–বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে ফারহান। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছি না । আমি পারলাম না আমাদের বাচ্চাটাকে আগলে রাখতে ।
সব শেষ ফারহান ।
ফারহানকে কথাগুলো বলতেই পাশে দাঁড়িয়ে আমার শাশুড়ি মা শুনলো।তারপর উনি বললেন,
–অপয়া মেয়ে।বাচ্চাটারে জন্মের আগেই খুন করে ফেললি ? তুই তো খুনি মা ।
–মা আমি…
–কোনো কথা বলবিনা তুই।কেন বাপু চাকরীটা করার কি দরকার শুনি ? এই জার্নিটাই তো বাচ্চাটাকে খুন করলো।মেয়ে মানুষ হয়ে চাকরী করার কি দরকার ?
–তোমাকে কত্তবার নিষেধ করেছি চাকরীটা না করার জন্য।কিন্তু তুমি কারও কথাই শুনলেনা।এখন শান্তি হলো তোমার ? আমার বাচ্চাটাকে শেষ করে দিলে ?
–ফারহান, বাচ্চাটাতো আমারও । আমি কি ইচ্ছে করে নিজের সন্তানকে খুন করতে পারি বলো ? তোমরা কেন বুঝতে চাইতেছোনা !
–ফারহান এখন ই তোর বউকে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল।এমন অলক্ষণ, অপয়া মেয়ে আমার বাড়িতে যেন না থাকে।বিদেয় কর এই খুনীটাকে ।
মায়ের কথা শুনে আমি ফারহানের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।ভাবছি , একে তো বাচ্চাটাকে হারালাম এখন কি তবে সংসারটাও হারাতে হবে ? ভরসা ছিলো ফারহানের উপর।ও হয়তো আমায় একলা ছেড়ে দিবেনা।
কিছুক্ষণ পর ফারহান নিজেই আমাকে বললো,
–দেখো নীলা , আমার মায়ের উপর আমি কোনো কথা বলিনা।সুতরাং মা কি বললো তুমি নিশ্চয় শুনতে পেলে।
–কিন্তু ফারহান, আমি কোথায় যাবো ? বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর ঘরটাই তো নিজের ঘর।আমি আমার ঘর ছেড়ে কোথায় থাকবো বলো?
ফারহান কোনো কথারই জবাব দিলোনা।ব্যাস আমার সামনে দিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো।
থাকতে পারলামনা শ্বশুর বাড়িতে।এক কাপড়ে বের করে দিলো ওরা।একটাই দোষ, আমার চাকরীর জন্য নাকি আমার বাচ্চাটা মারা গেছে। আর সেটা নাকি আমার ইচ্ছেতেই !
সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিলাম ফারাহানের বাড়ি থেকে।কারণ ওদের বলা কথাগুলো হৃদয়ে ভীষণভাবে লেগেছে।বাচ্চাটা শেষ তার সাথে পাঁচ বছর তিন মাসের সংসারটাও শেষ।
যেখানে নিজের বলতে কিছুই নেই সেখানে মিথ্যে আশা নিয়ে পড়ে থাকার কি দরকার ! তখন কেবল মাথায় এই বাক্যটাই ছিলো।নিজের বলতে কিছুই রইলোনা আমার।বাচ্চাকে হারিয়ে কষ্ট পেয়েছি খুব তবে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি।এর জন্যই মেয়েদের নিজের একটা সত্তার খুব দরকার।যেটা বরাবরই আমার ছিলো।স্বাবলম্বী ছিলাম খুব । তার জন্যই এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছি।পিছু হাঁটিনি।
বেশ কয়েকবছর পেরিয়ে গেলো।ও বাড়ি থেকে আর কোনো খবর আসলোনা।আমি নিশ্চিত ছিলাম,
যে কোনো মুহূর্তে ডিভোর্স পেপার চলে আসবে।তাই মানসিক প্রস্তুতি তখন থেকেই নিতে শুরু করি।
অফিস থেকে এসে বাসায় ঢুকলাম।
বাবার বাসা ? না বাবার বাসা নয়।সব হারিয়েছি ঠিকই
আত্মসম্মানটা হারাতে পারিনা । বাবার বাসায় থাকলে নিজেকে খুব ছোট মনে হত হয়তো । তাই অফিসের কাছেই একটা বাসা ভাড়া করে থাকতে শুরু করি।
তো সেদিন সকালে বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিলাম আর পত্রিকাতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশে রাখা সেলফোনটা বেজে উঠলো।
সেলফোনে চোখ রাখতেই অবাক হয়ে গেলাম।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ফোনের দিকে আর ফোন অনবরত বেজেই চলছে।এতদিন পর এই নম্বর থেকে ফোন আসবে ভাবতেই পারিনি !
–ফোনটা রিসিভড করে চুপ করে রইলাম।অপর পাশের ব্যক্তির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। খুব বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে ! তবে কি ফারহান ভালো নেই ?
–নীলা ,
–হু বলো।
–কাল কি একবার দেখা করবে আমার সাথে ?
–কাল ? আচ্ছা । কোথায় আসতে হবে টেক্সট করে দিও।
অপর পাশ থেকে ফারহান ফোনটা কেটে দিলো।এতদিন পর ফারহান দেখা করার কথা কেন বললো? তবে কি ফারহান ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলবে ? নানা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছি।অনেক বেশি ভালবাসি ছেলেটাকে।
পরেরদিন যথারীতি ফারহানের পাঠানো ঠিকানায় হাজির হলাম।জানিনা কি জন্য ডেকেছে ও তবে আর দুর্বলতা ওর সামনে প্রকাশ করা যাবেনা ঠিক ঐরকম একটা প্রস্তুতি নিয়েই ওর সামনে গিয়ে বসলাম।
–ডাকলে যে ?
ফারহান তাকিয়ে দেখছে আমাকে।অনেকদিন পর দেখা তাই হয়তো !
–হু । আমাদের বিয়ের বয়সতো অনেক পেরিয়ে গেলো..
–ডিভোর্স চাও, তাইতো ?
সমস্যা নেই।পেপার দাও । সাইন করে দিবো ।
–নীলা,
ছোটির বাচ্চাটা নেই ।
ছোটি ফারহানের ছোট বোন মানে আমার ননদ।ভালো ঘরেই বিয়ে হয়েছে মেয়েটার।
–কিভাবে ?
–মিসক্যারেজ ।
জানো , ১৪সপ্তাহের বাচ্চা ছিলো। কিন্তু…
ফারহানের চোখ টলমল করছে । ছেলেটা কাঁদছে !
–ছোটি কেমন আছে এখন ?
একজন মায়ের বাচ্চা মারা গেলে কতটা কষ্ট তা আমি খুব ভালো করেই জানি।তারপরেও খুব জানতে ইচ্ছে করছে ছোটি ভালো আছে তো?
–হ্যাঁ । আমার বোনটা কপাল করে এমন শ্বশুর বাড়ি পেয়েছে।ওকে সবাই খুব আপন করে নিয়েছে।ওর কষ্টটা সবাই ভাগ করে নিয়েছে।
–বাহ্ ।
শুনে খুশী হলাম। মেয়েটা অন্তত নিজের একটা অবলম্বন পেয়েছে।
তা তুমি আমাকে এখানে আসতে বলার কারণ কি এটা?
–না আবার হ্যাঁ।
–বুঝলাম না ।
–আমায় ক্ষমা করে দাও। ফিরে চলো নীলা ।
–মানে ?
–আমি খুব অনুতপ্ত।
–ফারহান বাসায় গিয়ে ডিভোর্স পেপারটা পাঠিয়ে দিও।আমি প্রস্তুত ডিভোর্স দেওয়ার জন্য।কিন্তু সংসারটা আর জোড়া লাগবেনা ফারহান।কারণ তার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত নয়।যতটুকু সম্মান বাঁচিয়ে রেখেছি তা একান্তুই আমার।এই সম্মানটুকু বিলিয়ে দিতে পারবোনা।দুঃখিত আমি।
–নীলা…
–ভালো থেকো ।
ফারহানকে পিছনে রেখেই এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাচ্ছি।বরাবরই পিছু হাঁটি না । একদম অভ্যাস নেই।
একজীবনে অনেক ভালবেসেছি ফারহানকে।যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন ভালো ঠিকই বাসবো।কিন্তু এক ছাদের নিচে আর থাকতে পারবো না।যেখানে নিজের কিছুই নেই সেখানে শুধু শুধু অভিনয় করে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।