তেতো মেজাজে অফিস থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো অলোক। না , বাড়ি যেতে ইচ্ছা করছেনা একদম। কোথায় যাওয়া যায়? যেখানে গেলে মাথাটা ঠান্ডা হয়,
কোনও কিছু না ভেবেই একটা বাসে উঠে পড়ল অলোক আবার বাস টা কিছুক্ষণ যাবার পর কোনও কিছু না ভেবেই নেমেও পড়ল বাস থেকে । কোথায় এল বোঝারও চেষ্টা করল না। হাঁটতে লাগলো উদ্দেশ্যহীন ভাবে। মনের ঘূর্ণিঝড়টাকে কিছুতেই থামাতে পারছে না। সন্ধ্যা নেমেছে, চলতে চলতে পথের পাশে একটা মন্দির দেখে সিঁড়িতে গিয়ে বসল। মন্দিরে সন্ধ্যারতি হচ্ছে।
তেতো জিভে চেটে নিলো আজকের অভিজ্ঞতা।
পুজা , হ্যাঁ পুজা ঘোষ আজ তাকে তার কাজের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।ওর এত সাহস? কিন্তু নিস্ফল আক্রোশ ঢোঁক গিলে সহ্য করা ছাড়া কোনও উপায়ও নেই। একসাথে কাজে ঢুকলেও নিজের যোগ্যতায়, দক্ষতায় এগিয়ে গেছে পুজা। প্রোমোশন পেয়ে এখন পুজা তার কাজের ভুল ধরার যোগ্যতা অর্জন করেছে। অতি সাধারণ একটা মেয়ে, তার এত বড় সাহস?
হঠাৎই অনাবশ্যক ভাবে
মিলির মুখটা মনে পড়ে অলোকের, দিনের পর দিন সে মিলির সাথে কতই না অপমানজনক ব্যবহার করে চলেছে। সে ভালো করেই জানে যে আজকের সমস্ত রাগের বোঝাও মিলিকেই বইতে হবে।
নিষ্ঠুর একটা আনন্দ উপভোগ করে সে মিলিকে অপমান করে, উঃ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে, বন্ধুমহলে সব সময় মিলির প্রশংসা….. বন্ধুরা সব সময় তার স্ত্রী ভাগ্যের প্রশংসা করে।
তার বাবা মা পর্যন্ত ফোন করলে আগে মিলির সাথেই কথা বলতে চায়, আর কথা যেন শেষ হতে চায়না আর অলোকের সাথে দুচারটে দায়সারা কথা । সম্মোহনী শক্তি আছে বোধহয় ওই মহিলার। কিন্তু এত অপমান সহ্য করেও মিলি কখনও তাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারেনা, সেটা অলোক জানে।
আজকাল অলোক খেয়াল করেছে যে মিলি যেন অতিরিক্ত শান্ত, নিস্পৃহ, নিরুত্তাপ। সংসারের দায়িত্বগুলোর ব্যাপারে যেন আগের চেয়ে বেশি নিঁখুত। একটা পার্টটাইম কাজ করে কোথাও। জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে না, শুধু বলে তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি? একটা নিঁখুত, পরিপাটি যান্ত্রিক রূপ দেখে আজকাল মিলির। শারিরীক আহ্বানেও কখনও না বলে না। অদ্ভুত নিস্পৃহভাবে অন্যান্য দায়িত্ব পালনের মত অলোকের শারীরিক চাহিদা মেটানোর দায়িত্বও পালন করে।
ওর খুঁত ধরার কোনও জায়গা পায়না অলোক তবু অকারণ , অযৌক্তিক ব্যাপারে ওর উপর রাগ দেখিয়ে ওকে অপমান করে এক নিষ্ঠুর আনন্দ পায় অলোক।
আবারও মনে পড়ে অলোকের পুজার অপমান জনক কথাগুলো ।
একটা বারে যায় অলোক, না আজ যেন মদের স্বাদেও কোনও ভালোলাগা খুঁজে পায়না সে, কোনো বন্ধুর বাড়িও যেতে ইচ্ছা হয়না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফেরে।
বেল বাজিয়ে আজ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, বেশ কিছুক্ষণ পরে একটু আলুথালু ভাবেই দরজা খোলে মিলি। একটু অবাক হয় অলোক এত তাড়তাড়ি তো ঘুমোয়না মিলি । রাতে ওকে বই পড়তে দেখেছে কিন্তু আজ ওর মুখ দেখে মনে হল যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। চলতে গিয়ে হোঁচট খেলো , টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে যেতে অলোক এগিয়ে এসে ওকে ধরতে গিয়ে বুঝলো ওর শরীরের উত্তাপ। বিছানায় শোয়ালো , খাবার টেবিলে গিয়ে দেখলো কিছুই খাবার তৈরি নেই। বিস্কুট জল খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালো অলোক । মিলিও অবাক চোখে দেখে অলোক কে ।
বসে থাকে অলোক মিলির মাথার কাছে।
কিছুক্ষণ বাদে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে মিলির। উঠে বসে। অলোককে শুতে যেতে বলে ঠান্ডা গলায়।
ওই নিরুত্তাপ কন্ঠস্বর আজ যেন আলোকের মর্মে আঘাত করে কোনও অজানা অঙ্কের সমীকরণে।
হঠাৎ কি যেন হয়ে যায় অলোকের সমস্ত অস্তিত্বে।
সমস্ত অস্তিত্ব যেন নতজানু হয়ে পড়ে মিলির কাছে। চিৎকার করে বলতে চায় যন্ত্র মানবী , তুমি মানুষী হও। সমস্ত সত্তা যেন চিৎকার করে বলতে চায় দাও,দাও দাও। মিলি দাও।
তোমার মানুষী সত্তার স্পর্শ দাও। তোমার শরীর, তোমার মন, তোমার সেবা , তোমার পাহাড় প্রমাণ অভিমান ভাঙা বরফ জলের ধারা , তোমার গভীর চোখের চাউনি, তোমার যাদুকরী ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী, তোমার জমাট বাঁধা অশ্রু, এভাবে দূরে যেওনা ।
ছুঁয়ে দাও মিলি,ছুঁয়ে দাও।
আগুন হয়ে পোড়াও, বৃষ্টি হয়ে ভেজাও।
ছুঁয়ে দাও, মিলি , ছুঁয়ে দাও।
বলে নি সে মুখে কিছুই তবু এক অজানা যোগসূত্রে প্রতিটি কথাই বুঝি পৌঁছে যায় মিলির কাছে ।
এবার অলোক এক অপ্রত্যাশিত স্পর্শ পায় তার মাথায়, সেই স্পর্শ, যার জন্য সাত সমুদ্র তের নদীও পেরোনো যায় অনায়াসে, রাজসুখও তুচ্ছ হয়ে যায়।
এখন রাত বারোটা। একটা নতুন দিন শুরু হল। অলোকের বানানো গরম চিকেন সুপ মুখে দিয়ে মিলি পায় সেই অমৃতের স্বাদ, যে অমৃতের জন্য জন্ম জন্মান্তর ধরে সে অপেক্ষা করেছিলো।