ঘুমটা ছ্যাঁত করে ভেঙে গেল, কুশলের। কেমন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি। এরকম তো হয়না সচরাচর। জ্বর টর হলো নাকি! ভাবতে ভাবতে লাল নাইট বাল্বের মৃদু আলোয় আলো-আঁধারি বেডরুমের চারদিকে একবার তাকিয়ে নেয় সে। কেমন গা ছমছমে ভাব যেন একটা। মাথার কাছের টেবিলটা থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখে। রাত দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। সন্ধ্যার পর থেকেই হঠাৎ ঝড় বৃষ্টির জন্য এই চৈত্র মাসেও কেমন শীত শীত ভাব। তাই আলমারি থেকে লেপটা বের করেই নিয়েছিল। সীমা দুদিন হলো বাপের বাড়ি গেছে। কার যেন বিয়ে। ফোনে বারবার বলে দিয়েছে, ‘যা বাজে ওয়েদার, যেন শোয়ার সময় লেপটা বের করে নিও। তোমার আবার যা ঠান্ডার ধাত!’
এখন লেপটা গা থেকে সড়িয়ে দিয়ে দেখে গোটা গা ঘামে চাপুচুপু অবস্থা! অথচ বাইরে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় যে বৃষ্টি ভেজা হয়েছিল এ নিশ্চয়ই তারই প্রতিক্রিয়া। নির্ঘাত জ্বর বাধিয়েছে। ভাবে কুশল। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মনটা খচখচ করতে লাগলো ওর। কী একটা যেন স্বপ্ন দেখছিল ঘুমটা ভেঙে যাওয়ার আগে। নাকি স্বপ্নটা দেখেই ঘুমটা ভেঙে গেল! মনে পড়ছে না কিছুতেই। কিন্তু, মনের ভেতর কেমন একটা অনুভুতি টানা টিমটিম করেই চলেছে; খুব জানা খুব পরিচিত খুব আপন কাউকে নিয়ে যেন একটা স্বপ্ন দেখছিল ও।
মাথার ধারের জানালার পর্দাটা তখনও একটু একটু নড়ছে। বাইরে হাওয়া টাওয়া উঠেছে হয়তো। চারতলার এই ফ্ল্যাটটায় হাওয়া বাতাস এমনিতেই একটু বেশি। এতক্ষণ ধরে তন্দ্রা মতো অবস্থায় থাকার জন্য বুঝতে পারেনি। এখন খেয়াল করলো, অদ্ভুত এক চেনা আর মুগ্ধতায় ভরা গন্ধে যেন ভরে আছে ঘরটা। খুব চেনা গন্ধ। কিন্তু চিনে উঠতে পারলনা সে কিছুতেই। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় জানালার পর্দাটা আবার কেঁপে উঠলো। এবং থেমে গেল। গন্ধটাও আর নেই। বসে থাকতে থাকতে কুশলের চোখ দুটো আবার ঘুমে জড়িয়ে পড়ল। লেপটা মাথা পর্যন্ত টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল আবার।
সকালে যখন ঘুমটা ভাঙল বেশ ঝরঝরে লাগল কুশলের নিজেকে। মর্নিং ওয়াকে বেরোবার আগে মাথাটা চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো গত রাতের স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। এবং একটা অবর্ণনীয় কষ্ট যেন বুকের ভিতর উথলে উথলে উঠতে লাগল। কথায় আছে, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা করেনা। কুশলেরও হয়েছে তাই। বিয়ের পর থেকে মা আর বৌ এর ঝগড়া অশান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কুশল। সীমাই আল্টিমেটাম দিল, ‘রেখে আসো বৃদ্ধাশ্রমে তোমার মাকে। না হলে আমার পক্ষে এ সংসার করা সম্ভব নয়।’ তারপরে কুশলের মতো ছেলের পক্ষে আর কিছু করাও সম্ভব ছিল না।
আজ সারে চার মাস হলো মা বৃদ্ধাশ্রমে। মাসে একবার করে কুশল যায়। বিল মেটাতে আর দেখা করতে। কমলা দেবী কিছুই বলেননা। শুধু ছেলে চলে যাওয়ার পর মুখে আঁচল ঢেকে কাঁদেন। কুশল সব জানে। কিন্তু।
মা যেন পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। মা এর শাড়ির সেই স্নিগ্ধ স্নিগ্ধ গন্ধে ঘরটা ম ম করছিল। কী অপরূপ শান্তি আর তৃপ্তি। ঠিক যেন বাচ্চা বেলার সেই দিন গুলো। রাতে দেখা এই স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে কুশলের। ভাবে, সারাজীবন মায়ের বাচ্চা খোকাটি হয়ে বেঁচে থাকলে কত ভালো হতো। কেন সে হঠাৎ এত বড়ো হয়ে গেল যে মাকে এত দূর করে দিল। ঘরে বৌরা এলেই তো মায়ের দোষগুলো সব এক এক করে আত্মপ্রকাশ করে! চোখের কোল বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে। বুঝতে পারে যে কী ভুল করেছে ও। মনে মনে ঠিক করে নেয় যে, আজই গিয়ে মাকে নিয়ে আসবে। বোঝাবে সীমাকে, সব সমস্যারই অন্যরকম সমাধান সব সময়ই থাকে। যেটা সব থেকে সহজ বলে মনে হয় তা সব সময় সঠিক পথ হয়না।
গেঞ্জিটা সবে গলিয়েছে গায়ে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নাম ‘আশ্রয়’। বৃদ্ধাশ্রমটার নাম। ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে কুশল ভাবে, কী কারণ হতে পারে এত সাত সকালে ওখান থেকে ফোন আসার? গতবার মাত্র একদিন দেরি করেছিল মাসের টাকাটা দিতে তাতেই রাত নেই সকাল নেই ফোনের পর ফোন! এখন তো মাস শেষ হতে আরও দুদিন বাকি; গত মাসের ঘটনার জন্য কি এবার আগে থেকেই ফোন করা শুরু?! কী অবস্থা! সব জায়গায় একই অবস্থা! টাকা ছাড়া কেউ কিছু বোঝে না। বিরক্ত হয়ে ফোনটা তোলে কুশল, ” হ্যালো।”
–” মিস্টার কুশল রয়?”
“বলছি।”
–” আশ্রয় বৃদ্ধাশ্রম থেকে বলছি।আপনাকে একবার এক্ষুনি আমাদের এখানে আসতে হবে।”
কুশল অবাক হয়ে যায়। সাতসকালে এ আবার কী সব কথা বার্তা! পরের মুহূর্তেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে। মা ঠিক আছে তো?!
উদগ্রীব হয়ে তাই জিজ্ঞেস করে,
“কেন কী হয়েছে বলুন তো? এনি প্রবলেম?”
অপর প্রান্তে কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। কুশলের বুকের ভেতর তখন ঝড় বয়ে চলেছে। এসব মুহূর্তে কুচিন্তা গুলোই তো ভীড় করে! কিন্তু মায়ের তো কোন অসুখ বিসুখ ছিল না। কুশল ভাবে।
–“আপনাকে সামনাসামনি জানাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি যখন জোর করছেন”
অপর প্রান্ত থেকে থেমে থেমে কথা গুলো ভেসে আসে। কথা তো নয় যেন এক একটা তীর। ঠিক বুকে এসে বেঁধে কুশলের। হৃৎপিণ্ডটা যেন পাগলের মতো লাফিয়ে চলেছে বুকের বাঁ দিকটায়।
“আপনার মা কমলা দেবী এমনিতেই খুব স্ট্রেস্ড থাকতেন। খাওয়া দাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। আপনাকে আগেও জানিয়েছিলাম। দুদিন ধরে নিজেকে পুরোপুরি আইসোলেট করে নিয়েছিলেন।”
একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, “গত কাল রাতে ওনার বুকে হঠাৎ ব্যথা ওঠে। ডাক্তার পরে জানিয়েছেন কার্ডিওমায়োপ্যাথি। আড়াইটার কিছু পরে। এবং উনি এক্সপায়ার করেন। আপনাকে রাতে ফোনে অনেক চেষ্টা”
পরের কথা গুলো যেন আর কানে ঢোকেনা ওর। যেন আকাশ ভেঙে পড়ল কুশলের মাথায়। ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। ফোনটা ছিটকে পড়ে কভার ব্যাটারি সব খুলে গেল। হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো কুশল, বাচ্চা ছেলের মতো। শুধু সেই বাচ্চাকে থামাবার জন্য তার মা আজ আর ছুটে আসবে না। সন্তান বড়ো হয়ে গেলে তার কাছে তার মা হয়তো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কিন্তু কোন মায়ের কাছে তার কুলাঙ্গার সন্তান কখনো অপ্রয়োজনীয় হয়না; সন্তান যতই খারাপ হোক মায়ের স্নেহ ভালবাসা তার জন্য সবসময় একই রকম থাকে। অসীম। নিখাদ। শুধু সন্তান গুলোই একটু বেশি হিসেবি হয়ে ওঠে। যখন ভুল ভাঙে তখন দেরি হয়ে যায়। অনেক দেরি।
কুশল আরও বেশি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে যখন রাতের ঘটনা গুলো এক এক করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রাত আড়াইটার পর ঘুম ভেঙে যাওয়া মাথায় মায়ের হাত বুলিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন সারা ঘর জুড়ে মায়ের গায়ের নিষ্পাপ মিষ্টি গন্ধ এক দমকা বাতাসে জানালার পর্দাটা উড়ে যাওয়া। এসবের একটাই মানে। মা তার সন্তানকে শেষ বারের মতো ঠিক ভালোবেসে গেল।