নির্ভীকবাবুকে মরাগাছতলায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল শেষ বাস। ব্যাকলাইটের লাল চোখ জোড়া দুরে মিলিয়ে যেতেই গা ছমছম করে উঠল নির্ভীকবাবুর। চারদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, বাড়িঘর দোকানপাট কিছুই তাে চোখে পড়ে না। জেদের বশে এরকম একটা অচেনা অজানা জায়গায় রাতের বেলা চলে আসাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হল ?
ভূতটুতকে তিনি পরােয়া করেন না, ভূতে তার মােটেই বিশ্বাস নেই, কিন্তু চোর-ছ্যাচোরদের তাে মানেন। এখন তাদের কারুর পাল্লায় পড়ে এই বিভুইয়ে নির্ভীকবাবুকে না নাকাল হতে হয়।
পরশুদিনই অফিসে জায়গাটার লুক পেয়েছেন নির্ভীক সিংহ! বর্ধমানের জগদীশবাবু বলছিলেন, বর্ধমান থেকে গুসকরা যাওয়ার পথে এমন একটা ডাকবাংলাে আছে, যেখানে রাত্রিবাস করলে ভূতের সঙ্গে মােলাকাত নাকি হবেই হবে। এই মরাগাছতলা থেকে বাংলােটির দূরত্ব নাকি মাত্র মাইল দুয়েক। পাশেই একটা নদীও আছে। বাঁকানদী। একসময়ে সরকারি সাহেবসুরাে বাংলােটিতে গিয়ে উঠতেন হরদম, ইদানীং ভূতের ভয়ে তারা কেউই নাকি আর ও পথ মাড়ান না।
শুনেই জগদীশের সঙ্গে নির্ভীকের জোর তর্ক, নয় নয় করে আজ পর্যন্ত নিরানব্বইখানা ভূতের বাড়িতে নির্ভীকবাবুর রাত কাটানাে হয়ে গেছে, কোথাও তেনাদের দর্শন মেলেনি, জগদীশবাবুর গুলগাপ্পি তিনি মানবেন কেন? তর্কাতর্কি থেকে বাজি ধরাধরি। ওই বাংলােতে এক রাত্তির থাকতে পারলে কড়কড়ে হাজার টাকা। এমন একটা চ্যালেঞ্জ নির্ভীকবাবু ছাড়েনই বা কী করে? তা চোর ডাকাতের খপ্পরে না পড়লে নির্ভীকবাবু এ যাত্রা বাজি জিতবেনই জিতবেন।
কবজি উলটে নির্ভীকবাবু ঘড়ি দেখলেন। সবজেটে আলাে ঝকমক করছে ডায়ালে। নটা পঞ্চাশ! কাঁধ থেকে কিটসব্যাগ খানা নামিয়ে টর্চ বার করলেন। অন্ধকারে চোখ মােটামুটি সয়ে এসেছে, তবু টর্চ জেলে হাত ঘােরালেন এদিক-ওদিক। নাহ, একেবারে পাণ্ডববর্জিত স্থান নয়, দোকান আছে দু-চারটে। তবে সব কটারই ঝাপ বন্ধ। একটা লােক দাঁড়িয়ে আছে না ওপারে?
নির্ভীকবাবু গলা ওঠালেন,—এই যে শুনছেন?
লােকটা একটু এগিয়ে এল,আমায় বলছেন?
—আর তাে কাউকে দেখছি না।…এখানকার সরকারি ডাকবাংলােটায় কোন দিক দিয়ে যাব বলতে পারেন?
—-আবছায়ার বাংলাে?
—মানে ?
লােকটা আর একটু সামনে এল,বাংলােটা যেখানে আছে, সেই জায়গাটার নামই
তাে আবছায়া।
বাহ, বেড়ে নাম তাে। স্থানীয় লােকদের দিব্যি রসবােধ আছে। ভূতেরা আবছায়াতেই ডেরা বাঁধে বটে। আবছায়াতেই চোখ ভুলভাল দেখে কিনা। এই যে লােকটা, শুনশান অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে, একে দেখেই কত লােক ভূত ভেবে ভিরমি খেতে পারে।
লোকটা আরও কাছে এসেছে। বলল,—তা আবছায়ার বাংলায় যেতে চান কেন?
নির্ভীকবাবু গলা ঝাড়লেন,—শুনলুম ওখানে নাকি ভূত-টুত আছে। চর্মচক্ষে তাদের দেখবো বলেই অধমের আজ এই আগমন ..কথাটা সত্যি নাকিমশাই?
-না, না, স্রেফ রটনা। মানুষ ওরকম গুজব ছড়িয়ে মজা পায়।
—-আমারও সেরকমই অনুমান। নির্ভীকবাবু টর্চ জ্বেলে লােকটিকে ভালাে করে নিরীক্ষণ করলেন। তবে সরাসরি মুখে আলো ফেললেন না, পাছে লােকটা কিছু মনে করে। আন্দাজে মানে হল সাদা ধুতিশার্ট পরা লােকটার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখদুটো যেন গর্তে ঢােকা। বাতি নিবিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,—তা যাব কোনদিক দিয়ে? বাঁদিক? ডানদিক?
“আজ্ঞে, ডাইনে। সরু পিচরাস্তা ধরে চলে যান, নাক বরাবর গেলেই পৌছে যাবেন।
ধন্যবাদ দিয়ে এগােতে যাচ্ছিলেন নির্ভীকবাবু। কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। চোখ পিটপিট করে বললেন,—যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিগ্যেস করব?
–আপনার কি খুব সর্দি হয়েছে?
–না তো !
-“তাহলে স্বরটা এমন ন্যাজাল কেন?
-“আজ্ঞে, আমার স্বর তাে এরকমই।
—অ। আমি ভাবলাম বুঝি চোরা ঠান্ডা লেগেছে।…যাই।
কিটসব্যাগ ফের কাঁধে তুলে নির্ভীকবাবু হাঁটা শুরু করলেন। যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন একবার। লােকটা একই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে এখনও। আপন মনে হেসে গলা ছেড়ে গান ধরলেন নির্ভীকবাবু হেঁড়ে গলায়। একটাই গান জানা আছে তঁার। যখনই মন বেশি খুশি খুশি লাগে, গলায় আপনা আপনি এসে যায় গানটা। খরবায়ু
বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে, ওগাে নেয়ে নাওখানি বাইও…। আজ এমন মধুর চৈত্রের রাত, মনােরম দখিনা বাতাস বইছে, মাথার ওপর গাঢ় নীল আকাশ জুড়ে ফটফটে তারা, দুপাশের ঝােপেঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে নিবছে, ঝিঝি পােকারা পর্যন্ত তারস্বরে গলা সাধছে, আর তিনি কি চুপ থাকবেন?
তবে হাঁইও হাইও অবধি অবশ্য পোঁছােতে পারলেন না নির্ভীকবাবু, তার আগেই থমকাতে হল। উলটোমুখ থেকে একটা ভ্যানরিকশা আসছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল যেন চালক নেই, পলকের জন্য বুকটা ছাৎ করে উঠেছিল, ক্ষণ পরে ভ্রম ভাঙল। লুঙ্গি পরা, খালি গা, এক নিকষ কালাে লােক আছে চালকের সিটে। লোকটার লুঙ্গিখানাও গাঢ় বর্ণের বলে হঠাৎ করে ঠাহর করা যায় না।
নির্ভীকবাবুকে দেখে ভ্যানরিকশাও থেমেছে। নির্ভীকবাবু গলা খাকারি দিলেন, কী হে, যাবে নাকি?
ধবধবে সাদা দাঁতের পাটি অন্ধকারে ঝকঝক করে উঠল,—কোথায় যাবেন গাে কর্তা?
—আবছায়ার বাংলােয়। চেনো নিশ্চয়ই?
—বিলক্ষণ। কত বার কত সাহেবকে সেখানে নিয়ে গেছি। ওঠেন কর্তা, বসেন।
ভ্যানের পাটাতনে গুছিয়ে বসলেন নির্ভীকবাবু। মুখ ঘুরিয়ে ফের চলতে শুরু করেছে ভ্যানরিকশা! জিভে কুলুপ এঁটে বসে থাকা নির্ভীকবাবুর ধাতে নেই, গল্প জুড়লেন লােকটার সঙ্গে।
-তােমার নাম কী ভাই?
—আজ্ঞে, আমাদের আবার নাম। সে কি আর বলার মতন?
আহা, লজ্জা পাচ্ছ কে? থাকো কোথায়?
—আজ্ঞে, আবছায়াতেই।
-তাই নাকি? তা এত রাতে ফাঁকা ভ্যান নিয়ে ওদিকে চলেছিলে কেন?
-সে যদি বলেন কর্তা, আমি তাে রাতেই ভ্যান নিয়ে বেরােই। যদি কারুর কখনও দরকার হয়…যেমন ধরুন, আজ আপনার সেবায় লাগতে পারলাম।। বাহ, কথার বাহার আছে তাে। অথচ মধ্যরাতে এই লােকটাকে দেখেই হয়তাে ভূতে বিশ্বাসী লােকরা মনগড়া আতঙ্কে থরহরি কম্পমান হবে। ভাগ্যিস ভয় শব্দটা নির্ভীকবাবুর অভিধানে নেই, থাকলে দিব্যি এমন হাওয়া খেতে খেতে ভূতের বাড়ি দেখতে যেতে পারতেন কী ?
আবার খরবায়ু ধরবেন কিনা ভাবছেন, চালকের প্রশ্ন কানে এল নির্ভীকবাবুর, তা কর্তা, আবছায়ার বাংলায় আপনার কী কাজ?
—এমনিই যাচ্ছি গাে। শুনলাম ভূতের বাড়ি…
-মিছে কথা। দুর্জনেরা বদনাম করে।
এবার গলাটা যেন কেমন কেমন লাগল নির্ভীকবাবুর। জিগ্যেস করলেন, তােমার কি নাকে কোনও সমস্যা আছে ?
না তো। কেন কর্তা?
—তােমার স্বর যেন কেমন খখানা খােনা শােনাচ্ছে?
—আজ্ঞে, সে তাে কর্তা অনেকদিনই। সেই বাঁকানদীতে যেবার বান ডাকল…
—বানের সঙ্গে গলার কী? নদীতে বন্যা হলে মানুষের কণ্ঠস্বর বদলে যায় নাকি?
—কীসের থেকে কী হয়ে যায় তা কি কেউ বলতে পারে, কর্তা?
কথা বলতে বলতেই সাঁই সাঁই ভ্যান চালাচ্ছে লােকটা। দু-ধারের বাঁশবাগান, পানাডােবা, ঝোপঝাড় টপকে হুশ করে পৌছে গেল এক লােহার ফটকের সামনে।
প্যাডলিং থামিয়ে বলল,—এসে গেছি গাে কর্তা।
পাটাতন থেকে নেমে পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করলেন নির্ভীকবাবু,—কত?
“ছি ছি, কী যে বলেন। লােকটা জোর জোর মাথা নাড়ল, আপনি আবছায়ার অতিথি, আপনার কাছ থেকে আমি টাকা নেব?
–এ আবার কোন দেশি কথা। ভাড়া না নিলে তােমার পেট চলবে কী করে?
-তেনার কৃপায় পেটের চিন্তা আমার নেই, কর্তা। আপনার উপকারে লাগতে পারলাম, এতেই আমি ধন্য।
বলেই ভ্যানরিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছে লেংকটা। নির্ভীকবাবু তাে হাঁ। অন্যের উপকার করার জন্য রাতদুপুরে ভ্যানরিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, এমন লােক এখনও আছে দুনিয়ায় ? উহু ভূত নয়, আবছায়া তে দেবদূতের আখড়া।
ফটক পেরিয়ে দু-পা যেতেই বাংলাে। আধাে অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে দিব্যি বোঝা যায় কটেজ প্যাটার্নের বাড়ি। সাহেবি আমলের। রক্ষণা বেক্ষণের অভাবে যথেষ্ট ভাঙাচোরা। আলাে টালােও চোখে পড়ছে না। অবশ্য আলাে তো না জ্বলারই কথা, এখানে তাে থাকে না কেউ। নির্ভীকবাবুর তাতে কিছু যায় আসে না।
ব্যাগ থেকে চাদরখানা বার করে, মশা তাড়ানাের ক্রিম গায়ে মেখে শুয়ে পড়বেন বাংলাের বারান্দায়, বাস। খাবার দাবারেরও ভাবনা নেই, হাফ পাউন্ড পাউরুটি আছে সঙ্গে, আর হাফ ডজন ডিমসেদ্ধ, বর্ধমান স্টেশন থেকে কলাও নিয়ে নিয়েছেন হাফ কাদি, বােতল ভরতি জলও।
একটা রাত কাটিয়ে দিতে আর কী চাই? টর্চ জ্বালিয়ে বারান্দার চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে নির্ভীকবাবু সবে বারান্দায় গুছিয়ে বসেছেন, ওমনি কঁাচকোচ আওয়াজ। একটা ঘরের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এসেছে টিমটিমে লণ্ঠন হতে এক মূর্তি।
লােকটা বিনয়ে গদগদ,—কোথা থেকে আসা হচ্ছে, স্যার?
–কলকাতা। বাংলােয় একটা মানুষ দেখতে পেয়ে নির্ভীকবাবু খুশি। আর কিছু হােক, কথা বলার সঙ্গী তাে জুটল। হাসি হাসি মুখে নির্ভীকবাবু প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? বাংলাের চৌকিদার?
—হা স্যার। তা আপনি বাইরে কেন? আসুন, রুম খুলে দিচ্ছি, বিশ্রাম করুন।
–আমার কিন্তু বুকিং টুকিং নেই।
—কিছু লাগবে না। কতদিন পর আপনার মতাে একজনের পায়ের ধুলাে পড়ল, এই না ঢের।
লণ্ঠন হাতে বারান্দার অন্য প্রান্তে গিয়ে একখানা ঘর খুলে দিল চৌকিদার। ছায়া ছায়া আলােয় নির্ভীকবাবু দেখলেন, ভারি চমৎকার বন্দোবস্ত। বিছানা মশারি চেয়ার টেবিল আলমারি আয়না, সবই মজুত। এবং বড়সড় ঘরটি রীতিমতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মেঝেয় লণ্ঠনটা নামিয়ে চৌকিদার হাত কচলাচ্ছে,—কিছু খাবেন তাে স্যার?
—তােমায় কষ্ট করতে হবে না। আমার সঙ্গে খাবার আছে।
—তা বললে কি হয় স্যার? অধম আপনাকে বেঁধে খাওয়ানাের সুযােগ পাবে?
—কিন্তু… কী বানাবে তুমি এত রাতে?
—যা বলবেন। ভাত রুটি… সঙ্গে মুরগি মাটন মাছ। ডিম পছন্দ করলে ডিমের ডালনা।
—মাঝরাত্তিরে তুমি পাবে ওসব?
—ঠিক জুটে যাবে স্যার। আবছায়ার চৌকিদার আমি, কী না পারি।
নির্ভীকবাবুর ঠিক যেন প্রত্যয় হল না। চোখ কুঁচকে বললেন, –এখন পাঁঠার মাংসও রেধে খাওয়াতে পারবে?
—একবার হুকুম করে দেখুন না স্যার।
—চড়াও তাহলে। বেশ কষকষে করে বানাও। ভূতবাংলায় একটা ভুঁড়িভােজের থুড়ি ভুরিভােজের অভিজ্ঞতা হােক।
চৌকিদার আহত সুরে বলল,–আপনিও ভূতবাংলাে বলছেন স্যার?
–সেরকমই তাে শুনেছি। ভূতের উপদ্রবে এখানে নাকি কেউ আসে না…।
ছি ছি ছি, কী অন্যায় অপবাদ। নিজেই আপনি পরখ করে দেখুন আপনার সেবাযত্নের কোনও ত্রুটি হয় কিনা।
প্রথম থেকেই চৌকিদারের গলার স্বরটাও কানে খচখচ বাজছিল নির্ভীকবাবুর। প্রশ্নটা করব না করব না করেও জিজ্ঞেস করে ফেললেন,-হা হে, তােমার ভােকাল কর্ডে কোনও সমস্যা আছে নাকি? আই মিন, স্বরযন্ত্রে?
—কেন স্যার?
—কেমন যেন নাকি নাকি শােনাচ্ছে।
–আজ্ঞে স্যার, ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে এই হাল।
—অ। তা এখন শরীর ঠিকঠাক তাে?
—হ্যা স্যার। এখন আর কোনও অসুখ বিসুখ নেই! ফাস্টো কেলাস আছি। চৌকিদার লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, দরজায় গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, অন্ধকারে একা ঘরে বসে থাকবেন কেন স্যার, বরং নদীর ধারে একটু ঘুরে আসুন। আমি ততক্ষণে আপনার খানা রেডি করি।
প্রস্তাবটা মন্দ নয়। মধ্যরাতে প্রকৃতি দর্শনও হবে, আবার নদীর হাওয়ায় খিদেটাও চনচনে হয়ে উঠবে বেশ। নির্ভীকবাবু জিজ্ঞেস করলেন,—তা নদী কদুর?
-এই তাে, বাংলাের পিছনেই। গেট থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে দু-মিনিট হাঁটলেই ঘাট।
হাতে এক জোড়া কলা আর টর্চার্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নির্ভীকবাবু। প্রথম কলাটি শেষ হওয়ার আগেই এসে গেছে বাকানদীর পাড়। এতক্ষণে আকাশে চাঁদ উঠেছে এক ফালি, মিহি জোৎস্নায় ভারি অপরূপ লাগছে চারদিক। নদী তেমন চওড়া নয়, আবার এক ও । ওপারে গাছপালার কালচে আভাস। চাঁদের কিরণ মেখে চিকচিক করছে নদীর জল।
কীমাশ্চর্য, ঘাটে একটা নৌকা বাঁধা। মাঝিও আছে। গলুইয়ে বসা মাঝির শরীরটাকে কেমন অলীক অলীক লাগে। নিসর্গেরই অংশ যেন।
নির্ভীকবাবুকে দেখে শরীরটা নড়েচড়ে উঠল, ওপারে যাবেন নাকি বাবু?
—নাহ। নির্ভীকবাবু গলা ওঠালেন, তুমি কি এখনও যাত্রীর অপেক্ষায় বসে?
—যদি কেউ যায় …আপনি চাইলে খানিকক্ষণ নৌকাভ্রমণও করতে পারেন। কত নেবে?
–পয়সার কথা পরে। আসুন তাে। দেখবেন, চাদের আলােয়, ফুরফুরে হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাবে আপনার।
সামান্য দোনামমানা করে নির্ভীকবাবু নামলেন ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে। চড়েছেন নৌকোয়। দুলতে দুলতে নৌকো চলল মাঝনদীতে।
দাঁড় টানতে টানতে মাঝি বলল,—রাতটা তাহলে আজ আবছায়াতেই থাকছেন ?
মাঝির স্বরও যেন কেমন কেমন। বড় বেশি অনুনাসিক। তবে নির্ভীকবাবু এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নে গেলেন না। সম্ভবত আবছায়ার বাসিন্দাদের গলা এরকমই, মিছিমিছি একটা ফালতু কারণ শুনে লাভ কী!
দ্বিতীয় কলাটিতে কামড় দিয়ে নির্ভীকবাবু মৃদু হাসলেন,—হুম। মাঝি আবার বলল,—রাতটা থাকুন, বেশ লাগবে।
—তাই তো মনে হচ্ছে।… অথচ সকলে বলে, এখানে নাকি ভূতের উৎপাতে এক দণ্ডও তিষ্ঠোনাে যায় না।
-কী অন্যায্য কথা। মাঝি ঘাড় দোলাচ্ছে,–আপনিই বলুন, সেই যে বাস রাস্তা থেকে এলেন… কোথাও এতটুকু অসুবিধে হয়েছে? কারুর কাছে খারাপ ব্যবহার পেয়েছেন? কত বছর আগে বাসের তলায় চাপা পড়ে মারা গেছে হারুদা, সে আপনাকে ঠিকঠাক রাস্তা বাতলে দিল। বানের জলে ডুবে চোদ্দো বছর আগে ফৌত হয়ে গেছে করিমভাই, কেমন সে দিব্যি আপনাকে ভ্যানে ছড়িয়ে পৌছে দিল বাংলােয়। ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে গােপাল চৌকিদার কতকাল আগে অক্কা পেয়েছে, সে আপনার জন্য এখন মাংস রাঁধছে।
নির্ভীকবাবুর কপালে ভাঁজ পড়ল,-
-অ্যাই অ্যাই, তুমি কি আমায় ভূতের ভয় দেখাচ্ছে?
—বালাই ষাট। ভয় দেখানাের মতলব থাকলে আমি তাে আপনার গলাটা টিপে ধরতাম। এইরকম করে। বলার সঙ্গে সঙ্গে মাঝির একটা হাত তড়াক করে লম্বা হয়ে এগিয়ে এল। প্রায় পাঁচ হত তফাতে বসে থাকা নির্ভীকবাবুর গলায় মুহূর্তে বরফ শীতল আঙুলের ছোঁয়া। পরক্ষণেই হাত অবশ্য ফিরে গেছে স্বস্থানে। নির্বিকার হাসছে মাঝি, বলুন বাবু, আমরা কি কেউ আপনাকে এভাবে ভয় দেখিয়েছি?
আজকাল আর রাতের বেলা মরাগাছতলার বাসস্টপে হারু মণ্ডলকে দেখা যায় না! তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন অন্য এক বিদেহী। নির্ভীক সিংহ স্বয়ং। রাতবিরেতে কচিৎ কখনও কোনও যাত্রী বাস থেকে নামলে নাকি নাকি সুরে তাকে প্রশ্ন জোড়েন, আবছায়ায় যাবেন ভাই? আবছায়া? সেখানে কোনও ভূত নেই, বিশ্বাস করুন।
(সমাপ্ত)