“কি রে কি ব্যাপার, এক চান্সে যার টাইট্রেশন পারফেক্ট হয়, আজ তার হলটা কি! সিম্পল স্টান্ডার্ডাইজেশনটাই এই নিয়ে তিনবার করলি, এখনো তো আসল কাজটা বাকি। ফেনলপথ্যালিনে ফেল করতে তোমাকে তো কখনও দেখিনি চাঁদ! নাকি তোমার ইন্ডিকেটার আজ আসেনি বলে রঙ মেলাতে পারছ না!”
মুখটা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে অর্কর। অনয় কথাগুলো ভুল কিছু বলেনি, এভাবে চললে কাজটা আজকের মধ্যে শেষ হবে না। আজ প্রথমবার এসব হচ্ছে ওর সাথে, ডি.পি স্যারের কাছে অব্দি বকা খেয়েছে আজ অমনোযোগী হওয়ার জন্য। কি করবে টেনশনে যে হাত-পা গুলো কাঁপছে!
“কি রে হয়েছেটা কি বলবি তো, এত অস্থির লাগছে কেন তোকে? কেসটা কি?”
“অনয় জানিস তো আজ না ডিম্পিকে দেখতে আসছে-”
“অ্যাঁ, বলিস কি! সেই ছোটবেলাতে অন্তাক্ষরীতে, কুই্যজে,স্কুলের নাটকে মায় কলেজে ল্যাবে পার্টনার তুই; আর লাইফ পার্টনার হবে অন্য কেউ! তখনই বলেছিলাম মা কালীর নাম করে জলদি বলে দে,নে সামলা এবার!”
“তুই তো জানিসই ডিম্পি কি জিনিস! কতবার ভেবেছি আজ সাহস করে বলেই দেব, কিন্তু যেই ও সামনে আসে আমার সব সাহসের প্রেসিপ্রিটেট পড়ে যায়!”
“দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে তুই যখন ডিম্পির প্রেমে পড়েছিস তখন তো ঠেলা সামলাতেই হবে ভাই! মেলা না ভেবে বলে দেখ কি হয়! উতরে যাস নাকি মায়ের ভোগে যাস! আর তা না হলে দেবদাস হয়ে পারোকে হাসিমুখে বিদায় দে! এত চাপ নেওয়া যায় নাকি!” অনয় যা বলার বলে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল কিন্তু অর্ক জানে ব্যাপারটা অতটাও সহজ নয়। ডিম্পির মত মেয়েকে প্রপোজ করতে যাওয়া আর বাঘের মুখে হাত রাখা একই ব্যাপার! এ মেয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মত নয়। মিউজিক চ্যানেলে রোমান্টিক গান শোনে না, সারাদিন ডিসকভারিতে বিষাক্ত জীবদের দেখে বেড়ায়।সাপ দেখলে দৌড়ে – না না পালিয়ে যায় না, কাছে এগিয়ে যায়। এই তো দুদিন আগে কলেজের মাঠে চন্দ্রবোড়া দেখে সব ছেলেমেয়েরা যখন বাবা গো মা গো বলে পালাচ্ছে, অর্ককে টেনে নিয়ে গিয়ে ডিম্পি বলল, “দ্যাখ, দ্যাখ কি দারুণ দেখতে সাপটাকে! চল্ না আর একটু কাছে গিয়ে দেখি।”
বলে কি মেয়েটা! সাপ সুন্দর দেখতে!আরো কাছে যাওয়া মানে তো এবার সাপের মুখে! অর্কর তখন যাই যাই অবস্থা। অনেক কষ্টে টেনে আনল ডিম্পিকে, ডিম্পি তখন ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছে। হ্যাঁ ষাঁড় বলাই উপযুক্ত,গরু বললে অবলা জীবকে অপমান করা হবে।
“তোর মতো কাপুরুষ আর ভীতুর ডিম আমি দুটো দেখিনি জীবনে! শালা সাপটা সাইজে বড় না তোর শরীরটা!ছাড় আমাকে আমি যাবই!ছেড়ে দে!” মুখ তো নয় যেন আস্তাকুঁড়! হাত ছাড়িয়ে ফিরে গিয়ে যখন ডিম্পি দেখল, ততক্ষণে সাপ বাবাজী গন। সাপটাই হয়ত এমন জীব দেখে খাবি খেয়ে পালিয়েছে। যাক্ বাঁচা গেল, অন্তত সাপটাতো বাঁচল! নয়ত এ মেয়ে যেমন শেষে সাপটার কি গতি হত কে জানে! কিন্তু এদিকে ডিম্পির মেজাজ সপ্তমে, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আবহাওয়া ভাল নয়। অর্ক দৌড় লাগাল,সাপে ছুঁলে যা হবার হত, কিন্তু ডিম্পি ছুঁলে যে কি হবে! এরকম মেয়ের বিয়ার গ্রিলসের মত লোকই পারফেক্ট, অর্ক তো ওর কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু! এদিকে ডিম্পির জন্য কেউ ওকে
চাইলেও প্রপোজ করতে পারে না,আর ও নিজে তো মুখ তুলে তাকাতেই পারে না। ন্যাড়া জীবনে একবারই বেলতলায় যায় কিনা! সেবার সামনে মাধ্যমিক, সরস্বতী পূজোর দিন টিউশনের ব্যাচের সুরভী বলে একটা মেয়ে অর্ককে প্রেম নিবেদন করতে এসেছিল। মেয়েটা ডানাকাটা পরী ছিল যাকে বলে, ব্যাচের সব ছেলেরাই ওকে চোখে হারাত। অর্ক এমনিতেই একটু লাজুক প্রকৃতির, তারপর এভাবে একটা মেয়ে নিজে এসে কথাগুলো বলায় লজ্জায় লাল হয়ে গেছিল। ওর কিছু বলার আগেই অমনি কালবৈশাখী ঝড়ের মত কোথা থেকে ডিম্পি উদয় হয়ে মেয়েটার হাত মচকে দিয়ে বলল,
“খুব বাড় বেড়েছে না তোর! ঐ পাড়ার তিমিরের পকেট মেরে মন ভরছে না,না?! এখানে এসে ভদ্দরলোকের ছেলেকে ফাঁসানো হচ্ছে! আজ তোর সব পিরীত আমি ঘোচাচ্ছি!” এই বলে সরস্বতীর বীণাটাই তুলে সুরভীর পিছনে তাড়া করল। অর্কর মনে খটকা লাগল তবে কি ডিম্পি ওকে চায়!? পজেজিভনেশ থেকে এসব করছে?! কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় সব ভুল ভাঙল ওর। বাড়ি ফিরে এসে আড়াল থেকে শুনল ডিম্পি ওর মায়ের কান ভাঙাচ্ছে ,
“কাকিমা তোমার ছেলে আজকাল মেয়েদের ঝাড়ি মারছে। চোখে চোখে রেখো।”
মায়ের আবার ডিম্পির উপর অগাধ বিশ্বাস!
“কি বলছিস, তুই একটু দেখে রাখিস তো মা। আমার ছেলেটা বোকাসোকা ধরনের, তোর মত যদি একটু চালাক-চম্পট, বোঝদার হত!এই বয়সে কোথায় পড়াশোনায় মন দেবে তা না-”
“তুমি চাপ নিও না কাকিমা, আমি সব নজর রাখব!”
অর্ক ঘরে ঢুকতেই মা আপাদমস্তক দেখল ওকে, যার মানে এই দাঁড়ায়, – রাত্রে খাবার সাপ্লাই বন্ধ। মা রান্নাঘরে যাওয়ার পর অর্ক ডিম্পিকে বলল “এই তুই এসব কি উল্টোপাল্টা লাগাচ্ছিস মাকে, আমি কখন ঝাড়ি মারি?!”
“থাম তো! তুই কিছুই না করলে ঐ মেয়ে এমনিই আসবে? আমাকে কি ভাবিস তুই! আমি দেখিনি কেমন তোর মনে লাড্ডু ফুটছিল, তোর থেকে আমি তোকে বেশী চিনি।” মায়ের হাতে তৈরী সদ্য গরম লুচিতে কামড় দিল ডিম্পি, অর্কর কপালে আজ উপোস নাচছে! সেইজন্যই আরো বেশী করে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে অর্ক, “সামনে পরীক্ষা, তাতে কন্সেনট্রেট কর। নাহলে ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে টাঙিয়ে রেখে দেব, তোকে না, সুরভীকে! আজ অল্পের জন্য টার্গেটটা মিস হয়ে গেছে, বীণাটা ঘাড়ে পড়তে পড়তে পড়ল না। এবার তুই-ই ভেবে দেখ তোর জন্য যদি লোকের মেয়ে মায়ের ভোগে যায়- ”
“কি সাংঘাতিক! তু-তুই ওকে -”
“তোতলাচ্ছিস কেন? এদিকে কথা ফোটেনি ভাল করে মুখ দিয়ে আর মেয়েদের ঝাড়ি মারছেন।”
“আমি কোথায় কিছু করি-”
“জানি তো তুই ভাল ছেলে, মেয়েগুলো তোকে ডিসটার্ব করে। নে এখন থেকে তোকে কোনো মেয়ে ডিসটার্ব করবে না আর! আজ সবার শিক্ষা হয়েছে। বিয়ের বয়স হলে বাড়ির লোক এমনিই দেবে চাঁদু, এখন পড়ায় মন দাও।কাকিমাকেও এলার্ট করে দিয়েছি!”
ব্যাস সেদিন থেকে অর্কর সব স্বাধীনতা বিসর্জনে গেল।
তারপর থেকে আর কোন মেয়েও ভয়েই অর্কর ধার পাশ দিয়ে যায় না। এ হেন ডিম্পিকে অর্ক যে কখন ভালবাসল আর কেনই যে বাসল ও নিজেও জানে না। গত এক বছর আগেই ও নিজে ব্যাপারটা আঁচ করেছে। ডিম্পির তখন ডিপ জন্ডিস, সিরিয়াস অবস্থা। ছোটবেলা থেকে অর্ক রোজ ডিম্পির মুখ দেখত,তাই বুঝতে পারেনি ওর
অনুপস্থিতিটা কোনদিন। সারাক্ষণ ওর ওপর ছড়ি ঘোরায়,জ্বর-জ্বালা হলেও ফোন করে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে যখন অমন দামাল মেয়েকে হসপিটালের বেডে কাতর হয়ে পড়ে থাকতে দেখল, অর্কর বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন করে উঠল। কলেজে অত বন্ধু-বান্ধবের মাঝেও কিছু একটা মিসিং লাগল। ফুচকা, পাপড়িচাট, এগরোল সবই কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকল। সব কিছুর মধ্যেও কিছু যেন নেই মনে হল।
ক্লাসে ওকে পেনের খোঁচা মারার কেউ নেই, ল্যাবে ওর পরিস্কার অ্যাপ্রনে হাত মোছার কেউ নেই, পিপেট আউট করার সময় চিমটি কাটার কেউ নেই! অথচ যখন এগুলো ঘটত তখন মারাত্মক রাগ আর বিরক্তি হত ওর, কিন্তু ডিম্পির অবর্তমানে এগুলোই যেন বেশী মিস করতে লাগল। অজান্তেই কেমন যেন অভ্যাস আর ভালোলাগায় পরিণত হয়েছে এই ব্যাপারগুলো। তারপর যেদিন ডিম্পির রিকভারির নিউজ পেয়ে ওকে বাড়িতে দেখতে গিয়ে ডিম্পির গলার থেকে শুনল,”খুব মস্তিতে আছিস না! মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছিস্! শালা বেশী উড়িস না! করে নে দুদিন যা করছিস্! আই অ্যাম ব্যাক নাউ!”,ওর মনে হল বসে বসে দুদিন ওর গালাগালগুলোই শোনে! মানুষের মন বোঝা বড়ই দায়! অর্ক বুঝল জন্ডিস শুধু ডিম্পির হয়নি, ওরও কেস জন্ডিস! এরপর থেকে রোজ বলব বলব ভাবে কিন্তু বলার সাহস পায় না। যা মেয়ে, যদি ওর মনে কিছু না থাকে তখন যদি ওর হাত মুচড়ে ঠ্যাং খোঁড়া করে রেখে দেয়! তাছাড়া ল্যাবে তো কেমিক্যাল সহজলভ্য!ওকে বিশ্বাস নেই, সব করতে পারে! অর্ককে পুরো ওয়ান এইট্টি ঘোরালে যা দাঁড়ায় ডিম্পি তাই। অর্ক শান্তশিষ্ট প্রকৃতির, ঝামেলার ধারে পাশে যায় না, শান্তি বজায় রাখতে দুকথা শুনে আসবে, ধীর,স্থির, ভদ্র,মার্জিত।
পক্ষান্তরে ডিম্পি ঝামেলার দিকে সবসময় এক পা বাড়িয়েই আছে, পাড়া হোক বা কলেজ, ঝামেলা যেখানে ডিম্পি সেখানে। মুখের ভাষা শুনলে মনে হবে এ মেয়েকে জন্মের সময় মুখে মধুর বদলে পৌরসভার আবর্জনার গাড়ী ঢালা হয়েছিল! বোসকাকিমার পোষা পাখি ওড়ানো থেকে আরম্ভ করে পাড়ার রকবাজদের মাথায় হাই ভোল্টেজের তার ফেলে শক খাওয়ানো, যত রাজ্যের উদ্ভট কাজের মাস্টারপিস্। মাঝে মাঝে অর্ক ভাবে এত মেয়ে থাকতে ডিম্পির মত মেয়েকে যে কেন ভালবাসতে গেল। ঐ যে কথায় আছে না, অপজিট অ্যাটরাক্টস্ , হয়ত তাই! তবে ডিম্পির সবথেকে বড় গুণ ও খুব ভাল মনের, আপাতদৃষ্টিতে ওর কাজগুলো খারাপ লাগলেও ও যা করে ভালোর জন্যই করে। অর্কর খেয়ালও রাখে খুব। তবে সেটা ওর ধরণ দেখে বোঝা দায়, কিন্তু উপলব্ধি করা যায়। পরীক্ষার সময় টেনশন করে যখন অর্ক কিছু খায় না, ডিম্পিই জোর করে গেলায় ওকে। প্রতিবার পরীক্ষার আগে খাবার কিনে একটু খুঁটে বলবে, “এটা গিলে দে তো, নাহলে পয়সাটা জলে যাবে! খবরদার না শেষ করলে আজ তোর পরীক্ষার বারোটা বাজিয়ে দেব আমি!” লোকে দেখলে ভাববে কি ভয়ঙ্কর মেয়েরে বাবা! নিজের পয়সা বাঁচাতে লোকের ওপর জুলুম করছে।
কিন্তু অর্ক জানে ডিম্পি এরকমই, কমদিন তো দেখছে না ওকে। একবার স্কুলে পড়ার সময় অর্কর ইতিহাস পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছিল, টাইফয়েডের জন্য পড়তেই পারেনি সেবার। এমনি ও পড়াশোনাতে ভালই, তাই ভয় করছিল যদি পাশ না করতে পারে। টেনশনে খাওয়া -দাওয়া বন্ধ। ডিম্পি ব্যাপারটা জানার পর রাত্রিবেলা পেত্নী সেজে ইতিহাসের বীরেনবাবুকে ভয় দেখাল, যদি কেউ ফেল করে তবে ঘাড় মটকে দেবে। ব্যাস সেবার সবাই পাশ! ব্যাপারটা অবশ্য অনেক পরে জানতে পেরেছে অর্ক, ডিম্পি নিজের থেকে কিন্তু একটা কথাও বলেনি। এমনকি অর্ক জিজ্ঞেস করাতে স্বীকার পর্যন্ত করেনি যে কাজটা ও করেছে। এহেন ডিম্পি ড্যাংড্যাং করে অন্য কারো সাথে চলে যাবে, ভেবেই চোখটা ঝাপসা হয়ে এল। এভাবে যদি যাবিই তবে কেন অন্য মেয়েদের ভয় দেখালি, কেন অভ্যাস খারাপ করলি! খুব রাগ হচ্ছে অর্কর। আগে বললেও না হয় একটা ব্যবস্থা করা যেত। কাল রাতে ফোনে প্র্যাক্টিক্যালের ব্যাপারে ডিসকাস্ করার সময়
উনি বললেন, ওনার আজ পাকাদেখা, তাই উনি কলেজে আসবেন না। ডিম্পির মত মেয়ে এত সহজে রাজি হয়ে গেল বিয়ের জন্য, তাও এত কম বয়সে- এই ব্যাপারটাই অর্কর হজম হচ্ছে না কাল রাত থেকে। ডিম্পিকে জিজ্ঞেসও করেছিল কথাটা-
” আরে বাবা,বিয়ে তো করতেই হবে, আগে হোক বা পরে। আর যখন ভালো ছেলে পাওয়া গেছে কথা এগিয়ে রাখতে দোষ কোথায়!”
নাঃ দোষ থাকবে কেন বালাই ষাট! দোষ তো ওর নিজের! ডিম্পি ছেলেমানুষ, অবুঝ, কি বলতে কি বলবে এসব ভেবে ও-ই বলেনি, কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ডিম্পি ভাল রকম বোঝদার!
“তোর ছেলেটাকে পছন্দ ,তার মানে তুই ছেলেটার সাথে কথা বলেছিস!”
“হুঁ, বলেছিই তো! আজকালকার দিনে কি না দেখেশুনে, না বাজিয়ে কেউ বিয়ে করে নাকি! বলদ একটা!”
সত্যি এত কিছু হয়ে গেল ভেতর ভেতর আর ও এখন জানতে পারছে। এতদিন ডিম্পির পিছনে চরে বেড়িয়ে শেষে এই হল! বলদ না হলে আর কি !
“সব থেকে বড় ব্যাপার বাবা-মায়ের খুব পছন্দ জানিস!”
জানতেই হবে! ফোনের ঐ পার থেকে ডিম্পির গলার উচ্ছ্বাস বলে দিচ্ছিল ও কি পরিমাণ খুশি!
“তুই কাল প্র্যাক্টিক্যালটা একা সামলে নিস্ একটু, আমি জানি তুই পারবি। রেজাল্টের ডেটাগুলো পরে নিয়ে নেব তোর কাছে, বাই!”
অর্ক বাই বলার আগেই ডিম্পি কেটে দিয়েছিল ফোনটা। গোটারাত নির্ঘুম চোখে ছটপট করেছে ও। সব কিছু সেটল্ হয়ে যাবার পর এখন বলেই আর কি হবে! ধুর আজ আর প্র্যাক্টিক্যালটা কমপ্লিট হবে না মনে হচ্ছে, কিছুই ভালো লাগছে না ছাতা!
বাড়ি ফিরে এসে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচাল, “মা-, খেতে দাও!”
খাবার টেবিলে গিয়ে বসতেই মা বলল, “খেয়ে নিয়ে জলদি রেডি হয়ে পড়!”
“কেন?কেউ আসবে নাকি!”
“না আমরা যাব-”
“এখন কোথায় যাবে?”
“সে কি রে, তুই জানিস না ডিম্পির আজ পাকাদেখা-”
মুখটা কেমন তেতো হয়ে গেল অর্কর, খাবারগুলো ফেলে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল,
“আমি যেয়ে কি করব ওখানে-”
“যেয়ে কি করবি মানে? ডিম্পির বাবা- মা যেতে বলেছেন বারবার। এসব কথা আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতিতেই তো হয়ে থাকে, ওদের তেমন কেউ নেইও। তোর বাবা বললেন যাওয়াটা দরকার এসময় , না গেলে খারাপ দেখায়!”
উফ্! মা-বাবাটাও যে কি! সত্যি! ডিম্পির বাবা-মা ডাকল আর ওরাও এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল! এত কিছুর বোধ
আছে অথচ এটা এতদিনে বুঝল না ডিম্পি ওর জীবনের সাথে কতটা জড়িয়ে আছে, কতটা জুড়ে আছে! একেই বলে ঘর শত্রু বিভীষণ!অর্ককে এখন ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে সব দেখতে হবে!
“তোমরা গুরুজনরা থাকো না, আমি ওখানে থেকে কি করব!”
“শোন্ বাবু ওদের গুছিয়ে দেবার তো কোনো লোক নেই, এই ধর নোনতা, মিষ্টি এসব আনার; কখন কি দরকার পড়বে! আমি বলে দিয়েছি এসবের দায়িত্ব তোর!”
“অ্যাঁ, কি!” বোঝ কান্ড! রাগে গা রি রি করছে অর্কর! কি ভাবে সবাই ওকে! জোকার! ওকে এখন পাত্রের জন্য মিষ্টি-নোনতা কিনতে হবে! বাড়ির জামাইয়ের বদলে ঠিকে চাকর বানিয়ে দিল শেষে! কিন্তু বাবার মুখের উপর তো কিছু বলতেও পারবে না। অগত্যা নিমরাজি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
ডিম্পির সাজের বহর দেখে থ হয়ে গেল অর্ক। বরাবরের টমবয় ডিম্পিকে এত গুছিয়ে সাজতে কখনও দেখেনি ও। আর এই সব কিছুই নিশ্চয় ঐ উড্ বি অবতারের জন্য! মর্কটটা আসুক একবার মজা দেখাচ্ছি! ডিম্পিকে এত সুন্দর লাগছে আজ, চোখ সরানোই যাচ্ছে না। গেছো মেয়েটার মধ্যে এরকম সুন্দর একটা মেয়ে যে লুকিয়ে ছিল, ভাবতেই পারেনি অর্ক। ওর প্রিয় পিচ কালারেরই শাড়ি পরেছে আজ ডিম্পি। সব কিছুই পারফেক্ট, খালি ওর নিজেকে এসবের মধ্যে বেমানান লাগছে।
“এই যে, এতক্ষণে আসার সময় হল! দেখ তো শাড়িটা ঠিক পরা হয়েছে?”
“শাড়ির ব্যাপারে আমি কি বুঝি!” গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বলল অর্ক।
“বুঝতে তো হবেই। দু দিন পর বৌকে শাড়ি কিনে দিতে হবে না!”
শাড়ি পরে ডিম্পি যেন পুরো পাল্টে গেছে। ওর মুখে এসব ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনে অবাকই লাগছে অর্কর। এসব নিশ্চয় ঐ অবতারের সঙ্গদোষ! ভেবেই গা জ্বলতে লাগল ওর।
“আমি বিয়ে করব না!”
“ইঃ তোর ঘাড় করবে!”
“তুই নিজে করার আগে তো আমার পারমিশন নিচ্ছিস না, তাহলে তোর কথা আমাকে শুনতে হবে কেন?! আর আমি না তোর মতো এত হ্যাংলা আর বিয়েপাগল না! ”
কথাটা বেশ রূঢ় শোনাল, এর আগে কোনদিন এভাবে ডিম্পির সাথে কথা বলেনি ও। কথাটা বেরিয়ে যাবার পর চোখটা ভিজে এল। ডিম্পিও যে অবাক হয়েছে ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “খুব রেগে গেছিস না!? ওকে ডান, এরপর সব কিছু তোকে বলেই করব। হানিমুন ডেস্টিনেশনটা তুই ঠিক করে দিস কেমন! এখন যা তো মোড়ের দোকান থেকে চারটে এগরোল নিয়ে আয়, নাহলে পাত্রপক্ষ বলবে জলখাবারে সব মিষ্টি; নোনতা নেই কিছুই।”
এরপর এই মেয়েকে কি বলবে অর্ক, আর কিই বা বলার থাকতে পারে! ওর মনে হচ্ছে এরপর হয়ত রাগের চোটে ফেটেই পড়বে! মুখটা ব্যাজার করে বেরিয়ে পড়ল। ইচ্ছে করছে মাথার চুলগুলো ছিঁড়ে নিতে, রাস্তায় যাকেই দেখছে মনে হচ্ছে চিবিয়ে খায়। এই জন্যেই বলে সময়ের কাজ সময় থাকতে করতে হয়। আচ্ছা ডিম্পিরই বা এত কিসের তাড়া! সবে তো কুড়ি! বাড়ির লোকরাও কিরকম! এতদিন ধরে দেখছে ওদেরকে, ওদের মনে হয় না ওরা দু’দুজনের রাজজোটক! পাড়ায়-কলেজে তো সর্বত্র আড়ালে এই কথায় হয়, ডিম্পিকে যদি কেউ সামলাতে পারে তো সেটা অর্ক। বাইকের হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে ভাবল অর্ক, এখনো সবটা শেষ হয়ে যায়নি। যে করেই হোক আটকাতে হবে ব্যাপারটা।
“এই পিন্টু চারটে এগরোল। আর শোন্ একটাতে যত পারিস ঝাল দিবি, তবে ওটা মার্ক করে দিবি। সাদার বদলে নিউজ পেপার দিয়ে মুড়বি তাহলেই হবে!”
“কি ব্যাপার অর্কদা, তুমি তো আজ অব্দি কাউকে বাঁশ দাওনি, পিসটা কার জন্য?”
“ডিম্পিকে যে মাকালটা দেখতে আসবে তাকে খাওয়াবো।”
“অ্যাঁ– আ-আমি নেই এতে। ডিম্পিদি জানলে আমার দোকানেই আমাকে ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে টাঙিয়ে দেবে-”
“আঃ জানতে পারলে তো! আমি তো পারলে পটাশিয়াম সায়ানাইড খাওয়াতাম, নেহাত ব্যানড হয়ে গেছে তাই!দেখ না কি অবস্থা করি ব্যাটার! কাল থেকে ওর জন্য টেনশনে মরছি আমি! খাওয়াচ্ছি এগরোল!”
“কিন্তু তুমি এসব করছ কেন, ডিম্পিদির বিয়েতে মত নেই নাকি?”
“ডিম্পিকে আমি ভালবাসি, বিয়েটা আমি করব তাই-”
“কি সাংঘাতিক!” বলেই পিন্টু ধপ্ করে বসে পড়ল।
“কি হল কি এই-”
“এত মেয়ে থাকতে তুমি কিনা শেষে ঐ মেয়ের পাল্লায়-,”
” ডিম্পির কাজগুলোই দেখিস তোরা, ওর মনটা কত ভালো সেটা দেখতে পাস না। সবাই তো সমান হয় না। গোলাপ থাকতেও কিন্তু শিবের পূজায় ধুতরোই লাগে, আমার ঐ জঙ্গলী মেয়েই পছন্দ! ওর ঐ ছন্নছাড়া অগোছালোভাবই আমার ভালো লাগে, অন্তত লোক দেখানো কিছু নেই! সি ইজ ইউনিক!”
“তা দেবাদিদেব মহাদেব,দুদিন আগে এই উপলব্ধিটা হলে ভালো হত না! আমাকে মাঝখান থেকে ফাঁসালে। তবে তোমার জন্য এই রিস্কটা নিলাম, আজই বলে দাও ব্যাপারটা। তারপর দ্যাখো কি আছে কপালে!”
রোলগুলো রেডি করে অর্কর হাতে দিল পিন্টু, এখনও লোকজন আসেনি তেমন, তাই ওর দোকান ফাঁকা। সন্ধ্যে যত হবে, তত ভিড় বাড়বে। মাঝে একটা ওষুধের দোকানে ঢুকল কিছুক্ষণের জন্য তারপর ডিম্পির বাড়ির দিকে বাইক ছোটাল অর্ক। এতক্ষণে হয়ত পাত্রপক্ষ এসে পড়েছে। আগে গিয়েই কায়দা করে সরবতে যে মোক্ষম দাওয়াইটা কিনেছে সেটা মেশাতে হবে। সরবত, এগরোল খাইয়ে বাবাজীবনকে বাথরুম বা বাড়ি পাঠাতে পারলেই কেল্লা ফতে! তারপর সবার সামনে ডিম্পিকে কথাটা বলবে। ডিম্পি রাজি হোক বা নাই হোক,পাত্রপক্ষ এভাবে অপদস্থ হবার পর এই বিয়েতে নিশ্চয় না করে দেবে! পরেরটা অর্ক সামলে নেবে। ব্যাপারটা খুবই ছেলেমানুষি আর অসভ্যতামি হচ্ছে,ও জানে। ইনফ্যাক্ট এরকম কাজ যে অর্ক করবে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু উপায় নেই!
ঘরের ভিতরে ঢোকার আগে জুতো খোলার সময় শুনতে পেল, ডিম্পির বাবা বলছেন,
“তাহলে ঐ কথাই রইল বেয়ান, ফাইনাল এক্সামের পর ভালো দিন দেখে বিয়েটা দিলেই হল। যাকে বলে শুভস্য শীঘ্রম! তারপর বিয়ের পর একসাথে পড়ো যত খুশী। কারো কোনো আপত্তি নেই!হেঁ হেঁ-”
যাহ্ তার মানে সব ফাইনাল হয়ে গেল! আপত্তি নেই মানে! আলবাৎ আছে! আর কারো না হোক ওর আছে। আজ যা হবার হোক, পাত্রপক্ষের সামনে সিন ক্রিয়েট হোক, ও এ বিয়ে ভাঙবেই! বাবা হয়ত বাড়ি থেকে বেরও করে দেবে এসবের পর! তা দিক! কিন্তু বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী না ইয়ে মানে ডিম্পি! অর্ক মনে জেদ নিয়ে ঢুকে পড়ল বসার ঘরে, কিন্তু বলতে গিয়েই থম মেরে গেল। ঘরেতো ওর আর ডিম্পির বাবা মা ছাড়া কেউ নেই! ডিম্পি বিজ্ঞের মতো সোফায় পা তুলে বসে চোখ পিটপিট করছে ওর দিকে তাকিয়ে। তাহলে বেয়ানটা কে?
“ওরা আসেনি এখনো?”
“কারা?” ডিম্পি মুখ ব্যাঁকাল।
“তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন।”
“এরাই আমার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন!” অর্কর বাবা-মার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল ডিম্পি।
“মা-মানে?”
” হাঁদা গঙ্গারাম তুই তো চাসই আমাকে অন্য কারো ঘাড়ে চাপাতে, নিজে অন্য মেয়ে দেখে বেড়াবি তাই না? শয়তান একটা! কিন্তু আমি তো এত সহজে তোমার ঘাড় থেকে নামব না চাঁদু! আমি বেতালের মত তোমার ঘাড়েই চাপব, তুইই হবি আমার বিক্রম!” ডিম্পির কথা শুনে সকলে হাসতে শুরু করল। ডিম্পির মা বললেন,” আচ্ছা অর্ক তুই ছাড়া আমার এই পাগলী মেয়েটাকে আর কে সামলাবে বল তো! অন্য কারো ক্ষমতা আছে!”
“এসবের মানে কি? মা তার মানে তোমরা সব জানতে আগে থেকে!” অর্ক ওর মায়ের দিকে তাকাল।
“তুই ছোটবেলায় যখন কথা বলতে পারতিস না তখন তোর মনের কথা বুঝতে পারতাম, আর এখন পারব না? আমরা তো সবই জানি, বুঝি। কিন্তু তোর মুখ দিয়ে কি কিছুই বেরোবে না!ভেবেছিলাম তোরাই সব ঠিক করে আমাদের বলবি, আচ্ছা ছেলে বটে! ডিম্পি কি কপাল রে তোর! তোর মত ঠোঁটকাটা মেয়ের বর হবে কিনা এমন মুখচোরা ছেলে! ”
“তাহলেই বোঝ কাকিমা, কেমন জলে পড়ছি! এতক্ষণেও ওনার মৌনব্রত ভাঙল না। ভাবলাম পাকাদেখার কথা শুনে হয়ত মনে একটু হিংসে জাগবে, তখন হয়ত বলবে! কিন্তু নাহ্! এ জীবনে মনের কথাটা বলবে বলে তো মনে হয় না। আমার এর থেকে কলাগাছকে বিয়ে করা ভাল, হাওয়া দিলে দুটো পাতাও তো দুলবে!যা তা একদম!”
অর্কর চোখে জল এসে গেছে। তার মানে সবাই মিলে ওদের দুজনের বিয়ের প্ল্যান করছিল এতক্ষণ, এটা ওদের পাকাদেখা।
“আঃ ডিম্পি, অর্ক তো বরাবরই ওরকম; বুক ফাটবে কিন্তু মুখ ফুটবে না। ও এত ভালো বলেই কিন্তু তোমাকে আমরা পাত্রস্থ করতে পারছি, নয়ত তুমি যেমন ! কে যে বিয়ে করত তোমায়!যা ওকে এগরোল খাওয়া, বেচারার কিরকম মুখ শুকিয়ে গেছে দ্যাখ্! ” ডিম্পির মা বললেন।
“ব্যাস, তুমি তো ওকেই সাপোর্ট করবে!বলদ একটা! কত হিন্টস দিলাম জানো! বললাম আমি চিনি ছেলেটাকে, বৌকে শাড়ি কিনে দিতে হবে এবার, হানিমুন ডেস্টিনেশনটা তুই ঠিক করিস-”
“ওতে বোঝা যায় নাকি!” মুখ বেঁকিয়ে বলল অর্ক।
“আজ্ঞে! বুদ্ধি থাকলে ঠিকই বোঝা যায়। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে কি তোকে দিয়ে হানিমুনের জায়গা ঠিক করাতাম নাকি! আর চারটে রোল আনতে বলেছি সেটাতেও ধরতে পারলি না, এত তালকানা!”
“মানে?”
“আজ কি বার?”
তাই তো! আজ বৃহস্পতিবার! মা-কাকিমার নিরামিষ!চারটে রোল বাকি চারজনের! আগেও এনেছে এরকম! ইস্ টেনশনে কমনসেন্সটাই ছিল না।
“ডিম্পিকে যে বিয়ে করবে তার তো মুখ শুকোবেই কাকিমা!কপালে যে কি কি আছে!” নিজেকে সামলে বলল অর্ক।
“বাঃ এই তো মুখ ফুটেছে! আজ তোর হচ্ছে দাঁড়া! কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা আর- ছাড় তো, আগে আমি এগরোল খাব-”
অর্ক কিছু বোঝার আগেই ডিম্পি সোফার থেকে ঝাঁপিয়ে এসে প্যাকেট থেকে রোল বের করে মোক্ষম কামড় বসাল!
“অ্যাঁ–,মরে গেলাম মাগো-” ডিম্পি আর্তনাদ করল।
“সর্বনাশ করেছে!” দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল অর্ক। এটা যে সেই মাস্টারপিস্ স্পাইসজেট! কিন্তু ততক্ষণে যা অ্যাকশান হবার হয়ে গেছে! এরপর বিয়ে হবে না ডিভোর্স ভগবান- নাহ্ ডিম্পির ব্যাপার-স্যাপার ভগবানেরও অজানা! আবার কেস জন্ডিস!