মেয়ে মানে রহমত, মেয়ে মানেই জান্নাত। আবার মেয়ে মানে গজব, মেয়ে মানেই জাহান্নামের কারণ হুজুর খুতবা টা বলার পর সকল কে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন আপনারাই বলুন, আপনারা কোনটা চান?? রহমত আর জান্নাত নাকি গজব আর জাহান্নাম??
সকলেই বলে উঠলো, আমরা রহমত আর জান্নাত চাই হুজুর। শুধু একজন কে হুজুর কিছু বলতে শুনলেন না। বরং মানুষ টাকে কান্নারত অবস্থায় দেখলেন ব্যাপার টা তখন না তুললেও নামাজ শেষে হুজুর, মানুষ টাকে ডাক দিয়ে সালাম দিলেন, আসসালামুয়ালাইকুম জনাব (হুজুর) অলাইকুমুসসালাম হুজুর…(মানুষ টি) আমি কি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে পারি??(হুজুর) জি হুজুর, অবশ্যই। (মানুষ টি) ধন্যবাদ জনাব। আপনার নাম??(হুজুর) জি, আমার নাম মোঃ আলী হাসান…(মানুষ টি সাধারণ ভাবেই বললো কথাটা) বাহ, মাশাল্লাহ। অনেক সুন্দর নাম। তা আলী ভাই আপনি কিছু না মনে করলে আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি??(হুজুর) জি হুজুর সাহেব। বলুন (আলী)
আমি যখন মেয়ে নিয়ে (উপরের বাক্য টা) বললাম আপনি তখন কোন কিছু না বলে কান্নারত অবস্থাতে ছিলেন, তখন জিজ্ঞেস করলে নামাজে বিলম্ব হতো জন্য এখন জিজ্ঞেস করছি। আমি কি জানতে পারি সেই কান্নার কারণ?? যদি আপনার মনে হই যে আমাকে বললে আপনার ক্ষতি হতে পারে ত আমি জানবো না। তবে জানানোর হলে জানাতে পারেন(হুজুর) আলীর কথাটা মনে পড়তেই আবার মন টা ভারী হয়ে গেলো। হুজুরের দিকে তাকিয়ে, আমি অনেক বড় পাপ করছি হুজুর। বলেই চোখ থেকে জল ঝড়ালেন হুজুর সাহেব আলীর হাতে হাত রেখে সাহস দিয়ে, কি পাপ করছেন?? আমাকে বলুন আলী এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলতে লাগলো হুজুর সাহেব কে…হুজুর কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে আলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন আমি আলী।
বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের জব করি আজ ১০ বছর। আয়শার সাথে আমার পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হই। আমাদের পরিবার ছিলো জয়েন্ট ফ্যামিলি। আমরা ছিলাম ৫ ভাই।।আমি ছিলাম ৪ নাম্বার। আমাদের কোন বোন ছিলো না জন্য মা কিছুটা অখুশি ছিলেন আর চাইতেন যাতে আমার ভাই ভাবি বা আমাদের পরিবারে যেনো মেয়েই প্রথমে আসে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার বড় ভাবির প্রথম কন্যা সন্তান হই। পরিবারের লোক সবাই এতটা খুশি হয়েছিলাম যে পুরো গ্রামের লোকদের দাওয়াত করে খাইয়েছিলাম। এতটা খুশি হয়েছিলাম আমরা সবাই। কিন্তু খুশিটা দুঃখে আর ভয়ংকর কাজের দিকে ধাবিত হতে থাকে যখন আমার আগের ৩ টা ভাবির শুধু কন্যা সন্তানি হতে থাকে। বড় ভাবির ৩ মেয়ে, মেজ ভাবির ২ মেয়ে, সেজ ভাবির ১ মেয়ে থাকার দরুন, বাবা মায়ের নজর পড়েছিলো আমার স্ত্রী আয়শার উপর।
বিবাহের প্রথম রাত্রে সবাই পুত্রবধুর রুপ গুনের প্রশংসা করে, আর আমার মায়ের বলা আমার বউ কে প্রথম কথাই ছিলো, বউমা আর যাই হউক, আমার কিন্তু নাতি চাই একখান। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো আমার মায়ের দিকে। মা তখন ফিক করে হেসে বলেছিলো, আহা মজা করলাম ত। সবাই তখন হেসে দেয়।। আয়শা নিজেও হেসে দেয়।
কিন্তু মায়ের কথাটা যে মজা ছিলো না সেইটা বুঝতে পেরেছিলাম তখন, যখন আমার স্ত্রী প্রথম প্রেগন্যান্ট হয়। মা সবসময় আয়শাকে বলতো, বউমা আমার কিন্তু একখান নাতি চাই। নাতি। তা না হলে কিন্তু ভালো হবে না।(মা)আয়শা ভয়ে থাকতো সবসময়। আমাদের বাসার বউদের হাসপাতালে কখনো ডেলিভারি করা হতো না বা কোন চেকাপ ও করানো হতো না। বাসাতেই দাইমার দ্বারা বাচ্চা হউয়ানোর কাজ হতো। এই জন্য আগেভাগে কেউ দেখতেও পারতো না যে বাচ্চা ছেলে নাকি মেয়ে হবে। কিন্তু আমার মা আয়শার ক্ষেত্রে আমাকে এসে বললো, বাবা আলী, তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।
কি কথা মা?? বউ মার ত ৭ মাস চলছে। ত, একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। আর দেখে আয় আমার নাতি টা কেমন আছে। কিন্তু মা তোমার নাতি না নাতনি আছে সেইটা কেমনে জানলা?? সেইডাও পরীক্ষা করে আইবি।(মা) আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। কি কউ মা তুমি?? আমাদের বাড়ির ত কোন ভাবিদের এই কাজ করো নি।(আমি) ভাবিদের টা বাদ দে। তোর বউ এর টা দেখ। আর শোন, ছেলে না হলে কিন্তু খারাপ হবে এই আমি বলে রাখলুম।(মা) আলী মায়ের মুখের উপর কখনো কোন বলে নি তাই এখনও কোন কিছু বলতে পারলো না।
সেইদিন বিকেলেই আলী আয়শাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়, আল্ট্রাসনোগ্রাফি করতে। তবে রিপোর্ট দিতে দেরি হউয়ার জন্য প্রায় ৪ ঘন্টা ওয়েট করে। কিন্তু যখন রিপোর্ট দিলো তখন আলী আর আয়শা ২ জনেই ভয় পেয়ে যায়। আয়শা ভয় পেয়ে নীল বর্ণের হয়ে যায়। কারন রিপোর্টের রেজাল্ট ছিলো কন্যসন্তানের।
অটোরিকশা তে আসার সময় আয়শা কান্না করে বলেছিলো, তোমার ২ টো পায়ে পড়ি। আম্মা রে কিছু বলবা না। আমি আমার মেয়ে রে আমার বুকে জড়ায়ে রাখতে চাই।।আমার রক্ত মাংস ত ও আলী নিজেও চাইতো ওর প্রথম সন্তান মেয়ে হোক কিন্তু পরিবারের চাপে আর সেই চাওয়াটা বদলাতে তাই ওর সময় খুব কম ই লেগেছিলো। আর সত্য বলতে ছেলে সন্তান না হলে যে বংশ রক্ষার কেউ থাকবে না।
বাসায় গিয়ে ব্যাপার টা বলতেই সবাই রেগে যায়। ভাবিরা ত অনেক বাজে বাজে কথা বলতে লাগলো। মা ত সরাসরি বলে দেয়, বাচ্চা এবোরশন করাতে। আয়শা তখন মায়ের পা ধরে বলেছিলো, আম্মা, এমন বইলেন না। এইটা ত আপনাদেরি বংশের আলো। এইভাবে নিভায়ে দিয়েন না আম্মা। মায়ের মন একটুও গলেছিলো না। এরপর আর কোন কথা আমার বউ কে, কেউ না বললেও সমস্ত কথা আমার মা আমাকেই বলতো।
আয়শার সামনে সবাই হাসিখুশি, ঠাট্টামজা করলেও সবার মনে একটাই প্লেন ছিলো বাচ্চাটা নষ্ট করার। আমার নিজের মনেও ছিলো। কারণ মা আমাকে অনেক ভুলভাল কিছু বুঝিয়েছিলো। এটাও বলেছিলো, এরপরে আমার স্ত্রী যদি ছেলে বাচ্চা আমায় দিতে পারে ত সম্পত্তির আধাই বাবা মা আমার আর আমার ছেলের নামে লিখে দিবে। লোভে এমন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে মা যেই যেই কথা বলতো আমি সেই সেই কাজ ই করতাম। বেশি তোরের মেডিসিন আয়শাকে প্রতিদিন খাওয়ায়তাম। আয়শা আমায় এত মেডিসিন খাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমি বলতাম, বাচ্চার পুষ্টির জন্য এই মেডিসিন গুলো তোমাকে খায়তে হবে।
আয়শা আমার কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে নিতো। এর কিছুদিন পরে, আয়শার যখন ৮ মাস চলছে, একদিন হঠাৎ করে আয়শার ব্যাথা উঠে। এমন ব্যাথা যে, আয়শার নিজেরি অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি করে হসপিটালাইজড করলাম ওকে। প্রায় ২ ঘন্টা পড়ে ওটির মধ্যে থেকে ডাক্তার এসে ২ই টা খবর দিলেন। যার একটা ছিলো আমার পরিবারের জন্য আনন্দের। আর একটা ছিলো আমার জন্য বেদনাদায়ক।
ডাক্তার এসে প্রথম কথাটা বললেন, আপনাদের পেসেন্টের বাচ্চাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি(ডাক্তার) কথাটা শুনতেই মায়ের চোখে মুখে আমি হাসি দেখতে পেলাম। আর ২য় কথাটা ছিলো, আপনাদের পেসেন্ট আর কখনো মা হতে পারবেন না। কারন ওনার জরায়ুর নাড়ি টা কেটে ফেলা হয়েছে। অতিরিক্ত মেডিসিনের কারনে নাড়ি টাতে পচন ধরেছিলো। আর কয়েকদিন হলে আপনাদের পেসেন্ট কেই আর বাঁচানো যেতো না(ডাক্তার) আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সড়ে গিয়েছিলো কথাটা শুনে। ফ্লোরে বসে পড়ি আমি। বার বার শুধু এটাই বলছিলাম এ আমি কি কাজ করলাম?? নিজ হাতে নিজের সন্তান, নিজের স্ত্রীর ক্ষতি করলাম।
মা এসে তখন বলেছিলো বাবা তুই চিন্তা করিস না। এই মাইয়ারে তুই ডিভোর্স দিয়ে দিবি। তোর জন্য আমরা আবার মেয়ে দেখবো আমি মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু এটুকু ভাবছিলাম আর মনে মনে বলছিলাম, মা, তুমিও ত মেয়ে, কিভাবে পারো একটা অপরাধ করার পরেও আবার সেই অপরাধ ই করতে?? আলী হু হু করে কেঁদে দেয়। হুজুর, আমি আমার মেয়েকে মেরে ফেলেছি হুজুর। বাবা হয়ে মেয়েকে খুন করেছি। এর চেয়ে বড় পাপ কি দুনিয়াতে আছে বলুন?? এর ক্ষমা কি আছে?? হুজুর কিছু বলতে পারলেন না, শুধু এটুকু বললেন, ক্ষমা চান আপনার রবের কাছে। এটা ছাড়া আর কিছু করার নেই। মসজিদ থেকে বেরোয়ে গোরস্তানের ভেতরে ঢুকলো আলী কবরের পাশে গিয়ে অঝোর ধারায় চোখের জল ঝড়ায় আলী, আর জোরে জোরে বলতে থাকে, আমায় ক্ষমা করে দাও আয়শা। আমায় ক্ষমা করে দাও হুম, আয়শার মৃত্যু হয়েছে আজ দেড় বছর।
আলী আয়শার জন্য নিজের পরিবারকে ছেড়ে এই অজপাড়াগায়ে এসে বসত বাড়ি গড়ে। কারণ আলীর মা বলেছিলো আয়শাকে ছেড়ে দিতে। বন্ধা মেয়ের সাথে সংসার করতে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আলী সেই ভুল আর ২য় বার করেনি। নিজের পরিবার কে ত্যাগ করে আয়শাকে নিয়ে ঘর বাধে এইখানে। কিন্তু আয়শা সবসময় মানসিক চিন্তায়, পাগলের মতো হয়ে গেছিলো। সব সময় শুধু আমার বাচ্চা আমার বাচ্চা বলে কান্না করতো। শেষ সময় টাতে আয়শা আলীর দিকে তাকিয়ে বলতো, খুব খারাপ হয়েছে। খুব খারাপ আলী কেঁদেই চলেছে আয়শার কবরের পাশে। আর বলতে থাকে, সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে আয়শা। সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে…