সকাল থেকে মাথাটা খারাপ হয়ে আছে। আজ ছোট দেবরের ঘর থেকে রবীন্দ্রনাথের একটা বই নিয়ে এসেছিলাম পড়বো বলে। বইটা খুলতেই একটা ছবি পেলাম৷ আমার দেবর আবিদের সাথে রাকিবের ছবি৷ কি সম্পর্ক এই দুজনের মাঝে? দীর্ঘ সাতবছর পর এই মানুষটার চেহারা দেখলাম। সেদিনের প্রতারনার শিকার হওয়ার পর এই মানুষটার চেহারা আমি একবারের জন্যও দেখিনি। তার যত স্মৃতি ছিলো সব পুঁড়ে ফেলেছি৷ কিছু পুড়েছি দেশলাইয়ের আগুনে আর কিছু পুড়েছি মনের আগুনে। আজ এতগুলো বছর পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মুখটা আমাকে দেখতে হলো। ইতিমধ্যে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে মনে। সেইসাথে অনেকগুলো প্রশ্নও৷ আবিদ থাকে সেই দূর বিদেশে। অস্ট্রেলিয়ায়। একটা মানুষকে এতদূর থেকে রাকিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু মনে জাগা প্রশ্নগুলো? সেগুলোর তো উত্তর জানতে হবে। না জানা পর্যন্ত যে শান্তি মিলবে না।
রাকিব আমার প্রাক্তন প্রেমিক। সমবয়সী ছিলাম। দুইবছরের প্রেম ছিলো। প্রচন্ড ভালোবাসতাম ছেলেটাকে। তখনকার সময়ে অন্য কাওকে বিয়ে করবো মনে হলেই দম আটকে আসতো৷ নিজের অজান্তেই দুগাল বেয়ে পানি ঝড়তো৷ আর এখন? দিব্যি আজাদকে বিয়ে করে সংসার করছি। করতে পারতাম না যদি ঐ সময় রাকিব প্রতারনা না করতো। ছেলেটা খুব ভালো অভিনেতা৷ নিখুঁত অভিনয় জানে। কি যে সুন্দর ভালোবাসার অভিনয় জানে! উফফ! একদম ঘোর লাগানো পরিস্থিতি। ওর প্রেমে এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে আমার ঘোরই কাঁটতো না। পুরো দু- দু’টো বছর কঠিন ঘোরে পড়েছিলাম। রাতের পর রাত জেগে কথা বলা।
ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্নজালগুলো একটু একটু করে বোনা। দিনের বেলা এক বেঞ্চে পাশাপাশি বসে পড়া এবং ভালোবাসার আদান প্রদান। ক্লাস শেষে ফুচকা বা ভেলপুরি মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া৷ তখন মনে হতো, আরেহ্! স্বর্গের সব সুখ তো পৃথিবীতেই আছে। একদিন রাকিব শুনেছিলো বেলী আমার প্রিয়। সেই থেকে প্রায় রাতেই বেলীর মালা নিয়ে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। কখনো সুযোগ পেলে যেয়ে নিয়ে আসতাম, কখনোবা পরদিন ক্লাসে যেয়ে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ফুলটা আমার হাতে তুলে দিতো। কিন্তু অনুভূতিটা একদম তাজা ফুলেরই পেতাম। মনেই হতো না এটা বাসি ফুল৷ ঐ যে বললাম ঘোরে ডুবে ছিলাম। তাইতো তাজা আর নিস্তেজ ফুলের মাঝে পার্থক্য দেখি নি। প্রেমিক আর প্রতারকের মাঝে পার্থক্য দেখিনি।
সাত বছর আগের গল্প। বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করলো আজাদের সাথে। রাকিবের কথা বাসায় বলার সাহসই হয়নি। বলতাম কি করে? ছেলে তো বেকার। সবে মাত্র থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি আমরা৷ একে তো বেকার, তারউপর সমবয়সী৷ কখনোই আমাদের সম্পর্ক বাসা থেকে মেনে নিতো না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম পালাবো। রাকিবও রাজি৷ আকদের আগের রাতে বাসা থেকে কোনোমতে নিজেকে সবার আড়াল করে বের হলাম। রাত দেড়টা থেকে সোয়া চারটা পর্যন্ত এলাকার মেইন রোডে বোরকা পড়ে রাকিবের অপেক্ষা করেছি৷ একের পর এক কল করেছি৷ নীরবে চোখের পানি ফেলেছি। ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসছিলো,
– আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে এই মূহূর্ত্বে সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না৷ অনুগ্রহপূর্বক আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।
সেদিন রাতে এই একটা কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো৷ রাতটা অনেক বড় ছিলো। আমার জীবনে কাটানো সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত। স্বপ্ন ভাঙার রাত৷ প্রেমিকের মাঝে প্রতারক খুঁজে পাওয়ার রাত। সে রাতের অনুভূতিগুলো আসলে আমি কাওকে বলে বুঝাতে পারবো না। দূর থেকে খুব ধীর শব্দে ফজরের আজান শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম ভোর হয়ে গেছে৷ আলো ফুটে উঠার সময় হয়ে আসছে৷ এবার আমারও অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। সত্যিটা মেনে নেয়া উচিত। বাসায় আসার পর ঐ ছেলেটার জন্য একফোঁটা চোখের পানিও আমি ফেলিনি৷ কেনো ফেলবো? আমার চোখের পানি তো স্বস্তা না যে কোনো প্রতারকের জন্য ফেলে নষ্ট করবো। এরপর আর পড়ালেখা করিনি। আমি চাইনি ভার্সিটিতে ঐ প্রতারকটার সাথে আমার আবার দেখা হোক। আমি ওকে চিরতরে মন থেকে মুছে ফেলতে চাচ্ছিলাম৷ এবং আমি পেরেছিও৷ ঘোরটা কেটে গিয়েছিলো৷ তাই পেরেছি। সোফায় বসে টিভি দেখছে আজাদ। ছবিটা হাতে নিয়ে ওর পাশে বসলাম৷ ছবিটা ওর দিকে এগিয়ে বললাম,
– আবিদের ঘর থেকে বই এনেছিলাম। ছবিটা বইয়ে পেয়েছি৷ কোথায় রাখবো এটা? বইয়ের ভাঁজেই রেখে দিবো নাকি এ্যালবামে রাখবো? আজাদ হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিলো৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– এ্যালবামে রেখে দাও৷ বইয়ের ভাঁজে থাকলে হারিয়ে যেতে পারে।
– ঠিকাছে।
-…….।
– আচ্ছা, এই ছেলেটা কে? আবিদের পাশে?
– আবিদের স্কুল ফ্রেন্ড রাকিব। খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো ওদের৷ ইন্টার পর্যন্ত একি কলেজে পড়েছে৷ এরপর তো আবিদকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিলাম স্টুডেন্ট ভিসায়৷ আর রাকিব থেকে গেলো বাংলাদেশে৷ তবু ওদের মাঝে যোগাযোগ ছিলো।
– ছিলো? এখন আর নেই?
– থাকবে কি করে। রাকিব তো মারা গেছে বহু বছর হলো।
আজাদের শেষ কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কথাটা বুঝা দরকার। আবার জিজ্ঞেস করলাম,
– কে মারা গেছে?
– রাকিব৷ এই যে ছবির ছেলেটা।
– কবে?
– আমাদের বিয়ে যেদিন হলো সেদিন রাত দশটায়৷ মনে আছে তোমার আমি যে সারারাত বাহিরে ছিলাম? ওরই বাসার ওখানে ছিলাম। লাশ দাফন করে ভোরে ফিরেছিলাম। আগেরদিন রাত সাড়ে বারোটায় ছেলেটা বাইক এক্সিডেন্ট করলো৷ পরদিন রাত দশটায় মারা গেলো৷ শুনেছি কোন মেয়েকে নাকি ভালোবাসতো৷ জ্ঞান ফেরার পর থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত নাকি একটা কথাই বারবার বন্ধুদের বলেছে ওর খবর যেনো কোনোভাবেই ঐ মেয়ের কানে না পৌঁছায়৷ মেয়েটার নাকি বিয়ে ঠিক ছিলো। রাকিব চাচ্ছিলো মেয়েটার ঐ জায়গাতে বিয়ে হয়ে যাক৷ রাকিবের ঐ কন্ডিশন শুনলে ঐ মেয়ে কখনোই অন্য ছেলেকে বিয়ে করবে না।
– ছেলেটা এমন করলো কেনো? ও কেনো চাচ্ছিলো ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে?
– তা তো আমি জানি না৷ হয়তোবা ও বুঝতে পেরেছিলো জীবনের শেষ মূহুর্ত চলে এসেছে৷ হয়তোবা ও চাচ্ছিলো মেয়েটা যেনো রাকিবকে মনে আগলে রেখে আজীবন কষ্ট না ভুগে। অন্য কারো সাথে যেনো সুখী হয়।
– সুখী…… ওর প্রেমিকা খুব সুখে আছে আজাদ।
– চিনো নাকি ওর প্রেমিকাকে?
– নাহ্৷ চিনি না।
– তাহলে বললে যে?
– এমনিই…… ছাদে কাপড় আছে৷ আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। নিয়ে আসি।
আকাশের তারাগুলো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে৷ ঝড়ো হাওয়া বইছে। বৈশাখ মাসের ঝড়৷ রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রাকিবকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। রাকিব…. যে মানুষটাকে আমি সাতবছর আগে ভুলে গিয়েছিলাম। অনুভব করা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
– ঝড় আসছে৷ তুমি এখানে কি করো? জলদি কাপড় নাও৷
– হুম নিচ্ছি।
– তুমি কাঁদছো কেনো?
– কই কাঁদলাম?
– কই কাঁদলাম মানে? আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি কাঁদছো।
– কাঁদছি না। চোখে বালু ঢুকেছে।
– ঢুকবেই তো৷ ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো। বালু ঢুকবে না তো কি ঢুকবে?
-…….
– কি যে করো না বাচ্চাদের মতো? জলদি বাসায় যাও৷ চোখে পানির ছিটা দাও। যাও।
– কাপড়গুলো নিয়ে নেই?
– তোমার চোখের পানি আমার সহ্য হয়না। এবার তুমি কান্না করো আর বালু ঢুকুক। যেভাবেই চোখ থেকে পানি আসুক না কেনো আমার সহ্য হয়না৷ কাপড় আমি নিচ্ছি। তুমি যাও।
রাকিব, শুনতে পাচ্ছো আমার মনের কথাগুলো? তোমার প্রেমিকা সুখে আছে৷ খুব সুখে আছে৷ তোমার প্রেমিকার স্বামী তোমার প্রেমিকাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে৷ সে তোমার মতো প্রতারক না৷ সে কখনো আমাকে না বলে কোথাও যায় না। তুমি তো প্রতারক তাই আমাকে না বলেই চলে গিয়েছো। পুরো সাতটা বছর একটা মিথ্যার মাঝে ডুবিয়ে রেখেছো। যতবড় প্রতারক তোমায় আমি ভেবেছিলাম তুমি তার চেয়ে আরও বড় প্রতারক।