ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাবার শেষ বাসটায় চড়ে বসলো সাইফুল। ব্যাপারটা মোটেও টাট্টু ঘোড়ায় লাফিয়ে চড়ার মতো আনন্দদায়ক ছিল না। বরং বেশ কিছুটা নিরানন্দময় আর গ্যাঞ্জামপূর্ণ ছিল।
গ্যাঞ্জামের হোতা হেল্পার কন্ডাকটর গ্যাঞ্জাম তৈরির প্রথম ছবক হিসাবে বাসের শরীরে শক্তিশালী সব থাপ্পড় কষিয়ে যাচ্ছিল নন স্টপ।
সঙ্গে ছিল লম্বা চিল্লানির টাঙ্গাইল… টাঙ্গাইল… টাঙ্গাইল… সত্তর ট্যাকা… সত্তর ট্যাকা… সত্তর ট্যাকা… লাশটিপ… লাশটিপ…
গাড়ির গতিক জানিয়ে দেওয়ার ভয়াবহ অবৈজ্ঞানিক এবং তুরুত ফুরুত পদ্ধতি।
যাত্রীরা যত্রতত্র অপেক্ষা করছিল টাঙ্গাইল যাবার বাসের জন্যই। তবে তারা নিশ্চিত ছিলো না বাসটি আদৌ যাবে কি-না? এ অনিশ্চয়তাপূর্ণ ঘোলাইট্যা পরিস্থিতি অবশ্য বাসওয়ালারাই তৈরি করেছিল।
উহাদের বক্তব্য মতে, সিরিয়ালের শেষ বাসটি মিনিট বিশেক আগেই টাঙ্গাইলের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু ঈদে বাড়ি যেতে উদগ্রীব বাসযাত্রীদের থেকে ফোকটে পয়সা খসানোর চান্স পেয়ে ওরাই বেলাইনে আরেকটি বাস নামিয়ে দিয়েছে।
ওদের টাঙ্গাইল…টাঙ্গাইল থাপ্পড় চিৎকার শুনেই মূলত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল বিপদাপন্ন উদ্ভ্রান্ত যাত্রীরা। কিন্তু বাসওয়ালাদের এক্সট্রা ২৫ টাকা ভাড়া কামিয়ে নেওয়ার ধাঁধাঁটিকে কেউই খোলা মনে গ্রহণ করলো না। অনেকেই শঙ্কায় ঘেমে গেল। যাদের বিড়ি সিগারেট ফোঁকার অভ্যাস তারা ঘন ঘন বিড়ি ফুঁকতে লাগলো।
জটলা যখন জোশাত্মক মুখ ঘোরাচ্ছে… ঠিক তখনই কে যেন বলে বসে ‘মগের মুল্লুক না ভাইয়া মাগীর মুল্লুক পাইছে।’
২৫ ট্যাকা বেশি ভাড়া গুনবার যাতনায় নিরীহ যাত্রীদের মূত্রথলি ফুলে উঠল মূত্রত্যাগের বাসনায়। অপেক্ষাকৃত তরুণ যাত্রীদের কারো কারো বুকে ক্ষোভের বুঁদবুঁদ জমে উঠল।
কেবল এক নং খাঁটি ভর্দলোকরা ভদ্রলোকদের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, যারা অন্যের দুঃখ কষ্টে, আনন্দ বেদনায় কখনই মাথা ঘামায় না।
তা আফনে যাই কইন্ন্যা ভাই, পাঁচচলি্লশ ট্যাকার ভাড়া বাইড়্যা সত্তর ট্যাকা হইবার পারে না কুনো সুময়ই। যতই রিদের বাজার থাইক না ক্যা।’
টুশকি দিয়ে ছাই ঝেড়ে এবং মাড়ির ভেতরের দিকে লুকিয়ে থাকা পানের কণাকে জিভের ডগা দিয়ে কুড়িয়ে এনে দাঁতের হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘খুব বেশি হইলে পাঁচ দশ ট্যাকা বাইড়া পুচ্পান্ন ট্যাকা অইবার পারে। তাই বইলা তো এক্কেবারে পঁতিশ ট্যাকা বাইড়া সত্তর ট্যাকা অইবার পারে না। এইডা একটা পাইজামি।’
হ..হ..বলে ক্রমেই পেকে ওঠা জটলা সমর্থনের সুর দেয় তাকে।
জটলার অন্য আরেকজন চেঁচিয়ে উঠে ‘ঠিকই কইছেন ভাই…কুনো একটা ছুতা পাইলেই অইল হালারা…দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা। হরতাল অইছে… কি ত্যালের দাম বাড়ছে… দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা… বালের দাম বাড়ছে.. দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা।’
জটলা শেষ কারণটায় অনেক কষ্টেও ব্যাপক হাসল।
এতে বক্তার জোশ বেড়ে গেল। বক্তব্য টেনে লম্বা করে..’এক্সিডিন অইছে কী…মালিকের বউ মরছে…দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা..’
জটলা আদি রসাত্মক আলাপের ধান্দায় বেশ মনোযোগী হয়ে পড়ে, যদি মালিকের বউয়ের কোনো রগড় শোনা যায়! কিন্তু বক্তার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে ‘বাঁই হাত’ ঢুকিয়ে দেয় আরেকজন ‘এ্যারা দ্যাশটারে মগের মুল্লুক পাইছে..।’
নতুন বক্তাকে দেখার জন্য জটলা যখন জোশাত্মক মুখ ঘোরাচ্ছে… ঠিক তখনই কে যেন বলে বসে ‘মগের মুল্লুক না ভাইয়া মাগীর মুল্লুক পাইছে।’
এ কথা শোনার পর সঙ্গত কারণেই জটলা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল রাজনৈতিক গ্যাঞ্জামের আশঙ্কায় দু’দাবনার মাঝখানে লেজ ঢুকিয়ে পিছিয়ে যায়।
অন্যদল যারা রুলিং পার্টির ষন্ডামার্কা যাত্রী, তারা ‘ক্যারা কতা কইল..ক্যারা কতা কইল’ বলে হৈহৈ করে উঠল। কিন্তু মাগীর মুল্লুকের লোকটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় গেল না।
জটলা ফাঁকা হয়ে গেলে মাগীর মুল্লুকে বাস করা লোকটার সঙ্গী আবদার করে বসে ‘দুস্ত একটা বিড়ি খাওয়াও..।’
‘ক্যা…? তরে বিড়ি খাওয়াম ক্যা..?’
‘এই যে তরে বাঁচাইলাম।’
‘বাঁচাইলি মানে? কেমতে?’
‘বাঁচাই নাই! যদি কইয়া দিতাম, কতাডা তুইই কইছত। তাইলে কি তর ছাল বাকলা থাকতো? আড্ডি দিয়্যা পাতা কাটতো না, মাইনষ্যে?’
‘আড্ডি দিয়া পাতা কাটলে কাটত, তর সমেস্যা কী? আমি কি তরে কইছিলাম…আমারে বাঁছাও গো আব্বা? আমারে মাইর্যা গাইড়া ফালাইলো গো?’
‘তুই একটা জাইর্যাও রে..’ বলে ফোকটে বিড়ি খাওয়ার লোভ সামলায় সঙ্গী।
‘সত্যি কতা কইলেই জাইরামি অয় ন্যা?’
দুস্ত বুঝে ফেলে, বিরাট ভুল হয়ে গেছে। বিড়ি তো দূরের কতা, ছাতুও খাওয়াবে না। উল্টো ঊনিশ বিশ বুঝাবে।
কিন্তু দুস্তকে অবাক করে মাগীর মুল্লুকবাসী দুটো স্টার ফিল্টার সিগারেট কিনে। একটা নিজে ধরায় আরেকটা দুস্তকে দেয়।
‘বহুদ্দিন পর ফাইন একটা কতা কইছি। তাও ম্যালা মাইনষের সামনে। বিড়ি খাবি ক্যা? সিকারেট খা ..নি ধরা।’
আগুন ধরাতে ধরাতে দুস্ত বলে বসে, তুই আসলেও একটা জাইর্যা… খিলাবি না খিলাবি না কইয়া সিকারেটই খিলিয়া হালাইলি!
এদিকে যারা নরোম মেয়েছেলে এবং গরম বালবাচ্চাসমেত ঈদে বাড়ি যেতে এসেছে কিংবা যারা খানিকটা ভদ্রলোক, মোটামুটি ফর্সা কাপড়ের জোরে এবং ভালবাসে হুজ্জতে ইজ্জত না হারাতে কিংবা যারা সাংঘাতিক ডরপুক, তারা সকলেই হেল্পার কন্ডাকটরের সম্মিলিত চিৎকারের লাশটিপ… লাশটিপ…টাঙ্গাইল …টাঙ্গাইল …শুনতে পেয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করে বাসের গহ্বরে।
ফলে হুলাহুলি, পাড়াপাড়ি, চ্যাঁচামেচি, ক্যাওম্যাও, বৃথা তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাটি এবং প্রায় মারামারিতে ছোটখাটো একটা দোযখে পরিণত হলো বাসের গহ্বর।
বিশেষ করে ভদ্রলোকদের সিট দখলের অভদ্রতা ছিল দেখার মতো।
যারা দৌড়ে পিছনে পড়ে গেল নিজেদের গাধামিতে, তারাও গাধামি ঝেড়ে ফেলে চালাকি করে বাক্স পেটরা বাসের জানালা গলে জায়গা দখলে নিল।
এভাবে জানালা গলে আসন গেলা পছন্দ হলো না অনেকেরই। বিশেষ করে যারা দৌড়ে বাসের ভিতরে ঢুকতে পেরেছিল কিন্তু আসনে পুচ্ছ ঠেকাতে পারেনি আয়েশ করে।
ফলাফল বিরাট এক নাড়াই।
অন্যদিকে যারা জটলা করে ঘোঁটলা পাঁকিয়ে পয়সা কমাবার ধান্দায় ছিল, তারাও লোকবল কমে যাওয়ায় আপসে পা রাখল বাসের পাদানিত।
বাস রাস্তা ধরে ঝেড়ে দৌড় শুরু করলে গতিতে বশীভূত যাত্রীরা আপনাতেই থামিয়ে দিল বাসের ভেতরকার সকল গ্যাঞ্জাম।
রাত তখন সাড়ে এগারোটা আর আকাশে ঝুলে আছে একটা বিরাট চাঁদ।। সাইফুলের মনভর্তি বেদনা।
বিষয়টা দু’দিনের পোষা বিড়াল হলে মানা যেত কিংবা ঝেড়ে লাথি কষিয়েই হয়তো কাটানো যেত। কিন্তু এ সে মাল নয়। দীর্ঘদিনের পোষা বিড়াল। তাই প্রথমে চোখ বেঁধে, পরে ছালায় ভরে এবং তারপর ছালার মুখ বেঁধে ‘কইট্টার হাটে’ ছেড়ে দিলেও লাভ নেই।
রাস্তা চিনে, গাড়ি এবং ঘোড়া এড়িয়ে কিংবা আরো পরিষ্কার করে বললে ওদের চাক্কা এবং ক্ষুরের তলে না পড়ে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরে আসাটা ছিল বেদনাদায়ক বিড়ালটার জন্য ওয়ান টুর ব্যাপার।
ফলে বুদ্ধিমানের মতো ওটাকে না তাড়িয়ে, ঘুম পাড়িয়ে রাখার বাহানায় একের পর এক সিগ্রেট টেনে চলছিল সাইফুল।
কিন্তু ততোধিক চালাক বিড়াল ধোয়াশাচ্ছন্ন হয়ে ঘুম পেড়ে থাকার মাল নয়। তাই মটকা মেরে পড়ে থাকার পাশাপাশি সে সাইফুলের প্রেমপূর্ণ নাজুক হৃদয়ে মিষ্টি দাঁতের কামড় না বসিয়ে রসালো জিভের চাট বসিয়ে যাচ্ছিল, মন্থর। ফলে সাইফুলের প্রেম জর্জর ভাবটি কিছুতেই কাটছিল না।
তো এক ঝুম বৃষ্টির দিন। যখন ভিজে চুপসে যাওয়া আন্নাতারার বুকের গোল, ফুল হয়ে ফুটেছিল পস্ট, তখন চোখের দুষ্ট বিড়ালটাকে ঈষৎ নাচিয়ে আন্নাতারা সাইফুলকে বলেছিল… ‘তো ওই কথাই রইল?’
‘কোন কথা?’ সাইফুল ন্যাকা সাজে, খানিকটা বোকা।
‘আসছে পূর্ণিমার রাতে বাঁশি খাওয়াবেন, হুহ্?’
মুক্তমঞ্চের পেছনে বাচ্চা বটগাছটা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠেছিল…আন্নার এমনো রঙিনো বায়নায়…সাইফুলেরও একই দশা।
সাইফুলের প্রেম জর্জর ভাবটি উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। শয়নে স্বপনে ঘুম জাগরণে ভাবতে বাধ্য হচ্ছিল পূর্ণিমার রাতে বাঁশি খেয়ে কীভাবে দুজনে মিলে বাঁশি বাজাবে।
সময়মতো পূর্ণিমা আসে, আকাশে দেখা মেলে ভুইট্টাবানা চাঁদের। কিন্তু অমন বোম্বাস্টিং পূর্ণিমার রাতে যে একদল হাড় হাভাতে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্যাম্পাসে টেলিস্কোপ নিয়ে চাঁদ দেখার ফাঁদ পেতে বসবে, তা কে জানতো?
আর আন্নাও যে ওই যান্ত্রিক টেলিস্কোপে জমে যাবে এবং বেমালুম হবে চাঁদনী রাতে বাঁশি সেবনের কথা, সেটা তো জানা ছিল না সাইফুলেরও।
তাই কিছুদিন ধরে একটু একটু রঙিন হওয়া সাইফুলের শ্বাস প্রশ্বাস শুরুতেই একখানা মর্মান্তিক ধাক্কা খেয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ল।
অবশ্য অনতিকাল পরেই আন্নাতারা ফিরে আসে। ফিরে আসে বাচ্চা বটগাছটির পাশে। ছোট্ট কালভার্টটিতে। বন্ধু বান্ধব সহযোগে। যেখানে সাইফুল বাঁশি নিয়ে আগে থেকেই বসে আছে।
আন্নাতারা এসেই হেসে উঠে, ঝলমলে চাঁদ হয়ে ঢুকে পড়ে সাইফুলের মনের কোটরে। আর বেশ করে কান মলে, বাহ! আপনার কানগুলি তো বেশ নরোম!’
কানমলা খেয়ে সাইফুলের ভালো লাগে, ম্যালা ভালো লাগে। তার মন মরাভাবটা কোথায় যেন উড়ে যায়, একটা নিরীহ পাখির বাচ্চা হয়ে।
সেসব কোনো কিছুই না জেনে সাইফুলের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে, আন্নাতারা গেয়ে ওঠে,
‘অরণ্য ডাকে.. হেইডি আইডি আয়…’
ঝিরি ঝিরি বাতাসে কেঁপে ওঠে বাচ্চা বটবৃক্ষের পাতা। চাঁদ খুঁজে পায় সাইফুলের ফাঁকা মাথা। চাঁদের আলো কিলবিলিয়ে হেঁটে যায় আন্নাতারার চোখে, মুখে, নাকে, ঝকঝকে সাদা দাঁতে, চিবিয়ে খায় সাইফুলের টালমাটাল হৃদয়।
চোখের কাছে চোখ মুখের কাছে মুখ নিয়ে আন্নাতারা গেয়ে ওঠে, ‘ধরো আমি কথা বলি.. কথা বলি… জংলি ভাষায়’
বিড়ালটা গুক্কুর সাপের মতোই ফশ করে ধারালো কামড় বসায় সাইফুলের নাজুক হৃদয়ে। অসহনীয় মিষ্টি ব্যথায় সাইফুলের মাথার ভেতর ফনফন করে গজিয়ে উঠে জারুলের বেগুনি বন, কৃষ্ণচূঁড়ার লাল, বান্দর লাঠির হলুদে একাকার।
সেইসব অদ্ভুত জঙ্গলে জংলি মেয়েরা বেগুনি জারুলে কৃষ্ণচূঁড়ার লালে বান্দর লাঠির হলুদে সাজে। খুব করে সাজে। হাতগুলো রাখে সখীদের হাতে। তারপর গোল হয়ে ঘিরে ঘিরে নাচে। চুয়ের নেশায় তাদের ঢুলুঢুলু আঁখি… বুকের নিরীহ গোলাকার পাখি.. সবই দিলখোলা এ রাতে।।
গাড়ি ঘোড়ার মতোই ছুটতে থাকে টাঙ্গাইল রোড ধরে আরো উত্তরে। গেঁয়ো যাত্রীরা জানালার কাঁচ খুলে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখে। লাল নীল হলুদ সবুজ আলোয় শো শো শব্দে উড়ূজাহাজের উড়াউড়ি দেখে।
আন্নাতারা গেয়ে যায় গান, সাইফুলকে জংলি ভাষা শেখায়। ধানক্ষেতে যেমন মাছ চাষ চলে তেমনি গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে চোরা চোখের গুঢ় কারসাজি।
ক্ষেতের আলে বৃক্ষচাষের মতোই আন্নার বন্ধুরা ডেকে আনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে, চিলেকোঠার সেপাইকে, কাৎলাহার বিল, সারিয়াকান্দি, তমিজের বাপ আর তার নিগূঢ় খোয়াব।
বাদ যান না ইলিয়াস কাঞ্চনও। আর্সেনিক নামক ভূত নামে ভালবাসার ধানক্ষেতে। বিজাতীয় ভূতের গল্প হয়, ভূত আছে কি নেই সে নিয়ে বাঁধে তুমুল তর্ক।
তারপর যথারীতি ঈশ্বর আসেন। আন্নাতারা চেঁচিয়ে ওঠে, ঈশ্বর নেই। কোনোদিনও ছিল না।
অথচ ক্রমেই হলুদ হয়ে মরে যেতে থাকা ভালবাসার ধানক্ষেত থেকে জ্বলজ্যান্ত আর্সেনিকগুলোকে ঝেটিয়ে তাড়াতে সাইফুল ঈশ্বরের দরবারেই কৃপা মাগে,’ হে ইশ্বর.. আন্নাতারাকে আর্সেনিকমুক্ত করে দাও, ওর বন্ধুদের ভিন্ন দিকে তাড়িয়ে দাও, ওকে জংলি মেয়েদের মতো বেগুনি জারুলে সাজাও, সাজাও কৃষ্ণচূঁড়ার লালে, বান্দর লাঠির হলুদে। সখীদের হাতে হাত ধরে নাচতে বলো। চুয়ের নেশায় আখি ঢুলুঢুলু করো, বুকের পাখিটাকে করে দাও আরো নরম, আরো গরম। আমাকে ভালোবাসার তওফিক দাও।’
ঈশ্বর মুচকি হাসেন। গান শেষ হলে, যেহেতু শেষ হয় সবই, যেভাবে আন্না এসেছিল বন্ধুসমেত, সেভাবেই চলে যায় বন্ধুসমেত। এবং সাইফুল যেভাবে কালভার্টে বসেছিল মনমরা, সেভাবেই বসে থাকে মনমরা।
কেবল থেকে যায় চাঁদ, বাচ্চা বটগাছ আর কানমলা খাওয়ার সুতীব্র দীর্ঘশ্বাস।
এক উজ্জ্বল রোদের দিনে আন্নাতারার সাথে দেখা সাইফুলের। যার দু’দিন আগেই প্রেমবঞ্চিত এক ছাত্র মেরে রিকশাওয়ালা মামার কান ফাটিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যাবেলায়।
ঋণগ্রস্ত মামা ক্যাম্পাসে এসেছিল রিকশা চালিয়ে ঋণমুক্ত হবার ধান্দায়। কিন্তু তার সে আশা দুরাশায় পরিণত হল প্রেমবঞ্চিত ছাত্রটির আক্রমণে।
ঢাকা থেকে ছাত্রী পড়িয়ে ক্যাম্পাসে পা রাখতেই সাইফুলের শরীর জারিয়ে উঠল নরোম মেয়েটার গরম বকুনি শুনে। ‘কী সাংঘাতিক! কী নির্মম, কী অন্যায়, কী বীভৎস।’
সাইফুল ভেবেছিল প্রেমিকটাকে বুঝি বকছে! কিন্তু ডেইরিফার্ম থেকে ভাসানী হলে যাওয়ার পথে গেরুয়া গ্রামের এক পথ চলতি বুড়ি সাইফুলের সে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায়, ‘আল্লায় ইয়ার বিছার করব। রিকশায়ালা মাইরা ফালান.. আল্লায় সহ্য করব না। হাসরের দিনে ইয়ার বিচার অইব।’
বুড়ি অবশ্য আগে থেকেই খাপ্পা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। একে তো বাপদাদা-ভাই বেরাদর-স্বামীপুতের সয় সম্পত্তি জায়গা জমি একোয়ার করে সরকার একটা শয়তানির আখড়া বানাইছে, তার ওপর আবার এই হানকার মাগী-মর্দাদের কার্যকলাপের নানা কিচ্ছা কাহিনী বহু কান ঘুরে বুড়ির কানেও গরম ফুঁ দেয়।
বুড়ির পেটের ভিতর এতদিন তা ক্ষোভ হয়ে চুপচাপ জমে ছিল। কিন্তু রিকশায়ালা মাইরা ফালানের কেস বুড়ির মরচে ধরা ক্ষোভে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে আল্লার কাছে বিচার দেয়।
৩১৭ নম্বর রুমটি প্রায়ান্ধকার। তবুও লাথি দিয়ে দরোজা খুলে সাইফুল।
এই কে রে… বলে বাপ্পী তার লাল চোখ মেলে ধরে। মারুফ হাউয়ার পো এতক্ষণে আইলা বইলা অনুযোগ করে।
সাইফুল পাত্তাহীন থাকে। উল্টো বকে, ‘সন্ধ্যা না লাগতেই বাঁশি বাজাইতাছ, লক্ষণ তো ভালো মনে হইতাছে না’ বলে একটা সিগনেচার হাসি মারে।
‘মামা তুই! আমরা ভাবলাম কোন ডাইনোশুশোরের বাচ্চা দরোজায় লাথি কষিয়েছে..বলে দুজনে হাসতে থাকে। সে হাসিতে যোগ দেয় সাইফুল নিজেও।
হাসতে হাসতেই সাইফুল জিগেশ করে, ‘ডাইনোশুয়োর! ডাইনোশুয়োর নামটা কিন্তু ভালো…রে ডাইনোশুয়োরের ছেলেপিলে…’
এইবার তিনজন একসাথে হেসে ওঠে হো হো হাহা…
উথালি পাথালি সে ভালবাসা। ক্যাম্পাসে যত্রতত্রই দেখা যেত ওদের। কখনো আধ নেংটো, কখনো ফুল নেংটো।
হুট করে মাঝখানে হাসি থামিয়ে সাইফুল জিগাশ করে মঞ্চ নাটকীয় ভঙ্গিতে, ‘কিন্তু তার আগে তরা আমারে ক.. আইজ ক্যাম্পাসে কী হইয়াছে? কেনই বা ক্যাম্পাসের মানুষ আজ খণ্ড খণ্ড তর্কযুদ্ধে লিপ্ত? কেন মিষ্টি প্রেমিকাটি তাহার বশংবদ প্রেমিকটাকে হেবি চটকাচ্ছে, ‘কী বীভৎস, কী অন্যায় আর নির্মম বইল্যা? কেনই বা পথ চলতি বুড়িমা এক নিরীহ রিকশাওয়ালা মামাকে লিয়ে আহাজারিতে লিপ্ত হইয়াছে?’
‘ধীরে…বৎস্য ধীরে..তার আগে একটু বাঁশি বাজাও..তারপর নিরোর মতো এমনিতেই জেনে যাবে কেন রোম জ্বলছিল আগুনে।’ বলে মারুফ জাজ্বল্যমান স্টিক এগিয়ে দিয়ে সে নাটকে জয়েন করে।
আপসে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি সত্যিই কিছু জানো না?’
‘না’ সাইফুল তার দীর্ঘ চুমুকে ব্যাঘাত ঘটিয়ে খকখক করে কাঁশে।
কাঁশি উপশমে সাইফুলের মাথায় খানদুয়েক চাটি মারে মারুফ আর বলে ‘তুমি কি জানো না যে ঝন্টু নামক এক বাজে মায়ের ছেলে এক নিরীহ রিকশাওয়ালা মামাকে কলম দিয়ে কুপিয়েছে?’
‘কালামুন দিয়ে কুপিয়েছে?’ সাইফুলের লাল চোখ বেয়ে জল পড়ে, তারপরও নাক দিয়ে ফসফস করে ধোঁয়া ছাড়ে আর ঠা ঠা হেসে উঠে।
‘কলম দিয়্যা সে শুধু রিকশাওয়ালা মামাকে কুপিয়েই ছাড়েনি, মেরেও ফেলেছে।’ মারুফ এইবার হাসি চেপে মর্মাহত হওয়ার চেষ্টা করে।
‘মেরেও ফেলেছে!’ চোখ বড় বড় করে দম বন্ধ করার ভান করে সাইফুল।
‘মাইরাও ফালাইছে।’ বলে বাপ্পী মারুফকে সমর্থন করে।
একজনকে অবিশ্বাস চলে, কিন্তু দু’জনকে চলে না, অবশ্যই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা জাগে। আর যেখানে পথ চলতি বুড়ি এবং মিষ্টি প্রেমিকা সাইফুলকে ধন্দে ফেলেছে আগেই, তাই আর অবিশ্বাসী হতে পারে না সে,’ কিন্তু ঝন্টু নামক বাজে মায়ের শয়তানটা কে?’
‘ও একটা ক্ষণিকের পুলা। থাকে ছালাম বরকত হলে।’ বাপ্পী সিগারেটের শুকা ঝাড়া শেষ করে মেঝেতে কফ ফেলে।
‘ওকে আমি চিনছি না কেন যে? ওর কি আর কোনও পরিচয় নাই?’ সাইফুল চেনার চেষ্টা ছাড়ে না।
বাপ্পী বলে ‘তুই কি মুমুরে চিনিস?’
‘কোন মুমু? ড্রামার?’ সাইফুল মারুফের বাড়িয়ে ধরা স্টিকে বাড়ি দিতে দিতে বলে।
‘হ.. মামা..ওই মুমুর কতাই কইতাছি। যাহাকে তুমি খাইতে চাইছিলা।’ হাসতে থাকে বাপ্পী, মারুফও হাসে।
‘যাহ্ শালা ফণিমনসার ছেলে..কী সব বাজে বকছিস? খাইতে চাইব কেন, ওকে তো আমি ঝালমুড়ি খাওয়াতে চাইছিলাম। তা ওই মুমুর সঙ্গে ক্ষণিকের ছেলে ঝন্টুর কী সম্পর্ক?’ কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয় সাইফুল।
‘ওইখানেই তো কবি নীরব… মন্টির ছেলে। তুমি কি জান না সকল রসুনের গুহ্যদ্বার একসনে বাঁধা?’ বাপ্পী নতুন স্টিকে আগুন লাগায়।
অনেকটা দয়াপরবশ হয়ে বাপ্পী সাইফুলকে বলে..’নে..বাঁশিতে আরো একটা গভীর টান দে…মাথার মেঘ কেটে পরিষ্কার হয়ে যাবে। রোদ্র ঝিক দিয়ে উঠবে। আর তখনই দেখতে পাবি মুমুর বান্ধবী সীমু’
‘সীমু না সীমু না সুমু’ বলে শুদ্ধ করে দেয় মারুফ।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ…সুমু…সুমু।’ আবার শুরু করে বাপ্পী ‘তো ওর প্রেমের বনে একাধিক শেয়াল ঘুরছে। প্রেম খাবে বলে, এতদিন অবশ্য ওটা ঝন্টুই খেত।’
‘খেত মানে! এখন খায় না?’ বলে সাইফুল বনের গভীরে ঢুকতে চায়।
এইবার মারুফ নিজেকে এগিয়ে নিয়ে আসে ‘আহা… ওখানেই তো রিকশায়ালা মামার নিহত হওয়ার মূল সুর নিহীত।’
‘যা হালার পো…আবার হেঁয়ালি পেঁচাচ্ছিস? ঘন করে বল, ভালো করে বুঝি।’ সাইফুল অসহায়ত্ত্ব প্রকাশ করে।
‘আহা.. কেন বুঝছ না ডাইনোশুয়োর ছানা? দুয়ে দুয়ে পাঁচ মিলিয়ে নাও’ বলে বাপ্পী কষে একটা টান দেয় স্টিকে।
‘দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারব, পাঁচ পারব না।’ সাইফুল অপারগতা প্রকাশ করে।
‘খুব সত্যি কথা, তর মতো নমশূদ্রর পক্ষে দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ মেলানো কঠিনই বটে’… বলে মারুফ কফ ফেলে মেঝেতে। না..কোনও রক্ত বের হয়নি। তবে বের হবে, আরও কিছুদিন পরে।
তারপর বলে ‘ওই সুমুটাকেই ভালোবাসতো ঝন্টু। উথালি পাথালি সে ভালবাসা। ক্যাম্পাসে যত্রতত্রই দেখা যেত ওদের। কখনো আধ নেংটো, কখনো ফুল নেংটো। আবার কখনো ভয়াবহ কেরিক্যাচারে লিপ্ত। বছরখানেক ঝন্টুকে অবশ্য দিয়ে থুয়েই খেয়েছে। কিন্তু এখন আর ওটা খাওয়াতে রাজি নয় সুমু।… হতে পারে ওর প্রেমের বনে নতুন কোনও শিঁয়ালের আবির্ভাব ঘটেছে। সে যাই হোক, কথা সেখানে নয়। খাওয়ার জিনিস দু’জনেই খেয়েছে। ব্যাস ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু জিভে যদি কারও স্বাদ লেগে থাকে সে দায়িত্ব কার? আমার প্রশ্ন এখানেই।’
সাইফুল ঠা ঠা করে হাসে।
পাশের সিটের অভদ্রলোক, ময়লা পোশাকের কমজোরিতে, অবাক হয়।… পাগল নিহি হালায়? গাড়িতে উঠার পর থিক্যাই একটার পর একটা সিকারেট খাইতাছে, কোনও কতা নাই, বার্তা নাই, হঠাশ্ ফ্যাক ফ্যাক কইরা য়াসায়াসি তো ভালো মাইনষের নক্ষণ না। সাবদান অওয়া ভালো মনে কইরা বেশ চাইপ্যাচুইপ্যা বহে।
গাড়ি ঘোড়ার মতোই দ্রুত দৌড়ায় আশুলিয়া রোডে। জলের কাছ থেকে একঝাক শীতল বাতাস আছড়ে পড়ে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার শেষ বাসটার শরীরে।
অনেকেই জানালা খুলে বাতাস খায়, তাকিবুকি করে, জ্যোৎস্না আর জলের শোভা দেখে।
সাইফুল নির্বিকার। নিজের গভীরে ডুব দিয়ে পাতাল পুরীতে ঢোকে। টলোমলো পায়ে এগিয়ে যায় ৩০১ নম্বর রুমে।
মাথায় সুবাসিত বাঁশির সুর। মশারি না টাঙিয়ে, একবছর না ধোয়া চাদরের বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। ধাপ্পুশ।
হাঁটতে থাকে রোববারের নন্দনপুর হাটে। শত শত অচেনা মুখ, অচেনা মানুষ। ইঁন্দুরের যোম…..ইঁন্দুরের যোম…..দুই ট্যাকায় পাঁচ প্যাকেট….ইঁন্দুরের বংশ শেষ…
জুলমত হান্দার মানুষের পেটের ভিতর দিয়ে হেঁটে নাই হয়ে যায়। হঠাৎ ঘোড়ায় চড়ে কাঁচা মিঠা আম গাছ বেয়ে নেমে আসে।
আলা ক্যারানির বাড়ি থেকে সুলতানা চ্যাঁচায় সা….ইফু……ল……খেল…….বী..?
চল….বলে ইংলিশ প্যান্ট খুলতে থাকে সাইফুল। কল ঘরে জল পড়ার ছলছল উছল শব্দ। মাথা কামড়ায় শিরশিরে জল পোকা।
সাইফুল……এই সাইফুল…
হু…? ঘুমের ভিতর থেকে তাকায় সাইফুল।
অঞ্জনের ফর্সা মুখ স্পষ্ট হতে থাকে।
‘অসময়ে ঘুমিয়েছিস যে? শরীর খারাপ?’ উদ্বিগ্ন অঞ্জন প্রশ্ন করতেই থাকে।
‘ঊম্ না।’ সাইফুল চোখ ডলে উঠে বসে।
অঞ্জন সিগ্রেট ধরায়। ‘খবর শুনেছিস?’
‘কী খবর?’ ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করে সাইফুল।
রিকশাওয়ালা মামার কেস?
হ্যাঁ..য়্য্য্যা’ হাই তোলে সাইফুল।
‘চল্ বেরুতে হবে। হাতমুখ ধুয়ে আয়..।’ অঞ্জন তাগাদা দেয়।
‘কারণ কী?’ সাইফুল ব্যাখ্যা চায়।
‘চাঁদা তুলতে হবে।’ অঞ্জন ফশফশ ধোঁয়া ছাড়ে।
সাইফুল অঞ্জনের হাত থেকে সিগ্রেট নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে…‘উপলক্ষ?’
‘রিকশাওয়ালা মামার চিকিৎসা।’
অঞ্জন বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে বসে। খাতা টেনে কলম দিয়ে আঁকিবুকি কাটে। একটা বাঘ আঁকে, বিড়ালের মতো যার চেহারা। কেটে একটা গাছ আঁকে। গাছের ওপরে লেখে রিকশাওয়ালা।
‘ও তো মরে গেছে, ঝন্টু শালা ওকে মেরে ফেলেছে।’
সাইফুলের আঙ্গুলের চিপায় বন্দি সিগারেটের অতিরিক্ত লম্বা ছাই গড়িয়ে পড়ে বিছানায়।
অঞ্জনের ফর্সা মুখে সুগভীর বেদনা, একটা পেকে যাওয়া ব্রন এবং চোখের কোলে ঘন কালির আস্তর। বহু রাত না ঘুমানোর চিহ্ন।
অঞ্জন আঁকাবুকি থামায়। কলমটার মাথা লাগিয়ে ছুঁড়ে দেয় টেবিলের কোণে, ‘না..মরেনি…। তবে মরে যাওয়ার মতোই। গণস্বাস্থ্যে ভর্তি করা হয়েছে।’
সাইফুলের গলায় আটকে থাকা ধোঁয়া ফুরফুর করে নাক দিয়ে বেরয়, ‘মরেনি?! তবে যে বাপ্পী আর মারুফ বলল মরে গেছে!’
টেবিলের কোণ থেকে কলমটা কুড়িয়ে আনে অঞ্জন। মাথা খুলে, ‘গুজব ছড়িয়েছে।’ গাছের মাথায় একটা পাখি আঁকে, নিচে লেখে সাইফুল, ‘তবে কানের আঘাত মারাত্মক। কলম দিয়ে ঘা দিয়েছিল।’
অঞ্জন তাড়া লাগায়, ‘যা যা হাতমুখ ধুয়ে আয়…সময় নেই…বারোটার আগেই সবগুলো রুমে পৌঁছতে হবে। নইলে বেশি তোলা যাবে না।’
সিগারেটে লাস্ট টান দিয়ে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগুতে থাকে সাইফুল। হঠাৎ ঘুরে জিজ্ঞেস করে, ‘আর ক্ষণিকের ছেলে ঝন্টুর কী খবর?’
অঞ্জন পাখির বড় করে পা আঁকে, ‘ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও ওর ডিপার্টমেন্টের লোকজন ইতিমধ্যেই ওকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে..’
অঞ্জন গাছের পাশে লেখে পুলিশ ও ঝন্টু। জায়গা না থাকায় গাছের গোঁড়ায় লেখে নৃবিজ্ঞান।
সাইফুল মুচকি হাসে, তার মানে নৃবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের শ্রেণী সংগ্রাম ঝন্টুতে আটকে গেছে?’
অঞ্জন ফিক করে হেসে ফেলে।
সে রাতে সাইফুলরা চাঁদা তুলেছিল হাজার দেড়েক। যারা জীবনে কোনওদিন চাঁদা ফাঁদার ধার ধারেনি, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, কালচারাল চাঁদার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলের এ রুম থেকে ও রুমে, সে রুম থেকে ডাইনিঙে, ডাইনিং থেকে টিভি রুমে দৌড়িয়েছে। কিংবা ঘর অন্ধকার করে মশারি টাঙিয়ে মটকা মেরে পড়ে থেকেছে, যতক্ষণ না চাঁদাশিকারীরা রুম থেকে নাখোশ হয়ে বেরিয়ে যায় ততক্ষণ।
রক্ত চাই, দরিদ্র মেধাবী ছাত্র পয়সার অভাবে ভাল্ব নষ্ট, টাকা দাও ভাল্ব বাঁচাই, নিজে বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচাও… এসব অতি মানবিক ডায়লগ ড্যাম সিজনের মতো ডাল হয়ে গেছে তাদের কাছে, বরাবরই।
তাই কিডনি চাই, রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ, নাট্যোৎসব, নাচা গানা ফূর্তি, ঢাকা থেকে উড়ে আসছেন রুক্সি কিংবা জেমস ভাই নতুবা ন্যাড়াকুলি আইয়ুব চাচ্চু কোনওকিছুতেই তাদের কিছু যায়নি।
অথচ নিরীহ রিকশাওয়ালার করুণ পরিণতি তাদের চাঁদানিরোধক হৃদয়েও বাইসনের গুঁতো দিল। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তাদের জীবন যাপনের রূপরেখা। ট্রাঙ্কের চাইনিজ তালা খুলে টেনেটুনে মাস চালানোর সযত্নে সঞ্চিত টাকা থেকে দান করতে বাধ্য হল, হাত কচলে দু না চারের দ্বিধায় পড়ে শেষমেশ চার টাকাই দিয়ে ফেলল।
অনেকেই হতাশ লেকচার ঝাড়লো, অনেকেই বাগে পেলে ঝন্টুর পন্টুন ফাটিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিল। অনেকেই ছাত্রদের এমন নির্মমতায় সাংঘাতিক লজ্জিত, মর্মাহত এবং ব্যথিত হল। অনেকেই পকেট থেকে দ্রুত দশ টাকার নোট ঝেড়ে এ পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করল।
এর মধ্যেই সাইফুল জেনে গেল, সন্ধ্যায় প্রান্তিকে প্রায় দুই আড়াইশ’ ছাত্র-ছাত্রী পরিবেষ্টিত ঝন্টু রিকশাওয়ালা মামার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সকলেই ভেবেছে এ আর এমন কী। গতানুগতিক ভাড়া বিষয়ক পিট্টি।
তাই আর কেউ ওভাবে গা করেনি। বাঁচাতে আসেনি রিকশাওয়ালা মামাকে। ভেবেছে এমন দু’ চার ঘা প্রয়োজনে সকলেই দিয়ে থাকে। তাই কারোরই অতটা কষ্ট হয়নি চা চপ গিলতে। প্রেমিকার পাদুকায় নিজের পাদুকার চাপ টেবিলের নিচে আর ওপরে চোখ ও হাতের কারসাজিতে রাতের অভিসার নির্ধারিত হচ্ছিল যত্নেই।
তাই কারও কাছে বাধা না পেয়ে ঝন্টু পকেটের মসিটাকে অসি বানিয়ে ঘাই মেরে রিকশাওয়ালা মামার কানের গর্ত রক্তাক্ত করে দিল।
রক্ত মাটিতে না গড়ানো পর্যন্ত সহকর্মী রিকশাওয়ালারা ভোদাই হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সিনেমা দেখতে লাগলো। কেউই এগিয়ে যেতে সাহস করল না। বরং ভয়ে অনেকেরই লিঙ্গ ছোট হয়ে গেল।
দু’ একজন অবশ্য ক্ষুদ্রাকৃতির লিঙ্গ নিয়েও ‘মামা আর মাইরেন না…আর মাইরেন না’ বলে ছাড়াতে গিয়েছিল, তারাও ঝন্টুর সর্বগ্রাসী বক্সিংয়ের শিকার হল।
দু’ চার ঘা খেয়ে তারা ছিটকে পড়ল আশেপাশে।
সিমন দা বুভুয়ার নাম শুনেছো… নারীবাদ… লৈঙ্গিক রাজনীতি? শোনোনি তো… কেবল গ্রাম্যতা আর গোয়ার্তুমি ছাড়া কিচ্ছু বোঝো না তুমি…’
দৃশ্যে যখন বেশ কয়েকজন দরদী কৌতূহলী ছাত্রের আবির্ভাব ঘটল এবং ছেদো প্যাদানোর সিনেমা ঘন গোলমালের আশঙ্কা তৈরি করল ঠিক তখনই চা চপে মত্ত বিপ্লবী প্রেমিক-প্রেমিকারা হুঁশ ফিরে পেল। এগিয়ে এল প্রলেতাড়িয়েৎ রিকশাওয়ালা মামুকে বাঁচাতে।
ইতিমধ্যে ঝন্টু কাজের কাজ সেরে ফেলেছে। রিকশাওয়ালা মামার কানের গর্তটা মেরে দিয়েছে।
নিয়ম মতো সিনেমার শেষ দৃশ্যে পুলিশ এল। ঝন্টুটাকে আটক করে থানার ফাটকে পুরে দিল।
নৃবিজ্ঞান বিভাগ এ হেন অভূতপূর্ব ঘটনায় একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল দুঁদে নৃবিজ্ঞানীকে রক্ষাকল্পে।
তারা ফতোয়া দিল ‘ঝন্টু এক নিরীহ জটিল মানসিক রোগী! তাই ওকে দুধ কলা দিয়ে পুষতে হবে রিকশাওয়ালা মামাদের গুতানোর তরে।’
এ ঘটনার দিন দুই পর এক ঝকঝকে রোদের দিনে, আন্নাতারার সাথে দেখা।
তার ভ্রমরকালো আঁখি, বুকের গোলাকার পাখি, বেগুনি জারুলে, কৃষ্ণচূড়ার লালে বান্দরলাঠির হলুদে সে এক সর্বনাশা দশা।
অঞ্জনই পরিচয় করালো, এ আন্নাতারা। নৃবিজ্ঞান। চাঁদা তোলায় ম্যালা ওস্তাদ। আর ও সাইফুল। গোপাল। তোমরা দুজনেই উত্তম চাঁদা উত্তলক। বলে অঞ্জন হাসতে থাকে। হাসিতে তাল মেলায় বাকি দুজনে।
হুমহাম শব্দে ছুটে চলছে বাস। প্যাকেটে সিগ্রেটের অনুপস্থিতি টের পায় সাইফুল। সিগ্রেটহীন প্যাকেটের মতো সাইফুলের বুকটাও শূণ্য হয়ে যায়। শূণ্যতার সুযোগ নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা বিড়ালটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
দাঁত বিজলিয়ে বলে ‘আন্নাতারা তোমাকে কেন ভালবাসেনি তা আমি জানি’
সাইফুল কোনও উত্তর করে না, তার মন খারাপ ভাব তীব্র হতে থাকে। বিড়ালটা আমতা আমতা করে,’ না মানে ভালো হয়তো বেসেছিল…’
সাইফুল সিগ্রেট নাই জেনেও পকেট হাতড়াতে থাকে।
‘মন খারাপ করলে? জিজ্ঞেস করে বিড়ালটা নিজেই মন খারাপে ভোগে।
‘নাহ’ বলে পকেট হাতড়াতেই থাকে। যেন পকেট হাতড়ানো ছাড়া আর কোনও কাজ নাই পৃথিবীতে।
‘আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার মুখটা কালো হয়ে যাচ্ছে। তোমার শ্বাস প্রশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছে।’
বিরক্ত হয় সাইফুল, ‘আসলে তুমি কী বলতে চাইছ, সেইটা বলে ফেল, ভনিতা রেখে।’
‘ঠিক আছে ..বলছি’ বলে বিড়ালটা সাইফুলের লম্বা এলোমেলো দাঁড়িতে একবার হাত বুলায়।
‘খবরদার আমার দাঁড়িতে হাত দেবে না..’ মেজাজ চড়ে যায় সাইফুলের।
‘রাগ করছো কেন ভায়া..তোমার দাঁড়িগুলো তো সুন্দর, তাই…।’ আরেকবার ঝটপট হাত দিয়ে, ‘তবে মজার ব্যাপার কি জানো? তোমাকে ভালো না বাসলেও তোমার দাঁড়িটাকে কিন্তু ভালবাসতো আন্নাতারা।’
‘ফের বাজে বকছো? দাঁড়াও সামনের স্টেশনেই সিগ্রেট কিনছি আর তোমাকেও তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি..।’
‘এজন্যই তোমাকে ভালবাসেনি আন্না, বলে বিড়ালটা লাফ দিয়ে সাইফুলের গ্রীবায় চড়ে। এবং কানে কানে বলে,’ তোমাকে ভালোবাসেনি, কারণ তুমি একটা মফঃ’
‘মফঃ মানে?’
‘মফঃ মানে মফঃস্বলের গাঁইয়া একটা ছেলে।’
বজ্জাত বেড়ালটাকে এক লাথিতে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে পাঠাবার প্রস্তুতি নেয় সাইফুল মনে মনে। মনোভাব বুঝে দ্রুতই কেটে পড়ে সে।
কিছুক্ষণ পরই সাইফুল বিড়ালটাকে কন্ডাকটরের কাঁধে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দেখে।
দুঃখী দুঃখী হাসি হাসে। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলে, ‘পোস্ট মর্ডানিজম বোঝো? মর্ডানিজমই তো বোঝো না, তো আবার পোস্ট মর্ডানিজম! সিমন দা বুভুয়ার নাম শুনেছো… নারীবাদ… লৈঙ্গিক রাজনীতি? শোনোনি তো… কেবল গ্রাম্যতা আর গোয়ার্তুমি ছাড়া কিচ্ছু বোঝো না তুমি…’
সাইফুলের বমি পায়। জানালা খুলে মুখ বাড়িয়ে হাঁ করে। বাতাসে তোড়ে বল্টে যেতে থাকে তার মুখমণ্ডল। তারপরও ওয়াক ওয়াক করতে থাকে। কিন্তু সাইফুলের না খাওয়া পেট কোনও বমি বের করতে পারে না, চুকা কিছু আঠালো পানি বিনে।
পাশের যাত্রী আরও সইরা বসে, আরও একটু চাইপাচুইপা।
বিড়াল অপেক্ষা করে বমি শেষ হওয়ার। হলে ফের শুরু করে, ‘ জীবনে ছাড় দিতে হয় বুঝছ… সূতা ছাড়তে হয়, ঘুড্ডি যতদূর যেতে চায়, তাকে যেতে দিতে হয়, টানাটানি করলেই সে ছিঁড়ে চলে যায়। এসব তো তোমার জানা, তবু কেন যে…
এইবার সাইফুল হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে। কিন্তু লাভ হয় না তাতে। বিড়াল প্যাকর প্যাকর করতেই থাকে, ‘কেন বৃথা অভিমান পুষছো? ওসব পাতলা ইমোশান রাখো…সব বাস্কেটে ফেলে দাও। বৃথা প্রেম ফ্রেম নিয়ে হেদিয়ে মরছো। আনন্দ করো… উত্তম আনন্দ… উল্লাস, উল্লাসন!
‘উহ্ থামবে? নাকি আমি নিজেই লাফিয়ে পড়বো জানালা দিয়ে।’ সাইফুল বিরক্তির চরমে পৌঁছে।
একটু চুপ করে বিড়ালটা। তারপরও ফিসফিসিয়ে বলতে ছাড়ে না, ‘যাই করো না কেন বাছা…লাফিয়ে পড়ো না। তাইলে কেলেঙ্কারির একশেষ। সবাই বলবে প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে গাড়ির নিচে প্রাণ দিয়েছে।’
সাইফুল শূণ্য প্যাকেটটাকে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে মারে। বিড়ালটা সাইফুলের টোনায় বসে হাই তোলে।
কন্ডাকটর ভাড়া উত্তোলনের কাজে নেমে পড়ে। এবং প্রথমেই বাধাগ্রস্ত হয়।
‘কী কস! কত ট্যাহা দিমু?
… সত্তর ট্যাকা।’
‘ক্যা… পাচচলি্লশ ট্যাহা দেই।’
যাত্রীর এমন আহ্লাদে কন্ডাকটরের সাফ উত্তর..’তাইলে রিদের পরে যাইয়েন।’
‘আইজক্যা গেলে অসুবিদা কী..’বলে কন্ডাকটরকে যুক্তির পয়েন্টে বেঁধে ফেলে যাত্রী।
‘অসুবিদা আছে…আইজ বাদে কাইলক্যা রিদ…এহনো যুদি মাগনা যাইবার চাইন ..তাইলে তো অসুবিদাই..।’
‘মাগনা কীরে…মাগীর পুলা…দেশটারে নিজেগো বানাইয়া ফালাইছো…?’ বলে চিৎকার ক্রোধাক্রান্ত যাত্রী।
‘এই…ভর্দলোকের মতো কতা কন…এইডা ধলেশ্বরী বাস।’ কন্ডাকটর নিজের সম্মান জিইয়ে রাখতে চায়।
‘ধলেশ্বরী বাস চিনি রে…আমরা তর রিদের বাজারের পেসেন্দার না…আঙ্গো দৈনিকি আপডাউন করার নাগে…যা ভাড়া, তাই দিছি। পাঁচচলি্লশ ট্যাকার এক পাই কম দিতাম, তাইলে কিছু কইবার পারতি। সুযোগ একটা পাইছো…আর পাবলিকের পুটকি মারবার নুইছো…’ বলে ক্রোধাক্রান্ত যাত্রী কন্ডাকটরের মান সম্মান ধূলায় লুটিয়ে দেয়।
সারা বাস হেসে উঠে। কন্ডাকটর কাচুমাচু হয়, ‘কী করুম…টাঙ্গাইল থিক্যা খাইল্যা বাস নিয়া আহন লাগে।’
কন্ডাকটরের করুণ বাস্তবতাকে মোটেই পাত্তা দেয় না ক্ষুব্ধ যাত্রী,’ হ.. তাই পাবলিকের পকেট কাইট্যা লুশকান পুশাবি? তর মালিকের লাব অইলে, আঙ্গো ভাড়া কম নেয় না বড়? পাবলিকের নরোম গুয়ায় সব শালা গুতাইবার চাও?’
সারা বাস আবারো হেসে উঠে। যে লোকটা বাসের সিট না পেয়ে নিজের কাপড়ের বস্তার সিটে চড়ে যাচ্ছিলো সে তো হাসতে হাসতে হাফানির টান ধরিয়ে ফেলে। গাড়ি খন্দে পড়ে লাফিয়ে পড়লে সেও লাফিয়ে পড়ে এক যাত্রীর ঘাড়ে।
‘হুরু মিয়া! পড়ার আর জাগা পাইলেন না। একেবারে বেয়ুশ অইয়্যা যায়!’ ব্যথা পাওয়া যাত্রী ফোশ করে উঠে।
‘ভাইয়েরও মুনে হয় চাক্কা জ্বালাইছে..?’ পাশের রসিক যাত্রী বেদনাময় পরিস্থিতি হাল্কা করে দিলে আরেক পশলা হাসিতে যোগ দেয় অন্যরা।
পইড়া যাওয়া যাত্রীটা শ্লেষের সঙ্গে ‘চুদানির পুলারা রাস্তাডা এ্যাদ্দিনেও হারলো না’ বলে আবার নিজের কাপড়ের বস্তায় গিয়ে বসে পড়ে।
কন্ডাকটর গ্যাঞ্জাম বুঝে গাড়ির পেছনের দিক থেকে সটকে পড়ে সামনের দিক থেকে ভাড়া কাটা ধরে। সামনে বসা হুজ্জতে ইজ্জত খোঁয়াতে নারাজ ভদ্রলোকরা কোনো হাঙ্গামা ছাড়াই ৪৫ টাকার ভাড়া ৭০ টাকা দিয়ে দিতে থাকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বাসের জানালা গলে বেরুতেই বাতাসের তোড়ে উড়ে যায়। সাইফুলের নাজুক হৃদয় ক্রমেই পুড়ে যায় মিষ্টি বিড়ালের বাক্যবাণে।
আন্নাতারা কি সত্যিই ভালোবাসেনি তারে?
ওই মিয়া আমার দিকে ওইরম তাকাই থাকেন ক্যান?
কই তাকাইলাম?
কই তাকাইলাম মানে! সব সময় তাকাইয়া থাকেন। আপনের দিকে ঠিকঠাক তাকাইতেই পারি না, দেখি আপনে তাকাইয়া আছেন!
সাইফুল হাসে, ঠাঠা কইরা হাসে।
খ্যাক খ্যাক কইরা হাসবেন না। আপনার হাসি হয় না মিয়া, গা জ্বলে।
তেমু খ্যাক খ্যাক কইরা হাসতে থাকে সাইফুলে। আন্নাতারা কৃত্রিম রাগে জ্বলে। আর বলে, সন্ধ্যায় বটবৃক্ষ তলে আইসেন, হাসির বিচার হবে। বলে হন হন করে চইলা যাইতে থাকে।
ও দয়াল বিচার করো… ও দয়াল বিচার করো… দাও না তারে ফাঁসি, আমায় গুম করেছে খুন করেছে ও বাঁশি…গানটা ধরার খুব ইচ্ছা হয় সাইফুলের, কিন্তু লোকলজ্জায় ধরতে পারে না। কেবল গুনগুন করে।
হন হন করে চলে যাইতে থাকা আন্নাতারা বন বন করে ঘুরে ফের ফিরে আসে। আর ভ্রমর কালো চোখ ঈষৎ পাকিয়ে বুকের গোলাকার পাখি ইষৎ ঝাঁকিয়ে কহে, সন্ধ্যায় বিচার হবে, মনে আছে তো? বলে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই চলে যেতে থাকে।
সারা ক্যাম্পাস হাঁটতে থাকে সাইফুল, একটা ন্যায়বিচারের আশায়। তার অন্তরে তুমুল আমোদ গুনগুন করে গান গাহিয়া চলে।
ক্যাম্পাসে উদ্দেশ্যহীন বহুক্ষণ হেঁটে সাইফুল হলে ফিরে আসে।
‘কীরে অলুম্বুস এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’
সাইফুলকে দেখে চোখ বড় বড় করে অঞ্জন আরো বলে, ‘জানিস এর মধ্যে কত কাণ্ড? ঝন্টুকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে.. রিকশাওয়ালা মামা বাড়ি ফিরেছে।’
অঞ্জনের পেকে উঠা ব্রন শুকিয়ে যেতে বসেছে, চোখের কোলে কালো দাগ অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
সাইফুল ছেঁড়া ছেঁড়া শুনে মুচকি হাসে। উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না তার।
অঞ্জনের উৎসাহ কমে না তাতে, ‘জানিস এদিকে আমরা রিকশাওয়ালা মামাকে চাঁদার টাকা দিয়ে একটা নতুন রিকশা কিনে দিচ্ছি… আরেকটু সুস্থ হলেই সে রিকশা চালাতে পারবে।’
সাইফুল ধীরলয়ে অঞ্জনের কাঁধে হাত রাখে, গ্রীবা ধরে মুখটাকে কাছে এনে কানে কানে কী যেন বলতে যেয়ে চকাশ করে চুমু খেয়ে ফেলে।
হতভম্ব অঞ্জন ঈষৎ চমকে উঠে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে, শুয়োর ডাইনোশুয়োর, আমি গে নারে…
সেত জানি বন্ধু, কিন্তু তুমি কি জানো, আজ সন্ধ্যায় আমার একটি প্রেম হতে যাচ্ছে… সাইফুল গ্রীবা না ছেড়েই কানে কানে বলতে থাকে।
বলিস কীরে ঘটোৎকোচ, কার এমন সর্বনাশ হবে? আবার সেই ঠা ঠা হাসি অঞ্জনের…
রাতে বলবনি বলে সাইফুল পিছিয়ে যায়।
জ্বী নহে বাহে, এখনই বলে ফেল দিকিনি? অঞ্জন চাপে।
যদি না হয়, কী একটা লজ্জায় পড়ব, বল দিকিনি? সাইফুল পিছলায়।
আমার কাছে আবার লজ্জা কীরে, বলে ফেল তো শুনি। বলে ফাইনাল চাপ বজায় রাখে অঞ্জন।
ফলে ঝেড়ে কাশতে বাধ্য হয় সাইফুল, তোমার সেই চাঁদা উত্তোলনকারিনী।
এই মেরেছিস! মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার, করেছিস কী! আয় ভুকে আয় সাইভুল। বলে অঞ্জন তারে জড়ায়ে ধরে।
সেই সাথে বলতে ভোলে না, যাই করো… সাবধানে… খুব খতরনাক আদমিনী আছে।
আমারও তাই মনে হয়, একটা আগুনে ব্যাপার স্যাপার আছে। বলে সাইফুল সম্মতি দেয়।
সো ডিল কেয়ারফুলি। বলে অঞ্জন আরও কহে, কীরে খাবি না অলুম্বুস? নাকি প্রেমে পেট ভরপুর?
প্রেমে পেটভরপুর। সাইফুল স্বীকার করে।
কিন্তু আমার তো ক্ষুধা লাগছে, আমাকে তো খেতে হবে। চল, আমি খাব, তুই বসে বসে দেখবি।
গাড়ি ঘোড়ার মতোই দৌড়ায়। ত্যান্দর কন্ডাকটর সামনের দিকে ভাড়া কেটে পুনরায় ফিরে আসে পেছনে ‘কী ভাড়া দিবাইন ন্যাহ?’
‘ভাড়া না তরে হাদলাম। তুইতি তো নিলি ন্যা?’ সাফ জানিয়ে দেয় যাত্রী।
‘কত জানি দিছিলান?’
‘ক্যা? ভাড়া যা তাই। পাঁচচলি্লশ ট্যাহা।’
‘আজক্যার ভাড়া তো পাঁচচলি্লশ ন্যা। সত্তর ট্যাকা।’
‘তুই কইলেই মানমু?’
‘ব্যাকেই তো মানলো।’
‘ব্যাকে গু খাইলে আমিও গু খামু? একটু থেমে আরো বলে, ‘ব্যাকের তো কালা ট্যাহা আছে, আমার আছে না বড়?’
‘ওই সুমস্ত ভাবের কথা বাইত্তে যাইয়্যা কাক্কীর নগে প্যাঁচাল পাইরেন। এহন চালু কইরা পকোট থিক্যা সত্তরডা ট্যাহা বাইর করেন। চালু করেন… বলে ছোট্ট একটা ধমকও দেয়।
‘এই জ্যান্দরের বাচ্চা কতা বার্তা ইশাব মতো কবি।’
‘তোমার হাতে আবার কী ইশাব কইরা কতা কমু? ভাড়া না দিবার পারলে সামনের ইস্টিশনে ভর্দলোকের মতো আলগুস্তে বাস থিক্যা নাইম্যা যাইবা।’ যাত্রীর কেউগা চেহারা আর ময়লা জামা দেখে নিশ্চিন্ত মনে কন্ডাকটর আপনে আজ্ঞের ধার ধারা শেষ করে দেয়।
কিন্তু সেটা মানবে কেন অত ভালো যুক্তি বোঝা যাত্রী? ফলে ধুমাশ করে সে কন্ডাকটরের নাক প্যাঁচিয়ে একটি ঘুষি বসিয়ে দেয়।
হতভম্ব কন্ডাকটর দু’ সেকেন্ড সময় নেয় সামলে উঠার। তারপরই ধাম করে যে হাতের আঙ্গুলের খাঁজে খাঁজে টাকা রাখে, সে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে উল্টো দিক দিয়ে কিল বসায় বাসের ছাদে আর মুখের গোল থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসে, ‘ওস্তাদ গাড়ি থামান। হালায় আমারে বক্সিন দিছে।’
সাংঘাতিক উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে আরো বলে, ‘আমার কুচ থন নয় আজার ট্যাহা কাইড়্যা নিছে। ওস্তাদ গাড়ি থামান… হালারে আমি মারুম..।’
ঘ্যাচ করে গাড়ি থামিয়ে দেয় ড্রাইভার।
নন্দনপুর বাজারে জুলমত হান্দার ইঁন্দুরের বিষ বেচে। কাঁচামিঠা আমগাছে মড়া ইঁন্দুরের ন্যায় ঝুলতে থাকে সুলতানা, কী এক গভীর অভিমানে।
যাত্রীরা রা..রা করে উঠে। ভদ্রলোকদের গলা এবার সাংঘাতিক সোচ্চার’ ড্রাইভার সাহেব…গাড়ি থামালেন কেন? গাড়ি চালান।’
পাশে থেকে বলে উঠে,’ হ..জাগাডা ভালো না…ডাকাতি অয় মাঝেমদ্যেই।’ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের মধ্যে, ‘ওই ড্রাইভার..গাড়ি ধামাইল্যা ক্যা? ড্রাইভার সাব গাড়ি থামালেন ক্যান? ওই ডাইবর গাড়ি ছাড়ই। ওই চুদানির পুলা ডাইবার গাড়ি ছাড়। ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি ছাড়ছেন না কেন?’ যাত্রীরা একজোট হয়ে চিৎকার শুরু করে এবার, এইবার ভদ্রলোক অভর্দলুক কেহই বাদ যায় না যে।
ফলে গাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় ড্রাইভার। কারণ পচানব্বই ভাগ গ্যাঞ্জামও সামাল দেয়া যায়, কিন্তু একশ’ভাগ অসম্ভব।
গাড়ি আবারো ঘোড়ার মতো দৌড় শুরু করে রাস্তা ধরে।
কন্ডাকটর বক্সিন মারা যাত্রীর আশেপাশেই ফোঁস ফোঁস করে ঘোরে। কিন্তু কিছু করতে না পারার নিরানন্দে হাঁসফাঁস করে। খানিকক্ষণ পরে কন্ডাকটর যখন নিশ্চিত হয় প্রতিশোধ নেওয়া অসম্ভব, তখন গম্ভীর মুখে পুনরায় ভাড়া কাটতে আরম্ভ করে।
কন্ডাকটরের ব্যথামাখা গাম্ভীর্য নাকি অজানা গ্যাঞ্জামের আশঙ্কা নাকি দয়া, সে যাই হোক যাত্রীরা আর কথা না বাড়িয়ে অতিরিক্ত পঁচিশ টাকা কন্ডাকটরের হাতে তুলে দিতে থাকে।
শুধু একজন বলে.. ‘কন্ট্রাকটার ভাই.. আমার ঠ্যান পাঁচ ট্যাহা ছট আছে…বিশ্বাস করেন.. আর ট্যাহা নাইঙ্ক্যা..থাকলে দিয়া দিতাম।’
কন্ডাকটর কথা না বলে পাঁচ টাকা কম পয়ষট্টি টাকা নিয়ে ৯৯.৯৮ ভাগ অনৈতিক ভাড়া কাটার মিশন সাকসেসফুল করে তোলে।
সন্ধ্যায় বাচ্চা বটবৃক্ষতলা। সাইফুল বসে আছে একা। অনতিদূরে হাস্নুহেনা ছড়িয়ে দিচ্ছে উন্মাতাল সুবাস, আকাশে একটা বিরাট চাঁদ। আন্নাতারা আসে, পা টিপে টিপে। সাইফুলের অজান্তে পেছন হইতে কান ধরে এবং তাহা মুচড়ে দিতে থাকে।
সাইফুল হাসে, খ্যাক খ্যাক করে হাসে।
ইশ আপনার হাসি এত পচা ক্যান? অনুযোগ করতে করতে আন্নাতারা সাইফুলের পাশঘেঁষে বসে।
জবাব না দিয়ে সাইফুল আরও বেশি খ্যাক খ্যাক করে হাসে।
হইছে, থামেন। এইবার কন, আপনে আমার দিকে তাকাই থাকেন ক্যান?
কই তাকাই থাকি? সাইফুল উল্টা প্রশ্ন করে।
থাকেন, থাকেন, মিথ্যা বইলা লাভ নাই। আঁতকা আরও প্রশ্ন করে, প্রেমে পড়ছেন?
জানি না, বলে সাইফুল আন্নাতারার ভ্রমরচোখে তাকাই থাকে। বুকের গোলাকার পাখি দেখে, হাস্নুহেনার সুবাসিত আবেশে।
বহুৎ মেজাজ খারাপ। মাথা ধরছে। এইভাবে হাবলুর মতো তাকাই না থাইকা মাথা টিপেন। বলে আন্নাতারা তার ভ্রমরকালো চোখের ঝাঁপি নামিয়ে ফেলে।
সাইফুলের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা বাঘ হালুম দিয়ে ওঠে। সে আন্নাতারার ঘন কালো চুলের বনে নখর ডাবিয়ে টিপতে শুরু করে।
উহ্ আস্তে, বলে প্রতিবাদ জানায় আন্না, আরও কহে, এইটা একটা মাথা, পাথর নহে।
এইবার সাইফুল আস্তে আস্তে টেপা শুরু করে আর কেন যেন থরথর করে কাঁপে। তার নাক মুখ দিয়ে ডাইনোশুয়োরের মতো থুড়ি ড্রাগনের মতো ধোঁয়া বের হতে থাকে। আগুনে।
এমা..আপনি গাল টিপছেন কেন? মাথা তো ধরছে মাথাতে। বলে আন্না ফের অনুযোগ করে।
সাইফুল ভীষণ লজ্জা পায় এবং সাততাড়াতাড়ি মাথা টিপতে শুরু করে।
কিন্তু ব্যাপারটা ভালো লাগে না আন্নার। সে কহে, ঠিকাছে আপনার যেখানে খুশি সেখানে টিপেন। ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে দেয় সাইফুলকে।
এইবার সাইফুল সত্যি সত্যি বাঘ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আন্না হরিণ হয়, সেই একাকী জোসনা রাতে।
আন্নার ভ্রমরকালো আঁখি, বুকের গোলাকার পাখি, বেগুনী জারুলে কৃষ্ণচূড়ার লালে বান্দরলাঠির হলুদে একাকার হয় বাচ্চা বটগাছতলা।
রাতে হলে ফিরে সাইফুল, আহ্লাদে আটখানা। দানবীয় এক আমোদ ঘিরে ধরে তারে। মন তার আনন্দে নাচতে থাকে, হাসতে থাকে, ‘আমি ইহাকে পাইলাম… আমি ইহাকে খাইলাম’ বলে।
রুমে ঢুকে অঞ্জনকে দেখতে পায়, চেয়ারে বসে কী যেন লিখছে, মাথা ঝুঁকিয়ে। সাইফুল সন্তর্পণে পেছনে দাঁড়ায়, জাপ্টে ধরে চুমু খায়, আনন্দের আতিশয্যে।
আরেহ অলুম্বুস, থাম থাম বলে অঞ্জন পেছন ঘোরে। কহে, কীরে প্রেম পেয়েছিস?
পেয়েছি, বলে সাইফুল পাশের তক্তপোষে বসে। আলগোছে।
অঞ্জন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাইফুলকে দেখে। এক চোখ বন্ধ, আরেক চোখ খুলে ফের জিগেশ করে, পুরোটা?
সাইফুল বসা থেকে তক্তপোষে শুয়ে পড়ে, গা এলিয়ে, ‘পুরোটা।’
ঠাঠা করে হেসে ওঠে অঞ্জন। চল হারামি, সেলিব্রেট করি…
রাত সাড়ে তিনটা, ভাসানী হলের ছাদ। নাঙ্গা দুই যুবক, হেড়ে গলায় গান ধরে, অরণ্য ডাকে… হেইডি আয়ডি আয়…
পরের দিন সকাল গড়াইয়া যায়, দুপুর ছুঁই ছুঁই, ঘুম ভাঙ্গে সাইফুলের। খিদায় পেট চো চো করে। প্রাতঃক্রিয়াদি ঠিক ঠাক না সেরেই কেবল চোখে পানি ছিটিয়ে খাদ্যের সন্ধানে নামে।
হলের ক্যান্টিনে নাশতা নাই, ছোটে বটতলাপানে। কিছুদূর আগাইতেই সে আন্নাতারাকে দেখে। তার মনটা নেচে ওঠে তুমুলামোদে। হণ্টনের গতি বাড়ায়। পরক্ষণেই তার আমোদ ধূলিতে লুটায়, আন্নাতারার সনে অচেনা এক যুবককে দেখে।
আন্নাতারা হাসতে হাসতে রিকশায় চড়ে, সাথে যুবকটিও।
সাইফুল পেছন থেকে ডাকে আন্না..এই আন্না…। আন্না শোনে না যে! ফলে চিৎকার করে ডাকে। এই আন্না… আন্না… আন্নাহ….তারা… তারা… তারাহ…
আন্না হাসতে হাসতে চলে যায়, অচেনা যুবকের সাথে। সাইফুলকে সে শোনে না যে!
সাইফুল ধন্দে পড়ে। তবে কি সে ঠিক ঠাক চিৎকার করতে পারে নি? নাকি আন্নাতারা শুনেও শোনেনি। তা কী করে হয়! ফলে সাইফুল গলা খাকারি দিয়ে ফের চিৎকার করে নিজেকে শোনায়, আন্না…আন্না…আন্নাহ..তারা তারা তারাহ…।
বটতলা খা খা করিতে থাকে। নাশতা খেতে ভালো লাগে না সাইফুলের। কেবলই সিগ্রেট ফুঁকিতে থাকে। তার বেদনাহত হৃদয় নিদারুণ মুষড়ে পড়ে। সে এলোমেলো হাঁটতে থাকে ক্যাম্পাস জুড়ে।
হাঁটতে হাঁটতে আন্নার ডিপার্টমেন্টে চলে যায়, ক্যাফেটেরিয়া টিএসসি হয়ে অডিটরিয়াম, কোথাও আন্না নাই। সাইফুলের বুক খা খা করিতে থাকে, ট্রান্সপোর্ট চৌরঙ্গী কলাভবন, কোত্থাও নাই।
ফের হাঁটতে থাকে সাইফুল, ফুঁকতে থাকে সিগ্রেট, একের পর এক। তারপর বাচ্চা বটগাছটার নীচে এসে বসে, বসেই থাকে। আর ভাবতে থাকে আন্নাতারারে। তার ঘনকালো আঁখি, বুকের গোলাকার পাখি, বেগুণী লাল হলুদে, বান্দরলাঠি কৃষ্ণচূড়া জারুলে।
দুপুর গড়ায় বিকাল হয়, বিকাল গড়ায় সন্ধ্যা হয়। বাচ্চা বটগাছটা থেকে থেকে ঝিরি ঝিরি বাতাস আঁকে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। সাইফুল অন্ধকারে মিশে যায়।
আন্নাতারা আসে, আসিতে থাকে, হাসিতে হাসিতে। পাশে অচেনা যুবক, বড় বেশি জ্বলজ্বলে। সাইফুলের হৃদয় ককিয়ে ওঠে, ব্যথায়।
ওমা! তুমি এইখানে! কতক্ষণ? বলে আন্নাতারা সাইফুলের গাঘেঁষে বসে আর দণ্ডায়মান অচেনা যুবকের কাছে সাইফুলের পরিচয় দিতে থাকে, সুমন… এ হচ্ছে সাইফুল, আমার সিনিয়র ফ্রেন্ড, চাঁদা তোলায় ওস্তাদ।
আর দণ্ডায়মান যুবকের পরিচয়ে বলে, এ সুমন… আমার বাচ্চাকালের দোস্ত। বলে সুমনের হাত টেনে পাশে বসায়। তার পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে গান ধরে, সাইফুলের চোখে চোখ রেখে, ধরো আমি কথা বলি..কথা বলি জংলি ভাষায়…
সাইফুলের অন্তরাত্মা জ্বলে পুড়ে যেতে থাকে। গান থেমে গেলে সাইফুল কেটে কেটে বলে, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে…
বলো…বলে আন্নাতারা সুমনের পিঠে ঠ্যালা দিতে দিতে দুলতে থাকে।
না, এখানে বলা যাবে না। সাইফুল জেদ করে।
তাহলে বলো না, আন্নাতারা চোখমুখ শক্ত করে।
মানে?
মানে খুব সোজা। যে কথা এখানে বলা যাবে না, সে কথা আমি শুনব না।
তারমানে আমাদের সম্পর্কের কোনও প্রাইভেসি নাই?
কীসের সম্পর্ক?
কেন, প্রেমের।
আন্না হাসে, খিলখিল করে হাসে। একদিন শুলেই প্রেম হয়ে যায় বুঝি?
সাইফুল মরমে মরে যায়, তার সমস্ত স্নায়ু স্থির হয়ে যায়। সে পকেট হাতড়ে সিগ্রেট খুঁজতে থাকে, পায় না। তার লজ্জা লাগে, সুমনের সামনে এইসব কথা বলতে চায় না সে। কিন্তু নিরূপায় হয়ে বলতে থাকে, হয়তো…
হয় বুঝি? আন্নাতারা সাইফুলের চোখে স্থির চোখ রাখে।
আমি তো পড়েছি, সাইফুল আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলতে থাকে।
আমি তো পড়িনি, আন্না সাফ জানিয়ে দেয়। এইক্ষণে সুমন উঠে চলে যেতে চায়, আন্নাতারা তাকে টেনে থামায়।
পড়োনি? সাইফুল অবিশ্বাসের সুরে জানতে চায়।
না পড়িনি। শান্ত স্থির ভঙ্গিতে জানিয়ে দেয় আন্না।
কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসি আন্না…ভীষণ ভালোবাসি… এইক্ষণে সাইফুল একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়।
মিথ্যা বলো না… তুমি আমাকে ভালোবাসো না…দখল করতে চাও…সকলেই তাই চায়, তুমি কেবল একলা নও।
সাইফুল মাথা নিচু করে বসে থাকে, বাচ্চা বটগাছটা থরথর করে কাঁপে, হাস্নুহেনার সুবাস উড়ে উড়ে দূরে ছড়িয়ে যায়।
রাত দেড়টায় হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়ি পৌঁছায় টাঙ্গাইল পুরান বাসস্ট্যান্ডে। যাত্রীরা হাত পা ঝাড়া দেয়। গা মোচড়া মুচড়ি করে নামতে থাকে।
সাইফুলের নামতে ইচ্ছা করে না, ইচ্ছা করে না বাড়ি ফিরতে। বিড়ালটা তখনও সাইফুলের টোনার মধ্যে ঘুমিয়ে। তাকে আলগোছে পাশের সিটে রেখে সাইফুল দ্রুত নেমে যায়।
রিকশা নাই, হাঁটতে থাকে। পেছন থেকে কে যেন ডাকে, সাইফুল খেলবি?
বিড়ালটাই এবার সুলতানা সাজে। নন্দনপুর বাজারে জুলমত হান্দার ইঁন্দুরের বিষ বেচে। কাঁচামিঠা আমগাছে মড়া ইঁন্দুরের ন্যায় ঝুলতে থাকে সুলতানা, কী এক গভীর অভিমানে।
একে একে সকলে চলিয়া গেলে বক্সিনখেকো কন্ডাকটর ড্রাইভার আর হেল্পার মিলিয়া হুমা পিটান পিটাইতে থাকে পাঁচল্লিশ ট্যাকার ভাড়া সত্তুর ট্যাকা না দিতে চাওয়া যাত্রীটাকে।
বেগুনী জারুলে কৃষ্ণচূড়ার লালে বান্দরলাঠির হলুদে অরণ্য ডাকে… হেইডি আইডি আয়…
চাঁদনি রাত, বাচ্চা বটগাছ… থরথরিয়ে কাঁপে, আন্নাতারা অঞ্জনে।