রাণী

রাণী

রাণী,শখ করে মা নাম রেখেছিল।ভাবলেই শালা হাসি পায় ভুসভুস করে পেট গুলিয়ে।ফাটা কপালী ভিখিরি ঘরের মেয়ের নাম নাকি রাণী।যার বাপ নাকি জন্মে থেকে নিরুদ্দেশ,মা দু’বছর বয়সের রেখেই ট্রেনে কাটা পড়ে আল্লাহ পেয়ারী,ফুটপাথের ধুলোবালিতে গড়িয়ে গড়িয়ে গায়ে গতরে বড় হওয়া,তার নাম আর যাই হোক ‘রাণী’ হতে পারে না কক্ষণো।রাণীকে বলে কত লোক জন চেনে জানে,তার কত নামডাক থাকে, ছোঃ এই প্যাকাটি হাড় হাভাতে মেয়ে যাকে কিনা লোকে দিনে দু দশবার বিনা কারণে লাথিয়ে যায় তার নাম রাণী!সত্যিই আধপাগলী ছিল বটে বুড়ি।

স্টেশনের ধারের চায়ের দোকানে কাপ প্লেট ধুয়েই ছোটো থেকে পেট চলেছে,আরিফ চাচাই কুড়িয়ে তুলে এনে বাঁচিয়েছিল ঐ দু’বছরের রাণীকে।চাচার ঘরসংসার নেই,সেও ঠাঁই নাড়া মানুষ।এ দুয়ার ও দুয়ার ঘুরে সেও তখনই থিতু হয়েছিল ঐ স্টেশন চত্বরে।নিজে চোখে দেখেছিল চাচা আধপাগলী মা টা রেললাইন পাড় হয়ে দুধ কিনতে গিয়ে কাটা পড়েছিল ডাউন ট্রেনে।ছেঁড়া খোরা শরীরটা তোলার পরও পাশে রাণী খিদের জ্বালায় চিৎকার করে তল্লাট মাতাচ্ছিল,মা মরলেও সেকথা শালা পেট বুঝবে কেন, চাচাই কোলে তুলে চায়ের জন্য রাখা দুধ খাইয়ে থামিয়েছিল শেষে।রাণী সবসময়ই ভাবে পেটের চেয়ে হারামী স্বার্থপর জিনিস আর নেই এ দুনিয়ায় দুটো।ও শালা কিচ্ছু বোঝে না,কারো জন্য দুখদরদ,মায়া মমতা কিচ্ছু না।ট্যাঙ্কি ভর্তি থাকলে পিরীতের গল্প,আর খালি ট্যাঙ্কির আগুন নেভাতে সব জায়েজ।

চাচার দোকান থেকেও তো সে জন্যই পালিয়েছিল রাণী।মোটে মায়া হয় নি বুড়োর জন্য।আধপেটা খেয়ে লোকের এঁটো ধুয়ে দিন গুজরানের কিসমত কো ঘেন্না করেছে রাণী বরাবর।নিজের জাতপাতের ঠিকঠিকানা নেই,তাই চাচার আল্লাহ কেই সেরা মনে করে চিরকাল দুষেছে পেটের দাউদাউ আগুনের জন্য।এ আগুন একটু কমালে তো এমন নিষ্ঠুর হতে হয় না মানুষকে।

ছিনিয়ে নিয়ে বাঁচার কথা রাণীকে কারো শেখাতে লাগেনি।সুযোগ মতো কেঁদে কেটে ভিক্ষে করে,আবার কখনো পা কাটা কেল্টুর সাথে লড়াই করে,কিংবা বড়লোক খদ্দেরের পকেট কেটে রাণী পেটকে সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করেছে।রাতের অন্ধকারে ঘাড়ের কাছে এসে বেঞ্চে শোয়া রাণীকে লোকটা শুধু বলেছিল খেতে দেবে পেট পুরে রোজ ওর সাথে গেলে।ব্যস আধঘুমে নিভে আসা চোখও দপ করে জ্বলে উঠেছিল।চোঁ চোঁ করা পেট মুহূর্তে সায় দিয়েছিল।চেনাজানা রাস্তা পেরোতেই জলভরা সন্দেশ খাইয়েছিল লোকটা।নাহ,লোকটা জালিয়াত নয় তবে,৫ খানা সন্দেশ,যতটা চেটেপুটে খেয়েছিল রাণী,ততটা চেটেপুটে ঐ লোকও ওকে খেতে পারেনি।

রাণী ভুখা মরতে নারাজ চিরদিনই।দরকার হলে মেরে মরবে,কিন্তু ভুখা কেন মরবে।হাজার হোক একটা মাত্র মায়ের দেওয়া সাধের নাম।সে নামের ইজ্জত রাখার কিছু ফর্জ তো বানতা হ্যায়।এই একটাই উশুল মানে রাণী জীবনে যে ভুখা পেট আদমি কি অউরত তার জন্য পৃথিবীর সব কাম জায়েজ।এই জ্বালামুখী পেট রাণীর পা টিকতে দেয় নি সেই পালিয়ে আসা থেকে বেশীদিন এক জায়গায়।চেনা শরীর চোষার নেশা মিটলেই,এরা বেইমানি শুরু করে।মারধর করে শালা লোকটা বেচে দিয়েছিল মোটা নগদের সওদা করে তিন চার দিন বাদেই।তারপর থেকেই এ হাত ও হাত হয়েছে রাণী।খিদে পেলে যতক্ষণ খাবার মিলেছে ততক্ষণ রাণীও চুপ থেকেছে।কিন্তু বরাত খারাপ ছিল রাণীর,গতর বেচেও ভরপেট খাওয়া জোটেনি সবসময়।হাত বদল হতে হতে এখন যেখানে এসে পড়েছে এখানে দুবেলা খাওয়া জোটে ঠিকঠাক।এইটাই সবচেয়ে শান্তি লাগে রাণীর।

চায়ের দোকানে খদ্দের পেপার খুলে বসে,চাচা আপন মনে চা পাতার পুঁটলিতে গিট্টু দেয়।হঠাৎই চেনা মুখ টা চোখে পড়ে পেপারের প্রথম পাতায়।রাণী দাগী আসামী।জেলে বন্দি।বিচার চলছে,খুব শিগগিরই হয়তো ফাঁসির সাজা হবে।

বাকি সবটা ঝাপসা হয়ে যায় নিমেষে।কালো হরফে বড় বড় করে লেখা রাণীর নামটা শুধু দেখতে পায় আরিফ চাচা।রাণীকে এখন দেশের সক্কলে চেনে।সবার মুখেই রাণীর খবর।বেলা বাড়তেই ভিড় উপচে পড়ে চাচার দোকান।দাগী আসামী রাণীর প্রথম ডেরা এই আরিফ চাচার দোকান।

চাচা হতভম্ব হয়ে বসে থাকে,মনে পড়ে রাণীর রোজকার গজগজানি, “মরতে কি জন্যে বুড়ি নাম রেখেছিল রাণী! শ্লা কে চেনে এই রাণীকে! কে মানে!”

স্নান সেরে পেট ভরে খেয়ে রাণী সেলে বসে অপেক্ষা করে শান্ত হয়ে।দাউদাউ আগুন নেভার অপেক্ষা।কোনো আক্ষেপ নেই আর রাণীর।যাওয়ার দিনেও খাওয়া জুটেছে,তাও আবার পছন্দিদার খানা।ভুখা মরেনি রাণী,রাণীর মতোই মরছে।

মাত্র আধখানা পাউরুটির জন্য দৌড়তে দৌড়তে এসে লোকটার গলায় চাকু বিঁধিয়ে দিয়েছিল রাণী ভরা বাজারে।ঝোপের আড়ালে লোকটা নিজের খিদে মিটিয়ে পালাচ্ছিল,কথা ছিল অন্তত হাফ পাউন্ড রুটি আর ঘুঘনি দেবে কাজ শেষে।দেয়নি,বেইমান,বেওকুফ আদমি।জানত না রাণী তখন ওর চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভুখা,আর ভুখা লোকের কোনও ধরম হয় না,ন্যায় অন্যায় হয় না।

জেলের বাইরে পিলপিল করা ভিড় কাগজের অফিস,টিভির অফিসের লোকের।আরিফ চাচাও এক কোণে এসে দাঁড়িয়েছে।বুড়োর বোধহয় চোখে কিছু পড়েছে,লুঙ্গির খুঁটে বারবার চোখ মুছছে।কিন্তু রাণী এসব কিছু থেকে আনজান।ভরা পেটে শান্তিতে চোখ বুজে আছে,দড়িতে টান পড়ার অপেক্ষায়।

রাণীর মতো জন্মায় নি ঠিকই,কিন্তু সব খিদে মিটিয়ে জন্মের মতো,সারা দেশকে জানিয়ে রাণীর মতোই মরছে।বুড়ি মা টা শালী আজ নিশ্চয়ই উপর থেকে হাসছে।

লোকে কত কি বলছে,আহা বেচারী খিদের জ্বালায় কি করে ফেলল!কিন্তু আর কেউ না জানুক আল্লাহ জানে,রাণী ভুখা মরেনি,রাণী কথা রেখেছে নিজের,রাণী নামের ইজ্জত খোয়ায় নি হারগিস।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত