অবন্তীকে বারবার বলেছি, এখন আমাদের সন্তান নেওয়ার উপযুক্ত সময় হয়নি। তবুও অবন্তী’র খুব শখ, মা হবে!
এখুনি মা হওয়ার কি আছে, মা হওয়ার জন্যে তো অনেক সময় পরেই আছে? অল্পবয়সী মেয়েদের এই একটা ফালতু সেন্টিমেন্ট, বিয়ের দুই এক বছরের মধ্যেই মা হওয়া চাই। বিরক্তিকর যতসব।
সেদিন অফিস থেকে বাসায় আসার পথে, বাসে’র জানালা দিয়ে খেয়াল করলাম, অবন্তী কুর্মিটোলা মেডিকেল থেকে বের হচ্ছে! অবন্তী অসুস্থ! কই আমাকে তো কিছুই বলেনি।
বাসায় গিয়ে, অবন্তী’র আসার অপেক্ষায় কিছুক্ষণ শুয়ে আছি। এমন সময় পাশের বাসার ভাবী এসে অবন্তীকে খোঁজ করল। আমি তাকে বললাম, “অবন্তী তো বাইরে গেছে, কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে”।
ভাবী বলল ” তা ভাই, কয়দিন পর বাবা হবেন। বউ কে একটু দেখে শুনে রাখবেন না?” প্রায় দেখি একা একা মেডিক্যাল যায়।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়া প্রকাশ না করেই, ভাবীকে সালাম দিয়ে বিদায় দিলাম।
কিন্তু, ভাবী’র কথা গুলো মাথায় ঘুরছে। প্রায় মেডিক্যাল যায় মানে? আর বাবা হবো, মানে কি?
তবে, অবন্তী আমার কাছে মা হওয়ার ব্যাপার টা চেপে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কোনোমতেই বাবা হতে চাইনি, হতে চাইও না।
আমাদের দুজন মানুষের চলতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে নতুন আর একটা মানুষ। তাছাড়া বাচ্চাদের খরচাদি একটু বেশিই হয়। অবন্তী কি আর এইগুলো বুঝবে।
অবন্তী বাসায় প্রবেশ করতেই বেশ জোরেশোরে একটা চড় মারলাম। চড় খেয়েই অবন্তী নিচে পরে গেলো।
ওকে উঠিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, সন্তানের কথা আমাকে বলো নাই কেনো?? সন্তান নেওয়ার সময় কি শেষ! এখুনি সন্তান নিতে হবে?
এমনিতে ব্যবসার অবস্থা ভালো না। এখন সন্তান নিলে, তাকে মানুষ কিভাবে করব? আমি আমার সন্তান কে উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ দিতে চাই। ভালো পরিবেশ দিতে চাই। সন্তান এখন লাগবেনা। পরে হবে। এখন এবোরশন করে নাও। চলো মেডিকেলে।
কথা গুলো বলতে বলতে অবন্তী’র দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম অবন্তী কান্না করছে! প্রচন্ড কান্না করছে।
হাউমাউ করে কান্না করছে।
অবন্তী আমার পায়ে ধরে বলল, প্লীজ শুভ্র, আমি মা হতে চাই। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি মা হওয়ার স্বপ্ন দেখি।
জানো, পুতুল খেলার সময় আমিই পুতুল গুলোর মা হতাম! পুতুলের যত্ন করতাম। গোসল করাতাম। মাঝেমধ্যে শুনতে পেতাম, পুতুল গুলো আমাকে আম্মু বলে ডাকছে।
প্লীজ শুভ্র_
আমার গর্ভে আমাদের সন্তান। এই সন্তান তো আমাদেরই।
আমি কাজ করব। পরিশ্রম করব। আমাদের সন্তানের কোনো অযত্ন হবেনা। প্লীজ!
আমি অবন্তী’র কোনো কথাই শুনলাম না। জোরপূর্বক অবন্তীকে নিয়ে তখনি একটা প্রাইভেট মেডিকেলে গেলাম। ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। আমরা চাচ্ছি, এবোরশন করাতে। কিন্তু ডাক্তার বলল, এবোরশন করার সময় শেষ। এখন আর এবোরশন করানো যাবেনা।
এই কথা শুনেই, প্রচন্ড রেগে গেলাম।
রাগান্বিত হয়ে, অবন্তীকে মেডিকেলে রেখেই চলে আসলাম। অস্বস্তিতে ক্লান্ত লাগছে। ভালো লাগছেনা। আমি বাসায় আসার কয়েক মিনিট পরেই অবন্তী বাসায় আসলো।
অবন্তী’র উপরে প্রচন্ড রাগ জমে আছে,
কোনো কথাই বলিনি। কথা বলতে ইচ্ছেও হচ্ছেনা। এবোরশন করাতে পারলে কতই না ভালো হতো! সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে সন্তান নিতে নেই, কি করব না করব! নানারকম চিন্তায় ডুবে যাচ্ছি। চিন্তায় চিন্তায় ঘুমিয়ে গেলাম।
দিন দিন ব্যবসায় দারুণ লাভ হচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে তো হচ্ছেই। ৪-৫ মাসের মধ্যেই আমাদের প্রায় সাত আট লাখ টাকা লাভ হলো। আমি কখনো কল্পনাও করিনি এতোটা লাভ হতে পারে।
দিন যাচ্ছে আমাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। শুরুতে, অবন্তী’র প্রতি অযত্ন করলেও একটা সময় যত্ন নেওয়া শুরু করি। অবন্তী’র প্রতি দায়িত্বশীল হচ্ছি। যত্ন করছি। অবন্তী’র গর্ভে আমাদের সন্তান। সন্তানের প্রতি একটা মায়া জন্ম নিচ্ছে। আলট্রাসনো করে জানতে পারি, আমাদের কন্যা সন্তান হবে।
বাবা’র প্রতি কন্যা সন্তানের আলাদা একটা ভালোবাসা কাজ করে, আমাকেও আমার মেয়ে অনেক ভালোবাসবে।
কতশত স্বপ্ন যে দেখতে শুরু করলাম। আমরা দুজনে আমাদের মেয়ের নাম রাখলাম ‘মেঘলা’।
দিন দিন ব্যবসা বড় হচ্ছে, প্রতিটা কাজেই সফল হচ্ছি। প্রতিটা কাজেই আকাশচুম্বী লাভ হচ্ছে।
দিন যেতে যেতে ডেলিভারি’র সময় হয়ে যায়। অবন্তীকে নিয়ে “মা ও শিশু” ক্লিনিকে ভর্তি করালাম। কয়েকদিনের মধ্যেই ডেলিভারি হবে। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছেই না।
অবশেষে ডেলিভারি’র হয়। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের দিকে তাকিয়ে আমি যেনো পৃথিবী’র সমস্ত সুখ খুঁজে পাই। প্রকৃত ভালোবাসা খুঁজে পাই।
কিন্তু, মেঘলা কান্না করছেনা, চোখ মেলে আমাকে দেখছেনা, সুখের হাসি হাসছেনা! আমাকে দেখবেইনা। অভিমান।
আমার উপর খুব অভিমান করেছে, মেঘলা’র অভিমান এতোটাই বেশি জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই আমার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে।
মেঘলা নেই আর! আমি মেঘলা’র মুখে কখনো আব্বু ডাক শুনতে পারবো না। অবন্তী আম্মু ডাক শুনতে পারবে না।
অবন্তী’র খুব শখ পূরণ হবেনা। অবন্তীকে আম্মু বলে ডাকবে না।
অবন্তী’র তো অনেক ইচ্ছে ছিলো। মা হবে! কিন্তু অবন্তী মা হওয়া সত্ত্বেও মা ডাক শুনবে না।
অবন্তী কি করে সহ্য করবে! অবন্তী’র যে খুব শখ, মেঘলা’র যত্ন নিবে। মেঘলাকে খুব আগলে রাখবে। মেঘলাকে ঘুম পারিয়ে দিবে। অবন্তী কিভাবে থাকবে, মেঘলাকে ছাড়া।
অবন্তীকে ডাকছি, অবন্তী ঘুমিয়েই আছে! অবন্তী উঠছেনা। অবন্তী, প্লীজ উঠো! আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকবো!
অবন্তী প্লীজ উঠো আমার কোনো টাকা পয়সা লাগবেনা। আমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইনা। তোমাদের চাই, তোমাদের নিয়েই এই অল্পদিনের পৃথিবীতে দিন কাটাতে চাই। সম্পদ হারিয়ে সম্পত্তি চাইনা।
অবন্তী উঠছেনা, অবন্তী চলে গেছে। অবন্তী আমাকে একা রেখে মেঘলা’র সাথে চলে গেছে। মেঘলা ও অবন্তী এক সাথে থাকবে। এক সাথেই সময় কাটাবে। আমি কখনো মেঘলা’র মুখে আব্বু ডাক না শুনলেও, প্রতিনিয়ত অবন্তী মেঘলা’র আম্মু ডাক ঠিক শুনবে।