রাত প্রায় এগারোটায় অয়নের ফোন টা এসেছিল। অনুপমা তখন জেগেই ছিলেন।আজকাল তাঁর তাড়াতাড়ি ঘুম আসতে চায়না। এইসময় তিনি টিভি দেখেন, বই পড়েন টুকিটাকি কাজ সারেন।
ফোনে অয়নের কথাগুলো তাঁর প্রথমে বিশ্বাস হয়নি।এতবড় একটা সিদ্ধান্ত ওরা একাই নিয়ে নিল।তাঁকে একবার জানাবার প্রয়োজন বোধ করল না। তবু সেই মুহূর্তে অয়ন কে কিছু বলার মতো ভাষা তিনি খুঁজে পাননি।নিজের একমাত্র ছেলের কাছ থেকে এত টা অবজ্ঞা মা হিসেবে কি মেনে নেওয়া যায় ?
নিজের অভিমান রাগ কাউকে জানাবার মত দ্বিতীয় ব্যাক্তি তাঁর বাড়িতে নেই। স্বামী অমলেন্দুর ফটোর সামনে গিয়ে চোখের জল ফেললেন অনুপমা। একবার ভাবলেন ফোন করে অয়নের কাছে কৈফিয়ত চাইবেন । তারপর ভাবলেন কাল দুপুরেই তো ওরা আসবে বলল তখনই জিজ্ঞেস করবেন।
সকালে একরাশ মন খারাপ নিয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনুপমা । অয়ন বৌমা দুপুরে খাবে। রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে তাঁকে । সকালে স্নান সেরে পুজোয় বসেন তিনি। কিন্তু থেকে থেকে দমকা বাতাসের মত অভিমান বেরিয়ে আসছে তাঁর । অসময়ে অমলেন্দুর চলে যাওয়াটা তাঁকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে । তবুও সেই ভয়ঙ্কর শোকের দিনগুলোতে অয়ন ছিল তাঁর পাশে। তখন অয়ন চাকরি পায়নি। চারদিকে ইন্টারভিউ দিচ্ছে । মা ছেলের সংসার ।একেক দিনের একেকরকম অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতো সে মা কে। তারপর একদিন ভালো চাকরি হল অয়নের । শুধু ওকে আঁকড়েই তখন অনুপমা জীবনের স্রোতে ফিরতে পেরেছিলেন। আর সেই ছেলেই কিনা এত বড় একটা সিদ্ধান্ত তাঁকে না জানিয়ে নিয়ে নিল।
দুবছর পর দেখে শুনে সায়নীকে বৌ করে ঘরে আনলেন অনুপমা। বাড়ি টা ঝলমল করে উঠলো। সায়নী রহড়ায় সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা । বিয়ের পর টালিগঞ্জ থেকে যাতায়াত করতে খুব কষ্ট হত সায়নীর। কিছদিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাধ্য হয়ে তাকে বাপের বাড়িতে থেকে স্কুল করতে হত।সায়নীর বাপের বাড়িতে বাবা একা। মা অনেক দিন মারা গেছেন। সোম থেকে শনি স্কুল করে বিকেলে শ্বশুর বাড়িতে ফিরতো সে। আর সোমবার সকাল হলেই বেরিয়ে যেতে হত।অয়ন কিন্তু একদিনের জন্যও মা কে ছেড়ে সায়নীদের বাড়িতে রাতে থাকতো না। অনুপমাও মনে মনে কষ্ট পেতেন। কিছুদিন এইভাবে চলার পর সায়নী চাইল উত্তর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিতে। তাহলে সবাই মিলে একসাথে থাকতে পারবে। অয়ন ও মনে মনে সেটাই চাইলো। কিন্তু অনুপমা কি করে স্বামীর তৈরি বাড়ি এতদিনের পুরানো পাড়া ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে ওঠেন।
শুরু হল দ্বন্দ্ব ।অনুপমা বেশ বুঝতে পারলেন তাঁর এই জেদের জন্য সম্পর্কে চিড় ধরছে। সায়নী আজকাল ভালো ভাবে কথা বলেনা।রবিবার অয়ন কে নিয়ে এদিকে ওদিকে বেরিয়ে যায় । সোমবার যাবার সময় ওর মুখটা থমথমে হয়ে থাকে। ছেলেরও কিছু বদল অনুপমার চোখে ধরা দিয়েছে। এর ছমাস পর অয়ন জানালো সে দমদমে ফ্ল্যাট কিনছে।খেতে বসে মা কে বলল,
“মা ফ্ল্যাট টা আমি নিজের টাকায় কিনছি।এবার নিশ্চয়ই ওখানে গিয়ে থাকতে তোমার অসুবিধে হবেনা। ছেলের বাড়ি তে থাকতে কোনও আপত্তি নেই তো।”
অনুপমা কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলেন । ছেলে বৌমার এই টানাপোড়েন মনখারাপ তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না। শুধুমাত্র ওর জন্য ওরা একসাথে সংসার করতে পারছেনা এই অপরাধ বোধ তাঁকে যেন কুরেকুরে খাচ্ছিল। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে পঁয়ত্রিশ বছরের দীর্ঘ স্মৃতি পিছনে ফেলে তিনি চললেন ছেলে বৌমার নতুন সংসারে।
সবাই খুশি সব সমস্যার যেন সমাধান হয়ে গেল।
কিন্তু অচেনা অজানা পরিবেশে ফ্ল্যাটের বদ্ধ জীবনে অনুপমা ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠতে লাগলেন । সকাল দশটার মধ্যে অয়ন সায়নী দুজনেই বেরিয়ে যায় । সায়নী স্কুল থেকে ফিরেই টিউশন করতে বসে ।সারাদিন তার কথা বলার সময় নেই ।এই ফ্ল্যাটে কারোর সাথেই ওদের তেমন আলাপ পরিচয় নেই। রাতের খাবার টেবিলেই যা ছেলে বৌমার সাথে অনুপমার একটু কথা হয়। পুরনো পাড়ার প্রতিবেশীরা প্রায় ফোন করে অনুপমা কে।কত অনুষ্ঠান কত পুজো হয়ে যাচ্ছে। সবাই তাঁকে খুব ডাকে। কিন্তু যাবার উপায় নেই । কার সঙ্গে যাবেন? তিনি বুঝতে পারেন এখানে থাকলে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবেন না।শেষে একদিন বাধ্য হয়ে রাতে খাবার টেবিলে কথাটা পাড়লেন ।শুনেই অয়ন না করে দিল। সায়নী বলল
” তোমার কোথায় অসুবিধে হচ্ছে বলো। সারাদিন টিভি দেখো বই পড়ো ? বিকেলে ছাদে গিয়ে একটু হাঁটো।”
অনুপমা কিছুতেই বোঝাতে পারলেন না নিঃসঙ্গতা কতটা ভয়ঙ্কর ।যাইহোক তিনি কিন্তু হাল ছাড়লেন না।লাগাতার ছেলে কে বলে বলে রাজি করালেন।প্রথমে এক সপ্তাহ তারপর একমাস করে করে পুরনো বাড়ি তে স্থায়ী ভাবে থাকা শুরু করলেন।এখন বছরে দুতিন বার ছেলের কাছে যান।ওরাও আসে।এইভাবেই একা থাকাটা কখন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে ।কেটেও গেল চারটে বছর।
পুজো সেরে রান্না ঘরে ঢুকলেন অনুপমা। কাজের মেয়েটা এলে তাকে দিয়ে মাছ মাংস আনিয়ে নিজের হাতে রান্না করলেন।কতদিন বাদে ওরা দুপুরে খাবে। একটা নাগাদ অয়নের গাড়ি টা এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। অনুপমার কৌতুহল বাঁধন ছাড়া হচ্ছে ।তিনি দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।একে একে অয়ন সায়নী ভেতরে এল।সায়নীর হাত ধরে আছে একটি বছর পাঁচেকের ছেলে। সায়নী নিজে প্রনাম করে ছেলেটি কে বলল “রাজা প্রনাম করো।ইনি তোমার ঠাম্মী।”
ঘরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল অয়ন। সায়নী বাচ্চাটিকে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুপমা রান্না ঘর থেকে ওদের জন্য করে রাখা লেবুর সরবত নিয়ে এলেন। বাচ্চা টি এক চুমুকে শেষ করল।অনুপমা আড় চোখে বাচ্চটির দিকে তাকালেন।দেখতে শুনতে খারাপ নয় একটা বড় ঘরের ছাপ আছে। নীরবতা ভেঙে অয়ন প্রথমে বলল,
” মা এখানে একটু বসো ।তোমার সাথে কথা আছে।”
অনুপমা চেয়ারে বসে বললেন
“বল কি বলার আছে?”
“তুমি রাগ করেছো?”
চুপ করে থাকলেন অনুপমা।কাতর গলায় অয়ন বলল
“মা বিশ্বাস করো বহুবার তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি।কিন্তু ভয় পেয়েছি যদি না করে দাও।”
“আমি যদি না করতাম তোরা কি সেটা শুনতিস।কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন সিদ্ধান্ত? ”
চুপ থাকে দুজনে।অনুপমা বললেন
“ছবছর পর কি কারো বাচ্চা হয়না?নাকি কোথাও কোন অসুবিধা আছে।”
এবার সায়নী এগিয়ে আসে অনুপমার দিকে।নরম গলায় ধীরে ধীরে বলল,
” মা বিশ্বাস করো ওসব কিছু না। এখনো যে কোনদিন আমাদের নিজেদের সন্তান আসবেনা সেটা বলছি না।কিন্তু রাজার ওপর বড্ড মায়া পড়ে গেছে। ও কে যে হোম থেকে নিয়েছি ওখানে মাঝেমাঝে আমরা যেতাম।আমার এক বান্ধবী ওখানে যুক্ত । প্রথম দিন থেকেই কেন জানি না রাজা কেমন মায়ায় জড়িয়ে ফেলল।তখন ও আরো ছোট ছিল আমরা গেলেই দৌড়ে আসতো। ওর টানে বারবার যেতাম ওখানে।আমার বান্ধবী একদিন প্রস্তাব দিল।বলল একটা অসহায় অনাথ শিশু কে নিজেদের মনের মতো করে বড় কর না। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো। ”
গলা বুজে আসে আসে সায়নীর।অয়ন বলল ,
“মা আমরা ভাবতেই পারিনি এত সহজে রাজা কে পাবো।হঠাৎ করেই সব কিছু হয়ে গেল।”
অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে সবটা শুনলেন অনুপমা। সবই বুঝলেন তবু কোথায় যেন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ।
সায়নী হঠাৎ অনুপমার চেয়ারের কাছে মাটিতে বসে পড়ে অনুপমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো।
“মা এবার তুমি আমাদের কাছে যাবে তো?রাজা কে তোমার দায়িত্বে রেখে নিশ্চিন্তে থাকবো।”
অনুপমা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তারপর অভিমানের সুরে বললেন,
” কাল পর্যন্ত কোনকিছু জানালে না আর আজ একেবারে আমাকে নিতে চলে এলে।ভাবলে কি করে বললেই চলে যাবো?”
তারপর একটু সামলে নিয়ে বললেন,
“অনেক বেলা হয়ে গেছে।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ।হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে চলে এসো সবাই।”
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে অনুপমা নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। অয়ন সায়নী পাশের ঘরে রাজা কে নিয়ে শুয়েছে।
বড় অস্থির লাগছে অনুপমার ।নিজেকে কেমন ছোট লাগছে। মনে হচ্ছে ওদের উদারতার পাশে তিনি ভীষণ স্বার্থপর।আজ ওদের নিজেদের বাচ্চা হলে কি তিনি মুখের ওপর না বলতে পারতেন। কিন্তু সে তো ওনার নিজের রক্তের হত।এমন সময় হঠাৎ তিনি পায়ে ছোট্ট হাতের স্পর্শ পান। চমকে উঠে দেখলেন পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাজা।
“এ কি তুমি ঘুমায়ো নি।”
“তোমার কাছে যাবো ঠাম্মী?”
“উঠে এসো।”
হাত বাড়িয়ে রাজা কে খাটে তুলে নিলেন অনুপমা।
দুচোখে জল টলটল করছে রাজার।
“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
মাথা নিচু করে বসে থাকে রাজা। অনুপমা আবার জিজ্ঞেস করলেন
” বলো কি হয়েছে? তোমার মা বকেছে?”
“না।”
“তাহলে?”
“মা বাবা কে বলছে আমাকে হোমে পাঠিয়ে দেবে।”
“কিন্তু কেন?”
“তুমি যদি আমাদের সাথে না যাও তাহলে পাঠিয়ে দেবে।”
তারপর এক ঝটকায় রাজা অনুপমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।ছোট হাতে গলা জড়িয়ে বলল,
“বলো না ঠাম্মী যাবে তো?”
শিশু হাতের স্পর্শে অনুপমার সব অভিমান মুছে যায়। মনে ভাবেন আজও তিনি এতটা গুরুত্বপূর্ণ কারোর জীবনে । তিনি আজ না গেলে এই শিশু টিকে মা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। নিজের অজান্তেই বুকে টেনে নিলেন রাজাকে। কোথাও তো আর কোন সমস্যা হচ্ছে না তার।
এত দিনে যেন বেঁচে থাকার যথার্থ মানে খুঁজে পেলেন অনুপমা ।