তৈরি করে বালিশ। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দুলজান ভাবে—হাতেমের বউকে দিতে হবে একটি, অন্যটি পাবে স্বয়ং তার পুত্রবধূ জুলেখা। মস্ত্কাধান দুটিতে আরাম করে ঘুমাবে তারা। বিনিময়ে মনস্কামনা পূরণ হবে দুলজান বিবির। গত চার-পাঁচ বছর ধরে গ্রামের বহু মানুষকে বালিশ উপহার দিয়েছে দুলজান বিবি। আড়তদার বাচ্চু শেখ, আবসার মাতব্বর, চেয়ারম্যান ফজল মুন্সী, জোতদার সুবেদ প্রামাণিকসহ আরো অনেককে। ঝাড়-ফুঁক ও তুক-তাক দেওয়া বালিশে তাদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, সেটা শুধু একমাত্র দুলজান বিবিই জানে। এ নিয়ে অবশ্য গ্রামের অন্য কারো মাথাব্যথা নেই। ফাওয়ের ওপর তাদের মধ্যে কেউ কেউ একটি করে খাঁটি শিমুল তুলার নরম বালিশ পাচ্ছে—এটিই তাদের লাভ।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসই বলতে হয়। সে বছরেরই বৈশাখের শেষ দিকে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা উঠে আচানক ইহলোক ত্যাগ করে দুলজান বিবি। তারাকান্দা গ্রামের এজমালি গোরস্তানে তাকে সমাহিত করা হয় তার স্বামী নুশরত আলীর কবরের পাশে। দুলজান বিবির ইন্তেকালের মাসখানেক পর একদিন ফজরের ওয়াক্তে তার পুত্রবধূ জুলেখা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কবরস্থানের উদ্দেশে। শাশুড়ির কবরের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে জুলেখা। হাতের মুঠোয় থাকা জিনিসগুলো পুঁতে দেয় মাটির ভেতর। গরমের মৌসুম বলেই হয়তো অন্ধকার কেটে চারদিক ফর্সা হতে থাকে দ্রুত। পাখ-পাখালির অবিরত কলতান। কবরস্থান থেকে ঈষৎ পেছনে তারাকান্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবুর মৃধার বাড়ি। তিনি রোজ ফজরের ওয়াক্তে নামাজ পড়তে যান গোরস্তানের সামনের রাস্তাটি ধরে। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি রাস্তা থেকে জুলেখাকে দেখলেন। জুলেখাকে উদ্দেশ্য করে বললেন—কী জুলেখা, শাশুড়ির কবর জিয়ারত করতে এসেছ। জুলেখা কোনো দিক না তাকিয়েই শুধু বলল—হুম। তাবিজগুলো কি তোমার শাশুড়ির কবরে পুঁতে দিয়েছ। জুলেখা এবার আর কোনো কথা বলল না। এটা কি কাকতালীয় ব্যাপার, নাকি তোমাদের সবার সলাপরামর্শের ফসল, সেটা আমার জানা নেই। তবে দেখো জুলেখা, এক মাস ধরেই দেখছি, দু-এক দিন পর পর কেউ না কেউ এসে তাবিজ-কবজগুলো সব প্রোথিত করে দিয়ে যাচ্ছে দুলজান বিবির কবরে। কী আর বলব তোমাকে, সত্যি কথা বলতে কি, দুলজানও ছিল আস্ত একটা পাগলী। তাবিজ-কবজ করে কি আর মানুষকে বদলানো যায় কখনো। যদি তা-ই হতো, তাহলে তো আমি এই গ্রামের চার হাজার মানুষের জন্য আট হাজার তাবিজ বানিয়ে পুরে দিতাম তাদের বালিশে। তবে আফসোস শুধু এতটুকুই—তবু তো গ্রামে এমন একজন ছিল, যে তার মতো করে কাউকে কাউকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। এখন তো গ্রামে দুলজানের মতো আর একটি মানুষও রইল না। এই বলে সবুর মৃধা মাথাটি ঈষৎ নেড়ে চুকচুক করতে লাগল। তারপর হালট ধরে ধীর পদক্ষেপে হাঁটতে হাঁটতে একসময় মিলিয়ে গেল দূরে।