সেদিন জমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে সকাল থেকে। হস্টেলে থাকি। বিবেকানন্দ রোডের ওপরেই আমাদের ছাত্রী আবাস। পড়ুয়া মেয়েরাও যেমন থাকতাম, আবার চাকরি-করা কিছু দিদিরাও থাকত। পুজোর পরপরই এমন আচমকা পৃথিবী-অন্ধকার-করা বৃষ্টি বলেই হয়ত কেউই বাইরে বেরোবার তাগিদ অনুভব করলাম না। সবাই এ ওকে বললাম, আজ আর কলেজ যাওয়ার দরকার নেই। দিদিদের বলতে, তারাও অফিস যাওয়া মাথায় তুলল।
এমনিতেই পুজো পুজো গন্ধ আর আলসেমি তখন সকলের মধ্যে, ফলে মুহুর্তেই একটা হৈ-হৈ ভাব ছড়িয়ে পড়ল হস্টেলের একতলা থেকে দোতলা জুড়ে।
কড়কড় করে বাজের শব্দ মুহুমুহু। সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস। আর এমন বৃষ্টি যেন আজই পৃথিবীর শেষ দিন। ধূ ধূ অন্ধকার রাতের ঘনত্বকেও হার মানায়। ঠান্ডা বাতাসের চোটে বেশ শীত করছে। সবাই যে যার বিছানার চাদর জড়িয়ে নিয়েছি এই সকাল এগারোটাতেই। দল পাকিয়ে গল্প করছি যে যে যার মতো। অন্ত্যাক্ষরী খেলাও চলল। কিন্তু ঠিক যেন অকাল এই ভয়ঙ্কর বৃষ্টিকে এনজয় করা যাচ্ছিল না। তখনই এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টের মালবিকাদি বলল, ভূতের গল্প চাই। খাটি ভূতের গল্প। সঙ্গে চা আর যার যা নোনতা আছে সঙ্গে, বার করে ফেল। রান্নার মাসিকে অলরেডি বলে দিয়েছি খিচুড়ি আর ওমলেটের কথা, কেমন?
মালবিকাদির কথা শেষ হল কি হল না, মেয়েরা সমস্বরে ‘উউউ.. করে চেচিয়ে উঠল।
শুরু হল খাঁটি ভূতের গল্প। আমরা সব ভূতের নাম শুনেই একে অপরের গায়ে এটুলির মতো সেঁটে বসেছি তখন।
মালবিকাদি বলল, সবাইকেই বলতে হবে, , ছোটো ছোটো গল্প। আমাদের হস্টেলের সবচেয়ে বিচ্ছু মেয়ে রোশনারা, ও বলে উঠল, মালবিকাদি আমি যদি শুরু করি ?
-কর। কিন্তু সিরিয়াস, দুষ্টুমি চলবে না।
রোশনারা ঘাড় নাড়ল, বলল, একদম সিরিয়াস। আমি এর আগে ঘটনাটা কাউকে বলিনি কিন্তু তোমরা ভয় পাবে বলে। সমস্বরে বলে উঠলাম, তার মানে? ঘটনাটা কি হস্টেলের ?
গম্ভীর মুখে রোশনারা মাথা নাড়ল। আমরা পরস্পর আরো জড়োসড়ো। রোশনারার মুখেচোখেও কেমন ভয়ের ভাব। একটু সময় নিল। ও ভাবতে, তারপর ফিসফিস করে বলল, এইখানে, এই হস্টেলেই এমন একজন আছে যে আমাদের মতো নয়। একসময় ছিল, এখন শরীর ধারণ করে মাঝে মাঝে!
সায়েন্স কলেজের জয়িতাদি বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে, তোর না পিওর সায়েন্স রোশন ?
তো?
মালবিকাদির বয়স পয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে, আমাদের সকলের সিনিয়র, ধমক দিয়ে উঠল এবার, বলল, সায়েন্স কবে এসেছে জয়িতা? সায়েন্স কী?
প্রকৃতির মধ্যে এই যুনিভার্সের মধ্যে যা কিছু আছে তাকে নিজের বুদ্ধি দিয়ে আবিষ্কার করে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা অথবা ধরো শুধুই আবিষ্কার। আর আজ আমরা ভূতের গল্প শুনব। সে বস্তু আছে কি নেই বলেই তো আমাদের এত প্রিয় বিষয়। যুক্তি-তর্কে গিয়ে লাভ কি ? তাহলে ল্যাবরেটরিতে চলে যাও যারা যারা ভাবছ তর্ক করবে। আামাদের মধ্যে আবার গুনগুন।
জানলা আর জানলা পেরিয়ে লম্বা বারান্দার ওপারে তখন পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়া দুর্যোগ চলছে। জলের ছাট আসছে ঘরে, কিন্তু জানলা বন্ধ হতে দিইনি আমরা। তাহলে এই প্রলয়ঙ্করী বৃষ্টি দেখতে পাব না, তাই।
রোশনারা আবার ধরল, আমি তার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু কোনোদিন মুখ দেখিনি।.প্রথম আমি তাকে দেখেছি পয়লা বৈশাখের দিন সন্ধেবেলা! বড়মামার বাড়ি থেকে ফিরছি। সন্ধেবেলা এখানে পাওয়ার কাট ছিল মনে আছে? সবাই মাথা নাড়লাম, হ্যা,
একতলার সিড়িটা সবে পেরিয়েছি, দোতলার সিড়ির দুটো কি তিনটে স্টেপে তখন, হঠাৎ আমার সামনে দেখি একটা রোগা মতন শাড়ি পরা মেয়ে ওপরে উঠছে। বিশ্বাস করো সবাই, আমি এমন চমকে উঠেছিলাম যে প্রথমত পড়ে যেতে পারতাম। সেকেন্ডেরও কম সময়ে আমার মনে হল, কে এ? একতলায় দেখিনি! আমাকে ক্রস করে উঠলেও পায়ের শব্দ হত অথবা গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগত ? কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। ভাবতে না ভাবতে দেখি সিাঁড়িতে আর কেউ নেই! আমি তাও দৌড়ে উঠলাম। কেউ কোথাও নেই! ছাদ পর্যন্ত গেলাম। নাহ, নেই কেউ।
ওর শাড়িটা ছিল লাল হলুদের প্রিন্ট। স্পষ্ট মনে ছিল, তাই ঘরে ঘরে উকি দিয়ে দেখলাম ওরকম শাড়ি কেউ পরেছে কিনা আজ। মাথা নাড়ল রোশনারা, না, কেউ পরেনি। কাজল মাসি তখন রান্না করছিল, ‘মাসিকেও জিজ্ঞেস করলাম, ওরকম কেউ মাসির কাছে এসেছে কিনা। শুনে মাসি যেন কেমন হয়ে গেল, বুঝলে? পরিস্কার দেখলাম মাসির মুখটা একেবারে এইটুকু হয়ে গেল। বলল, ও তুমি ভুল দ্যাখছ। কী দ্যাখতে কী দ্যাখছ, ভইল্যা যাও।
-ভুল দেখেছি মানে?
-মানুষের মনে কত রকম ব্যায়রাম থাকে জানো না ? কিসু এটা চিন্তা কইরতা কইরতা উঠছিলা হয়তো..।
মাসিকে আর ঘাঁটালাম না। মনে হল, মাসি জানে ব্যাপারটা। এবং সেটা খুব একটা আমাদের পক্ষে সুবিধার হবে না বলেই চেপে দিল। আমাদের গায়ের রোম কাটা তখন। ঢোক গিলছি, পরস্পর আরো চেপে বসেছি। জয়িতা বলল, ওই একদিনই..?
-উহ। বার পাঁচেক দেখেছি। একদিন অন্ধকার থাকতে উঠে বাথরুমে যাব, দেখি বাথরুমের দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিই, কেউ সাড়া শব্দ করে না। জিজ্ঞেস করলাম, কে আছ? বেরোও। জোর চেপে গেছে আমার। ওমা কোনো উত্তর নেই। দু’পা পেছনে ফিরেছি অন্য বাথরুমে যাব। বলে, হঠাৎ দেখি হুড়মুড়িয়ে আমাকে ডিঙিয়ে কেউ একজন সদ্য স্নান করে চলে গেল, এবং নিমেষে ভ্যানিশ! এবং পরিষ্কার বুঝলাম তিনি সিড়িতে দেখা হওয়া সেই মেয়েই!
আর?
উত্তমাদি বলল, আর দরকার নেই। এই তো যথেষ্ট। এর উত্তর কাজল মাসির কাছেই আছে। পরে জেনে নেব। আমাদের ক্ষতি তো কিছু হয়নি না একদিনে? তাহলে যে আছে সে থাক। কী বলো মালবিকা? মাথা নাড়ল মালবিকাদি যার অর্থ সম্মতিসূচক। আর আমরা ?
পারলে এ ওকে খিমচে ধরি। মনীষার হাত পা হঠাৎ ঠান্ডা। সে যেন কাঠের পুতুল, বলল, আমি আর থাকব না এখানে। বাথরুম পেয়েছে। জয়িতা বলল, ইল্যুশন!
মালবিকাদি বলল, তাহলে আমি বলি?
তখনই সঙ্গে সঙ্গে কানে-তালা-লাগিয়ে দেওয়া শব্দে বিকট জোরে বাজ পড়ল। রাস্তা থেকে উড়ে এল ছেড়া একটা কাগজের পৃষ্ঠা পড়ল সোজা আমাদের মাঝখানে। নোংরা ভেজা কাগজ ভেবে ফেলতে যাবে। সেটা অয়নিকা ফেলার আগেই চিৎকার করে উঠল সে, বলল, দ্যা—খ, দ্যাখ কী লেখা
-কী লেখা মানে ?
অয়নিকা কাপছে, বলল, তপনদার হাতের লেখা। আ-আ-মার গ্রামের বাড়ির পাড়ার। বলতে বলতে ‘আঁ আঁ’ করতে করতে অয়নিকা ঝড়ে নোয়ানো গাছের মতো ভেঙে পড়ল।
মালবিকাদি ওকে কোলে টেনে নিয়েছে, জড়িয়ে গিয়ে মাথায় গায়ে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ব্যাপারটা বল? কোনো ভয় নেই। আমরা আছি না? ভূত হলে ভূতের জ্যাঠা পর্যন্ত পালাবে আমাদের মধুরিমার মুখের ঠ্যালায়। মধুরিমার সঙ্গে ঝগড়ায় বা ভালোবাসয় আমরা কেউ পেরে উঠিনি তখন পর্যন্ত। সে এক ভারী মজার মেয়ে তেড়ে ঝগড়া করে প্রতিপক্ষকে কাদিয়ে তারপর নিজে কাদতে বসে। অয়নিকার হাত থেকে তখন সোনাল কাগজটা নিয়ে নিয়েছে। তাতে লেখা, ‘চললাম, চির বিদায় ।
আশ্চর্য! অমন ভেজা স্যাতসেতে কাগজে লেখাটা কিন্তু অবিকৃত! আরো আশ্চর্য? অমন ভেজা কাগজ উড়ে আসে কী করে?
অয়নিকা কাগজটার দিকে তাকিয়ে কাপতে কাপতে প্রায় মূর্ছা যাবার মতো অবস্থায় বলল, তপনদা সুইসাইড করার আগে আমায় লিখেছিল!– আ-আমি গুরুত্ব দিইনি। ওর লেখা ওকেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম..!
-সে কোথায়?
অয়নিকা আঙুল তুলে দেখাল, পরপারে।
বিশ্বাস হচ্ছে না আমাদের হচ্ছিল না। রোশনারার ভূতের গল্পও যেন কেমন ঠান্ডা মেরে গেল। সকলেই মনে মনে ভাবছি এ কী করে সম্ভব ? এ তো হাতে গরম প্রমাণ? কিন্তু এর সত্যতা মানতে মন চাইছিল না। মালবিকাদি উত্তমাদিকে বলল, ভূত আছে প্রমাণ করতে অয়নিকার এক্স বয়ফ্রেন্ড কেমন হাজির হল দেখলে উত্তমা? এরপরও বলবে ভূত নেই? আমরা সবাই হাসলাম, আবার হাসলামও না। অয়নিকা তখনই বলল ‘আমি ঘরে গিয়ে শোব। আমার ভালো লাগছে না কিছু। আমি যাই,’ বলতে বলতে ও প্রায় ছুটে ওর রুমে চলে গেল।
মালবিকাদি বলল, ভয় পাবি না তো একা?
সে কথা ও শুনল নাকি শুনল না বোঝাই গেল না। আমরা আবার পরস্পর চোখ চাওয়াচাওয়ি করছি। গল্প হচ্ছিল ভালো, তার মধ্যে এ কী আজব ঘটনা! এই কথাই মনে হচ্ছিল সকলের।
অয়নিকা চলে যেতেই জয়িতা বলল, কমপ্লিট ঢপের কেস! বাদ দাও । সবই চপের, তবুও শুনতে তো মন্দ লাগছে না। মালবিকাদি তুমি বলো এবার তোমার খাটি ভূতের ছানার গল্প।
মালবিকাদি একটু গম্ভীর যেন। যদিও লহমায় । স্বাভাবিক হল, বলল, ‘মায়ের মুখে শোনা ঘটনা এটা। বিশ্বাস করলে কর, না করলে আমার কিছু যায় আসে না ।’
কাজল মাসি এই সময়েই চা দিয়ে গেল আমাদের। চায়ে চুমুক দিয়ে আয়েশ করে বসল মালবিকাদি, শুরু করল, । আমার দিদিমা খুব রিলিজিয়াস মহিলা ছিলেন। আমিও দেখেছি। তবে উকিল বাড়ির মেয়ে ছিলেন বলেই হয়তো প্র্যাকটিক্যালও ছিলেন খুব বেশি। ছোটখাটো ব্যাপারেই কী কেন জিজ্ঞাসা করতেন। সে যাই হোক, তার এক গুরুদেব ছিলেন। গুরুদেবের প্রতি ভঙ্গি তাঁর অগাধ। তো সেবার গুরুদেব তাঁর পদসেবা টেবা নিয়ে ফিরে গেলেন প্রায় দিন পাঁচ দিদার বাড়িতে কাটিয়ে।
মা’র মুখে শোনা, গুরুদেব নাকি দিদাকে সেইবার পরলোক, আত্মা এসব সম্বন্ধে বেশ কিছু জ্ঞান দিয়েছিলেন। কিন্তু দিদার মনে যতই ভক্তি থাক দিদা এই ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করেননি। স্পষ্টই নাকি বলেছিলেন, ঈশ্বরে মতি আাছে আমার গুরুদেব, কিন্তু ক্ষমা করবেন, আত্মাপরলোক, ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই। গুরুদেব প্রজ্ঞানন্দ মহারাজ মৃদু হেসে সেইদিন বিদায় নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দেখা হবে খুব শীগ্রই। দিদিমা প্রণাম করে বললেন, “যত শিগগির পারেন পদধূলি দেন যেন।”
সাধারণত বছরে একবার আসেন গুরুদেব। কিন্তু সেইবার গুরুদেবের কথার মধ্যে যেন প্রচ্ছন্ন কোনো ইঙ্গিত ছিল বলে মনে হয়েছিল দিদিমার। দাদুকে বলেওছিলেন সে কথা। দাদু এসব কিছুই মানতেন না। দাদু সবই উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ভূত প্ৰেত ঈশ্বর দত্যি দানো আমি কিছুই মানি না। অতএব কানের কাছে ম্যালা ঘ্যানঘ্যান করো না।
ঘটনাটা ঘটল ঠিক দুদিন বাদে। গুরুদেবের আশ্রম থেকে চিঠি এল। দিদিমা সেই নিমন্ত্ৰণ-পত্রটি পড়ে সঙ্গে সঙ্গে সেন্সলেস! নিমন্ত্ৰণ-পত্রে গুরুদেবের মৃত্যুর দিন লেখা ছিল। আর পারলৌকিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার জন্য অনুরোধ ছিল।
—কী!!!
হ্যা, একেবারে সত্যি ঘটনা। ওই মৃত্যুর দিনই ওদের দিদিমার বাড়িতে এসেছিলেন। পাঁচ দিন কাটিয়েছিলেন। আর দেখা হল পারলৌকিক কাজে।
‘আমরা আবার এ ওর কোলে উঠে বসেছি প্রায়। মালবিকাদি বলল, জয়িতা একে কোন সায়েন্সে ব্যাখ্যা করবে? আমার দাদু পর্যন্ত সব ‘বুজরুকি বুজরুকি’ বলেও বাথরুম যাবার সময় দরোয়ান নিয়ে যেতেন যতদিন বেঁচে ছিলেন।
আমি বললাম, আমি বলব একটা ঘটনা?
রোশনারা আমার রুমমেট, ও বলল, তোরও ভূত দর্শনের এক্সপিরিয়েন্স আছে নাকি? গাঁজা দিস না কিন্তু, ধরে ফেলব। মাথা নাড়লাম আমি। বলব কি তার আগেই আমার গলার ভেতরটা শুকনো খটখটে। কারণ এখন যা বলব তা তো আমি নিজের চোখে দেখেছি! এ তো অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার উপলব্ধি নয় ? আমার সমস্ত অতীত বর্তমান জুড়ে ওই ক্ষতবিক্ষত প্রাণীটি! আমার যুক্তিবাদী মনকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় যে আজও। যুক্তি-তর্কের মধ্যে আবার ঢুকে যাচ্ছিলাম বোধহয়, তাই উত্তমাদি বলল, অবন্তী কী ভাবছিস?
আমার দু’হাতের রোম তখন কাটার মতো দাঁড়িয়ে গেছে। ঢোক গিললাম, আমি ফিরে গেছি আমার ছ’বছর বয়সে। দেখতে পাচ্ছি সেই মধ্যরাত স্পষ্ট।
কে যেন তার মধ্যেই বলল, আরেকটু চা হলে হতো না? মাসিকে গিয়ে বলে আয় না কেউ ?
মালবিকাদি বলল, এখন না। অবন্তীর ঘটনা শেষ হোক। তারপর। আমি ফিরে গেছি তখন সেই ভীষণ গ্রীষ্মের রাতে। বয়স কত আমার? ছয়? স্পষ্ট মনে পড়ে দুপুর থেকেই সেদিন ভীষণ গরম। তার ওপর ঘনঘন লোডশেডিং। সারা দুপুর ঘুমোইনি আমরা। ওদিকে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। সেই বছরই স্কুলে ভর্তি হয়েছি একেবারে ক্লাস টুতে। সে যাই হোক। সেদিন সন্ধে বেলাতেও কারেন্ট চলে গেল কয়েকবার। তার মধ্যেই আমাদের বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটের কয়েকজন এল মা’র সঙ্গে গল্প করতে। ওরা সব চলে যাওয়ার পর আমি আর মা শুয়ে পড়লাম সেদিন অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই। আমার বাবা তখন অফিসিয়াল টুরে বাইরে আছেন।
আমাদের বাড়ির ভৌগোলিক অবস্থান না বললে গোটা ব্যাপারটার মাঝখানে ফাঁক থেকে যাবে। বরানগরে প্রফুল্লচাকী রোডে যেখানটায় আমাদের বাড়িটা, তার পেছনে পশ্চিম-উত্তর কোণ জুড়ে অন্তত কয়েক বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল দুলু মিত্তিরদের পোড়ো জমিদার বাড়িটা। জঙ্গল আর আগাছাভরা জমিটার দিকে আমি প্রায়ই তাকিয়ে থাকতাম। অনেক পাখি আসত জঙ্গলটায়। আর মাঝে মাঝে গামছা পরা দু-একজনকে দেখতাম সংলগ্ন পুকুরে স্নান করতে। সন্ধে হলে ভাঙাচোরা লাল ইটের বাড়িটার ফাক-ফোকর দিয়ে আলো ভেসে আসত।
লাল ম্যাড়মেড়ে সেই আলোর রং! আর আমাদের বাড়িটা একটি তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। বস্তুত, বাড়ির পেছন দিকে কোনো রেনশেড বা ‘জলের পাইপ’ ছিল না। খাড়া সোজা নির্মাণ ছিল বাড়ির পেছন দিকটা। সেই রাত; ভীষণ ভ্যাপসা গরমের রাতে আমরা দুজন প্রথমে খাটের ওপর শুলাম। সেই সময় অসম্ভব মশার উৎপাত। তাই মশারি ছিল বাধ্যতামূলক। শোয়ার পর তোশক চাদর মশারি সব মিলিয়ে গরমের উৎপাত বেড়ে গেল আরো। ঘামে ভিজে গেল চাদর বালিশ। আমি আর মা দু’জনেই এপাশ ওপাশ করেছি। অবশেষে মা বলল, চ, মানু নিচে মেঝেতে শুই। মশারিটা শুধু টাঙিয়ে নেব, চাদর পাতারও দরকার নেই। বলতে বলতেই মা লাফিয়ে নামল। মশারি খোলা হল। আমি আমার আর মার বালিশ মেজের ওপর পেতে শুতে তবে একটু যেন আরাম হল। মেজের নিজস্ব ঠান্ডা তখন পিঠে আরাম দিচ্ছে। তার ওপর মাথার ও পায়ের দিকের যথাক্রমে উত্তর-দক্ষিণের জানলা দিয়ে আসা বাতাস ক্রস ভেন্টিলেশন পাওয়ায় সেই বাতাস আমাদের ওপর দিয়ে মাঝে মাঝেই বয়ে যাচ্ছিল।
মা বলল, এইবারে ঘুমা। একটু আগে যদি এই বৃদ্ধিটা খুলত—!
তখন রাত কত জানি না। ঘুমিয়েও গেলাম। তারপর এল সেই সময়! হঠাৎ চোখ খুলে গেল আমার। কেন যে ঘুম ভেঙে গেল জানি না! চোখ খুলতেই আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল জানালার । লোহার লম্বা লম্বা শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বীভৎস মানুষটার শরীরের ওপর। তার দেহটি সম্পূর্ণ নয়। তার মুখ থেকে কোমর পর্যন্ত । আর সে যে কী বীভৎস তার শরীর। কারা যেন তার দেহটিকে ব্লেড বা ছুরির লম্বা লম্বা আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে! রক্তপাত নেই। শুধু ক্ষত আর ক্ষত নিয়ে আর ভয়ঙ্কর এক জোড়া আগুনের মতো চোখ নিয়ে সে আমার দিকে ভীষণভাবে তাকিয়ে আছে।
আমার বুদ্ধি যেন লোপ পেল সঙ্গে সঙ্গে। আমার ক্ষুদ্র শিশু বুদ্ধি দিয়েও বুঝলাম এ কোনো জীবন্ত মানুষ হতে পারে না। কিছুতেই না। চোখ বুজে গেল আপনা আপনিই। আবার চোখ খুললাম অল্প করে; কৌতুহল! সেই মানুষটি এখনও একইভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! চোখ অল্প ফাঁক করে দেখছি আমি, না, তার সৃষ্টির নড়চড় নেই। সে যেন কেন আমাকেই দেখছে অমন ভয়ঙ্কর ভাবে তা আমার ক্ষুদ্ৰ বুদ্ধিতে কুলোল না! শুধু মনে হচ্ছিল মাকে ডাকলে বা বলে দিলে সে জানলা ভেদ করে ঘরে চলে আসবে। তার শক্তি অনুমান করতে পারছি শুধু। আমি আর তাকে দেখব না ঠিক করলাম। সে যেন আমার নড়াচড়াও বুঝতে না পারে এমনভাবে মার শাড়ির আঁচল টেনে মুখে চাপা দিলাম। দেখব না ভেবেও কৌতুহল হচ্ছে প্রবল। আবার আঁচল সরাই খুব ধীরে, আবার দেখি, মানুষটা একইভাবে স্থির তাকিয়ে আছে তখনও। কতক্ষণ এমন চলল জানি না। বারবার মা’র আঁচল ধরে টানাটানির ফলে মা’র ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলও একবার, ঘুমের ঘোরেই বলল, ‘কী হল? জ্বর এল নাকি আবার ?’ বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল মা আবার। আর ঠিক তার পরমুহুর্তে কয়েকটি পেঁচার তীব্র চিৎকারে চমকে উঠে আবার যখন আঁচল সরালাম, তখন সে আর নেই। এক পলকে ভ্যানিশ! তবু ভয় যায় না আমার। মাকে ডেকে বলতে গেলে সে যদি আবার আসে এই ভয়ে চুপ করে রইলাম। বারবার চোখ গেল জানলার দিকে। না, সে আর আসেনি। তারপর কখন যেন ক্লান্তির চোটেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল হতেই মাকে বললাম।
-তারপর? অবন্তী তারপর?
-সে যে কিছু এটা বিশ্বাস করতে মা’র মন চাইছিল না, তাই বারবার ঘুরে ফিরে প্রশ্ন করল। যা দেখেছি তাই বললাম। একটু বেলার দিকে মা বাজারে গিয়ে পুরনো এক চায়ের দোকানের মালিককে ঘটনাটা বলেছিল। যোগেনবাবু সেই চায়ের দোকানের মালিক সব শুনে মাকে বলেছিল, মেয়েকে অবিশ্বাস করো না। বাচ্চা মেয়েরা মিথ্যে বলে না। তারপর তুমিই তো বলছ বারবার তোমার আঁচল টেনে মানু মুখ চাপা দিচ্ছিল? তার মানে সে নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখেছে। আর ওরকম দৃশ্য তো এলাকার অনেক লোকই বিভিন্ন সময় দেখেছে, মা। ও তো নতুন নয়। দুলুদের বাড়ির ঘটনা জানো না? অভিশপ্ত বংশ। দু-একটা মৃত্যু ছাড়া বাকি সবাই তো আত্মঘাতী!
জয়িতা আমার হাত খিমচে ধরেছে তখন, বলল, আর থাক অবন্তী উত্তমাদি বলল, চোর-টোর নয় তো? অনেক সময় ক্রিমিনাল গোছের লোক ?
—আগেই তো বললাম বাড়ির পেছন দিকটাতে না ছিল কোনো কার্নিশ, না পাইপ, কিছু না।
থম মেরে গেল সবাই। ঘরের মধ্যে অন্ধকার আরো ঘনিয়েছে গাঢ় হয়ে, এ ওর মুখ দেখতে পাই না যেন। বাইরে বৃষ্টি কমেছে একটু, কিন্তু নিকষ কালো আকাশের বুক চিরে চিরে বিদ্যুৎ লতার মতো এঁকে বেকে ঝলসে উঠছে। মেঘের ওপার থেকে গুমগুম শব্দ আসছে। যেন আরো বিপদের ধ্বনি!
কে যেন ঘরের আলো জেলে দিল। তখনই রোশনারা বলল, অবন্তী তুই যা বললি তা যদিও সত্যি হয়? প্লিজ, এখন থেকে মেট্রনকে বলে বাড়ির সমস্ত আলো জ্বালিয়ে রাখব। সবাই মিলে বলব, কেমন?
-হ্যা…হ্যা..হ্যা। একসঙ্গে বলে উঠল সবাই।
মালবিকাদি বলল, অয়নিকা কী করছে বল তো? দেখ তো গিয়ে কেউ ? মেয়েটা আবার কিছু না করে বসে! জয়িতা বলল, আমি যাচ্ছি, কিন্তু সঙ্গে কেউ চলুক। তুই যাবি অবন্তী?
-ই। যাব, চল ।
লম্বা করিডর পেরিয়ে সারি সারি ঘর আমাদের । করিডোরের টিমটিমে আলোটা জ্বলছে শুধু তখন। অয়নিকাদের ঘরের অর্ধেক ভেজানো জানলার সামনে যেতেই কানে এল চাপা স্বরে হাসছে অয়নিকা আর কথা বলছে। জয়িতা ইশারায় চুপ করতে বলল। জানলার ফাক দিয়ে চোখে পড়ল ওর আরেক রুমমেট ঋতু বলছে, প্ল্যানটা করলি কখন? —কখন আবার? যখন ভূতের গল্প হবে শুনলাম। ভাবলাম, দিই সবকটার দাত কপাটি লাগিয়ে, বোকা! বোকা সব! জলে ভেজা কাগজ
কখনো দোতলায় উড়ে আসতে পারে? ঘরের জানলার এক কোণে গুজে রেখেছিলাম। জানতাম, বেশি হাওয়া দিলে ঠিক ঘরের মধ্যে এসে পড়বে। হি হি হি …।
আমি আর জয়িতা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। জয়িতা ইশারায় বলল, চল, কাজল মাসিকে চায়ের কথা বলে আসি? আর যদি সঙ্গে একটু ভাজা দেয় ? ওই! জমে যাবে। কিন্তু তোর ঘটনাটা অয়নিকার মতো না তো? মাথা নাড়লাম। ব্লেড দিয়ে বা ছুরি দিয়ে ফালাফালা করা, ক্ষতবিক্ষত হওয়া মুখটা আবার চোখের সামনে আমার। দু’হাতের রোম খাড়া। বললাম, আমার হাতে হাতে ছোয়া, বুঝতে পারবি। রান্নাঘরের সামনে এসে চমকে গেলাম আামরা । হৃৎস্পন্দন থমকে গেল যেন নিমেষে।
হলুদ কলি করা ঘরটা বালবের আলোয় ছমছমে হয়ে উঠেছে এই অন্ধকার দিনে। কাজল মাসি খিচুড়ি রাঁধছে দেখলাম। আর আমাদের দিকে পেছন-করে-বসা লাল হলুদ ছাপা শাড়ি পরা একটি মেয়ে মাথা ঝুকিয়ে কুটনো কুটছিল যেন! আমাদের পায়ের শব্দে আমাদের চোখের সামনে কার্যত সে ভ্যানিশ হয়ে গেল!! পড়ে রয়েছে তখনও একটি বটি ও কিছু কাটা বেগুন!
আমরা আর দাঁড়াইনি। কী প্রচণ্ড গতিতে যে ঘরে এসে ঢুকেছিলাম! পরে জিজ্ঞেস করাতে কাজল মাসি বলেছিল, ‘ভুল! ভূল বেবাক ভূল দ্যাখছ! মাথা খারাপ হইয়া গ্যাছে গিয়া মাঈয়াগুলা নের !
(সমাপ্ত)