আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একজন ভদ্রলোক ছিল। দুই ছোট ছেলে আর একজন মাত্র স্ত্রী নিয়ে উনার সংসার। ভদ্রলোকের সবকিছুই ভাল ছিল। শুধু মাঝে মাঝে পান খেয়ে যাওয়ার সময় আমাদের দরজার সামনে পানের পিক ফেলে যেতো। এছাড়া গভীর রাতে প্রায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতো। ঐ শব্দে আমরা রাতে ঘুমোতে পারতাম না। আরও ধরেন মাঝে মাঝে তাদের বাচ্চারা আমাদের বাসায় কোন কারণ ছাড়া কলিং বেল দিয়ে সরে পড়তো। মাঝে মাঝে ভদ্রলোকের স্ত্রী ছাদে গিয়ে আমরা ছেলেরা কেন ছাদে আসি এই নিয়ে ঝগড়া করে । এই সব কিছু বাদ দিলে ভদ্রলোকের বাকি সব কিছু ভালই ছিল। আমি আর নিচ তলার ফ্ল্যাটের রাজন প্রায় চিন্তা করতাম এই ভদ্রলোক কি কখনো ফ্ল্যাট ছেড়ে যাবে না?
তারপর একদিন সোনালী দিন। ভদ্রলোক ফ্ল্যাট ছেড়ে দিলো। উনার বাচ্চাদের জন্যে নাকি খেলার মাঠ দরকার। রাজন বিড়বিড় করে বলল, ‘ওদের জন্যে আসলে দরকার মিরপুরের চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানার বাঁদরের খাঁচা।”
আমরা হাসিমুখে ভদ্রলোককে বিদায় দিলাম। আমি আর রাজন বিশাল হাফ ছেড়ে তারপর বাঁচতে আরম্ভ করলাম।সাতদিন খালি ছিল পাশের ফ্ল্যাট। তারপর নতুন ভাড়াটে এলো। নতুন কোন ভাড়াটে এলে আমাদের যে তারকাখচিত প্রশ্ন থাকে সেটাই মনে এলো। “এদের পরিবারে ছেলে মেয়ে কজন? আসল কথা হচ্ছে মেয়ে কজন।”
উত্তর পেতে দেরি হল না। ভদ্রলোক ব্যাংকার। এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে আমাদের সমবয়সী। নাম সুস্মিতা। ভদ্রলোক যখন আমাদের সাথে পরিচয় হতে এলো সেই মেয়েকে আমরা প্রথম দেখলাম। মেয়েকে দেখে প্রথমে জীবনানন্দ দাশের কথা মনে এলো। বনলতা সেন কি একে দেখেই লেখা হয়েছিল? এরপর মনে এলো হুমায়ূন আহমেদের কথা। হিমুর রূপা চরিত্র এখান থেকেই নেওয়া? মেয়েকে দেখে সময় থমকে গেল। পরে রাজনের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম রাজনেরও একই ব্যাপার ঘটেছিল। সময় থমকে গিয়েছিল, বাতাস থেমে গিয়েছিল। সুস্মিতার সাথে আমাদের প্রায় দেখা হতো। লিফটে, কখনো সিঁড়িতে। মেয়েটা মুচকি হাসতো, হাই হ্যালো বলতো। আমি আর রাজন হার্ট বিট মিস করতে করতে বক্ষ ব্যাধি হাসপাতালে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করতে লাগলাম।
তারপর একদিন অলস দুপুর। আমি বসে বসে গান শুনছি। দরজায় নক হলো। খুলে দেখি বনলতা সেন, না না রূপা, না না সুস্মিতা দাঁড়িয়ে আছে। ‘সরি ডিস্টার্ব করছি।’ মেয়েটা হেসে বলল। ‘না না, বলেন।’ আমার হৃদয়ে কোথাও ঝর্না বয়ে গেল।‘আসলে কিভাবে যে বলি। ছাদে যাবেন? ওখানেই বলি?’’
আমার বেশ কিছু হার্ট বিট মনে হয় মিস হল। ছাদে আমি আর সুস্মিতা। সুস্মিতা আর আমি। আর কিছু মাতাল হাওয়া বইছে, দূরে পাখি গাইছে গান। ‘আসলে আমার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল।’ আমি চুপ। ‘ইদানিং খুব ঝগড়া হচ্ছে ওর সাথে।’ আমি চুপ। ‘কাল রাতেই ব্রেক আপ হয়ে গেল।’ ‘দারুণ!’ সুস্মিতা অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। ‘ইয়ে না মানে ভালই। ঝগড়া হলে রিলেশন নিয়ে না এগোনোই ভাল।’সুস্মিতা আমার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলো। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। আমরা ফেসবুকে বন্ধু হলাম। প্রায় চ্যাট হতে লাগলো। আর আমার হৃদয়ে ট্যাপ পড়তে লাগলো।
সুস্মিতার মেটাল ব্যান্ড খুবই পছন্দ। যে সব ছেলেরা মেটাল ব্যান্ডের টিশার্ট পরে তাদের নাকি তার খুব কুল লাগে। সুস্মিতা কথায় কথায় আমাকে জানালো, একটা মেটাল ব্যান্ডের টিশার্টের দোকানের কথা। সেখানে নাকি দারুণ সব টিশার্ট পাওয়া যায়। সুস্মিতার সব কথায় এখন আমার জন্যে আদেশের মত। তার যা ভাল্লাগে আমারো তাই। সুস্মিতা যে গান শুনে হাসে আমিও হাসি। যে গান শুনে বলে, ‘এমা ছিঃ!’’ আমিও বলি ‘এমা ছিঃ ইয়াক থু!’’পরদিন হাজির হয়ে গেলাম সে টিশার্টের দোকানে। চার পাঁচটা কিনে নিলাম। টিশার্টের দোকানটার যে মালিক তার ফোন নাম্বারও নিয়ে এলাম। নতুন টি শার্ট আসলেই যেন খবর নিতে পারি।
আমি এখন অন্য আর কিছু পরি না। সবসময় সেই টিশার্ট গুলিই পরছি। একদিন মেটালিকা ব্যান্ডের টিশার্ট পরে বিকালে বের হয়েছি দেখি রাজন। আসলে সুস্মিতার সাথে সম্পর্কটা হওয়ার পর থেকে রাজনের সাথে যোগাযোগ অনেক কমে গেছে। রাজনও কেন জানি ইদানিং আমার সাথে দেখা করে না। কাছে আসতেই দেখি রাজনেরও গায়েও একই টিশার্ট যেটা আমি পরেছি। ‘কোথা থেকে কিনলি এটা?’ রাজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। ‘বেইলি রোড।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে রাজন বলল। কি যেন লুকাচ্ছে সে। ‘দোকানের নাম কি? কে রেফার করেছে?’ ‘কেন তোর কি দরকার?’ রাজন যেন রেগে যাচ্ছে। ‘তুই কোথা থেকে কিনলি?’’ আমরা দুজন দুজনের দেখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকলাম।
দুটি টিউবলাইট একসাথে জ্বলে উঠল। দুজন একসাথে বলে উঠলাম, ‘‘সুস্মিতা!’’ একটু পরেই দেখি সুস্মিতা আসছে সাথে টিশার্টের দোকানের সেই মালিক ছেলেটা। ‘রাজন, সাকিব পরিচয় করিয়ে দিই এই হচ্ছে আমার বয়ফ্রেন্ড। যার সাথে আমার ঝগড়া চলছিল। আসলে আমরা আবার ঝগড়া মিটমাট করে ফেলেছি। তোমরা মনে হয় চেনো একে।’ সুস্মিতা হড়বড় করে বলল। ‘হুম চিনি।’ আমি আর রাজন মাথা নাড়লাম। আমাদের দুজনের গায়েই সেই একই দোকান থেকে কেনা মেটালিকা ব্যান্ডের টিশার্ট।