জীবন যখন একা

জীবন যখন একা

রনির থেকে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা আমি হুট করেই নিয়ে ফেললাম। টানা চব্বিশঘণ্টার বেশি আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।ওর ফোন হারায়ে গেছে। যে ফোন নিয়ে ও বাড়ি গেছে সেটিও লক হয়েছে। তারপর টেলিটকের নেটওয়ার্ক । গ্রামে জিপিরই ফাইভজি নেটওয়ার্ক পেতে হয় গাছের আগায় উঠে।সেখানে অন্য সিমের নেটওয়ার্ক কল্পনাতে পাওয়া অসম্ভব। রনির সাথে আমার রিলেশনটা এক পাক্ষিক।ওকে আমি কোনো কারণ ছাড়াই পাগলের মত ভালোবাসি। সেখানে বরাবরই ও নিঃস্পৃহ। আমার তাতেও আপত্তি ছিলো না। আমি ভালোবাসার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলাম। একাই দুজনের ভালোবাসা পুষিয়ে দেবো ভেবেছিলাম।কি হাস্যকর ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনা!

রনির থেকে দূরে যেতে হবে -এই সিদ্ধান্ত নেয়া মাত্র আমার মনে হলো আমার বর্তমান অবস্থা কি । আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে বসলাম। দুটোয় এক্সাম আছে, চারটেয় একটা এক্সামের রেজাল্ট দেবে, নটায় একটা অনলাইন এক্সাম আছে। পকেটে আছে ষাট টাকা। আমি চুপচাপ বালিশে মাথা রাখলাম। গাল বেয়ে উত্তপ্ত লাভা গড়িয়ে পড়ছে। আমি মুছলাম না। আমার সামনের দীর্ঘ একা থাকার যে জার্নিটা শুরু হচ্ছে সেটার জন্য হলেও কান্নাগুলোকে আটকাতে পারলাম না।

আমি চার মাসের একটা রুটিন তৈরি করে ফেললাম। নিজেকে বোঝানোর জন্য। আমার ফেসবুক আইডি পার্মানেন্টলি ডিলিট করে দিলাম। টুকটাক লেখালেখি করতে লাগলাম একটা নামহীন আইডি থেকে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থার জন্য বই টই কিনতে পারছিলাম না। যেখানে যত পিডিএফ ছিল পড়া শুরু করলাম আবার। টুকটাক গান শুনতে শুরু করলাম। নিজেকে একটা রুটিনে ফেলে দিলাম। দশটা থেকে একটা চাকরি, দুইটা থেকে পাঁচটা ক্লাস। ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে গোসল দিয়ে নাকেমুখে কিছু দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায়। চা শেষ করে পড়তে পড়তে ঘুম দশটার মধ্যে। আমি নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। রনির জন্য নয়। নিজের জন্যই। নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম ‘একাকীত্ব কিছু নয়। ‘ আমার কখনোই কোনো বন্ধু বান্ধব ছিলো না।দু একজন যা ছিলো তাও বাদ দিলাম। নির্বান্ধব, একা দিন কাটাতে লাগলাম। এর মধ্যেও যে কষ্ট হতো না তা নয়। দিনটুকু যাও পার করতাম। রাতটুকু আমার কিছুতেই পার হতে চাইতো না। অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে রনি ওর সমস্ত অস্ত্বিত্ব নিয়ে আমাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিত। রোজ রাত্তিরে ওকে ভেবে ঘুমুতে যাওয়া আর সকালে জেগে ওঠা এক প্রচণ্ড শূন্যতা নিয়ে।

রনিকে ভালোবাসায় ঘাটতি পড়েনি কখনোই। ওকে আমি ঠিক প্রথম দিনের মতই ভালোবেসেছি। কিন্তু নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি শুধু। আমার ইন্টার্নের সময় যখন এগিয়ে আসছিলো আমি শরীফ স্যারকে গিয়ে ধরলাম।

-স্যার
-কি ব্যাপার প্রিয়ন্তী অনিন্দিতা !
শরীফ স্যার বরাবর আমার পুরো নাম ধরে ডাকে।
-আমার ইন্টার্ন ঢাকার বাইরে দিন।
-তুইই তো বলতিস ঢাকায় করবি ইন্টার্ন। আমি হোটেল কন্টিনেন্টালে কথা বললাম যে।
-উঁহু। আমি ঢাকার বাইরে যাব।
-কোথায়?
-চিটাগাং হলে ভালো হয়।
-অতদূরে কেন?
-খুলনা দিন তাহলে
-সর্বনাশ! একেবারে জনাব রয়েল বেঙ্গলের কাছে?তোর হয়েছে টা কি?
আমি কাঁদবো না কাঁদবো না ভেবেও কেঁদে ফেললাম। একটু স্নেহ, স্পর্শ,মমতা ভেতরের কোনো একটা সুইচ অন করে দেয় হয়তো। স্যার বিব্রত হয়ে বললো,
-কাঁদছিস কেন গাধী মেয়ে। চোখ মোছ। ন্যাকামী একদম পছন্দ নয় আমার।

খুলনার হোটেল রুপসীতে আমি ইন্টার্নি শুরু করলাম। ফোন টোন বন্ধ। খুব প্রয়োজনে আমি স্যারকে ফোন দিই। রনির সাথে যোগাযোগ নেই। কিন্তু ওর খোঁজ রাখি। রাখতে ভালো লাগে। অফ সিজনে ট্যুরিস্টের

ঝামেলা কম থাকায় আমি বই লেখার কাজে হাত দিলাম। ওই একাকীত্ব আমাকে বেঁচে থাকার মন্ত্র দিয়েছিলো দুহাত ভরে। আমি লিখলাম আমার প্রথম উপন্যাস ‘গোধূলির বেলাভূমি ‘।

এতটুকু বলে থামলো প্রিয়ন্তী অনিন্দিতা। চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। বোতল ধরে পানি খেলো ঢক ঢক করে। অকারণেই কপাল স্পর্শ করলো একবার। তারপর আবার টেবিলে এসে বসলো।

আমি রায়হান রশীদ। জার্নালিস্ট। লেখিকা প্রিয়ন্তী অনিন্দিতার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলাম। খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবেই উনি উনার গল্প বলছেন। যেন ঘরের কথা বলছেন নিতান্ত পরিচিত জনকে । লেখিকাকে আগে কখনো সামনাসামনি দেখা হয় নি। দেখে খানিকটা ভড়কেই গেছি। এই মেয়ের তো বয়স সাতাশ পার হয়নি। এই বয়সে এত গম্ভীর লেখা লিখে, চেহারায় ভারিক্কি ভাব ধরে কেমন বয়স বাড়ানোর চেষ্টা। অথচ এই মুখোশের আড়ালে কি ভীষণ ছটফটে, প্রাণোচ্ছল, দুর্দান্ত হাসিখুশি মেয়ে লুকিয়ে আছে।

-তারপর কি হলো?
-তারপর নাম, যশ, অর্থ, খ্যাতি সবই হলো। পরের গল্পটা সবারই জানা।
-আপনার বাবা মা?
-ছোটবেলাতেই মারা -ছোটবেলাতেই মারা যান।
-ভাই বোন?
-আমার একমাত্র আত্মার আত্মীয় এখন লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস এ পড়ছে। সেমন্তী অবন্তিকা । আমার বোন।
-আর রনি?রনির কি হলো?

প্রিয়ন্তী হাসলো।হাসলে মেয়েটির গালে টোল পরে।ঠোঁটের নীচে অদ্ভুত একটা ভাঁজ পরে। কি চমৎকার লাগে দেখতে। এইজন্যই বুড়ো ব্যাটা মনেহয় বলেছিলো ‘বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা। ‘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রায়হান।

-ও ভালো আছে। কানাডাতে আছে।বর বউ দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার।
-আপনি বিয়ে করবেন কবে বলুন তো?
খিলখিল করে হেসে উঠলো প্রিয়ন্তী। যেন একশো বেলোয়ারী কাঁচ ভাঙলো মেঝেতে। কি প্রাণ হাসিতে!
-ন্যাড়া কি দুবার বেলতলায় যায় বলুন?দুবার গেলেও তিনবার যায় না নিশ্চয়ই! আমার খুব শিক্ষা হয়েছে বাবা। হৃদয়ের মামলায় আমি খুব দুর্বল প্রতিপক্ষ।

-কিন্তু…
প্রশ্ন শেষ করতে পারলো না রায়হান। কলিংবেল বাজলো।প্রিয়ন্তী মুচকি হেসে বললো,
-এটা আপনার জন্য সারপ্রাইজ জার্নালিস্ট সাহেব। ক্যামেরা ফ্যামেরা নিয়ে রেডি হোন।দুর্দান্ত স্টোরি পেতে পারেন।

দরজা খুলতেই একটা মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রিয়ন্তীর বুকে।
-আপুলিইইই’ হ্যাপি বার্থডে ‘।
বোনকে বুকে ধরে আরেকহাতে সোফার হাতল ধরে ভর সামলালো প্রিয়ন্তী।
-ওরে! আস্তে আস্তে!তুই আর ছোটটি নোস।
-নই?

বলে সেমন্তী কোমরে হাত দিয়ে রাগী চোখে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকালো।তারপর দুই বোনই হেসে ফেললো খিলখিলিয়ে।

সাদাসিধে ঘরোয়া পার্টি শেষে বেরিয়ে এসে ঘড়ির দিকে তাকালাম। দশটা বাজে। আকাশ ভর্তি অসংখ্য তারা সবজে-নীলাভ আলো নিয়ে ঝিকমিক করছে।

ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠলো।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম প্রাইভেট নম্বর শো করছে।মেসেজটা দেখলাম।
‘রায়হান সাহেব, সব গল্পই ছাপার যোগ্য হয় না। সব একাকীত্বও দূর হয় না। কিছু স্পেস নিয়ে আমৃত্যু থেকে যায় মনে। ‘

প্রিয়ন্তীর ছবিগুলো রেখে বাকী সব ইরেজ করে দিলাম। চৈত্রের এক ঝলক দমকা হাওয়া গরমের হুল ফুটিয়ে গেলো শরীর জুড়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত