কাজী বিড়ম্বনা

কাজী বিড়ম্বনা

সিএনজির পেছনের সিটে আমি বসে আছি। আমার কোলে ভাগ্নী, আর পাশে আপু বসে আছে। হঠাৎ করে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আপু বলতেছিল। কিন্তু আমি যেতে চাই নাই। এসব অনুষ্ঠান আমার ভালো লাগে না। তারপরও যেতে হচ্ছে। না গিয়ে উপায় নেই। কোলে বসে থাকা ভাগ্নী আমার দিকে তাকিয়েই বেশ মিষ্টি একটা হাসি দিল। তারমানে রেড সিগন্যাল। কোনো অঘটন ঘটতে চলছে। আমি বেশ ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞাসা করলাম..

– মামা কি হইছে?
– আমি বাথরুমে যামু।

কথাটা শুনার পরই আমার মস্তিষ্কে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ভাগ্নী কে নিয়ে বাইরে কোথাও বের হই না ঠিক এই কারণে। শপিং করতে নিয়ে গেলে হঠাৎই বলে উঠে “মামা বাথরুমে যামু”। কোথাও ঘুরতে গেলে বলে মামা বাথরুমে যামু।” ঠিক এই কারণে প্রতিটা শপিং মল থেকে শুরু করে পাবলিক বাথরুম আমার জানাশোনা।
আমি ভাগ্নীর মুখের দিকে তাকালাম। ব্যাপারটা সিরিয়াস কি না বুঝা দরকার। যদি সিরিয়াস না হয় তাহলে আরেকটু এগিয়ে যাওয়া দরকার, এই রাস্তার মধ্যে হঠাৎ করে বাথরুম খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আর যদি সিরিয়াস হয়, তাহলে তো আর কি করার। এখানেই কোথাও কাজটা শেষ করতে হবে। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললাম..

– ভাই কোথাও বাথরুম পাওয়া যাবে?
– কেন ভাই?
– না, মানে আমার ভাগ্নীটা একটু হিসু করতে চাইছিল?
– এই চলন্ত গাড়িতে বাথরুম কোথায় পাবো?

ভাগ্নী কথা শুনেই বেশ খেপে গিয়ে বলল ” মামা আমি কিন্তু…. “শেষ করতে না দিয়ে নিজেই ড্রাইভারের পা হাতে ধরে বললাম।” ও ভাই এমন করেন কেন?

– তো কি করব?
– ভাই কোথাও কি বাথরুম নাই?
– দাঁড়াও, ওই সামনেই গ্যাসের পাম্প আছে। ওইখানে বাথরুম পাওয়া যাবে।
– বাঁচাইলেন ভাই।

সফাত উল্লাহ্‌ সিএনজি ষ্টেশনে এসে কাজটা সারতে হল। ভাগ্নী গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল “কি দুর্গন্ধ! মামা এসব জায়গায় কি বাথরুম করা যায়।” আমি বেশ হতাশ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিছু বলতে পারি নাই। বিয়ের সেন্টারে এসে বেশ অবাক হয়েছি। এত আধুনিক যুগের ছোঁয়ায় এসে এরকম একটা সাধারণ বিয়ে দেখব সেটা ভাবতে পারিনি। কোনো ক্যামেরাম্যান নাই, কেউ মুখ বাঁকিয়ে সেল্ফি তুলছে না। এটা দেখার পর মনের ভেতরে বেশ সুন্দর একটা স্বপ্ন তৈরি করলাম। যে আমিও বিয়ে করব, ঠিক এইভাবে। যেখানে থাকবে না কোনো ক্যামেরাম্যান, না কোনো সাজগোজ।

বেশ সুন্দর করে নিজের বিয়ের আয়োজনটা কল্পনা করতেছিলাম। আহা, কি সুন্দর। আমার কল্পনার মধ্যেই কেউ একজন বেশ উচ্চস্বরে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করা শুরু করল। আমি তড়িঘড়ি করে চেয়ার থেকে উঠে বরের দিকে এগিয়ে গেলাম। কেননা ওখান থেকেই ডাকতেছে। উপস্থিত বর আর মঞ্চ জনতার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম..”আমাকে ডাকিতেছিলেন? “কয়েকজন তখন বলল” এই তো কাজী সাহেব চলে এসেছেন। চলুন বিয়ে পড়া শুরু করুন।”আমি হতভম্ব হয়ে তাদের দিকে তাকালাম। এরা এসব বলে কি? কে কাজী? তখনি আরেকজন বলল ” কাজী সাহেবের খাতা কলম কোথায়?”আরেকজন বলে উঠল..” উনি তো আমার ছেলের কাছে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। আমার ছেলে আমার কাছে দিয়ে গেছে। এই যে!”

ভদ্রলোক খাতা কলম আমার হাতে দিয়ে দিলেন। আমি এখনো হতভম্ব। কোনো কিছু মস্তিষ্কে ঢুকতেছে না। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? একজন বয়স্ক লোক বলে উঠেলন” কাজী সাহেব শুরু করুন।” নিজের পোশাকের দিকে তাকালাম। বিয়েতে যাবো বলে পাঞ্জাবী পড়েছিলাম। মাথার চুল গুলো বেশি পরে যাওয়ার জন্য মাথায় টুপিটা পড়েছিলাম। যাতে হাটতে গিয়ে শরীরের মধ্যে চুল না পড়ে। এখন দেখছি এই পোশাক গুলোই আমাকে ডাইরেক্ট কাজী সাহেবে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। বিয়ের মঞ্চ জনতার একজন বেশ রাগান্বিত হয়ে বলল” এই শালার ব্যাটা কাজী, বিয়ে পড়াবি না গণধোলাই খাবি.”

মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হল না। আমি নিরুপায় হয়ে খাতা কলম নিয়ে বসলাম। খাতা উল্টিয়ে অন্য বিয়ের কাগজ একবার দেখে নিলাম কিভাবে কি লিখতে হবে। সবকিছু লিখে বরের দিকে তাকিয়ে বললাম “বল বাবা কবুল?”

বর আমার কথাটা শেষ করার আগেই উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে পাঁচ ছয় বার বলল কবুল, কবুল। বরের রিয়েকশন দেখে আমি হতভম্ব। চলে গেলাম মেয়ে পক্ষের রায় শুনার জন্য। ঠিক একই ভাবে মেয়েটা কেও বললাম “বল মা কবুল?” কিন্তু উত্তর নেই। আমি আবারও বললাম,, এবারও কোনো উত্তর নেই। আমার পাশেই মেয়ের বাবা দাঁড়িয়ে। উনি বললেন “আলহামদুলিল্লাহ্‌ মেয়ে কবুল বলেছে।”আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম “মেয়ে তো কবুল বলেনি। আমি শুনিনি।”

মেয়ের বাবা আমার দিকে বেশ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন। এইদিকে আবার আমার আরেক সমস্যা কোনো মেয়ের কথা আমি শুনতে ও পাইনা, বুঝতেও পারিনা। যেন মেয়েদের কণ্ঠস্বর আমার কান অব্ধি যায়না। এই সমস্যাটা বেশ কয়েকবছর ধরেই আমাকে বেশ পেইন দিচ্ছে। আমার এখনো মনে আছে ভার্সিটি ফার্স্ট যখন এক রিটেক দেয়া বড় আপু এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। তোমার নাম কি? কিন্তু আমি উত্তর দিয়েছিলাম আমি বিবিএ। সেই থেকেই শুরু হয়েছিল উল্টাপাল্টা শুনা। কোনো মেয়ে কথা বললেই আমি শুনতে পেতাম না। আর শুনলেও উল্ট শুনতাম। শুধু আমার পরিচিত যারা তাদের কথা গুলো বুঝতে পারতাম।

আমি আবারও মেয়েকে বললাম “বল মা কবুল?” মেয়ের চাচা এবার বলল ” আলহামদুলিল্লাহ্‌ কবুল বলেছে।” আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম। “কিন্তু আমি তো শুনতে পাইনি। মেয়ের মনে হয় বিয়েতে মত নেই।”এবার কনের বাবা আমার দিকে তাকালেন। “ওই ব্যাটা বয়রা কাজী, চুপ থাক। হারামজাদা কানে কম শুনে আর আসছে বিয়ে পড়াতে।”আমি বেশ আহত দৃষ্টিতে তাকালাম। বেশ কষ্ট পেয়েছি। ইমোশনাল রিয়েকশন দিয়ে বিয়ে পড়ানি শেষ করলাম।কিন্তু সত্য বলছি আমি কনের কবুল বলাটা শুনিনি। খাতা কলম বন্ধ করে আমি বরের সাথে বসলাম খাওয়ার জন্য। আজ এই পোশাকের জন্য আমাকে কতকিছু করতে হচ্ছে। আর এই নামটার জন্য। এইবার এই নামটা আমি চেঞ্জ করেই ছাড়ব।

রোষ্টের অংশটা হাতে নিতেই বর আমার হাত থেকে রোষ্টের টুকরাটা কেড়ে নিল। আমি অসহায় দৃষ্টিতে এইবার বরের দিকে তাকালাম। সবকিছু মেনে নেয়া যায় কিন্তু এই রোষ্টের ভাগ কাউকে দেয়া সম্ভব না। আমি বরের হাত থেকে রোষ্টের টুকরাটা কেড়ে নিলাম। এবার বড় আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। সামনে থাকা প্লেট আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলল। সবাই এখন বরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়ের বাবা এসে বললেন “বাবা কি হয়েছে? ”
বর বলল.” আমাকে মুরগির পশ্চাদ্ভাগের অংশ দিয়েছে। আমি খাবো না। ” ওই শালার ব্যাটা কাজী তর রোষ্টের টুকরা দে। দে বলছি।” আমি রোষ্টের অংশটা বাম পায়ের তলা চাটিয়ে বরের হাতে দিয়ে দিলাম। বর বেশ আগ্রহভরে রোষ্টে খামড় দিচ্ছে। আমি রোষ্টের আশা ছেড়ে দিয়ে ডাল দিয়ে সবুর করে খেয়ে নিলাম।

খাওয়া শেষ হতেই মেয়ের বাপ এসে আমাকে বললেন “বয়রা কাজী এই নেন” বলেই আমার হাতে গুঁজে দিলেন। কি গুঁজে দিলেন সেটা না দেখে পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। ছেলের চাচা এসে ও হাতে গুঁজে দিলেন। এতকিছুর পর এই গুঁজে দেয়া দেখে সব কষ্ট যেন মাটির সাথে মিশে গেল। যাক, যাই হউক ফল তো একটা পেয়েছি। সেন্টারের বাইরে এসে পকেটে হাত দিয়ে গুঁজে দেয়া নোট গুলো বের করলাম। আহা, ৫০০ টাকার দুটো চকচকে নোট। আমিতো শিহরিত। এই কাজটা যদি সবসময় করা যেতো তাহলে তো পকেট খরচটা হয়ে যেতো। তখনি ভাগ্নীটা এসে সামনে দাঁড়াল। “মামা, আমার বিয়েটা আরো ধুমধাম করে হবে। কিন্তু এখন আমি বাথরুমে যামু!”  আমি অসহায় দৃষ্টিতে ভাগ্নীর দিকে তাকালাম। এখন বাথরুম গিয়ে খুঁজতে হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত