আয়েশাকে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর ‘ইসাক’ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো, তখন আয়েশার বয়েস ষোলো-সতেরো’র মতো। শরীরে যৌবনের বাঁক, মাথায় ঘন চুল, চালচলনে গ্রাম্য চপলতা। যুদ্ধের কারণে সারা দেশের পরিবেশ থমথমে। আয়েশারও কোনো কাজ নেই। তার দুই জোড়া কবুতর আছে, সেগুলোকে সময় মতো খেতে দেয় এবং মাঝে মাঝে সে কদবেল মাখা খেতে খেতে নিচু কোনো গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে- কাজ বলতে এইটুকুই।
পাকিস্তানি মেজরের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসার পর থেকেই আয়েশাদের বাড়িতে গুমোট একটা ভাব চলে এসেছে। সবচেয়ে বেশি গম্ভীর হয়ে গেছেন আয়েশার বাবা মজিদ খলিফা। মেয়ের জন্য এমন কোনো প্রস্তাব তিনি আশা করেন নি।
তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরের বারান্দায় হুক্কা টেনে কাটান, এই সময় তাকে আরো বেশি বিরক্ত দেখায়। তিনি বলে দিয়েছেন, হুক্কা টানার সময় তিনি গভীর চিন্তায় থাকেন, এই সময় বাড়ির কেউ যেনো তাঁর ধারে কাছে না যায়।
দিন পাঁচেক আগে মেজর ইসার মজিদ খলিফাকে আয়েশায় ব্যাপারে বলে গেছেন। বলেছেন- ‘আপনি ভাবুন, আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিবাহ দেবেন কি-না। আপনাকে ভাবার জন্য পাঁচ দিন সময় দিলাম। পাঁচ দিন পর এসে আমি সিদ্ধান্ত জেনে যাবো।’
মজিদ খলিফা বারান্দায় বসে হুক্কা টানছেন। আজ পাঁচ দিন সময় শেষ হয়েছে। মেজর ইসাকের আসার কথা। মজিদ খলিফা এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি।
মেজর ইসাক দুইটা জিপ গাড়ি ভর্তি সৈন্য নিয়ে মজিদ খলিফার বাড়িতে উপস্থিত হলেন রাত নয়টার পর পর। গ্রাম্য এলাকা, রাত নয়টা মানেই নিশুতি। চারদিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের বুটের আওয়াজ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।
মেজর ইসাককে ঘরে বসতে দেওয়া হলো। মজিদ খলিফার স্ত্রী ঘোমটা নাক পর্যন্ত টেনে ভয়ে ভয়ে ঘরে এসে নীচু স্বরে মেজরকে বলল, আপনে বসেন, উনি নামাজে দাঁড়াইছে। নামাজ শেষ করে আসতেছে।
নামাজ শেষ করে মজিদ খলিফা ঘরে এলেন। কিছুক্ষণ কুশল বিনিময়ের পর বললেন, আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি নাই হুজুর। আমি বুঝতেছি না আমি কি করবো! আয়েশা আমার বড় মেয়ে, খুব আদরের।
মেজর ইসাক বললেন, আপনাকে আমি আরেকটা প্রস্তাব দিচ্ছি। কিছুদিন পর একটা অপারেশন হবে। ব্লু প্রিন্ট করা হয়ে গেছে। সেদিন রাতে আমরা কিছু কিছু লোককে ধরে নিয়ে যেয়ে মেরে ফেলবো। গ্রামের প্রধানদের নাম আছে এতে। এবং সবচেয়ে বড় কথা আপনার নামও আছে লিস্টে।
মজিদ খলিফা ঢোঁক গিলে বলল, ইয়া মাবুদ! এইটা কি বললেন!?
ঘরের দরজার পেছন থেকে মজিদ খলিফার স্ত্রীর কান্নার শব্দ শোনা গেলো। কান্নার শব্দ শোনা না বোঝাই যেত না, তিনি এতক্ষণ দরজার আঁড়াল থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁর স্বামী এবং মেজরের কথোপকথন শুনছেন।
মজিদ খলিফা কান্না শুনে বললেন, আম্বিয়া, তুমি অন্য ঘরে যাও, আঁড়াল থেইকা পুরুষ মানুষের কথা শুনন কেমন অভ্যাস? যাও।
মেজর ইসাক বললেন, আপনি যদি আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিবাদ দিতে রাজি হোন, তাহলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। দেখুন খলিফা সাহেব, আমি চাইলেই কিন্তু আপনার মেয়েকে জোর জবরদস্তি করে তুলে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করিনি। ওর প্রতি আমার একটা পেয়ার হয়েছে। এইজন্যই ভালোভাবে প্রস্তাব দিয়েছি।
মজিদ খলিফা বললেন, আপনে আমারে কেমনে সাহায্য করবেন?
মেজর বললেন, আমি প্লান করেছি- আপনাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হবে। আপনিও লাইনে দাঁড়াবেন। কিন্তু যে গুলি করবে তাকে আমি আগে থেকেই বলে রাখবো যেন সে আপনাকে গুলি না করে। সে ফাঁকা ফায়ার করবে। আপনাকে মরার ভান করতে হবে।
মজিদ খলিফা ভ্রঁ কুঁচকে বললেন, এত কিছু কেন করা লাগতেছে? আমারে না নিয়া গেলেই তো হয়। মেজর ইসাক বললেন, না হয় না। উপরের নির্দেশ,লিস্টের সবাইকেই নিতে হবে। আর উপর মহল যদি জানতে পারে আমি একটা বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য এত কিছু করতেছি তাহলে আমার সমস্যা হবে। শুনুন, আপনি মরার ভান করে পড়ে থাকবেন, সৈন্যরা চলে আসার পর আপনি গোপনে বাড়িতে চলে আসবেন। ক্লিয়ার? আপনি বাড়িতে ফেরার পর আমি এসে আয়েশাকে নিয়ে যাবো।
মেজর চলে যাওয়ার পর মজিদ মিয়া আবার বারান্দায় হুক্কা নিয়ে বসলেন। ভয়ে ভয়ে মজিদের স্ত্রী আম্বিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্বিয়া জিজ্ঞেস করলেন, কি ভাবতেছেন? কি করবেন?
মজিদ খলিফা উত্তর দেওয়ার আগেই আয়েশা বারান্দায় হাজির। কোনো দেরী না করেই চটপট করে একনাগাড়ে বলল, আব্বা, আমি এই বিবাহতে রাজি।
মজিদ খলিফা বললেন, মাগো, বিবাহের পর তো তোমারে পাকিস্তান নিয়া যাবে। তোমারে তো আর দেখবো না।
আম্বিয়া বলল, বিবাহ না দিলে তোমারে মাইরা ফেলবে। মরার পর কি আমারে দেখবা?
আয়েশার গলা ভারী হয়ে এলো। আম্বিয়া আবারো নাক পর্যন্ত ঘোমটা ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলেন।
২৫ মার্চ রাতে মজিদ খলিফাকে টেনে হিঁচড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা জিপে উঠালো। জিপে উঠে দেখলেন, সেখানে গ্রামের হাই স্কুলের হেড মাস্টারও আছেন, বাজারের হিন্দু ব্যবসায়ীও আছেন। সবার চোখ ভীত।
নয়-দশ জন মানুষকে চোখে বেঁধে সারি করে দাঁড় করানো হয়েছে। মজিদ খলিফা বাম থেকে তিন নম্বর। তিনি পর পর দুটা গুলির শব্দ শুনলেন, এবং চোখ বাঁধা অবস্থাতেই বুঝতে পারলেন তার পাশে দুইটা দেহ ধুপধাপ শব্দ করে পড়ে গেলো। এবার কি তার পালা? মেজর ইসাক কি বলে দিয়েছেন যে তাকে যেনো গুলি করা না হয়? যদি না বলেন, তাহলে তো এখানেই শেষ। তিনি কি সুরা পরতে শুরু করবেন? কোন সুরা পরা যায়? আর রাহ্মান, আল্লামাল কুরআন । আর মনে পড়ছে না। এমন সময় বিকট শব্দে গুলির আওয়াজ হলো। মজিদ খলিফা পড়ে গেলেন। তার কোনো ব্যথা বোধ হচ্ছে না। তার মানে কি তাকে গুলি করা হয়নি? তিনি কি বেঁচে আছেন?
মজিদ খলিফা পর পর আরো অনেকগুলো গুলি শব্দ শুনলেন। এবং বুঝতে পারলেন তার পাশে একটা করে লাশ যোগ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন লাশগুলোকে টেনে টেনে একটা বড় গর্তে ফেলে দিলো। মজিদ খলিফা বুঝতে পারছেন, তার উপর মাটি এসে পড়ছে। তাদের কি কবর দেওয়া হচ্ছে? গণকবর? মজিদ খলিফা বুঝতে পারছেন না, তিনি কি এখনোই উঠে পড়বেন নাকি অপেক্ষা করবেন? অপেক্ষা করতে গিয়ে যদি মাটি চাপা পড়ে যান তাহলে তো সমস্যা।
মিনিট দশেক পরেই মাটি দেওয়া বন্ধ হলো। মজিদ খলিদ আস্তে আস্তে চোখের বাঁধন সরালেন। দেখলেন, হাইস্কুলের হেড মাস্টারের মাথা থেকে মগজ গলে গলে পড়ছে। কোনো লাশের চোখ বের হয়ে আছে, কারো বুক ঝাঁঝরা।
মজিদ খলিফা উঠে দাঁড়ালেন। আশেপাশে কেউ নেই। তিনি লাশগুলোর দিকে তাকালেন আরেকবার, দেখলেন এবং হড়বড় করে বমি করে দিলেন।
আয়েশা সুন্দর করে সেজেছে। চোখে কাজল দিয়েছে, চুল খোঁপা করেছে, পায়ে টকটকে আলতা। মেজর ইসাক গাড়ি নিয়ে উঠোনে এসেছেন। আয়েশার কবুতর গুলো খোয়ারে বসে আছে। মজিদ খলিফা বারান্দায় হুক্কা ধরিয়েছেন। তিনি শুনতে পেলেন, উঠোনে কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। আয়েশা চিৎকার করে বলছে, আব্বা আপনে একটু আসেন, আপনাকে শেষ দেখি।
মজিদ খলিফা উঠোনে গিয়েছিলেন কিনা কে জানে! তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত বারান্দায় বসা। তার স্ত্রী পাশে এসে দেখলেন মজিদ খলিফার চোখে পানি। স্ত্রীকে দেখে খলিফা বললেন, এই হুক্কাটা নষ্ট হইয়া গেসে। এর ধুমায় চোখ জ্বালা করে। দেখো না চোখ দিয়া পানি পড়তেছে। হুক্কায় সমস্যা, অন্য কিছু না।
পুনশ্চঃ উক্ত ঘটনায় বর্ণিত ‘আয়েশা’ চরিত্রটি আমার ফুপি। আমার বাবার বড় বোন। মজিদ খলিফা আমার দাদাজান। এই ঘটনার সময় আমার বাবার বয়েসে সাত, পুরো ঘটনা তার বয়ানেই শোনা।
আমার ফুপি পাকিস্তানে চলে গিয়েছে। এই আটচল্লিশ বছরে একবার তিনি বাংলাদেশে আসেন নি, কিংবা তাকে আসতে দেওয়া হয় নি। কিংবা তিনি হয়ত বেঁচেই নেই। হতেও পারে।
দাদাজান মারা গেলেন যুদ্ধের বছর চারেক পর। মৃত্যু শয্যায় তিনি বারবার বলেছেন, আমার বড় মাইয়া আয়েশা কই? তারে খবর দাও নাই? আমি মইরা যাইতেছি এইটা সে জানে না? তারে খবর দাও।
এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে, চাইলেই কিছু ডাল পালা যুক্ত করে একটা গল্প দাঁড় করানো যেতো। কিন্তু আমি সেটা চাইনি। আমি বাস্তবতাকে বাস্তবতাই রাখতে চেয়েছি। আমার মনে হয়, বাস্তবতা গল্পের চেয়েও সুন্দর, বেদনাদায়ক, মর্মস্পর্শী। কল্পনা মিশিয়ে এই বাস্তবতাকে আমি ম্রিয়মাণ করতে চাইনি।
আমার ফুপি নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে বাবার জীবন বাঁচানোর জন্য। আমার কাছে এই বিসর্জন খুব মূল্যবান। পরিবার ছেড়ে শত্রু দেশে গিয়ে বসবাস করা নিশ্চয়ই ত্যাগের।
কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে , আমার পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা!
আমি সংকোচ ছাড়াই উত্তর দেই, হ্যাঁ, আমার ফুপি একজন মুক্তিযোদ্ধা।