ভালো থাক ফারহানা

ভালো থাক ফারহানা

বাচ্চাদের মধ্যে একটা অসম্ভব আকর্ষণ শক্তি আছে। ‘অনেকটা বড় হয়ে গেছি’, এই থিওরিটিক্যাল নার্সিসিজম থেকে বেরোলে সেই আকর্ষণ অনুভব করা যায়। ফিরে যাওয়া যায় হাঁটি হাঁটি পা পা’র দেশে, একরত্তি মানুষদের পৃথিবীতে। যেখানে মিচকে হাসি, মিহি কান্না, মিত্তি মিত্তি ছটফটানি, নিজেদের ডায়াপার জীবনের লজ্জাকে দাঁড়ি-গোঁফ হাসির রাবার দিয়ে মুছে ফেলে। আফটার অল, এখন আর প্যান্টে হিসু করি না, বড় হয়ে গেছি।

হাসপাতালের শিশু বিভাগ হল নিজেদের ছোটবেলাকে দু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার জায়গা। তবে অন্য ভাবে। চারিদিকে নিষ্পাপ পুচকে পুচকিরা নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। ওদের সব্বার শরীর খারাপ।এত ছোট্ট শরীর গুলোতে কেন যে রোগের বিষ ঢুকে যায় তা কল্পনার অতীত। মিহি শরীর গুলোতে ছুঁচ ফোটাতে গেলে হাত কাঁপে, দরকারি পরীক্ষার জন্য রক্ত নিতে গেলেও দু’বার ভাবতে হয়। কিন্তু করতে হয়। হয়ত সেটা ওদের ভালোর জন্যই।

ওয়ার্ডের মেন হলে ঢুকেই সামনে ডাক্তারদের বসার জায়গা। এবং তার পাশে সিস্টারদের।চেয়ারে বসলে সামনেটা পরিষ্কার দেখা যায়। কাজের ফাঁকে দু এক ঝলক তাকিয়ে দেখলেই ঠোঁটের কোণে অজান্তে একটা হাঁসি চলে আসে। পুচকু গুলো কেউ মায়ের কোলে খেলছে, কেউ ঘুমোচ্ছে, তো কেউ কান্নাকাটি করে সারা ওয়ার্ড মাথায় করে রেখেছে। সব মিলিয়ে হাসপাতালের চার দেওয়ালের পৃথিবী এই অসুস্থ ছোট্ট মানুষ গুলোর কাছে লড়াই লড়াই খেলাঘর।

আজকে যার গল্প লিখছি, সে একটু স্পেশাল। সুদূর কাশ্মীরের বাসিন্দা,অপূর্ব এক ভিনদেশী তারা। তিন বছরের মেয়ে ফারহানা।

ফারহানা গত বেশ কয়েকদিন হল নয় নম্বর বেডে প্রবাসী হয়ে রয়েছে। ছোট্ট এত্তটুকু শরীর, গায়ের রং দুধের মত সাদা ধপধপে। ও এতটাই ফর্সা যে ওয়ার্ডে ঢুকলেই চট করে চোখ আটকে যায় ওর দিকে। কাশ্মীরি আপেলের মত ফোলা ফোলা গাল, পুরু ভুরু, সরু ঠোঁট আর ছোট ছোট দুটো তীক্ষ্ণ চোখ। চোখের চাউনিতে সারাক্ষন কেমন যেন একটা ইতস্ততঃ ভাব। চারিদিকে যা ঘটেছে তাতে ও যেন অস্বাভাবিক রকম বিরক্তি বোধ করছে। আসলে সেটাই স্বাভাবিক। বেচারি নেফ্রোটিক সিনড্রোমে ভুগছে। শুধু ভুগছে বললে ভুল হবে, বেশ অনেক দিন ধরে ভুগছে। সারা শরীরটা ফুলে একটা বড় ফুটবলের মত হয়ে গেছে। চোখের চারিদিকে ফোলা, পেট অনেকটা ফুলেছে, হাত পা ফোলা, এমনকি লেবিয়াল সোয়েলিং’ও চোখে পড়ার মত। ওর বয়সী বাচ্চাদের এটা একটা ওতি কমন রোগ। কিডনির কার্যক্ষমতা ব্যাহত হওয়ার জন্য সারা শরীরে জল জমতে শুরু করে। পেচ্ছাপের সাথে শরীর থেকে প্রোটিন বেরিয়ে যায় বেশি মাত্রায়। ক্রমে হাত পা মুখ পেট সবই ফুলতে শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে বুকে এবং পেটে জলও জমে। সব মিলিয়ে ছোট্ট ফারহানাকে আপাতত বিছানা বন্দী করে রেখেছে এই বিভীষিকা। যখনই দেখি বিছানার এক কোনায় বসে থাকে পুচকিটা। কাছে গেলেই আড় চোখে তাকায়। কখনোই হাসতে দেখিনা ওকে। হাসবেই বা কিকরে, শরীরে এরকম অস্বস্তি নিয়ে মুখে হাসি আসে না।

আমার প্রতিদিনের কাজ ছিল সকালে ওয়ার্ডে গিয়ে ওর ব্লাড প্রেসার, ওজন, পালস রেট, এবং ইউ এইচ টি চেক করা। ইউ এইচ টি অর্থাৎ ইউরিন হিট টেস্ট, একটা টেস্ট টিউবে কিছুটা পেচ্ছাপ ধরে সেটা আগুনের উপর রেখে দেখতে হয় কতটা প্রোটিন শরীর থেকে বেরিয়েছে বা আদৌ বেরিয়েছে কিনা! একদিন সকালে প্রেসার মাপতে গিয়ে দেখি ফারহানা বাবু হয়ে বসেছে বিছানার উপর। হাতে একটা চামচ ধরে সামনে রাখা দুধের বাটি থেকে একটু একটু করে দুধ খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ” কিরে কি করছিস ?”

একবার চোখ বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর ,” ধুর পাগলা, তুই কে রে!” এরকম একটা হাইফাই লুকস্ দিয়ে আবার নীচের দিকে মাথা নামিয়ে নিল। জাস্ট কোন পাত্তাই দিল না আমাকে মহারানী। আমি ওর মা’কে জিজ্ঞেস করলাম,” ও কি বাংলা বলে?”

ফারহানার মা আদ্যোপান্ত বাঙালী মেয়ে। বয়স একেবারেই বেশি না। চোখ মুখের সারল্য দেখলে মায়া হয়। মেয়ের সাথে সাথে উনিও তো একটা লড়াই লড়ছেন! যাই হোক, ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন,” না স্যার। তবে বাংলা বোঝে।”

” তাহলে ও কি কথা বলে না নাকি!?” তিন বছরের মেয়ের কথা বলতে না পারাটা অস্বাভাবিক।
” হ্যাঁ স্যার, কথা বলতে পারে। কাশ্মীরি ভাষা বলে।” উত্তর দিলেন ভদ্রমহিলা।
“ও। আজকে সকাল থেকে কি ও পেচ্ছাপ করেছে !?”
” না স্যার। ওই কাল থেকে যা করেছে এই বোতলে ধরে রেখেছি।” বিছানায় নীচ থেকে একটা প্লাস্টিকের বোতল তুলে দেখালেন ভদ্রমহিলা।

বোতলে খুব অল্পই ইউরিন আছে। স্বাভাবিক। কিডনির কাজ করার ক্ষমতা কমে গিয়ে কম ইউরিন’ই হওয়ার কথা। হচ্ছেও তাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ” আগে কি ওর এরকম হয়েছিল কোনদিন ?”

” হ্যাঁ স্যার।”
” কবে?”
” কয়েক মাস আগে। তখন ডাক্তার দেখানো’ও হয়েছিল।”
” কোথায় দেখিয়েছিলেন?”
” শ্রীনগরে।”
” শ্রীনগর মেডিক্যাল কলেজে ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
” আপনাদের বাড়ি কি শ্রীনগর ?”
” আমার শশুর বাড়ী শ্রীনগর। বাপের বাড়ি এখানেই, জয়নগর। তবে ওর জন্ম শ্রীনগরেই । আসলে ওর বাবা কাশ্মীরের মানুষ, উনিই ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেন।”
” শ্রীনগরে যখন ওকে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন তখন কি ও ভালো হয়ে গেছিল ?”

” হ্যাঁ স্যার। একদম ফোলা টোলা সব কমে গেছিল। তারপর এই কিছুদিন আগে শ্রীনগর থেকে কোলকাতা আসার সময় ট্রেনের মধ্যেই আবার ফুলে গেছে ওর গোটা গা।” গলা সামান্য কেঁপে গেল ভদ্রমহিলার।

আমি বুঝলাম এটা শুধু সামান্য নেফ্রোটিক সিনড্রোম নয়, এটা নেফ্রোটিক সিনড্রোম রিল্যাপ্স। অর্থাৎ পুরো পুরি সুস্থ হওয়ার পর পুনরায় আবার একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। খুব অস্বাভাবিক কিছু না। অনেক বাচ্চারই এরকম হয়। সাধারণ ভাবে এ রোগের চিকিৎসায় অন্যান্য ওষুধের সাথে মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে স্টেরয়েডই ভরসা। শ্রীনগরে স্টেরয়েড থেরাপি দিয়েই চিকিৎসা হয়েছিল ওর।একবার সম্পূর্ন চিকিৎসার পর আবার একই রকম উপসর্গ নিয়ে এই রোগ ফিরে আসতে পারে। ফারহানার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। তবে এবারে পরিস্থিতি একটু বেশি ভয়াবহ। কিছু ক্ষেত্রে অনেক দিন স্টেরয়েড থেরাপি চলা সত্ত্বেও রুগীর উপসর্গের উন্নতি হয় না। সেগুলোকে স্টেরয়েড রেসিস্টেন্ট কেস বলে। ফারহানার শরীরে সেই ভয়ের কালো মেঘই ঘনিয়ে এসেছে। স্টেরয়েডের সাথে কিছু ইমিউনো মডুলেটার ড্রাগ অর্থাৎ যেগুলো আমাদের রোগ নিরাময় ক্ষমতাকে মডুলেট করে , এমন কিছু ওষুধ ওকে দিতে বাধ্য হতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। এত রকম ওষুধের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেচারি কেমন জানি মিইয়ে পড়ছে দিন দিন। চুপ চাপ বসে থাকে বিছানার এক কোনায়। মায়ের সাথে ছাড়া কারুর সাথে কথা বলে না। খেলে না। হাঁটা হাঁটি করে না। কোথাও গেলে মায়ের কোল ছাড়া নড়ে না। ওর মা কে একদিন বললাম, ” ওকে হাঁটান না কেন ?”

জবাবে ভদ্রমহিলা বললেন, ” স্যার, ও হাঁটতেই চাইছে না। খালি কোলে নিতে বলছে।”
সত্যি কথা বলতে সারা শরীরে যন্ত্রনা নিয়ে ওই টুকু পুচকি কেন, বড়রাই হাঁটতে চাইবে না।

ফারহানাকে দেখে মন খারাপ হত বড়। এত সুন্দর একটা ফুটফুটে জীবন যন্ত্রনায় ছটফট করছে দেখলে বুক কেঁপে যায়। রোজ ডিউটি শেষ হলে ওয়ার্ড থেকে বেরোনোর সময় ওকে একবার দেখে বেরতাম। অদ্ভুত একটা মায়া জড়িয়ে গেছিল এই তিন বছরের কাশ্মীরি উর্বশীর সাথে। একদিন ডক্টরস টেবিলে বসে আছি, দেখি ফারহানাকে কোলে নিয়ে ওর মা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বললাম, ” কি হল, ওর কি খুব শরীর খারাপ করছে নাকি?”

” না মানে স্যার, ওর চ্যানেলটা খুলে গেছে। একটা নতুন চ্যানেল করে দেন যদি…”
“আচ্ছা বেশ। আপনি ওকে ওখানে নিয়ে যান, আমি আসছি।” হাত দিয়ে পাশের চ্যানেল করার ঘরটা দেখিয়ে দিলাম আমি।

বাচ্চাদের চ্যানেল করাটা সব সময় ভয়ানক চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। ওয়ার্ডের এক পাশে চ্যানেল করার জন্য আলাদা একটা ঘর আছে। সেখানে চ্যানেল করার সরঞ্জাম, তুলো, স্পিরিট, লিউকো, সব রাখা। বাচ্চাদের ছোট ছোট হাত, তাতে ভেন’ও ছোট ছোট, সুতরাং ফুল কনফিডেন্সে চ্যানেল করতে সত্যিই পারদর্শিতা লাগে। কারণ বার বার ফুটিয়ে চ্যানেল করতে খারাপ লাগে বড্ড। ফারহানার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো কঠিন, কারণ সারা শরীরে ইডিমা হয়ে হাত পা সবই ফোলা। ভেন খুঁজে পাওয়া শক্ত কাজ। তার উপর আগে ওর শরীরের অনেক জায়গায় চ্যানেল করা হয়েছিল অতএব সেগুলোতে দ্বিতীয়বার চ্যানেল করতে গেলে ফেলিওরের চান্স বেশি। এনি ওয়ে, অনেক কষ্টে বাম হাতের কব্জির কাছে একটা সরু ভেনে চ্যানেল করা গেল শেষ পর্যন্ত। অদ্ভুত ভাবে, চ্যানেল করার সময় পুচকিটা একবারও কাঁদল না। অবাক কান্ড!! ঘটনাটা দেখে ভাবলাম, বাঃ! এতো ভারী চমৎকার মেয়ে, এবার একে কোলে নেওয়া যাবে। এক পকেট লো কনফিডেন্স নিয়েই যেই না কোলে নিয়েছি ওকে, ওরেব্বাপ!!! মেয়ে একেবারে কেঁদে কেটে একসা!! শেষে মায়ের কোলে গিয়ে শান্ত হলেন ম্যাডাম।

এমন ভাবেই বেশ কিছু দিন কাটল। ধীরে ধীরে ফারহানা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকল নিজের মত করে। গা হাত পায়ের ফোলা কমল। চোখের চারিদিকে ফোলা কমে গিয়ে ছোট চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর হয়ে উঠল। পেচ্ছাপে প্রোটিনের পরিমান কমতে কমতে একেবারে চলে গেল। পর পর তিন দিন ইউরিন হিট টেস্ট ক্লিয়ার আসার পর আমাদের স্যার ওকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ছোট ছোট পায়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সুস্থ শরীরে বাড়ি গেল কাশ্মীর কি কলী। ভূস্বর্গের পরী ডানা মেলে উড়ল আকাশে।

এর কিছুদিন পরে, ঠিক গত চোদ্দই ফেব্রুয়ারী পুলওয়ামা জঙ্গী হামলার দু দিন পরের কথা। গোটা দেশ তখন রাগে ফুঁসছে, গোটা কাশ্মীর উত্তাল। সারা দেশে কাশ্মিরী বয়কট চলছে হুড়মুড়িয়ে। সেদিন সকালে দেখি মায়ের কোলে নতুন জামা কাপড় পরে সেজে গুজে হাজির ফারহানা। চেক আপে এসেছে। এখন অনেক সুস্থ ও। তবে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে আরো বেশ কিছুদিন। ফারহানার মায়ের দিকে তাকাতেই কেমন একটা লাগল। সারা মুখে কেমন যেন একটা ভয়ের ছাপ। কুঁকড়ে আছেন মনে হল। হয়ত বা নিজের স্বামীর চিন্তায় ভেতরে ভেতরে কাঁপছেন! হয়ত বা চিন্তায় আছেন অনেক। ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করি, কেমন আছে আপনার বাড়ির লোকজন!? শ্রীনগরের অবস্থা কেমন!? ইত্যাদি। তারপর কেন জানি না থমকে গেলাম। যার মেয়ে অসুখে ভুগছে তাকে দেশের কথা না জিজ্ঞেস করাই ভালো। ওই তিন বছরের কাশ্মীরি পুচকিটা’ই ওনার দেশ। ওনার সব কিছু।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত