বালতাসারের অদ্ভুত বিকেল

বালতাসারের অদ্ভুত বিকেল

খাঁচা বানানো শেষ হয়েছে। বালতাসার অভ্যাসবসে খাঁচাটা ছাদের কিনারায় ঝুলিয়ে দিল। এরপর সে দুপুরের খাবার খেতে বসল। খাওয়া শেষ হলে শুনল লোকজন বলাবলি করছে, বাহ্ কী সুন্দর পাখির খাঁচা! এমন তো দেখি নি! পৃথিবীর সেরা খাঁচা এটি! দলে দলে লোকজন তার বাড়ির সামনে ভিড় জমাল। উদ্দেশ্য একটাই, বালতাসার যে খাঁচাটা বানিয়েছে—তা সচক্ষে দেখা। সুতরাং বালতাসারকে খাঁচাটা ভালো করে দেখানোর জন্য এটাকে ছাদের কিনারা থেকে নামাতে হলো এবং ওর ছুতার মিস্ত্রির দোকানটা বন্ধ করতে হলো।

‘তোমার দাড়ি কামাতে হবে।’, বউ উরশুলা বলল। ‘তোমাকে দেখতে দাড়িওলা কাপুচিন বানরের মতো লাগছে।’

‘দুপুরে খাওয়ার পর দাড়ি গোফ কামানো ঠিক নয়। অমঙ্গল হয়।’ বালতাসার বলল।

ওর মাথায় খচ্চরের কেশরের মতো দুই সপ্তাহের ছোট খরখরে শক্ত চুল। চোখ দুটোতে ভয় পাওয়া বালকের অভিব্যক্তি। তবে এই অভিব্যক্তিটা যথার্থ নয়। এই ফেব্রুয়ারিতে ওর বয়স হয়েছে তিরিশ। ও উরশুলাকে বিয়ে না করে, বাচ্চা না নিয়েই তার সাথে চার বছর সংসার করছে। জীবনটা ওকে সব সময় সদা সতর্ক থাকার এবং ভয় না পাওয়ার শিক্ষা দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, এই যে ও লোকজনের জন্য খাঁচা তৈরি করে এবং সেগুলো পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর খাঁচা—এ সম্পর্কে ও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নয়। ও ছোটবেলা থেকে খাঁচা বানিয়ে অভ্যস্ত। তাই অন্যদের চেয়ে ভালো কিছু বানানো ওর জন্য বিশেষ কোনো বিষয় না।

‘তাহলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও।’ উরশুলা বলল। ‘ওই দাড়ি মুখ তুমি কাউকে দেখাতে পারবে না।’

দোল-বিছানা অর্থাৎ হ্যামোকে শুয়ে বিশ্রাম নেবার সময়, ওকে অনেকবার খাঁচাটা দেখানোর জন্য নেমে আসতে হলো। তখন পর্যন্ত উরশুলা জিনিসটার প্রতি অল্পই মনোযোগ দিয়েছে। তার স্বামী ছুতার মিস্ত্রির দোকানের কাজ অবহেলা করে, অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে এই খাঁচা বানিয়েছে—এজন্য সে বিরক্ত। গত দু সপ্তাহ রাতের বেলায় বলা যায় ভালো করে তার স্বামী ঘুমায় নি। ঘুমের মধ্যে এপাশ-ওপাশ করেছে। অসংলগ্নভাবে বিড়বিড় করেছে। এমনকি দাড়ি কামাইয়ের কথা তার মাথায়ই আসে নি। কিন্তু খাঁচাটা তৈরি হতেই উরশুলার সমস্ত বিরক্তি উধাও।

বিগত যৌবনা রূপসী নারীর মতো ডাক্তারের শরীরে মসৃণ আর কমনীয় মেদের আভাস।
বালতাসার তন্দ্রা থেকে জেগে উঠলে উরশুলা তড়িঘড়ি করে প্যান্ট আর শার্ট ইস্ত্রি করে দিল। ওগুলো হ্যামোকের কাছে একটা চেয়ারে রাখল। খাঁচাটা খাবারের টেবিলের কাছে নিয়ে এল। এসবই সে নীরবে করছে।

‘তুমি খাঁচাটার দাম কত নেবে?’ সে জিজ্ঞেস করল।

‘আমি জানি না।’ বালতাসার উত্তর দিল। ‘ওরা যদি আমাকে কুড়ি পেসো দেয়, তবে আমি তিরিশ চাইব।’

‘পঞ্চাশ চেয়ো।’ উরশুলা বলল। ‘এই কয় সপ্তাহে তোমার অনেক ঘুম খোয়া গেছে। এছাড়া জিনিসটা আকারেও বড়। আমি মনে করি, আমার জীবনে দেখা এটা সবচেয়ে বড় খাঁচা।

বালতাসার দাড়ি কামানো শুরু করল।

‘তোমার কি মনে হয়, ওরা আমাকে পঞ্চাশ পেসো দেবে?’

‘ওটা চেপে মন্তিয়েলের জন্য কিছুই না। আর খাঁচাটার দাম এমনই হবে।’ উরশুলা বলল। ‘তোমার বরং ষাট চাওয়া উচিত।’

ওদের বাড়িটা ভ্যাপসা, দমবন্ধ করা ছায়ায় তৈরি করা হয়েছিল। এখন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। গরমটা ঘুর্ঘুরে পোকার একঘেয়ে তারস্বরে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বালতাসারের কাপড়-চোপড় পরা হয়ে গেলে, ও উঠোনের দিকের দরজা খুলে দিল যাতে বাড়ির ভিতর হাওয়া ঢুকে একটু শীতল হয়। সঙ্গে সঙ্গে একদঙ্গল ছেলেমেয়ে হুড়মুড়িয়ে ওদের খাবার ঘরে ঢুকল।

খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ড. অক্তাভিও জিরাল্দো একজন বুড়ো ডাক্তার। উনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আজ তিনি তার পঙ্গু স্ত্রীর সাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় বালতাসারের খাঁচাটা সম্পর্কে ভাবলেন। তাদের বাড়ির ভিতরের বারান্দায় গরমের কারণে একটা টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলের ওপর কতগুলো ছোটছোট ফুলের টব রাখা। আর আছে দুটো ক্যানারি পাখি সমেত খাঁচা। উনার স্ত্রী পাখিগুলোকে খুব ভালোবাসেন। এতটাই ভালোবাসেন যে, ঘরের বিড়ালটাকে রীতিমতো ঘৃণা করতে শুরু করেছেন। কারণ বিড়ালটা হয়তো যে কোনো সময় মুফতে পেয়ে পাখি দুটোকে গায়েব করে দিতে পারে। বউয়ের কথা ভেবে ড. জিরাল্দো সন্ধ্যায় রোগী দেখে ফিরে আসার সময় বালতাসারের বাড়িতে পা দিলেন। উদ্দেশ্য বিখ্যাত খাঁচাটা সরেজমিনে দেখা।

খাবারের ঘরে অনেক লোকের ভিড়। খাঁচাটা টেবিলে প্রদর্শিত হচ্ছে। তিন তলা খাঁচার মাথায় গুনা দিয়ে বিশাল এক গম্বুজ বানানো হয়েছে। ভিতরে পাখির যাতায়াতের পথসহ খাবার ঘর, শোবার ঘর, এমনকি চিত্তবিনোদনের জন্য দোল খাওয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত আছে। দেখে মনে হবে, এটা যেন বিশাল বরফ কারখানার ছোটখাটো নকশা। ডাক্তার খুব সাবধানে কোনো প্রকার স্পর্শ ছাড়াই খাঁচাটা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করলেন। ভাবলেন সুনামের তুলনায় এটা শক্তপোক্ত; আর এটার যে ভুবন ভোলানো সৌন্দর্য তিনি দেখতে পাচ্ছেন—তা স্বপ্নেও ভাবেন নি।

‘কল্পনারা দেখি ডানা মেলেছে।’ উনি খুশি হয়ে বললেন। এরপর উনি ভিড়ের মধ্য থেকে বালতাসারকে খুঁজে বের করলেন। ওর দিকে সাবধানী চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার বিরাট কোনো স্থপতি হওয়া উচিত ছিল।’

বালতাসার লজ্জায় রাঙা হলো।

‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জনাব।’

‘কথাটা কিন্তু আমি মিথ্যে বলি নি,’ ডাক্তার সাহেব বললেন। বালতাসার তার দিকে তাকাল। বিগত যৌবনা রূপসী নারীর মতো ডাক্তারের শরীরে মসৃণ আর কমনীয় মেদের আভাস। আর হাতদুটোও বেশ সুঢৌল। উনার শান্ত, সৌম্য কণ্ঠস্বর শুনে যেন ভ্রম হয়—কোনো লাতিন যাজক কথা বলছেন। ‘এমনকি তোমার এই খাঁচায় কোনো পাখি রাখারও দরকার নেই।’ উনি দর্শনার্থীদের সামনে ঘুরে এমনভাবে বললেন, যেন ওটা নিলামে উঠছে। ‘এটাকে কোনো গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিলেই চলবে; তাতেই এটা গান গাইতে শুরু করে দেবে।’ এরপর খাঁচাটা টেবিলে ফেরত নিয়ে, কি একটু যেন ভেবে বললেন :

‘যাক্, আমি তাহলে এটাকে নিয়ে নিচ্ছি।’

‘ওটা বিক্রি হয়ে গেছে।’ উরশুলা বলল।

‘এটার মালিক সেনোর চেপে মন্তিয়েলের ছেলে।’ বালতাসার বলল। ‘সে বিশেষভাবে এটার ফরমায়েশ দিয়েছে।’

ডাক্তার সাহেব আচরণে সম্ভ্রমভাব বজায় রেখেছেন। ‘তুমি কি তাকে এই খাঁচাটার নকশা দিয়েছ?’

‘না।’ বালতাসার বলল। ‘ছেলেটা অনুরোধ করছে, তার একজোড়া ত্রৌপিয়াল পাখির জন্য একটা বড়সড় খাঁচা বানিয়ে দিতে।’

ডাক্তার খাঁচার দিকে তাকালেন।

‘কিন্তু এটা ত্রৌপিয়ালের জন্য নয়।’

‘অবশ্যই ডাক্তার সাহেব, এটা ত্রৌপিয়ালের জন্য।’ টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে বালতাসার বলল। তার পাশে বাচ্চাকাচ্চার দল। ‘সেজন্য মাপ-জোকগুলোর হিসাব সাবধানে কষেছি।’ খাঁচার ভিতরে বিভিন্ন খোপের দিকে তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে, ও বলল। এরপর আঙুলের গিঁট দিয়ে খাঁচার গম্বুজে আঘাত করল। খাঁচাটা ঝনঝন ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে ভরে গেল।

‘এই গুনাগুলোর মতো মজবুত আর কোনটি পাবেন না ডাক্তার সাহেব। গিঁটগুলো বাইরে আর ভিতর থেকে ঝালাই করে দেয়া।’ ও বলল।

‘এইটা তোতাপাখির জন্যও যথেষ্ট বড়।’ একজন বাচ্চা মাঝখান থেকে বলে উঠল।

‘তাইই হবে,’ বালতাসার বলল।

ডাক্তার তার মাথাটা ঘুরালেন।

‘বেশ। কিন্তু চেপে মন্তিয়েলের ছেলে তোমায় নকশাটা দেয় নি।’ তিনি বললেন। ‘খাঁচায় কী কী থাকবে—তাও তোমাকে বলে নি। শুধু বলেছে, তার ত্রৌপিয়ালগুলোর জন্য একটা বড়সড় খাঁচা লাগবে। কি, ঠিক বলেছি না?’

‘জি, ঠিক বলেছেন।’ বালতাসার বলল।

‘তাহলে কোনো সমস্যাই নেই।’ ডাক্তার সাহেব বললেন। ‘এমনিতে ত্রৌপিয়ালগুলোর জন্য খাঁচা জিনিসটাই বড়। এখন বিষয় হলো এই খাঁচা। কোনো প্রমাণ নেই যে, এই খাঁচাটাই সে তোমাকে বানাতে বলেছিল।’

‘এটাই সে-খাঁচা।’ বালতাসার যেন কিছুটা বিভ্রান্ত। ‘তার জন্যই তো আমি এটা বানিয়েছি।’ ডাক্তারের চোখেমুখে অধৈর্যের প্রকাশ।

‘তুমি আরেকটি বানাতে পারতে।’ উরশুলা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল। এরপর ডাক্তার সাহেবের দিকে ঘুরে বলল, ‘আপনার কোনো তাড়া নেই, ঠিক না?’

‘আমি আজ বিকেলে, আমার স্ত্রীর কাছে প্রতীজ্ঞা করেছি।’ ডাক্তার বললেন।

‘আমি খুবই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব।’ বালতাসার বলল। ‘কিন্তু যে জিনিস বিক্রি হয়ে গেছে, তা আমি আপনার কাছে বিক্রি করতে পারি না।’

ডাক্তার সাহেব কাঁধটা ঝাঁকালেন। রুমাল দিয়ে গলার ঘাম মুছে, খাঁচাটার দিকে নীরবে এমনভাবে তাকালেন যেন কোনো জাহাজ তাকে রেখে গভীর সমুদ্রে পাড়ি জমাতে যাচ্ছে।

‘এর জন্য সেনোর মন্তিয়েল তোমাদের কত টাকা দিয়েছে?’

বালতাসার উত্তর না দিয়ে উরশুলার দিকে তাকাল।

‘ষাট পেসো।’ সে বলল।

ডাক্তার সাহেব খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ‘খুব সুন্দর, এটি।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘অতি সুন্দর!’ এরপর দরজার দিকে ফিরে নিজেকে চাঙা করার জন্য ঘটনাটা চিরতরে ভুলে যাবার মনস্থ করে স্মিত হেসে বললেন :

‘মন্তিয়েল সত্যিই অনেক ধনী।’

বালতাসার খাঁচাসহ একটা অনিশ্চিত ভাব নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর সে কুকুরের গজরানির মতো গরগর আওয়াজ তুলল।
প্রকৃত সত্যটা হলো—হোসে মন্তিয়েলকে যতটা ধনী দেখায়, অতটা সে নয়। কিন্তু সেটা দেখানোর জন্য, যা যা করার দরকার তা সে করতে পারে। এখান থেকে কয়েকটা বাড়ি পরে, নানা যন্ত্রপাতি আর সরঞ্জামে ঠাসা একটা বাড়ি আছে—যাতে এমন কোনো জিনিস পাওয়া যাবে না—যেটার গন্ধ শুঁকলে মনে হবে এটা নতুন নয়, বিক্রি করা যাবে না। মন্তিয়েল খাঁচার খবর শুনে নির্বিকার হয়ে রইল। তার স্ত্রী দুপুরে খাওয়ার পর মৃত্যুর ভয়ে আধমরা হয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে টানা দুঘণ্টা ঘরের আঁধারের দিকে তাকিয়ে কাটায়। স্বামী হোসে মন্তিয়েল ততক্ষণে সিয়েস্তা বা দিবানিদ্রা সেরে নেয়। আজ বিকেলে বাড়ির বাইরে লোকজনের হৈচৈ তাকে অবাক করে। বসার ঘরের দরজা খুলে দেখে—তার বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড়। আর বালতাসার সে ভিড়ের মধ্যমণি। সে বেশ গোঁফ কামিয়ে সাদা পোশাক পরে একটা অমায়িক হাসি মুখে ছড়িয়ে রেখেছে। দরিদ্ররা যেভাবে বড়লোকের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়, অনেকটা সেভাবে।

‘বাহ্, বেশ অদ্ভুত তো জিনিসটা!’ হোসে মন্তিয়েলের স্ত্রীর এমন দীপ্তি ছড়ানো অভিব্যক্তি বালতাসারকে বাড়ির ভিতরে পথ দেখাল। ‘আমি আমার জীবনে এমন জিনিস দেখি নি।’ সে বলল। এরপর দরজার সামনে লোকজনের উপচে পড়া ভিড় দেখে বলল :

‘কিন্তু ওটাকে ভিতরে আনো। বসার ঘরটাকে ওরা বাজার বানিয়ে ফেলবে।’

বালতাসার হোসে মন্তিয়েলের বাড়িতে অপরিচিত কেউ নয়। বিভিন্ন উৎসব পার্বণে তার দক্ষতা আর অতিদ্রুত ছুতোরের কাজ করার কারণে তাকে এ বাড়িতে ডাকা হয়। কিন্তু ও বড়লোকের মাঝে খুব একটা আরাম বোধ করে না। বড়লোক সম্পর্কে ওর ধারণা হলো, ওদের বউরা কুৎসিত আর ঝগড়াটে। ওদের দেহে অস্ত্রোপচার হয়। বলা যায়, ওদের প্রতি বালতাসার বেশ করুণা বোধ করে। তাই ওদের বাড়িতে যখন সে প্রবেশ করে। তখন ওর পায়ের গতি মন্থর হয়, পা না ছেচড়ে হাঁটতে পারে না।

‘পেপে বাড়ি আছে?’ বালতাসার মন্তিয়েলের ছেলের কথা জিজ্ঞেস করে খাবারের ঘরের টেবিলের ওপর খাঁচাটা রাখল।

‘ও এখন স্কুলে।’ হোসে মন্তিয়েলের বউ বলল। ‘তবে ও বেশিক্ষণ সেখানে থাকবে না। আর মন্তিয়েল গোসল করছে।’

বাস্তবে হোসে মন্তিয়েলের গোসল করার অত সময় ছিল না। সে শরীরে অতি জরুরি অ্যালকোহল ঘসে নিচ্ছিল। কী ঘটছে—তা দেখতে সে শোবার ঘরের বাইরে এল। মন্তিয়েল এত সাবধানী লোক যে, ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা পর্যন্ত ছেড়ে শোয় নি যাতে বাইরে কোনো কোলাহল হলে সহজেই শুনতে পায়।

‘আদেলাইদে!’ সে চিৎকার করে বলল। ‘কী হচ্ছে, কী?’

‘আসো। এসে দেখে যাও, কী অদ্ভুত জিনিস!’ তার বউ আনন্দে চিৎকার করে।

মোটকু আর লোমশ হোসে মন্তিয়েল গলায় তোয়ালে প্যাঁচিয়ে গোসলখানার জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল।

‘কী ওটা?’

‘আপনার ছেলে পেপের খাঁচা।’ বালতাসার বলল।

মন্তিয়েলের বউ ওর দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকালো।

‘কার বললে?’

‘পেপের,’ বালতাসারের সংক্ষিপ্ত উত্তর। এরপর হোসে মন্তিয়েলের দিকে ফিরে বলল, ‘পেপে এটাকে ফরমাশ দিয়েছে।’

তাৎক্ষণিকভাবে কিছু ঘটল না। কিন্তু বালতাসারের মনে হলো, কেউ বাথরুমের দরজাটা ওর মুখের ওপর খুলল। হোসে মন্তিয়েল অন্তর্বাস পরা অবস্থায় গোসলখানা থেকে বের হলো।

‘পেপে!’ সে চিৎকার করে ডাকল।

‘ও ফেরে নি।’ স্ত্রী ফিসফিস করে কাঠের পুতুলের মতো বলল।

দরজায় পেপের দেখা মিলল। বয়স প্রায় বারো। মায়ের মতো চেহারায় করুণভাব, আর চোখের পাপড়ি কোঁকড়ানো।

‘এখানে এসো।’ হোসে মন্তিয়েল বলল। ‘তুমি কি এটা ফরমাশ দিয়েছ?’

বাচ্চটা মাথা নোয়াল। চুলের মুঠি ধরে, হোসে মন্তিয়েল পেপেকে তার চোখের দিকে তাকাতে বাধ্য করল।

‘উত্তর দাও।’

বাচ্চাটি উত্তর না দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল।

‘মন্তিয়েল।’ বউ ফিসফিসিয়ে বলল।

হোসে মন্তিয়েল বাচ্চাটিকে ছেড়ে দিয়ে বালতাসারের দিকে ক্রোধে উন্মত্তভাবে তাকাল। ‘আমি দুঃখিত, বালতাসার! কিন্তু কাজটা করার আগে, তুমি আমার মতামত নিতে পারতে। তা না করে ছোট বাচ্চাটার সাথে চুক্তি করলে।’ এরপর সে খাঁচার দিকে না তাকিয়েই এটাকে তুলে বালতাসারকে দিয়ে দিল।

‘এখনি এটাকে নিয়ে যাও এবং যার কাছে পারো বিক্রি করে ফেল।’ সে রাগে গজগজ করছে। ‘সব কিছুর পরও, আমি তোমার কাছে অনুরোধ করব, এনিয়ে মিছে তর্ক করো না।’ সে বালতাসারের পিঠে হালকা চাপড় মেরে ব্যাখ্যা করল, ‘ডাক্তার আমাকে রাগ করতে নিষেধ করেছে, বুঝলে।’

বাচ্চাটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পাতা পড়ছে না। বালতাসার খাঁচাসহ একটা অনিশ্চিত ভাব নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর সে কুকুরের গজরানির মতো গরগর আওয়াজ তুলল। মেঝেতে আছড়ে পড়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল।

মন্তিয়েলের বউ যখন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, হোসে মন্তিয়েল বাচ্চাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ‘ওকে উঠাবে না, আদেলইাদে।’ সে রাগত স্বরে বলল। ‘মেঝেতে পড়ে আগে ওর মাথা ভাঙতে দাও। এরপর ওতে লবণ আর লেবুর রস ছিটিয়ে দিয়ে দেবো—যাতে ও সাধ মিটিয়ে তর্জন গর্জন করতে পারে। মন্তিয়েলের বউ বাচ্চাটার কবজি ধরে রেখেছে। আর সে চোখের জল ছাড়াই তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে।

‘ওকে একা থাকতে দাও,’ হোসে মন্তিয়েল বলল।

বালতাসারের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, যেন সে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কোনো প্রাণীর মৃত্যু দেখছে। এখন বিকেল প্রায় চারটা। এসময়ে ওর নিজের বাড়িতে উরশুলা পেঁয়াজ চাকচাক করে কাটছে আর পুরনো কোনো এক গানের সুর ভাঁজছে।

‘পেপে।’ বালতাসার বলল।

ও বাচ্চাটার দিকে মৃদু হেসে খাঁচা হাতে এগিয়ে গেল। বাচ্চাটা লাফিয়ে উঠে খাঁচাটা ধরল। ওটা প্রায় ওরই সমান। এরপর তারের সূক্ষ্ম কারুকার্যের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারছে না কী করবে? ওর চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই।

‘বালতাসার।’ হোসে মন্তিয়েল গলার সুর নামাল। ‘আমি তোমাকে আগেই বলেছি এটা নিয়ে যাও।’

‘ওনাকে ফেরত দাও।’ মন্তিয়েলের বউ বাচ্চাকে নির্দেশ দিলেন।

‘এটা রেখে দাও, সোনা।’ বালতাসার বলল। এরপর হোসে মন্তিয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল : ‘যাই হোক, আমি এটা ওর জন্য বানিয়েছি।’ হোসে মন্তিয়েল বালতাসারকে বসার ঘর পর্যন্ত অনুসরণ করল।

‘বোকামি করো না, বালতাসার।’ সে তার পথ রুদ্ধ করে বলল। ‘তোমার জিনিসটা বাড়ি নিয়ে যাও। মূর্খামি করো না। তোমাকে আমার এক সেন্টও দেয়ার ইচ্ছে নেই।’

‘কোনো ব্যাপার না,’ বালতাসার নির্বিকারভাবে বলে গেল। ‘আমি সম্পূর্ণভাবে এটা পেপের জন্য উপহার হিসেবে বানিয়েছি। এর বিনিময়ে কোনো অর্থকড়ি আশা করি না।’

বিষয়টা কাঁদার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এখন ওর মনে হচ্ছে—কারো কারো কাছে এটার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
বালতাসার দরজার সামনে ভিড় করা দর্শকদের মধ্য দিয়ে তার চলে যাওয়ার পথ করে নিল। হোসে মন্তিয়েল বসার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে চলেছে। তার মুখটা ফ্যাকাশে আর চোখ টকটকে লাল হতে শুরু করেছে।

‘আহাম্মক!’ ক্রোধে তার প্রায় মূর্ছা যাবার দশা। ‘তুই এখান থেকে তোর খেলনা নিয়ে যা! আমার বাড়ি থেকে, আমার অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো অর্ডার করতে পারে না। বেজন্মা কোথাকার!’

পুল হলে সবাই বালতাসারকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাল। একটু আগে পর্যন্ত, ও বিশ্বাস করেছিল—ও একটা ভালো খাঁচা তৈরি করেছে। এবং তা হোসে মন্তিয়েলের ছেলেকে দিয়ে এসেছে। তাই ও আর কাঁদবে না। বিষয়টা কাঁদার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এখন ওর মনে হচ্ছে—কারো কারো কাছে এটার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাই, ও একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল।

‘সুতরাং, চেপে মন্তিয়েল তোমাকে খাঁচার জন্য পঞ্চাশ পেসো দিয়ে দিল।’ কেউ একজন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল।

‘ষাট।’ বালতাসার বলল।

‘দশ পেসো তুমি গুণে পেয়েছ।’ ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল। ‘তুমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে চেপে মন্তিয়েলের কাছ থেকে এত টাকা আদায় করতে পারো। আমাদের আজ আনন্দ করতেই হবে।’

ওরা বালতাসারের জন্য বিয়ার নিয়ে এল। ও এক পাক ঘুরে সবাইকে ধন্যবাদ দিল। যেহেতু এই প্রথম মদ খেল; তাই সন্ধ্যার মধ্যেই সে পুরোপুরি মাতাল বনে গেল। আর সে একটা কল্পিত প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলছিল। সে হাজারটা খাঁচা বানাবে। প্রতিটার দাম হবে ষাট পেসো করে। এরপর দশ লাখ বানাবে। দাম হবে কোটি লাখ পেসো। ‘আমাদের ধনীরা মারা যাবার আগেই তাদের জন্য অনেক অনেক জিনিস বানাতে হবে।’ ও বদ্ধ মাতাল অবস্থায় বলল। ‘ওরা সবাই অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে। ওরা এত গুবলেট অবস্থায় আছে যে, ওদের রাগ করা পর্যন্ত নিষেধ।’ ও কোনো বাধা ছাড়াই জুকেবক্সের জন্য টাকা দিয়ে যাচ্ছিল। সকলেই বালতাসারের সুস্বাস্থ্য, সৌভাগ্য, এমনকি ধনীদের মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করে মদের গ্লাস ঠুকল। খাওয়ার সময় উপস্থিত হলে দেখা গেল, পুল হলে ওরা ওকে একাই রেখে চলে গেছে।

উরশুলা রাত আটটা পর্যন্ত পেঁয়াজের চাকতি দিয়ে সাজানো ভাজা মাংস নিয়ে অপেক্ষা করল। কেউ একজন এসে খবর দিল তার স্বামী পুল হলে অত্যধিক সুখে উন্মত্ত হয়ে আছে। সবাইকে বিয়ার কিনে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু উরশুলা বিশ্বাস করে নি। কারণ, বালতাসার কখনো মাতাল হয় নি। সে প্রায় মাঝরাতে বিছানায় গেল। এদিকে বালতাসার, আলো ঝলমলে যে ঘরে আছে, সেখানে ছোট ছোট টেবিল ঘিরে চারটা করে চেয়ার রাখা। আর বাইরের ডান্স ফ্লোরে টিট্টিভ পাখি হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওর মুখে মেয়েদের রুজ পাউডার লেগে আছে। এক পা-ও নড়তে পারছে না। ও বুঝে উঠতে পারছে না, এক বিছানায় দুই নারী নিয়ে ফুর্তি করা যায় কিনা। বালতাসার এখানে এতটা সময় থেকেছে যে—পরেরদিন টাকা দেবে এই প্রতীজ্ঞা করে ওকে ঘড়ি বন্ধক রাখতে হলো। মুহূর্তখানেক পরে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে সে বুঝতে পারল—জুতোটা কেউ নিয়ে গেছে। কিন্তু তাতেও সে ওর জীবনের সবচেয়ে সুখের স্বপ্নটা বাদ দিল না। বালতাসারের পাশ দিয়ে যে নারীগুলো ভোর পাঁচটার গির্জায় প্রার্থনায় যোগ দিতে যাচ্ছে, তারা ওর দিকে তাকাতে একটুও সাহস করল না। ভাবল, লোকটা মরে গেছে কিনা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত