শহরের এক নামিদামি নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে। নেতাদের গ্রেপ্তারের ফলে যা হয় আরকি, রাস্তা অবরোধ যাত্রীদের হয়রানি তো আছেই। সাথে মিছিল মিটিং ইত্যাদি। সকালেই খবরের কাগজে বড় বড় হেড লাইনে খবরও ছাপানো হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মূলত খুনের অভিযোগে। কিন্তু আগে পিছে অবৈধ ভাবে টাকা আত্বসাধের সাথে নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এটা নতুন কিছু না, নেতাদের ধরতে পারলেই নানান অপরাধের কথা লিখতে হয়, নয়তো কেসটা পাঁকাপোক্ত হয়ে উঠে না।
নানান বাধ্য অতিক্রম করে থানায় পৌছাতে পৌছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ভদ্রলোকের বয়স মোটামুটি ৬০ পেরিয়েছে। চুলগুলো সাদাসাদা মুখে দাড়ি। লম্বা পাঞ্জাবি সাথে কাঁধে ঝুলানো একটা সাদা চাদর। চাদরটা মোটেও শীত কাটানোর জন্য নয় বরং অাভিজাত্য প্রকাশই মূল লক্ষ। রাতের খাবার শেষে বেশ ক্লান্তিতে শরীরটা এলিয়ে আসছিলো। তাই বিছানায় গিয়ে বসতেই মোবাইল ইঙ্গিত দিলো কেউ আমাকে ডাকছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক পিনপিনে কণ্ঠে ভেসে আসলো,,
-এডভোকেট সজীব মাহমদু?
-জ্বী বলছি তারপর এই কেসের সম্পর্কে খুটি নাটি কিছু তথ্য দিয়ে সরাসরি দেখা করতে চাইলো। কিন্তু আমিই নাহ্ করে দিয়ে বললাম,,,
-আমি পৌছে যাবো ঠিক সময়ে।
-তুই এসেছিস? আমিই আমার সেক্রেটারিকে তোর কথা বলেছি। তোকে যেন জানায় বিষয়টা। জেলের সেলে ডুকতেই বসা থেকে উঠে এসে কথাটা বললেন জনাব আফাজ উদ্দীন। জনাব আফাজ উদ্দীনের হুট করেই এমন ব্যবহারে একটু মৃদু হাসলাম।
-দেখ, তুই তো জানিস আমি এই কাজ করিনি। কিন্তু তোর মা কথাটা বলেই খানিক চুপ থাকে আবার বলা শুরু করলেন,
– যদি প্রশ্ন করিস আমি খুন করেছি কিনা তবে বলবো “না “আমি করিনি। পার্টির অফিস থেকে বের হয়েই সোজা তোর মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রুমে বাইরে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পরও যখন দরজা খুললো না তখন সেখান থেকে বেরিয়ে আমার মতিঝিলের বাসায় চলে গিয়েছিলাম। সারাটা রাত সেখানেই ছিলাম সাথে অবশ্য কেউ ছিলো না। সকালে আমার সেক্রেটারি মানে তোকে যে খবর দিয়েছিলো তিনি আমাকে জানালেন তোর মাকে কেউ খুন করেছে। আর পুলিশ নাকি আমাকেই খুজছে। তখন বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, বাধ্য হয়ে গা ঢাকা দিই। আমি জানি এটা করা ঠিক হয়নি কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। একে তো তোর মায়ের সাথে আমার এতদিনের ঝামেলা পুলিশ আমাকেই সন্দেহ করতো। আর তার উপর আবার আমি সেই রাতে তোর মায়ের…..
-এই তোর মা এই কথাটা আশা করি আর বলবেন না। কারণটা আপনার জানা তাই প্লিজ জনাব আফাজ উদ্দীন অর্থাৎ আমার বাবাকে কথাটা বলতেই তিনি মাথা নিচু করে নিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন…
-সেইদিন রাতে যখন আমি রাহেলার বাসাতে যাই তখন সিসিটিভি ক্যামেরাতে সেটা ধরা পরে।
-কেন গিয়েছিলেন?
-রাহেলাকে বোঝাতে যে এমনটা যেন আর না করে, রাহেলার যখন টাকাই সব তখন ওকে সব টাকা দিয়ে দিবো। সামনে পার্টির..
-বাবা দেখো আমি পার্টি সম্পর্কে তোমার মুখ থেকে কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি জেনেই এসেছি।
নিজের মুখ থেকে বাবা শব্দটা শুনে নিজেই বেশ অবাক হলাম। মনে পরে না শেষ কবে মানুষটাকে বাবা বলে ডেকেছি। আমার মুখে বাবা ডাকটা শুনেই বেশ অাগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকালো, চোখটা যে তার ছলছল করছে তা দেখেই বুঝতে পারলাম। কেন জানি আজ মানুষটাকে খুব বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছা করছে।
মা মারা গেল যখন তখন আমার বয়স বিশ, ছোট একটা ভাই আছে মাধ্যমিক পরিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। কিন্তু হঠাতই মায়ের এই ভাবে চলে যাওয়া দুইভাইয়ের কেউ মেনে নিতে পারিনি। মায়ের মৃত্যুর মাস খানেকের মধ্যেই বাবার বিয়েটা যেন আরো ভেঙ্গে দিলো দুইভাইকে। মা আমাদের নামে কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলো সেইটা দিয়েই দুইভাইয়ের চলতো। তারপর আইন বিভাগে পড়া তারপর এটাকেই পেশা হিসাবে নিলাম। তারপর থেকে বাবার সাথে কথা হয়েছে দুই একবার।
– আমি জানি তোর আমার প্রতি খুব রাগ। কিন্তু আমার তখন কিছুই করার ছিলো না। পার্টির টিকেট পাওয়াটা জরুরি ছিলো কিন্তু শর্ত ছিলো পার্টির প্রেসিডেন্টের মেয়েকে যদি বিয়ে করি তবেই সেটা পাবো। আসলে..
-কেসটা বিষয়ে কিছু বলো বাবা অতীত ঘাটতে চাই না আর না চাই শুনতে। তোমার যা মনে হয়েছে তা তুমি করেছো আর আমাদের যা মনে হয়েছে তা আমরা করেছি।
-রাহেলার উপর আমার একটা রাগ ছিলো ঠিক কিন্তু খুনটা আমি করিনি। আমাকে ফাসানো হয়েছে, আর আমি ঠিক বুঝতে পারছি কাজটা কে করেছে।
-কে?
-আমাদের দলের আরেকজন জনাব মতিন মিয়া।
-হুমম রাতারাতি তাকে প্রেসিডেন্টের পদটাও দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তোমার কিছু হয়ে গেলে তাকেই এই পদ দেওয়া হবে। যাই হোক দেখা হবে কোর্টে। কথাটা বলেই বেরিয়ে আসবো, তখনিই পেছন থেকে বলে উঠলেন,,
-আরেকবার আগের মত বলবি?
থমকে দাড়ালাম, ভেতরটা দুমড়ে মুছড়ে যাচ্ছে। চোখেও হালকা পানির ছোয়া। পেছন ঘুরে তাকালাম। মানুষটা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-ভালোবাসি বাবা অনেকটাই।
মৃদু হেসে বললাম কথাটা। আমি যখন খুব ছোট তখন থেকেই বাবাকে কথাটা বলি।চলে যাওয়া সময় পেছন ঘুরে কথাটা না বললে যেন আমার যাওয়ায় হয় না। কতবছর পর আবার বললাম কথাটা। নিজের বেশ হালকা লাগছে। কেসের রায় বের হলো, নির্দোষ বাবা। খুনটা করেছে আমার সৎ মামা। কারণ বোনের মৃত্যুর পর সকল সম্পদের মালিক তিনিই হতেন। আর ভাগ্যক্রমে বাবার সেখানে যাওয়ার কারণে বেশ ভালো ভাবেই ফেসে গিয়েছিলো। নিজেকে আর সফল উকিল বলে মনে হচ্ছে। জাজ সাহেব রায় দেওয়ার পরই একে একে সবাই বেরিয়ে গেল। বসে আছি চেয়ারে। কাঁধে কারো হাতের ছোয়া পেতেই তাকালাম..বাবা!
-তুমি যাওনি?
-নাহ্, ভাবছি তোর সাথেই যাবো।নিবি না আমাকে?
-ছুটু আর আমি একটা ভাড়া বাড়িতে থাকি। কাজের ভুয়া রাখিনি, ছুটুর সেটা পছন্দ না তাই নিজেরাই রান্না করি।
-আরেকজনের রান্না করতে পারবি না? কথাটা শুনেই বাবার দিকে তাকালাম।
-সত্যি তুমি রাজনীতি ছেড়ে দিবে বাবা?
-হুমমম ভাবছি এখন তোর মত হয়ে যাবো, তোর মায়ের মত।
-বাবা তুমি সত্যিই বলছো?
-হুমমম খোকা, নিবি আমায়?
-হ্যাঁ বাবা ছুটু তোমার কথা খুব বলে। ছুটু তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে। চলো বাবা এখনিই চলো
-তার আগে পার্টি থেকে ইস্তাফা দিতে হবে। তারপরই সারাটা জীবনের জন্য তোর কাছে চলে যাবো।
-আসবে তো বাবা?
-কথা দিলাম।
মুদৃ হেসে আমার কাঁধে ডান হাতটা রেখে বললেন। আজ বাবা আসবে। ছুটু বেশ খুশি, আজকে নিজের হাতে রান্না করেছে। বাবার শুটকি মাছ খুব পছন্দ তাই সেটাও আছে খাবারের মেনুতে। রুমটা একটু গোছগাছ করলাম। তিন দিন আগের বাবার মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। বাবা আসবে কারণ বাবা তো কথা দিয়েছে আমাকে। আর বাবা আমাকে কথা দিলে সে কথা রাখবেই রাখবেই ঠিক সব ছেড়ে আসবে, তাড়াছা রাতের নিউজে দেখলাম বাবা পার্টির পদ থেকে পদত্যাগ করেছে।
-এই ছুটু,,, কই রে তুই?
কথাটা বলতে বলতেই টিভির রিমোর্টটা হাতে নিয়েই টিভিটা চালু করতেই “দেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ জনাব আফাজ উদ্দীন আর নেই, আজ সকালেই তার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। খবরটা শুনেই থমকে গেলাম। নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। না না এটা কিভাবে সম্ভব? বাবা তো বলেছিলো আসবে? আর আমাকে কথা দিয়েছে। তবে কি রাজনীতি!! হা হা হা……