দাম্ভিক শোষকদের মৃত্যুভয় নেই

ফরাসি ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক ভিক্টর হুগো। ইংরেজ মহাকবি শেকসপিয়রের সঙ্গে পৃথিবীর আর যে চারজন লেখকের তুলনা চলে ভিক্টর হুগো তাদের মধ্যে অন্যতম। বাকি দু’জনও ইউরোপের। জার্মান লেখক গ্যেটে ও রুশ লেখক লিও তলস্তয়। তৃতীয় জন হলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮৫ সালের ২২শে মে শ্রমিকের মলিন পোশাকে প্যারিসের ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছেন হুগো। একটি মেয়ে তাকে দেখে দৌঁড়ে কাছে এসে বলল- কি আশ্চর্য! তোমাকে তো দেখতে একদম ভিক্টর হুগোর মত লাগছে। আমি তো ভেবেছিলাম কোন কালে মরে গেছেন তিনি। মেয়েটির কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলেন হুগো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেন। সেদিন রাতেই মৃত্যু হলো ভিক্টর হুগোর।
কোরবানী ঈদের আগে-পরে প্রয়াণ হল দেশের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তির। এই পৃথিবী ছেড়ে তাঁরা পাড়ি জমালেন অনন্তধামে। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ও কলামিষ্ট সঞ্জীব চৌধুরী, কাজী সিরাজ লেখক সালেহ চৌধুরী। যেহেতু প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমার জানাপরিচয় ও সখ্যতা ছিল যেহেতু তাদের মৃত্যুতে আমি কষ্ট পেয়েছি। হয়েছি শোকাভিভূত। তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় না থাকলেও তার সৃষ্টি কর্মের সঙ্গে আমি পরিচিত এবং তার দেহবসানে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমাদের শিল্প ও সাহিত্য।
মৃত্যু আসলে কি। মৃত্যু কী শুধুই একজন মানুষের এই পৃথিবী থেকে অন্তর্ধান। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার মৃত্যুকে বলেছেন- সম্ভাবনা। কিন্তু মৃত্যু সম্ভাবনা হলেও হাইডেগারের ভাষায় তা হল এক বিকল্পহীন সম্ভাবনা। কারণ সম্ভাবনার একাধিক বিকল্প থাকতে পারে কিন্তু মৃত্যুর কোন বিকল্প নেই। তা অমোঘ ও অনিবার্য। মৃত্যুকে নিয়ে সংশয়ে ভুগেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুকে নিয়ে তিনি রসিকতাও করেছেন কখনো সখনো। মাঝে মধ্যে অজ্ঞাত মৃত্যুর কথা ভেবে ভয়ার্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি লিখেছেন- মৃত্যু অজ্ঞাত মোর/আজি তার তরে/ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ওরে।
পাশাপাশি তিনি শান্তনা খুঁজেছেন, স্বস্তি পেতে চেয়েছেন মৃত্যুর নতুন ব্যাখ্যা খুজেঁ। তখন তিনি মৃত্যুকে দেখতে চেয়েছেন একজন দার্শনিকের দৃষ্টি দিয়ে। তিনি লিখেছেন- স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে/মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।
সত্যি বলতে কি, সমাজে এমন মানুষ ক’জন আছেন যারা দিনে অন্তত একটি বারের জন্য হলেও মৃত্যুর কথা ভেবে শংকিত হন। আমার তো মনে হয় এমন মানুষের সংখ্যা হয়তো হাজারে দু-এক জনের বেশি পাওয়া যাবে না। অথচ চোখ দুটি বন্ধ করে একটু ভাবলেই কিন্তু আমাদের সকলের উপলব্ধি হওয়ার কথা এই যে এতো আয়োজন, এতো সাজসজ্জা, সুখ-ঐশ্বর্য্য, প্রেম-ভালোবাসা সবকিছু কিন্তু মৃত্যুর দিকেই ধাবমান। মানুষকে একদিন আত্মহুতি দিতেই হবে মৃত্যুর পদতলে।
কয়েকদিন আগে জনৈক এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান বললেন- ‘একদিন মারা যাবো আর এজন্য কখনো শ্বৈরশাসক হবো না।’ তার এমন মনোভাবের জন্যই বোধকরি তার নিজ দেশ ও সমস্ত মুসলিম বিশ্বে তিনি এতো জনপ্রিয়। অথচ কোন কোন দেশের অধীশ্বরদের দেখা যায় প্রার্থনা সভায়, রাজপ্রসাদে, বিধান সভায়, বিমান বন্দরে, কিংবা জনগণের উদ্দেশ্যে এমন ভাবে বক্তব্য দেন, ভাবে মনে হয় যেন কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না তারা। তাদের কৃতকর্ম নিয়ে রচিত হবে না কোন ইতিহাস। উনারা অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। এ প্রসঙ্গে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের একটি বিপরীত মুখী বক্তব্যের কথা মনে পড়ে গেল। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে তার সঙ্গী-সাথীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন- মৃত্যুর পর তার হাত দুটো যেন কফিনের বাইরে বের করে রাখা হয়। যাতে করে সমস্ত পৃথিবীর মানুষ দেখতে পায় অর্ধেক পৃথিবীর যিনি অধীশ্বর অথচ তিনি আজ কবরে যাচ্ছেন একেবারে শূন্য হাতে। অন্যদিকে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের বিশাল আবিস্কারক প্রতিভা ষ্টিভ জোবসের সেই করুণ আর্তীর কথা মনে পড়ে। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় তিনি বলেছিলেন- যদিও আজ আমি হাজার কোটি টাকার মালিক অথচ আমার সমস্ত সম্পদ মৃত্যু দেবতার কাছে অর্পন করেও আরো একটি রাত বেশী বাঁচার কোন উপায় নেই। অথচ কে বলবে এই ষ্টিভ জোবসই ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করে বলেছিলেন- “এই জগতে কেউ মরতে চায় না, এমনকি যারা ভাবে মরে গেলে স্বর্গে যাবে, আর স্বর্গ হচ্ছে দারুন একটা সুখের জায়গা, তারাও চায় না মরতে।”
এই যে আমি বলতে চেয়েছি দাম্ভিক শোষকদের মৃত্যু ভয় নেই। কথাটি কিন্তু আংশিক সত্য। দাম্ভিক শোষকদের মৃত্যু ভয় নেই সেটি বোধকরি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পেরেছেন মৃত্যু এখন তাদের দোড় গোড়ায় দাঁড়িয়ে তখন কিন্তু ঠিকই তারা ভয়ে কুকড়ে গেছেন। কয়েকজন শ্বৈরশাসকের জীবনী থেকে সেটা আমরা অনায়াসে জানতে পারি। জোসেফ স্তালিন মারা যান ১৯৫৩ সালের ৫ই মার্চ। সকাল আনুমানিক সাড়ে ছটার দিকে স্তালিন ভয়াবহ ভাবে হার্টএট্যাকে আক্রান্ত হন। তারপর তিনি বিছানা থেকে পড়ে যান মেঝেতে। শহর থেকে দূরে একাকি বাস করতেন বলে দশটা-এগারোটা নাগাদ তার নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে নিজ নির্গত মূত্র ও বিষ্ঠায় মাখামাখি অবস্থায়। তখনও পর্যন্ত তিনি জীবিত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। মৃত্যুশয্যায় তার পাশে ছিলেন তার কন্যা সেভেৎলানা। তিনি আমাদের জানিয়েছেন মৃত্যুর পূর্বে কেমন আচরণ করেছিলেন স্তালিন। চোখ খুলেই ডান হাতটি উপরের দিকে তুলে গো গো শব্দ করতে থাকেন তিনি। ভাবে মনে হচ্ছিল যেন আগত মৃত্যুর প্রতি হুংকার দিচ্ছিলেন স্তালিন। কেন তাকে আজ এভাবে ভুপাতিত করা হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মৃত্যু একেবারে সামনে চলে এসেছে বুঝতে পেয়ে ভয়ে সমস্ত মুখবয়ব ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলো তার। এরপর তিনি ঢলে পড়েছেন মৃত্যু কোলে। মুসোলিনী তো জনসাধারণের রোষানল থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হায়! জনগণের হাত থেকে বাঁচা কি এতো সহজ। ধরা পড়ে গেলেন সাধারণ মানুষের হাতে। গুলি করে হত্যার পূর্বে সাধারণ মানুষজন তাকে ও তার প্রেমিকাকে কি বীভৎস ভাবে যে পিটিয়েছিলো তার একটি আলোকচিত্র রাখা আছে মিলানের মর্গে, দেখলে গা শিউরে ওঠে।
ইতিহাসের একসময়ের মহাপরাক্রমশালী অমিতবীর্যবান রাজা মহারাজা শ্বৈরশাসক-শোষক কিংবা অতি সাধারণ প্রজা সবাইকেই কোন না কোন সময় নিজেকে আত্মবলী দিতে হয়েছে মৃত্যুর মুখে। একদিকে এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে দুঃসহ কষ্ট অন্যদিকে কোন না কোন ভাবে বেঁচে থাকতে মানুষের অদম্য ইচ্ছে এ কারণেই হয়তো অনেক মানুষ রেখে যেতে চান তার স্মৃতি ও কীর্তি। যাতে করে তারা যুগযুগ বেঁচে থাকেন মানুষের মনে ও স্মৃতিতে। ‘ক্রন্দসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘সৃষ্টিরহস্য’ কবিতায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন- হয়তো মানুষ মরে কিন্তু তাঁর বৃত্তি বেঁচে রয়। মৃত্যুর পরও কর্মের অমরত্মের বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন কবি। এ প্রসঙ্গে মধ্যযুগের কবিদের একটি অদ্ভুত অভ্যাসের কথা মনে পড়ছে। তাঁরা অনেকেই নিজের চেয়ে নিজের সৃষ্টিকে বেশি মুল্যবান মনে করতেন, ভাবতেন আমি কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাই, আমাকে লোকে ভুলে যায় সে ঠিক আছে কিন্তু আমার কবিতা বা গান বেঁচে থাক, তা অনেক বেশি লোকের কাছে পৌছাক, সেটার সমাদর হোক। তাই তারা কোন বিখ্যাততর কবির নামের ভনিতা তাদের কবিতা বা গানের সঙ্গে জুড়ে দিতেন, সেই খ্যাততর নামের নৌকায় সে কবিতা অমর হয়ে থাকত। এই ভাবে চন্ডীদাস কিংবা বিদ্যাপতির নামের সঙ্গে কত কবি যে তাঁদের কবিতাকে জুড়ে দিয়ে কবিতা বা গানকে সময়ের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছেন অথচ তাঁরা নিজেরা আজ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন। সাহিত্য বা কাব্য তখন মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হত বলে হয়তো এই আকাঙ্খা একটু বেশি উৎসাহ পেয়েছে।
একটু ভিন্ন ভাবেও কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে। আমাদের প্রাণহীন অসাড় দেহটি কবরে যাওয়ার পর ধীর ধীরে দেহটি অধিকার করে নেয় মজ্জেরেলা চিজ রঙের অজস্র সব কিড়ে। সেসব কিড়ে গুলোও একসময় মিশে যায় মাটিতে। সেই মাটি থেকে জন্ম নেয় বৃক্ষ। আমরা কিন্তু প্রকারন্তরে মিশে থাকি সেই সব বৃক্ষের পত্র-পল্লবে, শাখা-প্রশাখা, ফুল কিংবা ফলে। কিন্তু মানুষ ওভাবে বেঁচে থাকতে চায় না। মানুষ চায় দৃঢ় ও প্রগাঢ় ভাবে বেঁচে থাকতে। যা হবে প্রচ্ছন্ন ভাবে দৃশ্যমান। আমি মৃত্যু ভাবনা নিয়ে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে দু’একজন মনে করেন জীবন যখন এতোটুকুই তখন যে কোন মুল্যে জীবনকে উপভোগ করতে হবে। জীবনটাকে সম্পূর্ণ রূপে নিংড়ে আমোদ-আহ্লাদে ব্যাপৃত থাকতে হবে। তাদের দর্শন হলো, আমি যদি এই পৃথিবীতে বেঁচেই না থাকি তাহলে আমার এই বৃত্তি, শিল্প, সাহিত্য, সৃষ্টি দিয়ে কি করব আমি। তাদের এই দর্শন যে কতটা বৈপরীত্যে ভরা তার একটি উদাহরণ দেই। এসব মানুষ যদি সত্যি সত্যি তাদের দর্শন সঠিক বলে মনে করে তবে কেন তারা তাদের সন্তানদের সবসময় আগলে রাখে নানা বিপদ-আপদ ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। জগত সংসারে প্রতিটি মানুষ-ই তার নিজ নিজ আত্মজকে দেখভাল করে অতন্ত্র প্রহরির মতো। যাতে করে ছেলেমেয়েদের শরীরে এতটুকু আঁচও না লাগে। মুখে এসব বললেও আসলে তারা তাদের সন্তানদের মনে করে তাদের আরেকটি বর্ধিত অংশ। অর্থাৎ মরে গেলেও তারা বেঁচে থাকবে তাদের সন্তান সন্ততিদের মধ্যে। মানুষের অবচেতন মনের এই আকাঙ্খাই প্রমাণ করে মৃত্যুর পর সংকীর্ণমনা ও স্বার্থপর মানুষও বেঁচে থাকতে চায়। যদিও মুখে বলেন অন্য কিছু।
তবে মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে দু’রকমের আচরণ লক্ষ্য করা যায়। এক ধরনের মানুষ আছেন যারা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। আবার অন্য দিকে কিছু মনীষী আছেন যারা জীবনে অতি নিকট জনদের মৃত্যুশোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে এই পৃথিবীকে উপহার দিয়ে গেছেন কালজয়ী কিছু সৃষ্টি। রোমান্টিক যুগের অন্যতম কর্ণধার ইংরেজ কবি শেলি একবার নৌবিহারে বেড়িয়েছেন ইতালির লেরিচি উপসাগরে। লিভোরনো নামক একটি স্থান হতে ফেরার সময় আকাশ ভেঙ্গে ঝড় উঠলো। উত্তাল ঢেউয়ের ভেতর শেলির পালতোলা নৌকা দেখে অন্য একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বলে উঠলেন- “চলে আসুন আমাদের নৌকায়, নয় তো আপনার নৌকার পালগুলো নামিয়ে ফেলুন। পালগুলো নামিয়ে নিলে হয়তো অনায়াসে বেঁচে যেতেন শেলি। কিন্তু তিনি বললেন- না। পাল আমি নামাবো না। মৃত্যুকে আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি। আজ নয় আমি জিতবো না হয় মৃত্যু। তিনটি পালসমেত নৌকা ডুবে গেল, শেলি, বন্ধু এডওয়ার্ড উইলিয়াম আর এক কিশোর নাবিক কে নিয়ে। মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন বলেই হয়তো আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে ৬১ বছর বয়সে কিংবা ইংরেজ কবি সিলভিয়া প্লাত ও রুশ কবি মায়াকোভস্কি যৌবনের একেবারে মধ্য গগনে আত্মহত্যা করে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।
প্রচন্ড রকম ব্যাথা না পেলে বোধকরি কালজয়ী কিছু সৃষ্টি করা যায় না। ভিক্টর হুগো যেমন মেয়ের মৃত্যু শোকে ব্যাকুল হয়ে কবিতা লিখেছিলেন, যা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন আরেক সন্তান হারানো কবি রবীন্দ্রনাথ- বেঁচেছিলো হেসে হেসে/খেলা করে বেড়াত সে- হে প্রকৃতি, তারে নিয়ে কী হল তোমার? ১৫৯৬ সালে মারা যায় শেক্সপিয়রের একমাত্র পুত্র হ্যামনেট। হ্যামনেটের মৃত্যু যাতে তাঁকে পাগল করে না দেয় তাই হয়তো তিনি কাজে ডুবে যান। চার বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর কালজয়ী নাটক হ্যামলেট। অনেকের মতে এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তবে এই চার বছরে তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নাকটও রচনা করেছিলেন। এডগার অ্যালান পো, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ এঁরা সবাই নিকটজনদের মৃত্যুতে ব্যাথাতুর হয়ে রচনা করেছিলেন অসামান্য সব সাহিত্য কীর্তি। এতো গেল মানুষের কথা অনেক ক্ষেত্রে প্রভুর মৃত্যুতে পশুও শোকগ্রস্থ হয়ে পড়ে। স¤্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর তার মৃত দেহটি নিয়ে আসা হলো তাজমহলে। সঙ্গে ছিলো শাহজাহানের প্রিয় হাতিটিও। হাতিটি ছিলো বাইরে বাঁধা। এমন সময় মাহুত কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওরে আজ তোর বড়ই দুর্দিন। স¤্রাট আর নেই। কে তোর পিঠে চড়বে, তুই তো আর এরকম প্রভু পাবি না?” হাতি সব কথা বুঝতে পারল। সে শুঁড় দিয়ে ধুলো এনে নিজের দেহে ছড়িয়ে কান্নাকাটি করতে লাগল। তারপর হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ল, আর উঠল না। ইতালিয়ান পরিব্রাজক মানুচি লিখে গেছেন এই ইতিহাস।
সাংবাদিক সঞ্জিব চৌধুরী অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো ভালো কলাম লিখতেন। তিনি ছিলেন আমারদেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক। দু’একবার তিনি আমার চেম্বারেও এসেছেন। যখন তিনি জানতে পেরেছেন আমি ব্যারিস্টার মীর হেলালের পরম বন্ধু তখন আমার প্রতি তার ¯েœহের পাল্লাটিও একটু বেশি ঝুঁকে পড়েছে। কারণ হেলালের মামা আবু তাহের পুতু ছিলেন সঞ্জিব চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাঝে মধ্যে ফোন করে বলতেন- ব্যারিস্টার সাহেব কেমন আছেন আপনি? তার মৃত্যু সংবাদ শুনে মনে হলো আহারে এমন করে কেউ আর আমাকে ডাকবে না কোনদিন। আমি অতি তুচ্ছ মানুষ। আমার শোক প্রকাশও তাই অতি সাধারণ। কিন্তু বিখ্যাত ব্যক্তিদের শোক প্রকাশও হয় ব্যতিক্রম। ফরাসি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো এবং ফরাসি আধুনিক কবিতার স্থপতি অ্যাপোলোনিয়ের ছিলেন দু’জন পরম বন্ধু। পিকাসো কে পিকাসো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে অ্যাপোলোনিয়ের ছিলো অগ্রগণ্য ভূমিকা। তিনি যথেষ্ট লিখালিখির মাধ্যমে পিকাসোর কিউবিজম আর্ট গুলো সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষদের সচেতন করে তুলেছিলেন। তো হয়েছে কি অ্যাপোলোনিয়ের মৃত্যুসংবাদ পিকাসোর কানে যখন পৌঁছালো পিকাসো তখন ¯œানাগারে দাঁড়ি কামাচ্ছিলেন। আয়নায় নিজের বীভৎস বিষাদাক্রান্ত মুখ দেখলেন তিনি। সেই শোকে পরবর্তী কুড়ি বছর আত্মপ্রতিকৃতি আর আঁকেননি পিকাসো। আরেক ফরাসি লেখক রম্যাঁ রলাঁ যিনি ছিলেন অর্ধেক ফরাসি আর অর্ধেক বাঙালি। বাঙালি বললাম এ কারণে যে রম্যাঁ রলাঁ জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন আমাদের এই বঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও মহাত্মাগান্ধির সহচার্যে। নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৫ সালে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার দু’বছর পরে। সেই রম্যাঁ রলাঁ ভিক্টর হুগোর মৃত্যুর কথা শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ফেলে রেখে বেশ কয়েকদিন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছিলেন হুগোর বাড়ির চারপাশে। বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল গুলো তার কেটেছিলো হুগোর লেখা পড়তে পড়তে।
সত্যি বলতে কি মৃত্যু ভয় আমি নিজেও সর্বদা ভীত। তবে মৃত্যু ভয় যেমন তেমন অপমৃত্যুর ভয়ই আমার বেশী। দেশের এমন করুণ পরিস্থিতিতে আমার এই শংকা নিশ্চয়ই অমূলক নয়। বিমানে ভ্রমনের সময় নিজেকে সবচেয়ে বেশী অসহায় মনে হয় আমার। এর একটি কারণ হয়তো আমার উচ্চতা ভীতি আছে- এজন্য। মনে পড়ে হাসি পায় যে শেক্সপিয়র ও ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরী প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ভয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। কিংবা মীর জাফরের মেয়ে জামাই মীর কাশিম বাংলায় নবাব হয়ে মৃত্যু ভয়ে নিজের রান্না নিজেই করতেন। পাছে কেউ খাবারে বিষ প্রয়োগ করে তাকে আবার হত্যা না করে ফেলে। স্থায়িত্ব লাভের আশায় কেউ গড়ে পিরামিড, কেউ তাজমহল, কেউ আবার আইফেল টাওয়ার কিংবা মহাপ্রাচীর। মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকার লোভ মানুষের জন্মগত। সে হোক, অসুবিধা নেই। তবে যেসব মানুষ এতো সব সৌধ ও কীর্তি রেখে যেতে অক্ষম তারাও কিন্তু মানুষের মনে বেঁচে থাকতে পারে যুগযুগ। শুধুমাত্র ভাল কাজ করে ও ভাল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন মানুষকে সমাধিস্থ করার পর যদি তার আশেপাশের মানুষজন দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জন করে বলে- ‘আহারে মানুষটি কত ভাল মানুষ ছিল গো।’ সমস্ত জীবন বেঁচে থাকার এটাই হবে সে মানুষটির সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা।