হাতি দিয়ে সন্ত্রাস

হাতি দিয়ে সন্ত্রাস

সম্রাট জাহাঙ্গির তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ইথিওপিয়া থেকে জাহাজে চড়িয়ে সভাসদ মুকাবর খাঁ তাঁকে একটি হাতি উপহার দেন যদিও হাতির প্রতি যে জাহাঙ্গিরের যে বেশ অনুরাগ ছিলো সেটা বলা যায় না। কিন্তু তারপরও তার আত্মকথায় কম করে হলেও হাতি প্রসঙ্গ এসেছে নিদেনপক্ষে পঞ্চাশ বার। হাতির প্রতি বরং দুর্বার আকর্ষণ ছিলো তার পিতা সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গিরের মধ্যম ভ্রাতা শাহাজাদা দানিয়েলের। এসব কথা আমরা জানতে পারি আবুল ফজল ও তুজুক্-ই-জাহাঙ্গিরি অর্থাৎ সম্রাট জাহাঙ্গিরের আত্মজীবনী থেকে। আকবরের হাতিশালায় সর্বসাকুল্যে হাতি ছিলো প্রায় ৩৫ হাজারের মতো। সে সময় অর্থাৎ সেই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে শুধুমাত্র হাতির খাওয়া বাবদ প্রতিদিন ব্যয় হতো ৪ লক্ষ টাকা। বর্তমান হিসেবে হয়তো সেটা শতকোটি টাকারও ছাড়িয়ে যাবে। সম্রাট জাহাঙ্গির তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন- পিতার হস্তীশালা ছিলো অতুলনীয়। পৃথিবীর কোন সম্রাটই এতো হাতি সংগ্রহ করতে পারে নাই এবং পারবেও না। কিন্তু আমি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যুদ্ধ এবং আমোদ প্রমোদের জন্য কয়েকটি হাতি রেখে অবশিষ্ট সব হাতি বনে ছেড়ে দেই। সম্রাট আকবর যে শুধু হাতি পছন্দ করতেন তা নয়। তিনি যে কোন হাতিকে সম্মহিত করতেও সক্ষম ছিলেন। অনেক সময় এক হাতির পৃষ্ঠদেশ হতে অন্য এক ভয়ঙ্কর ও অতিশয় দুর্দান্ত হাতির উপর লাফিয়ে পড়তেন নির্দ্বিধায়।

এটি ছিলো এমন এক হাতি যেটা ইতিপূর্বে বহু মাহুতকে অবলিয়ায় মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছে। সুতরাং এর পৃষ্ঠদেশে এভাবে আরোহন করাতে অনেক সুদক্ষ হাতিচালকও আশ্চর্জান্বিত হয়ে যেত। অনেক সময় দেখা যেত সম্রাট আকবর বড় কোন বৃক্ষ হতে কোন একটি প্রকা- এবং দুর্দান্ত হাতির পিঠে লাফিয়ে পড়লেন। তিনি বৃহৎ সেই হাতির পৃষ্ঠে আরোহন করামাত্র হাতিটিও যেন কোন এক মন্ত্রবলে তাঁর বশীভূত হয়ে যেত। সম্রাট জাহাঙ্গিরের সহোদর শাহাজাদা দানিয়েলের অধিনে হাতি ছিলো ১৫’শ। দানিয়েলের মৃত্যুর পর হাতি গুলোকে দেখাশুনার ভার জাহাঙ্গিরের উপর-ই বর্তায়। তিনি তার আত্মজীবনীতে আরো লিখেছেন- “আমার ভ্রাতার সুন্দর হস্তীর মধ্যে একটি অশেষ গুণসম্পন্ন হস্তী ছিলো। আমি ইহার নাম “ইন্দ্রের হস্তী” রাখিয়াছিলাম। এত বৃহৎ হস্তী আমি পূর্বে কখনো দেখি নাই। ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ করিতে হইলে চৌদ্দ ধাপবিশিষ্ট একটি মইয়ের প্রয়োজন হইয়া থাকে। ইহার স্বভাব এত মৃদু ও শান্ত যে অতিশয় উত্তেজিত হইলেও ইহার সম্মুখে কোনো শিশু পতিত হইলে তৎক্ষনাৎ শুড়দ্বারা সরাইয়া সযত্নে তাহাকে নিরাপদ স্থানে রাখিয়া দেয়। ইহা এত দ্রুত বেগে চলিতে পারে যে, অতি দ্রুতগামী অশ্বকেও পশ্চাদ্পদ করিয়া দেয়। এই হস্তী এত সাহসী যে একশত মত্ত হস্তীর সহিত অনায়াসে যুদ্ধ করিতে পারে। ইহার অন্যান্য অনেক সদ্গুণও আছে।

প্রতিদিন প্রাতঃকালে এই হস্তী ১৪ সের জল পান করে এবং প্রতি প্রাতে ও সন্ধ্যায় ইহার জন্য ৫৬ সের চাল, ২৮ সের ভেড়া কিংবা গোরুর মাংস, ১৪ সের তৈল অথবা ঘি দ্বারা রন্ধন করা হয়। হাতি মূলত নিরামিষভোজী হলেও রাজড়াদের হাতি বলে কথা, ওরা তো এসবই খাবে তাই না? চানাক্য কিংবা কৌটিল্য তো আরো একধাপ এগিয়ে তার অর্থশাস্ত্রে হাতিদের মদ ও মাংস খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

সমুদ্র কিংবা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ যেভাবে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, হাতির সামনেও বোধকরি এর দর্শনার্থী এর বিশালতা ও সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়। এই প্রাণীটিকে দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন সলোমন দ্য গ্রেট। ইথোপিয়ার রানি ‘কুইন অফ সিবা’ যখন সলোমনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন তিনি এসেছিলেন হাতির পিঠে চড়ে। অন্যদিকে সলোমন রানি সিবাকে দেখা বাদ দিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন সিবার হাতি গুলোর দিকে। এর কারণ সম্ভবত রাজা সলোমন ইতোপূর্বে কোনদিন হাতি দেখেন নি। হাতি অবশ্য শেকসপিয়রও জীবনে দেখেছিলেন কিনা বলা যায় না, (না দেখার সম্ভাবনাই অবশ্য বেশি)। যিনি ইংল্যান্ডের বাইরে এক পা না ফেলেই লিখে ফেলেন- ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’, ‘টু জ্যান্টেলম্যান ফ্রম ভেরোনা’ ইত্যাদি নাটক। তার পক্ষে সবই সম্ভব। কারণ তার লিখিত নাটক ‘জুলিয়াস সীজারে’ আছে সীজারকে হত্যার ঠিক আগের রাতে ক্যাসিয়াস ব্রুটাসকে বোঝাচ্ছেন- ভালুককে ঘাবড়ানো যায় আরশি দেখিয়ে, আর হাতিকে ফাঁদে ফেলা যায় গর্তে ফেলে- ‘বের্য়াস্ উইথ গ্লাসেস, এলিফ্যান্টস্ উইথ হোলস্।’

শুধু কিং সলোমন কিংবা শেকসপিয়রই নয়, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তুস্কর, ইরান, কাজাকিস্তান প্রভৃতি দেশ হতে আর্যরা যখন ভারতবর্ষে আসে তখন তারাও হাতি চিনতেন না। কারণ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে তখন হাতি পাওয়া যেত না। সে জন্যই আর্যজাতির প্রধান কীর্তি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ঋগে¦দে ‘হস্তি’ শব্দটি মোটে পাঁচ বার এসেছে। আর্যজাতি হাতি না চিনলেও মৃগ অর্থাৎ হরিণ চিনতেন খুব ভাল করে। আর এ জন্যই তারা হাতিকে বলতেন ‘হস্তি মৃগ’ ঋগ্বেদেও সে কারণে হাতিকে হস্তি মৃগ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত পলিনেশিয়ান অঞ্চলে ফরাসি ঔপনিবেশিক দেশ তাহিতি দ্বীপের লোক শুধু শূকর চিনতো। ইউরোপীয়রা যখন সেখানে ঘোড়া, কুকুর, ভেড়া আরও নানারকম জন্তু জানোয়ার নিয়ে গেলেন তখন লোকজন ঘোড়াকে বলতো চিঁ-হিঁ-হিঁ শুয়োর, কুকুরকে বলতো ঘেউ ঘেউ শুয়োর, ভেড়াকে বলতো ভ্যা ভ্যা শুয়োর। আর্যগণ সেরূপ মৃগ চিনতেন, কেননা তারা শিকারে খুব পারদর্শী ছিলেন। তাদের খাবার দাবারের মুল উৎস্যই ছিল হরিণের মাংস। ভারতবর্ষে এসে যখন তারা হাতি দেখলেন তখন তারা তাকে হাতওয়ালা হরিণ বলে ডাকতে লাগলেন। এক অর্থে হস্তি মানে তো হাত-ই।

এবার হাতি প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে দু’চার কথা বলি। এই তো কয়েকদিন আগে গাড়ি নিয়ে নিকুঞ্চ থেকে প্রধান সড়কে ওঠার জন্য যানজটে পড়েছি। সঙ্গে পুরো পরিবার। হঠাৎ কোত্থেকে বিশাল আকৃতির এক হাতি এসে দাড়ালো একেবারে গাড়ির সামনে। জানালা খুলে ড্রাইভার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই হাতিটি ওর লম্বা শুড়টি ঢুকিয়ে দিলো জানালার ভেতর দিয়ে। আর যায় কোথায়! আমার তিন বছরের ছেলেটি ভয় ও আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিলো। আমার স্ত্রী তড়িঘড়ি করে তার ব্যাগ থেকে দশটি টাকা তুলে দিলো হাতির শুড়ে। না, হাতি দশ টাকা নিতে রাজি নয়। পিঠের ওপর থেকে হাতিটিকে কৌশলে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছিলো চতুর মাহুত। হাতির দাবি পঞ্চাশ টাকা। অবশেষে বিশটি টাকা হাতির শুড়ে গুজে দিয়ে কোন মতে সে সময়ের জন্য রক্ষা পাওয়া গেল। এর কিছুদিন আগের ঘটনা। আমার ভগ্নিপতি ও আমার দু’ভাগ্নে জাহিন ও জাবির কে নিয়ে রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে সবেমাত্র বের হয়েছে। আমার ভাগ্নে দু’টি পড়ে ঐ স্কুলে। রিক্সায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আচানক এক হাতি এসে সামনে হাজির। দাঁড়িয়ে গেছে শুড় উচিয়ে। আমার ভাগ্নে দু’টি তো ভয়ে অস্থির। পঞ্চাশ টাকা গচ্চা দিয়ে তবেই মুক্তি। মাস খানেক আগে আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ, সুপ্রিমকোর্টের কীর্তিমান আইনজীবী, ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান নিজে ড্রাইভ করে বেড়াতে বেড়িয়েছিলো ঢাকার পূর্বাচলের দিকে। সেখানেও হাতির চাঁদাবাজির দৌরাত্ব্য। আচমকা অতিকায় এক হাতি এসে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে গেল তাঁর গাড়ির সামনে। ব্যারিস্টার হাসানেরও রোখ চেপে গেল মাথায়। এসব কি! দিন দুপুরে চাঁদাবাজি! যাক অবশেষে অল্পের জন্য রক্ষা পায় তার ব্যক্তিগত গাড়িটি। ভাবতেই অবাক লাগে হাতির মতো এমন একটি সংবেদনশীল প্রাণীকে দিয়ে চাঁদাবাজি করানো হচ্ছে। হাতি নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রাণীকূলের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধিদীপ্ত একটি প্রাণী। সেই সঙ্গে মানুষের স্বভাব চরিত্রের সঙ্গেও হাতির স্বভাব চরিত্রের রয়েছে বিস্তর সাযুজ্য।

বর্তমানে যদিও হাতি পোষা হয় প্রধানত চাঁদাবাজি ও সার্কাস খেলা দেখানোর জন্য। কিন্তু প্রাচীনকালে হাতি পোষা হতো মূলত হাতিকে যুদ্ধে ব্যবহার ও রাজা জমিদারদের শিকারের প্রয়োজনে। ভারতে হাতির ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর লেখা ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন- “গ্রীক ঐতিহাসিকেরা বলিতেন যুদ্ধে গঙ্গা রাষ্ট্রের সৈন্যবলের মধ্যে প্রধান বলই ছিলো হস্তীবল”। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় এই হস্তীবল-ই মার খেয়েছিল দুটি ক্ষেত্রে। বিশেষ করে আলেকজান্ডার ও তৈমুর লং এর কাছে।

যুদ্ধে হাতি ব্যবহারের চিন্তাভাবনার শুরু ভারতেই। ভারতীয় রাজা পুরু ও সম্রাট আলেকজান্ডারের সেই ইতিহাসবিখ্যাত যুদ্ধ-ফলাফলে পুরুরাজ হেরেছিলেন কিন্তু অমিতবিক্রম সম্রাটও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ভারতের ছোট্ট এক রাজ্যের রাজার রণবাহিনীতে এত হাতি দেখে। যুদ্ধে হাতি তিনিও ব্যবহার করেছিলেন, তবে পুরুরাজের ১৩০টার তুলনায় তা নেহাতই কম। মাত্র ৩৮টা। তবু আলেকজান্ডারের বুদ্ধির কাছে তাঁকে হার মানতে হয়েছিল। এ ছাড়া হাতিকে ঘায়েল করবার কলাকৌশল আলেকজান্ডারের জানা ছিল ভালভাবেই। এর আগে প্রুশিয়ার যুদ্ধে তিনি গজবাহিনী স্বচক্ষ্যে চাক্ষুষ করেছিলেন।

চিনাসম্রাট কুবলাই খানকে চার হাতির পিঠের ওপর বসানো কাঠের তৈরি প্রাসাদে কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা পাওয়া যাচ্ছে মার্কোপোলের বিবরণে ।

১৩৯৮ সালে তৈমুর লং যখন ভারত আক্রমন করেন তখন দিল্লীর সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ তুঘলক প্রায় সহস্রাধিক হাতি নিয়ে তৈমুর লং কে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন তিনি। তার ধারনা ছিলো যুদ্ধক্ষেত্রে চলমান পাহাড়ের মতো এইসব প্রাণীদের তেড়ে আসতে দেখে লড়াইয়ের আগেই হয়তো হেরে বসে থাকবেন তৈমুর। কিন্তু তৈমুর লং ছিলেন একজন অতিশয় দক্ষ ও দুধর্ষ সমরপতি। প্রায় হাজার খানেক উটের পৃষ্ঠদেশে খড়ের স্তূপ চাপিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন তৈমুর। আগুনের গনগনে আঁচে সে সব উট উদ্বভ্রান্তের মতো আছড়ে পড়ল সেই হাতির পালের মধ্যে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে হাতি গুলোও ছুটতে লাগলো দিক্বিদিক। সুলতানের সৈন্যবাহিনীর বেশীরভাগই পদদলীত হলো নিজ হাতি বাহিনী দ্বারা। সে এক চরম মর্মান্তিক দৃশ্য।

ঘরে পোষা হাতির কথা পাওয়া যায় হিন্দুদের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদে। এরও বহুপূর্বে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা থেকে সিলমোহরে পাওয়া গেছে দড়িবাঁধা হাতির ছবি। হরপ্পার কিছু পোড়ামাটির খেলনায় মিলেছে হাতির মূর্তি। এশিয়ার শিল্পীদের হাতে বানানো নানান জিনিসের ভেতর পাওয়া গেছে হাতিও। এগুলো প্রাক-সিন্ধু সভ্যতার। সিন্ধু উপত্যকা থেকে পাওয়া, খ্রিস্টজন্মের তিন হাজার বছর আগে। আজ থেকে দু’-তিন হাজার বছর আগে এশিয়া জুড়ে শুধু হাতি আর হাতি। মুদ্রায় হাতি, ছবিতে হাতি, ভাস্কর্যে হাতি, ধর্মে হাতি। প্রাচীন লোকগাথায় হাতি। রাজার উপাধি ‘গজপতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ব্রিটিশ আমলে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকাও ছিলো প্রচ্ছন্নভাবে হাতিময়। হাতির ঝিল থেকে হাতিদের গোসল করিয়ে হাতিরপুল এলাকায় সে সময় একটি শক্তপোক্ত শাঁকো ছিল। সেই শাঁকো পার হয়ে এলিফ্যান্ট রোড (হাতির সড়ক) দিয়ে সমস্ত হাতি নিয়ে রাখা হতো পিলখানায়। (পিল অর্থও হাতি) সেসব হাতিদের দেখভাল করার জন্য মাহুতেরা সাধারণত পুরান ঢাকার যে অঞ্চলটিতে থাকতেন সেটার নাম মাহুতটুলি। প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানও জন্মেছিলেন এই মাহুতটুলিতেই। অন্যদিকে সিরাজদৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করতে আসেন তখন তিনি তার হাতি গুলোকে যেখানে রেখেছিলেন সে স্থানের নাম ‘হাতিবাগান’। হাতির আরেকটি নাম হচ্ছে পিল। শুধু পিল বলে কথা নয় অভিধান ঘেটে দেখা যায় হাতির রয়েছে প্রায় অর্ধশত সমার্থক শব্দ। তাদের মধ্যে পিল, পীলু, ঐরাবত, গজ, দ্বিপ, দ্বিরদ এগুলো তো আছেই। এছাড়াও হাতির একটি সমার্থক শব্দ দারুন ভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে- সেটি হচ্ছে ‘নাগ’। আমরা সাধারণত জানি সাপের সমার্থক শব্দ হচ্ছে নাগ। কিন্তু হাতির সমার্থক শব্দ নাগ হয় কি করে! নিজের জ্ঞান ফলানোর জন্য বলছি না। বহুদিন পূর্বে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুস্পুত্র কবি ও প্রাবন্ধিক ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত একটি বইয়ে এই বিষয়ে একখানা লেখা পড়েছিলাম।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ঈষৎ অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও পাঠকদের কিছুতেই উক্ত বিষয়টি জানাবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। সংস্কৃত ভাষায় ‘নাগ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পর্বত, হস্তী, সাপ ও জাতি বিশেষ। হাতি ও সাপ প্রভৃতি প্রাণীগুলো সাধারণত পাহাড়-পর্বত অঞ্চলে বিচরণ করে বলেই কালক্রমে এগুলোর নাম হয়ে যায় ‘নাগ’। মানুষের মধ্যেও যেসব জাতি মধ্য ভারতের অরণ্য কিংবা পর্বত প্রদেশে হাতি ও সাপের ন্যায় বসবাস করতে থাকে তারাও কালক্রমে নাগ নামে খ্যাত হতে থাকে। ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজধানী নাগপুর এবং ভারতের অন্য একটি প্রদেশের নাম নাগাল্যান্ড। এই নাগলোকে অর্থাৎ পাহাড়-পর্বতে প্রচুর পরিমাণ কমলালেবু জন্মাতো বলে অতি প্রাচীনকালে মুনি ঋষিরা কমলালেবুর নাম দিয়েছিল ‘নাগরঙ্গ’। নাগলোক কিংবা নাগপ্রদেশ রঞ্জিত করে থাকে বলেই ‘নাগরঙ্গ’ নাম হয়েছে। ইউরোপ ও এশিয়ার অধিকাংশ ভাষায় কমলালেবুর নাম সংস্কৃত ‘নাগরঙ্গ’ হতেই গৃহীত হয়েছে। যেমন স্প্যানিস ভাষায় কমলালেবুকে বলে ‘নারাঞ্জা’ (Naranza)। ইটালীয় ভাষায়ও কমলালেবুর নাম ‘নারাঞ্জা’ এবং গ্রীক ভাষায় ‘নেরাঞ্জী’ (Nyranzi) বলে। এই শব্দগুলো কিন্তু ‘নাগরঙ্গ’ শব্দেরই অপভ্রংশ ছাড়া আর কিছু নয়। পারস্য ভাষার ‘নাগরঙ্গ’কে ‘নারাঞ্জ’ এবং আরবি ভাষায় ‘নেরাঞ্জ’ বলে। এতক্ষণে পাঠক হয়তো বুঝে গেছেন যে সংস্কৃত এই ‘নাগরঙ্গ’ শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কিঞ্চিৎ রূপান্তরিত হয়ে কিভাবে ‘নারাঞ্জ’ ইত্যাদি রূপ লাভ করেছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে ইংরেজি ভাষা থেকে আমরা অনেক শব্দ ধার করলেও কমলালেবুর ইংরেজি শব্দ অরেঞ্জ এই ‘নাগরঙ্গ’ শব্দ থেকেই উদ্ভুদ। তাহলে এখন কথা থেকে যায় যে, বাংলা শব্দ কমলালেবুর নামের উৎপত্তি কিভাবে হলো। দু’তিন শত বছর পূর্ব থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ও আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে কমলালেবু সাধারণত আমদানি হতো কুমিল্লা থেকে। প্রাচীনকাল থেকেই সিলেটে ও আসামের কমলালেবুর বড় বড় সব আড়ৎগুলো ছিলো কুমিল্লায়। আর সেই কুমিল্লা থেকে প্রাপ্ত ফলের নাম হয়ে যায় কমলা। অন্যদিকে এটি যেহেতু লেবু জাতীয় ফল সেজন্য কমলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেবু শব্দটি। যা হোক ধান ভানতে শিবের গীত আর নয়, এবার হাতি প্রসঙ্গে ফিরে আসি।

বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই বাংলাদেশের হাতি দিয়ে এভাবে চলছে চাঁদাবাজি। হাতি দিয়ে চাঁদাবাজি শিরোনামে শুধুমাত্র এ বছরই প্রায় ডজন খানেকের মতো খবর ছেপেছে পত্র-পত্রিকাগুলো। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত লিখেছে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। ৩ মার্চ ২০১৮ খবর ছেপেছে ‘প্রথম আলো’। এছাড়াও ‘যুগান্তর’, ‘দৈনিক সমকাল’, ‘পরিবর্তন’ সহ আরো অনেকে। এরপরও নেই কারো ভ্রুক্ষেপ। প্রশাসন ভাবলেশহীন ও নির্লিপ্ত। শুধু যে হাতি দিয়েই চাঁদাবাজি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আরও নানা ধরনের ও বৈচিত্রময় উৎপাত লক্ষ করা যায় শহরের অলিতে, গলিতে, সড়ক ও প্রান্তরে। বেশ কয়েক বছর আগে বোধহয় পত্রিকাতেই পড়েছিলাম এক শ্রেণীর চাঁদাবাজদের কথা তারা নাকি মানুষের বিষ্ঠা হাতে নিয়ে ঘুরতো। নিরিহ পথচারি কিংবা যাত্রীরা টাকা না দিলে সেই পুরীষ ছিটিয়ে দেয়ার হুমকি দিতো সেই চাঁদাবাজরা। দু’তিন বছর আগে গুলশান এক নম্বর ট্রাফিক সিগন্যালের আগে একদল বেদেনীদের দেখতাম ছোট ছোট কাঠের বাক্স নিয়ে ঘুরছে তারা। রিক্সা কিংবা গাড়িতে উপবিষ্ট যাত্রীদের প্রচ্ছন্ন ভাবে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করতো। একদিন আমি সিগন্যালের সামনে যানজটে বসে আছি রিক্সায়। ঠিক সেসময় এক বেদেনী কাছে এসে কাঠের ছোট্ট একটি বাক্স আমার মুখের সামনে ঘুরাতে ঘুরাতে টাকা চাইলো। আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো কাঠের ঐ বাক্সের মধ্যে আদৌ কোন বস্তু আছে কি না! থাকলেও আমার ধারনা ওগুলো নির্বিষ ধরনের কোন সাপ-টাপ হবে হয়তো। আমি আমার বা-হাতটি ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- তোমার ঐ সাপ দিয়ে বরং হাতে একটা ছোবল খাইয়ে যাও কিন্তু কোন টাকা-পয়সা দিতে পারবো না। আমি বললাম- তোমাকে দেখে তো যথেষ্ট কর্মঠ মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কাজ করে খাও না কেন! এমন একটি পরিস্থিতির জন্য বেদেনীটি মনে হয় মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। আমার কথা শুনে সে হনহন করে চলে গেল নতুন কোন শিকারের খোঁজে। এছাড়াও আছে হিজড়া ও স্বেচ্ছায় পতিত ভিক্ষুকের দল। তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলোর অত্যাচারে সাধারণ জনগণ একেবারে অতিষ্ট। সরকারের কি কোন দায়বদ্ধতা নেই অবহেলিত এই জনগোষ্ঠির প্রতি।

প্রতিদিন শতশত ভিক্ষুক কোন সুড়ঙ্গ থেকে যে পিলপিল করে পিপীলিকার মতো বেরিয়ে আসে সে এক বিস্ময়। তারা কে, কোন জাতি, কোন সমাজের লোক কিংবা কেমন তাদের জীবনযাত্রা কখনোই আমরা সেটা খতিয়ে দেখি না কিংবা দেখতে চাইনা। অন্ধ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গ, বিবিধ ব্যধিগ্রস্ত, কদাকার মেয়েপুরুষের এবং বালকবালিকার দল-সকল বয়সের। কারো পড়নে স্বল্প বসন, কারো শরীরে জীর্ণ কাপড়ের টুকরো, কোমরে জড়িয়ে রয়েছে ছেঁড়া ময়লা জামা, কারো চোখ নেশায় লাল, কারো মাথায় বন্যচুলের রাশ, কেউবা সর্বহারা। কারো কোলে কাঁকালে ঘুমের বড়িতে আচ্ছন্ন উলঙ্গ শিশু। যে সকল মানুষ সেচ্ছায় বেছে নেয়নি ভিক্ষাবৃত্তি, হয়তো তাদের সত্যি সত্যি কোন উপায়ন্ত নেই ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া জীবন ধারনের। দেশের সাধারণ জনগণের দাবি মন্ত্রিদের জন্য দামি দামি গাড়ি বাড়ি না কিনে আগে পুনর্বাসন করতে হবে রাষ্ট্রের অবহেলিত এই মানুষদের।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত