লাল ব্যাগ

লাল ব্যাগ

রিক্সায় একটা অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে আর মধ্যবয়সী একজন পুরুষ উঠেছে।সাধারণত এই বয়সী পুরুষরা অন্য কিছু নিয়ে দরদাম না করলেও রিক্সা ভাড়া নিয়ে তরকারি কেনার মতো দর কষাকষি করে।এই ভদ্রলোক সেদিকের ধার দিয়েও গেলেন না।আড়চোখে খেয়াল করলাম, দুজনের মধ্যে বয়সের তফাৎ থাকলেও লোকটার আচরণে উল্টোটাই ফুটে উঠছে।মেয়েটা একদমই চুপচাপ।রিক্সায় ওঠার পর থেকে একটাও কথা বলে নি।তবে স্নেহের সম্পর্ক দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো।রাত নয়টারও বেশি বাজে।মেয়েটিকে কলেজ মোড়ে নামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, যেদিকে মন চায় সেদিকে চালাও।ভাড়া নিয়েচিন্তা করতে হবে না।

ভেবেছিলাম আজ হয়তো আর ভাড়া হবে না।এই লাইনে নতুন তো তাই ভাড়া চাইতে লজ্জা করে।কিন্তু লজ্জা করলে তো আর পেট চলবে না।সারাদিন রিক্সা চালিয়ে মাত্র ২৮০ টাকা হয়েছে।তবে এই ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে শেষটা একবারে মন্দ হবে না।তবে মনের ভিতরে খুঁতখু্ঁত করছে,কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।তাল-লয় মেলাতে পারছি না।এইমনে পড়ছে সাথে সাথেই ভুলে যাচ্ছি।গাড়ির সমুদ্র থেকে বের হয়ে বাইপাস ধরে চালাতে লাগলাম।-একটা গল্প শুনবেন?বয়সে তার থেকে আমি বেশ ছোট। কিন্তু তারপরও আপনি সম্বোধন শুনে বেশ অবাকই হলাম।শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছি।রিক্সা চালাতে চালাতে এই অবস্থায় কেউই চাইবে না গল্প শুনতে।তবে খদ্দের লক্ষী,তাই আর না করলাম না।

-জানেন,আমি ছোটবেলা থেকেই খুব দুর্ভাগা ছিলাম।আমার বাবা রিক্সাআলা ছিলেন।তবে আমার কখনো টাকা বা কোন কিছুর প্রয়োজন নিয়ে চিম্তা করা লাগে নি।কারণ আমার একটা ক্ষমতা ছিলো।আমি খুব সহজেই যেকোন কাজ করে টাকা জোগাড় করতে পারতাম।রিক্সা চালানো,­দিনমজুরী,কুলিগিরি সবকিছুই পারতাম।মা ছিল না।সদস্য বলতে একটা বার মাসের মধ্যে তের মাস অসুস্থ থাকা ১০ বছরের বোন আর বাবা।আমি পড়াশুনায় তেমন ভালো ছিলাম না,তবে পাশ করে যেতাম।৪-৫ বছর আগে হঠাৎ একদিন বাবা অসুস্থ হলেন।কাজ না করলে খাওয়া হবে না।তাই ঐ দিন আমি রিক্সা নিয়ে বের হয়েছিলাম।এই যে মোড়টা দেখছেন তার একটু সামনে থেকেই আমার রিক্সায় একটা ছেলে উঠেছিল।উসকোখুশকো উদ্ভ্রান্ত চেহারা।

সাথে একটা লাল ব্যাগ।ভাড়া মিটিয়ে ছেলেটা নেমে গেলেও ব্যাগটা ফেলে গিয়েছিল।পরে ব্যাগটা চোখে পড়তেই খুলে দেখলাম প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা আছে। আমি কখনো অত টাকা চোখে দেখি নি।অসুস্থ বোন আর বাবার পরিশ্রমে হাড় বের হওয়া চেহারা ভেসে উঠলো চোখের সামনে।ভাবলাম নীতি দিয়ে তো আর বাবা বা আদরের ছোট বোনটা সুস্থ হবে না।টাকা লাগবে।টাকার ব্যাগটা নিয়ে বাড়ি চলে গেলাম।তবে বাড়ি যেতে না যেতেই টাকার উপর ভাগিদার কমে গেলো।বাবাকে বাড়ির পিছনে কবর দিলাম।শেষবার চোখ বেয়ে পানির ফোটাও পড়েছিলো ওইদিন।লাল সেই ব্যাগ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করলাম।বোনের চিকিৎসাও করালাম।ধীরে ধীরে ব্যবসারও কিছুটা উন্নতি হয়েছে এই ২-৩ বছরে।কিন্তু কোথায় জানি শূণ্যতা।বোনটা এখন কথা বলতে পারে না।বিয়ে করেছিলাম।কিন্তু গত বছর কার এ্যাকসিডেন্টে সে চলে গেল।আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন ও চলে গেলেও আমার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি পড়ে নি।আমার কাছেএখন সেই ত্রিশ লক্ষ টাকা অভিশপ্ত বলে মনে হয়;আমার বাবা,আমার স্ত্রী-র সাথে সাথে আমার হৃদয়টাকেও মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছে।ইচ্ছা করে তাকে খুজে পেলে টাকা ফেরত দিয়ে পাপমুক্ত হবো।

আমি এতক্ষণ তার কথা শুনছিলাম।একটা ফাঁকা জায়গা দেখে রিক্সাটা থামিয়ে বললাম,নামুন।ভদ্রলোকএকটু ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলেন।নেমে আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়ালেন।আকাশে রুপালি বাটির দিকে তাকিয়ে তার গান গাওয়া শুনে বুঝতে পারলাম তার কাছে এখন ছিনতাই,ডাকাতির কবলে পড়ার ভয়ের থেকে পাপের ভয়টাই বড়।বাবা,বোন,স্ত্রী এতজনের দায় নিতে না পারাটাই স্বাভাবিক।

আমি বললাম,আজ থেকে আপনি পাপমুক্ত।কারন সেই ত্রিশ লক্ষ টাকার মালিক এই মুহূর্তে আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।ভদ্রলোক অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।

আমি বলতে শুরু করলাম,আপনার গল্পের ঠিক উল্টো আমার গল্পটা।বাবা মোটামুটি সচ্ছল ব্যবসাদার ছিলেন।বাবামায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমার আবদার পূরণে কোন ঘাটতি রাখতেন না তারা।পড়াশোনায় একদম খারাপ ছিলাম।টাকা থাকায় কোন কাজও করা লাগতো না তারপরও প্রায়ই বাবার ড্রয়ার থেকে টাকা চুরি করতাম আর নেশা করতাম।একদিন এই নিয়ে বাবা আমাকে প্রচুর মারলেন।আমি রাগের বশে ঠিক করলাম বাড়ি থেকে চলে যাবো।মা আমাকে অনেক বোঝালেন কিন্তু আমি তার কথা না শুনে বাবার ড্রয়ার থেকে ব্যবসার ত্রিশ লক্ষ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেলাম।দুই দিন পর শুনলাম বাবার ব্যবসার পার্টনাররা তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে।আমাদের বাড়িটাও সিজ করে নেয় তারা।

এতকিছুর পরে বাবা সব জেনেও আমাকে চোর বলেন নি।এরমধ্যে তার একবার হার্টএ্যাটাক হয়।ভুল বুঝতে পেরে বাসায় ফেরার সময় ত্রিশ লক্ষ টাকার লাল ব্যাগটা হারিয়ে পথে বসে যাই।এরপর বাবা অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু চোর অপবাদের কারণে কোন কাজ পাননি।আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন ও সাহায্য করে নি।বরং বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছে।গত দুই বছর বাবা প্যারালাইজড।না পেরে আমাকেই কাজ খুঁজতে নামতে হয়।না পড়াশোনা না যোগ্যতা।এভাবেই কয়মাস ঘুরলাম তারপর রিক্সা চালানো শুরু করলাম।এক কথায় আকাশে ছিলাম,এক ধাক্কায় মাটিতে এসে পড়লাম।একটা মজার বিষয় কি জানেন,যখন টাকা ছিলো তখন বাবা মার সাথে শুধু কথা বলতাম নেশা করার জন্য টাকা নেবো তাই।এখন তো টাকা নেই।নেশাও করি না।বাড়ি যেয়ে অসুস্থ বাবার পাশে বসে রাজ্যের গল্প করি।রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া করি।মা ভাত-তরকারি বেড়ে নিয়ে আসেন।সবাই একসাথে বসে খাই।আমাদের ঐ টাকার প্রাসাদে আমি যে ভালাবাসাটা হারিয়ে ফেলেছিলাম আজ এই ছোট্ট কুটিরে সেই ভালবাসাকে জায়গা দিয়ে পারি না।আসলে লাল ব্যাগটা আমাকে অমানুষ থেকে মানুষ বানিয়ে দিয়েছে।হয়তো কিছু হারিয়েছি কিন্তু পেয়েছি তার চেয়েও বেশি কিছু।পাতাল জায়গাটা ও খারাপ না।এই বলে থামলাম আমি।আগে রাতে নেশার ঘোরে কখনো চাঁদ দেখার সময় হয় নি।এখন মনভরে চাঁদটা দেখতে ইচ্ছা করতে করছে।ভদ্রলোকও তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে,আমিও তাকিয়ে আছি।লালব্যাগ আমাদের জীবনকে পুরো উল্টে দিলেও চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা আটকাতে পারে নি,হোক না একটা হতাশার অপরটা তৃপ্তির।হয়তো এটার নামই জীবন।হয়তো।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত