নিজের বাড়ি

নিজের বাড়ি

বিকেল বেলা হাঁটতে বেরোনোটা বহুদিনের অভ্যাস শ্বেতার। সকালে শুভায়নের অফিস, তিতলির স্কুল, শাশুড়ির দেখভাল, কাজের লোকের পেছনে বকবক এই করেই কখন যেন বেলা গড়িয়ে যায়, তাই বিকেলটাই বেছে নিয়েছে সে।

সালোয়ার কামিজের সাথে স্নিকার পরে বেরিয়ে পড়ল রোজকার মতো। একই পথ আর তার চারপাশে একই দৃশ্যাবলী। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে গাছপালাগুলোর দিকে নজর যায় বারবার। এখন বসন্ত । রিক্ত শূন্য ডাল পালায় আবার নতুন প্রাণের সঞ্চার …ভারী ভালো লাগে দেখতে। পাখির ডাক ছাড়া আর বিশেষ কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট…মহিলা কণ্ঠে নাগাড়ে অনেক কথা বলে চলেছে। শব্দের উৎস চিলড্রেন্স পার্ক। কৌতুহলী শ্বেতা গতি বাড়ায়। পার্কের গেটে একটা ব্যানার লেখা- হ্যাপি উইমেন্স ডে।

বেশ বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। রত্নাবলীও ওর মতোই হাঁটতে বেরিয়ে থমকে গেছে পার্কের সামনে এসে। -এই রত্না ! কি হচ্ছে কিছু বুঝলে ?

-আরে একটা নামী রিয়েল এস্টেট কোম্পানি নারী দিবস উপলক্ষে কিছু গেম, কুইজ এইসব অ্যারেঞ্জে করেছে। ওদের নতুন প্রজেক্টে বিজেতা বেশ ভালো ডিসকাউন্ট পাবে ফ্ল্যাট বুকিংয়ে ….চলো ঢুকি।
-কিন্তু বিকেলের জলখাবার !

-ধুর ছাড়োতো, একদিন নাহয় বিকেলে শুধু জল খাক…খাবার রাতে দিও।
রত্নার কথায় হেসে ফেলে শ্বেতা। চলো তাহলে…

নানান কম্পিটিশন রয়েছে যেমন ফিটেস্ট উ্যম্যান, স্ট্রংগেস্ট উ্যম্যান, বিউটিফুল উ্যম্যান । মোস্ট স্পোর্টিং উ্যম্যান এর প্রাইজ পেয়ে গেল রত্না। শ্বেতা কিছুই পায়নি। মনটা একটু খারাপ। শুধু এই এক ঘন্টা হেঁটে কিছুই হচ্ছে না বোঝা গেল। কাল থেকে আরো কিছু ব্যায়াম করতে হবে নিজেকে ফিট রাখতে। অনুষ্ঠান প্রায় শেষের মুখে এবার ওদের লাস্ট ইভেন্ট। একটা প্রশ্ন । যার উত্তর যত সুন্দর হবে সেই বিজেতা ।
সঞ্চালিকা এক এক করে সবাইকে একটাই প্রশ্ন করছে…

-আপনার নিজের বাড়ি বলতে কি বোঝেন?

ধুর ফালতু…কদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়াতে এই রকমই একটা ভিডিও দেখেছিল শ্বেতা। যত্ত সব। একে প্রাইজ না পাওয়া তার ওপর এই বোকা বোকা খেলা। উঠে পড়ল সে।
-কি চলে যাচ্ছ ? রত্নাবলী ভুরু কুঁচকায়।
-হ্যাঁ গো। বাড়িতে অনেক কাজ পরে আছে। আর এই থিমটাই বোকা বোকা লাগে। নিজের বাড়ি আবার কি ?
হাসলো রত্নাবলী।
-চলো আমিও যাবো।

বেরিয়ে আসতে আসতে শুনলো কেউ প্রশ্ন শুনে হাসছে , কেউ বলছে স্বামীর বাড়িটাই তো নিজের বাড়ি। কেউ বলছে আমি বাপের বাড়ির অনেক সম্পত্তি পেয়েছি। তাই আমার বাবার বাড়িটাই নিজের বাড়ি। কেউ বলছে ফ্ল্যাটের ই এম আই টা তো আমি পে করি তাই বাড়িটা আমারই।

বিকেলের খেলাধুলার মজাটা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। শ্বেতা আর রত্না পাশাপাশি হাঁটছিল। কারো মুখেই কথা নেই। হয়তো প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে এসেও প্রশ্ন টা থেকে বেরোতে পারেনি ওরা। পরস্পর কে বিদায় জানিয়ে যে যার বাড়ি ঢুকলো। শুভায়ন ফিরে এসেছে।

পোশাক পরিবর্তন করে চট করে চা করে আনলো শ্বেতা। টিভি চলছে ঘর খালি এই তো ছিল, কোথায় গেল ?
ডাকতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শুভায়ন।।

-আরে ! এটা কি হচ্ছে সন্ধ্যেবেলা..তিতলি আছে তো নাকি?

জুঁই ফুলের মালাটা খোঁপায় জড়িয়ে দিতে দিতে হ্যাপি উইমেন্স ডে বলে ওঠে শুভায়ন। তারপর একটা প্যাকেট হাতে তুলে দেয়।

-থ্যাংক ইউ। হাসলো শ্বেতা।
-আরে খুলে না দেখেই থ্যাংক ইউ ? তোমার পছন্দের ফিরোজা রঙের শিফন …
-তোমার আনা কোনো কিছুই তো আজ পর্যন্ত অপছন্দ হয়নি শুভ। এটাও ভালোই হবে।
শ্বেতার আচরণে একটু অবাক হয় শুভ।

এরপর তিতলির হোমওয়ার্ক , ডিনার রেডি করা, শাশুড়ির খাবার ওষুধ এই সবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শ্বেতা। সব মিটলে রাতের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম লাগাতে লাগাতে কথাটা বলেই ফেলে শুভায়নকে।

-আচ্ছা শুভ, এই বাড়িটা কার নামে ?
-আমার ….ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই বলে ওঠে শুভ।
কেন ?
-আমি চাই বাড়িটা তুমি আমার নামে করে দাও।
-মানে ! হঠাৎ রাতদুপুরে এই অদ্ভুত খেয়াল কেন ?

-অদ্ভুতের কি দেখলে এতে ? এটা আমার একটা ইচ্ছে বলতে পারো। আমার নিজের একটা বাড়ি।
এমনিতে সংসারী শান্ত প্রকৃতির হলেও শ্বেতার মধ্যে কোথাও একটা খাম খেয়ালি ছেলেমানুষি আছে, তাই প্রায়ই এমন কিছু কথা বলে যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কবিতা লেখে। কয়েকবার পড়ার চেষ্টা করে দেখেছে শুভ বোঝেনি একবর্ণও। হেঁয়ালি করা ওর স্বভাব। তাই শ্বেতার এই সব কথার খুব একটা গুরুত্ব দেয় না শুভ। কিন্তু আজকে ওর গলায় এক অদ্ভুত জাগতিক চাহিদা ঝরে পড়ছে যা অচেনা লাগে শুভর কাছে।

-এখন তো অফিসের খুব চাপ..পরে ভেবে দেখেছি কি করা যায়।
রোজ লাঞ্চ শেষ করে একবার শুভ শ্বেতাকে ফোন করে। মা ঠিক আছে কিনা, তিতলি স্কুল থেকে ফিরল কিনা, শ্বেতা ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট খেয়েছে কিনা খোঁজ নেয়।। আজও তাই করেছিল। রুটিন মাফিক কথা শেষ হতেই শ্বেতা বলে ওঠে

-ভাবা হলো ?
-কি ভাববো ?
-বাড়ির নাম ট্রান্সফারের ব্যাপারে ?
অবাক হয়ে যায় শুভ। কাল রাতের সেই পাগলামি টা এখনো মাথা থেকে যায় নি !
-তুমি এখনো ওই নিয়ে পড়ে আছো ? এগুলো কি ছেলে খেলা ? বললাম আর হয়ে গেল ? উকিল জোগাড় করতে হবে, কোর্টে ছুটতে হবে। এসবের সময় কার আছে ? আমার প্রমোশান আটকে আছে তুমি জানো। টার্গেট অ্যাচিভ করতে না পারলে জুনিয়র কেউ আমার মাথায় বসবে…আমি টেনশনে অস্থির তার মধ্যে এই উটকো ঝামেলা।

-তার মানে তুমি করবে না ? তাই তো ? আমি সারাদিন তোমার মাকে সামলাবে, তোমার মেয়েকে সামলাবে তোমার আর তোমার বাড়ির দেখভাল করবো…কেন ? আমি এই বাড়ির কেয়ার টেকার ?

হতবাক হয়ে যায় শুভ। ভেবেছিল প্রোমোশনের কথাটা বলে সহানুভূতি আদায় করা যাবে কিন্তু এ কি শুনছে সে ? শ্বেতার মুখে এমন বস্তুবাদী কথা ! বিশ্বাস হচ্ছে না।

শোনো, না আমি উকিল খুঁজতে যাবো না আর না এই বিষয়ে অফিস টাইমে আর আলোচনা করবো। বাড়ি তোমার চাই তো ? তুমি সব অ্যারেঞ্জে করো আমি সই করে দেব। ফোন টা কেটে দেয় শুভ।

দাম্পত্যের পনেরোটা বছর কেটে গেছে। এত দিন মনে হতো তাদের দাম্পত্যটা পারফেক্ট। শুভর ভালোবাসা নিয়ে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন আসেনি মনে । অত্যন্ত দায়িত্ববান স্বামী । ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি বাদ দিলে অভিযোগের কোনো জায়গা নেই। কিন্তু এই বাড়ির মালিকানাকে কেন্দ্র করে ওর চরিত্রের এক অজানা দিক সামনে এসেছে। শুধু তো বাড়িটা শুভর নামের জায়গায় নিজের নামে করে দিতে বলেছে। বাড়ি তো আর গয়নার বাক্স না যে শ্বেতা বগলদাবা করে বাপের বাড়ি নিয়ে যাবে। আর বাপের বাড়ি বলতে যা বোঝায় সেটাও হয়তো নেই শ্বেতার। বাবা রেলে চাকরি করতেন। কোয়ার্টারের বড় হয়েছে ও। নিজের বাড়ি বাবা করে উঠতে পারেননি। বাবা মারা যাবার পর দাদা মাকে নিজের কাছে নিয়ে যায় মুম্বাইতে। দাদার সেই ফ্ল্যাটকে কি বাপের বাড়ি বলা যায় ? উত্তরটা জানা নেই। আসলে এতদিন এগুলো ভাবেই নি। সেদিনের ওই খেলাটাই…

হঠাৎ ই বাড়ির পরিবেশটা বদলে যায়। সদ্য কিশোরী তিতলি বুঝতে পারে তার বাবা মায়ের সম্পর্কটায় কোথায় যেন বেসুর বাজছে। সব কিছুই হচ্ছে কিন্তু হাসিখুশি ভাবটা বাড়িতে থেকে যেন হারিয়ে গেছে । এক রবিবার সকালে বাজার থেকে ফিরে সবে চা টা নিয়ে বসেছে শুভ কলিং বেল বাজলো। আরতিদি দরজা খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে শ্বেতা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
আসুন…

শ্বেতাকে অনুসরণ করে এক মাঝ বয়েসী ভদ্রলোক সোফায় এসে বসলেন ।
শ্বেতা বলে উঠলো ইনি শ্যামলেন্দু রায় ল’ইয়ার…

রাগে পা থেকে মাথা অব্দি জ্বলে যাচ্ছে শুভর। এত দূর ! প্রথমে ছেলেনানুষি ভেবেছিল। তারপর মনে হলো মাথায় একটা পোকা ঢুকেছে কদিন পর ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু নাঃ। এতো একে বারে উকিল নিয়ে এসেছে।
ভদ্রলোক শুরু করলেন…ম্যাডাম বললেন আপনি বাড়ি মালিকানা ম্যাডামের নামে ট্রান্সফার করতে চান, স্বেচ্ছায়?…চশমার ফাঁক দিয়ে একবার জরিপ করলেন ভদ্রলোক ।
কিছুক্ষন চুপ থেকে শুভ বলল

– ব্যাংকের লোনে বাড়িটা করেছিলাম। যেহেতু আমার নামে লোন তাই বাড়িটা ও আমার নামেই করা হয়। মানে নিয়ম তাই। দলিলে নাম যার ই থাকুক না কেন বাড়িটা আমাদের…মানে আমার, শ্বেতার, তিতলির, মায়ের। অন্তত এতদিন তাই ছিল। এখন ও যখন চাইছে বাড়িটা ওর নামে হোক তাই হবে । আপনি পেপার রেডি করুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িটা ওর নামে যাতে করা যায় সেই ব্যবস্থা করুন। আর এটা খেয়াল রাখবেন যেন বারবার আমায় কোর্টের চক্কর কাটতে নাহয়, ব্যস….উঠে যায় শুভ।

সেদিনের পর থেকে এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয় ওদের দাম্পত্যে। এত বছরের সম্পর্কের ভিতটা হঠাৎ কেমন নড়বড়ে হয়ে যায়। শুধু একটা নাম ! হয়তো সেটাও না একটা অস্তিত্বের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে দুটো মানুষ। একরকম নির্লিপ্ততার সাথে কেটে যায় একটা মাস তারপর ,

-কাল কোর্টে যেতে হবে এগারোটা নাগাদ …
অবাক ভাবটা কাটতেই শ্বেতার কথায় বিরক্তি ঘিরে ধরে শুভকে।
-পৌঁছে যাবো চিন্তা করো না। এই পনেরো বছরে তুমি যদিও সেভাবে কিছু চাওনি তবু যা চেয়েছো দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবারেও অন্যথা হবে না। তোমায় একটা কথা বলা হয়নি নর্থ ইস্টে আমার ট্রান্সফারের অফার এসেছে। নিলে প্রমোশান পাক্কা…এই সুযোগ মিস করতে চাইনা। সব ঠিকঠাক চললে মাস খানেকের মধ্যে চলে যেতে হবে আমায়।
-তোমায় মানে ! আমরা কি করবো ?
-মা যদি যেতে চায় যাবে আমার সাথে কিন্তু তুমি কি তোমার নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতে পারবে ? আর তিতলির পড়ার ব্যাপার টাও তো দেখতে হবে…বললেই তো আর নতুন স্কুলে এ্যাডমিশন হয়ে যাবে না। বছর তিনেক থাকতে হবে হয়তো… তারপর দেখা যাক…
“নিজের বাড়ি” খোঁচা টা ভালোই বুঝলো শ্বেতা। কথা বাড়ালো না।

পরদিন এগারোটায় কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুভ। সকাল অফিসে গিয়ে কিছুটা কাজ করে বিশেষ দরকার বলে ঘন্টা খানেকের জন্য বেরিয়ে এসেছে সে। কুড়ি মিনিট হয়ে গেল না উকিল না শ্বেতা…কারো পাত্তা নেই। ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। নট রিচেবল … এতো আচ্ছা জ্বালা হলো।

একঘন্টা পর শ্বেতার একটা মেসেজ এলো । তাতে লেখা …
নারী দিবসে একটা খেলায় একটা প্রশ্ন ছিল মেয়েদের সত্যিই কি কোনো বাড়ি থাকে? আমাদের নিজের বাড়ি কোনটা?

ছোটবেলায় বাবার বাড়ি , তারপর স্বামীর বাড়ি আর শেষে ছেলের বাড়ি….আমাদের নিজের বাড়ি বলতে কিছু নেই। কথাটা মানতে পারিনি, তোমার বাড়িটাই আমার বাড়ি এটাই এতদিন বিশ্বাস করে এসেছি কিন্তু সেদিনদের খেলাটা থেকে একটা ইচ্ছে জাগে…ভাবলাম দেখিই না এই বাড়িটা কতটা আমার…এই কদিন যা হয়েছে সবটাই নাটক। উকিলও সাজানো… উনি আমার বন্ধুর দাদা। সবটাই একটা খেলা…বাড়ি নিজের নামে আমি চাইনা শুভ। একটা দলিল বন্দি নাম হয়ে থেকে আমার কি লাভ ? আমার ভালোবাসার মানুষেরা যেখানে থাকে সেটাই আমার বাড়ি। দুঃখ একটাই তুমি আমায় আজও বুঝলে না। ট্রান্সফারটা ক্যান্সেল করাও…প্রমোশানটা নাহয় এবার নাই পেলে।

বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে শুভ…আজও শ্বেতা ওর কবিতার মতোই দুর্বোধ্য রয়ে গেল।

।। সমাপ্ত ।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত