মিরাচরের সেই বৃদ্ধাশ্রম

মিরাচরের সেই বৃদ্ধাশ্রম

ম্যাডাম, ঢাকা থেকে কয়েকজন মেয়ে আসছে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়

-অপেক্ষা করতে বল।

সবাই জিন্স প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, এটুকু বলেই ফজলু ফিক করে হেসে দেয়।

-তোর কাছে আমি জানতে চেয়েছি উনারা কি পরে এসেছে? বেশি কথা বলে। যা।

ফজলু মিয়া ঠিক মিথ্যাবাদী নাকি ভুলে যাওয়া বোকাসোকা রোগী সে বিষয়ে বুদ্ধিজীবীরা এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। বুদ্ধিজীবী কমিটির সভাপতি সদ্য মুসলমানি করানো ইয়াসিন। এই কমিটির সহ সভাপতি গেটের দারোয়ান নিয়ামুল পম পম। নিয়ামুলের নামের শেষে এই পম পম উপাধি জুড়েছে সাড়ে তেত্রিশদিন আগে,সেটা ইয়াসিনেরই দেয়া। ইয়াসিনের বয়স এগারো ছুঁই ছঁই। বয়স কম হলেও বুদ্ধির আড়ৎ খুলে বসেছে সে।

ঢাকা শহর থেকে শ কিলোমিটার দূরে “মিরারচর বৃদ্ধাশ্রম “। বিশাল বড় এরিয়া নিয়ে এই বৃদ্ধাশ্রম। শোনা যায় এই বৃদ্ধাশ্রমটি আগে মাত্র তিনরুম নিয়ে অল্প জায়গার ভেতরে ছিল। আষাঢ় মাসের ভর দুপুরে ইকরামুল চৌধুরী নামের এক ভদ্র লোক মিস পারভিনের কাছে এসে কয়েকশ বিঘা জমির দলিল ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “এই বৃদ্ধাশ্রমটাকে অনেক বড় করবেন যতটা বড় হলে দুনিয়ার সব জান্নাত এখানে এসে জমা হবে।আমি জান্নাতের মালিক হতে চাই। ”

দুটো বিশাল সাদা রঙের বিল্ডিং,একটা মাঝারি সাইজের পুকুর, বিশাল একখানা মাঠ আর নানা ফুল দিয়ে সাজানো সুবিশাল একখানা বাগান নিয়েই মিরারচর বৃদ্ধাশ্রম। লোপা গোলাপটা যত্নে নাকের গাছে টেনে এনে চোখ বুজে ঘ্রাণ নিচ্ছিল এমন সময় ফজলু পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, এই মহিলা! ফুল ছেঁড়েন কেন? ফুল দ্যাখলেই ছিঁড়াছিঁড়ির কুয়ারা লাইগা যায়! লোপা ফুলটা ছেঁড়ে দিয়ে বলল, গাছের ফুল গাছেই আছে।না দেখে কথা বলেন কেন? আর আমাকে দেখে কি আপনার মহিলা মনে হয়! ফজলুর এক নীতি মেয়ে মানুষের কাছে নত হওয়া যাবেনা,নত হলেই সংসারে অশান্তি। মেয়ে মানুষরে রাখতে হবে শূলের উপর। ফজলু কপাল কুঁচকে ত্যাড়া গলায় বলল, “আপনারে মহিলা বলে ভুল করেছি। মাফ করে দিবেন,আপনি আসলে বেডি। গেরাইম্মা মোডা(মোটা) বেডি”

লোপার কান লাল হয়ে আসছে,কান গরম হচ্ছে।এই মুহুর্তে ঠিক কি বলা উচিত সেটাও তার মাথায় আসছেনা।

ফজলু আর দাঁড়ায়না। হনহন করে পুকুর ঘাটের দিক হেটে চলে আসে। পুকুর ঘাটে বসে নিপা,শারমিন, মালিহা গলা ছেড়ে গাইছে –

“রঙ্গে মজায় দিন রঙ্গে আছো রে
ঘাটের কিনারায় একটা মরা পইড়াছে
সে খবর তুমি বন্ধু পাওনা কেন রে
রঙ্গে মজায় দিন রঙ্গে আছো যে”

মাইয়্যা মানুষের এমন বেলাল্লাপনাতে ফজলুর মেজাজ ঠিক থাকেনা। ফজলু গলা কেশে বলল,এইটা তো রঙঢঙের জায়গা না। তার উপরে মিছা কথায় গান ভর্তি! মরা কই পইড়া আছে দেখান আমারে। নিপা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় মালিহা নিপাকে থামিয়ে বলল,ফজলু মিয়া ম্যাডামকে আপনি আমাদের কথা বলেছেন? ফজলু রোবট কন্ঠে বলল,ম্যাডাম অনেক ব্যস্ত। বলেছে আজকালের ভেতর কারো সাথেই দেখা করা সম্ভব না। এটুকু বলেই ফজলু গোঁফের তলে মুচকি হাসতে হাসতে মাঠ বরাবর হেটে সাদা বিল্ডিং এর দিকে চলে যায়।

আচ্ছা আমরা সরাসরি ম্যাডামের সাথে দেখা করলেই তো হয় তাইনা?শারমিন নিপার উত্তরে শান্ত চাহনিতে বলল, না সেটা হয়না।সব কিছুর একটা সিস্টেম আছে। উনি ব্যস্ত থাকতে পারেন। উইদাউট পারমিশন উই কান্ট গো। দূর থেকে ইয়াসিনকে দেখেই লোপা গলা বাড়িয়ে ইয়াসিনকে ডাক দিল।লুঙ্গিটা ডান হাত দিয়ে সামনের দিকে টেনে উঁচু করে ধরে কোমরটা পেছনের দিকে বাঁকিয়ে ধীরে ধীরে লোপাদের কাছে আসে ইয়াসিন।

নিপা আগ বাড়িয়ে বলল,এই পিচ্চি তুমি এমন করে হাটছো কেন? ইয়াসিন নাকের সর্দি বা হাতের দু আঙুলে ঝেড়ে ফেলে বলল, লুঙ্গীর ভেতরে মেরামত কাজ চলছে। কি বলবেন এক নিশ্বাসে বলেন, পম পম মিঁয়ারে খুঁজতে যেতে হবে। শারমিন এইটুকুন ছেলের অসভ্যতাপনা দেখে চোখ বড়বড় করে রাগে নাক ফোলাচ্ছে । লোপা ইয়াসিনের মাথায় হাত রেখে বলল,বাবু আমরা ম্যাডামের সাথে দেখা করতে চাচ্ছি সেই সকাল থেকেই । তুমি যেয়ে ম্যাডামকে বলো তো তার সাথে দেখা করার জন্য অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি আমরা।

আচ্ছা এইটা কোন ব্যাপার ই না।আপনারা আসেন আমার সাথে। এক্ষনি কথা বলিয়ে দিচ্ছি।

ইডেন কলেজের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীদের এই গ্রুপের টিম লিডার লোপা। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোর কাজে এই বৃদ্ধাশ্রমে আসা তাদের। অনুমতি মিললেই এখানে দু তিনদিন থাকতে হবে এমন শর্তে বাকি তিনজনকে নিয়ে এই মিরারচরে আসা লোপার।

ইয়াসিন! তোর না কাল মুসলমানি হল! আজই চলে এসেছিস কাজে। তোকে তো পনেরোদিনের ছুটি দিলাম। ইয়াসিন টেবিলের উপর রাখা অর্ধেক আপেলটায় কামড় বসিয়ে বলল, পম পম মিয়াঁরে খুঁজতে আসছিলাম। এখন কয়েকজন আপা এসে বলল , আপনার সাথে নাকি তারা দেখা করতে চায় সে খবরটা দিতে আসলাম। পারভিন দ্রুত গলায় বলল, একদম ভুলে গিয়েছিলাম রে। তুই উনাদের ভেতরে নিয়ে আয়।

ইয়াসিন পারভিনের রুম থেকে বেরিয়ে ইশারায় বলল ম্যাডাম ডেকেছে। লোপাদের সাথে কথা বলে মিস পারভিন খুব আনন্দ নিয়ে জানালেন, লোপারা চাইলে এক সপ্তাহও থাকতে পারে।বিশাল এক গেস্ট রুমে চারজনের থাকার ব্যবস্থা হল।

ফজলুর বউ ঝগড়া বাঁধিয়ে বাপের বাড়ি গেছে আজ একুশ দিন। একটাবারের জন্য ফোন করেনি,ফজলু ফোন দিয়েছিল দুদিন। ফজলু কলেরায় মরবে এমন অভিশাপ দিয়ে নুর বানু ফোন রেখে দিয়েছে।ফজলু আর ফোন দেবেনা।আসলে এমনিতেই আসবে, ফজলুর এত পিরীতের ঠেকা পড়েনি।এমনটাই ভাবে ফজলু। সাড়ে ছয় ফুটের রোগা ফজলুর নামের শেষে ঘাড়ত্যাড়া,বদমেজাজি ট্যাগ লাগার পরেও সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়না ফজলু ।

আলু ছোট ছোট করে কেটে, ঝাল ঝাল কবুতরের মাংস রেঁধেছে ফজলু। আয়েশা চাচীকে কথা দিয়ে এসেছে আজ রাতে সে তার সাথে সাদা কইতরের ঝোল দিয়ে ভাত খাবে। ফজলু এক কথার মানুষ। বিকেল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে,ফজলু এই বৃষ্টিকে বলে ছ্যাঁচড়া বৃষ্টি। এই বৃষ্টি না থামে না আবার একনাগাড়ে হয়। টিফিন কেরিয়ারের উপরের দুই বাটি নূর বানুদের খেতের আটাশ ধানের চালের ভাতে ভর্তি। তিন নম্বর বাটিতর গলা সমান কবুতরের ঝাল ঝাল মাংস। নিচের বাটিতে লবণ আর দুটো বোম্বাই মরিচ। লুঙ্গীটা হাটুর উপরে উঠিয়ে গিঁট বেঁধে টিফিন ক্যারিয়ার শক্ত করে ধরে পা টিপেটিপে হাটা শুরু করল ফজলু। লাল গামছাটা মাথার ওপরে থাকাতে শরীরটা ঝাপসা ভিজেছে।

বিয়ের চারবছর পর হাসানের জন্ম।ঐ চারটাবছর কত অপমান ,কত কথা যে সয়েছি সে কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। বড় ননদ একদিন দুপুরে ভাতের থালাটা কেড়ে নিয়ে বলেছিল “খেয়ে খেয়ে হাতি হচ্ছিস,আমার ভাইটারে একটা বাচ্চা দিতে পারিস না। তোরে খাইয়ে আমাদের লাভ কিরে! ” মুখের ভেতরে থাকা ভাতের দলা সেদিন গেলার সময় মনে হচ্ছিল আমি আগুনের দলা গিলছি। এর ওর টিটকারি তো ছিলই। সেই হাসান আজ ছ মাসে একবারের জন্যও আমায় দেখতে আসেনা, ব্যস্ততার অজুহাত দেয় । আমার পেটের ছেলে, আমি তো বুঝি অজুহাতের আড়ালের গল্পটা কি।

আয়েশা বেগম খানিকটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল৷ একবার কি হয়েছে জানো, হাসানের বয়স তখন সাত। ফুটবল খেলতে যেয়ে হাসানের পা মচকে গিয়েছিল। ছেলেটা ব্যথায় হাটতে পারিনি বেশ কদিন। ফ্লোরে পা পর্যন্ত দিতে পারেনি। কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যেতাম। একদিন দুপুরে বাথরুম থেকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়েছি ওমন সময় হাসান আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মা আমি বড় হয়ে তোমাকেও কোলে নিব যখন তুমি ব্যথা পাবে। এইতো সেদিন সিঁড়ি বেয়ে নামতে যেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে পা ভেঙেছি। ছেলেটা আসেনি, আমাকে কোলেও নেয়নি। বোধহয় ছেলেটা আমার এখনো বড় হয়নি। আয়েশা বেগমের গলা ধরে আসে, লোপার চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ে। দুজনের মৌনতা ভাঙে ফজলুর উপস্থিতিতে। ফজলু রুমে ঢুকে টিফিন বাটিটা টেবিলের উপর রেখে গামছাটা চিপে মাথাটা মুছতে শুরু করে।

লোপার দিকে চোখ পড়াতে ফজলু মুচকি হেসে বলল,মহিলা আপা আপনারে খেয়াল করিনাই এতক্ষণ। অন্য সময় হলে লোপা বেশ কথা শুনিয়ে দিত, এই মুহুর্তে লোপার গলা পাথরসম ভারী। লোপা কোনরকম কান্না লুকিয়ে বলল,চাচী পরে আবার আসব৷ লোপা আর বসেনা, দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হচ্ছিল এমন সময় ফজলু গলা বাড়িয়ে বলল,আপা কইতরের ঝাল মাংস আনছি। কয়ডা খাইয়্যা যান। লোপা পেছন থেকে ঘাড় বাকিয়ে নরম গলায় বলল,চাচীকে খাওয়ান৷

তোমার আর আমার মেয়ের দুজনের নাম ই নিপা! কত্ত মিল দেখলে।তোমাদের মত কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা ছুটি না কাটিয়ে বুড়োবুড়িদের কাছে ছুটে আসতে পারে সে জানা ছিল না৷ শারমিন অশীতিপর বৃদ্ধর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল,আচ্ছা আপনি নাকি স্কুল টিচার ছিলেন? বৃদ্ধ প্রত্যুত্তরে মাথা ঝাঁকায়।নিপা কখন যে বৃদ্ধ হাত ধরেছে তা টেরই পায়নি৷ টের পেয়ে আরো শক্ত করে হাতটা ধরে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে আদুরে গলায় বলল,কি পড়াতেন আপনি? বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,ধর্ম পড়াতাম। ছাত্রদেরকে পাঁচ বছর ধর্ম পড়াতাম, সেই ছাত্র স্কুল পাশ করে বেরিয়ে যেত। আবার নতুন ছাত্র আসত। জানো সেই ছাত্রদের কয়েকজন প্রায় দেখতে আসে আমায়। পা ছুঁয়ে সালাম করে।নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। আর পারভিন তো সেদিন বলল ওরা নাকি অনেক টাকা দিয়ে যায় আমার খাতির যত্নের জন্য। মাঝ পুকুরে কঞ্চির উপর বসা পানকৌড়ির দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বলল,পাঁচ বছরে কত ছেলে মেয়েরে ধর্ম শেখালাম অথচ নিজের ছেলে মেয়েটারে পঞ্চাশ বছরেও ধর্ম শেখাতে পারলাম না। নিপা আর হাত ধরে রাখার সাহস পায়না। মুয়াজ্জিন আজান দিচ্ছে, বৃদ্ধ মসজিদের দিকে ক্লান্ত পায়ে হেটে চলেছে৷

এইযে দারোয়ান ভাই, আমাকে দুই প্যাকেট চানাচুর এনে দিতে পারবেন? নিয়ামুল মালিহার হাত থেকে টাকা নিয়ে মাথা গুঁজে বলল,আপা আমারে দারোয়ান ডাকলে মনে কষ্ট পাই। মালিহা নিয়ামুলের বুকে থাকা নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল,আচ্ছা নিয়ামুল ভাই আর বলবোনা। এখন আপনি আমাকে দু প্যাকেট চানাচুর এনে দিতে পারবেন?নিয়ামুল মাথা তুলে ঠোঁট টিপে হেসে বলল, দেয়া যাবেনা কেন! একশবার দেয়া যাবে তবে নামটা হবে নিয়ামুল পমপম। নামের শেষে পমপম না বললে মাথার একটা চুল পড়ে যাবে, তাই পমপম বলা অতীব জরুরি ব্যাপার। মালিহা হাসি চেপে বলল,এ কথা আপনাকে কে বলেছে? নিয়ামুল আর দাঁড়ায় না, হনহনিয়ে গোলাপ মিয়ার দিকে হাটা শুরু করে৷

ইয়াসিনকে ফজলু মিয়া চারবছর বয়সে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনে। সেই থেকে এই বৃদ্ধাশ্রমের একজন সদস্য বনে গেছে সে।

ইয়াসিন রাবেয়ার পাশে বসে ঢুলেঢুলে একনাগাড়ে “মামার বাড়ি” কবিতা পড়ে চলেছে। রাবেয়া এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকে আজ সাতবছর।রাবেয়া ইয়াসিনকে বড্ড আদর করে, তাই সন্ধ্যা হলেই ইয়াসিনকে খুঁজে খুঁজে পড়তে বসায়। ইয়াসিনের কাজ সকালে উঠে ফুল গাছে পানি দেয়া।যদিও সপ্তাহের একদিনের বেশি কখনো পানি দেয়না সে। এই নিয়ে কারো কোন অভিযোগ নেই। যত অভিযোগ ফজলুকে নিয়ে, ফজলু বাজার থেকে নরম মাছ এনেছে,কুমড়ো পঁচা ছিল,চালে পাথর ছিল। পারভিন ফজলুকে ডেকে প্রতিবার ই লাস্ট ওয়ার্নিং দেয়। ফজলু দুধ চুরি করে খাওয়া বিড়ালের মত অপরাধী চোখে আতাকিয়েই উত্তর সেরে ফেলে।

লোপারা রাবেয়ার সামনের চৌকিতে এসে বসতে বসল। শারমিন নিরবতা ভেঙে বলল,এই অবস্থায়ও পড়ছো ইয়াসিন? ইয়াসিন পড়া থামিয়ে ঢোক গিলে বলল,মুসলমানি তো আর মুখে দেয়ানাই। তাইলে পড়তে দোষ কি? মালিহা চোয়াল শক্ত করে বলল,এ তো মহা ফাজিল দেখছি! রাবেয়া একগাল হেসে বলল,আহ ছাড়ো তো।ইয়াসিন,এখন আর পড়তে হবেনা। তুই ফজলুরে বল আমি তারে ডাকতেছি।

রাবেয়া ইয়াসিনের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ছেলেটা খুব ভালো। একটু দুষ্টু। ইয়াসিন আমারে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে পারেনা, ইয়াসিন কোনদিন বলেনাই আমার গা দিয়ে গন্ধ আসে। ভালোই হয়েছে ইয়াসিনের কোন নানী নেই, থাকলে সে নানী ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না।

শারমিন রাবেয়ার চোখ বরাবর চেয়ে বলল,নানীরা বুঝি ভালো হয়না?রাবেয়া ভ্যাক করে কেঁদে দিল।খানিক্ষন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বলল, বউটা আমার পিয়াশরে ছোটবেলা থেকেই আমার কাছ থেকে দূরে দূরে রেখেছে।সেই নাতিটা বয়স বাড়ার সাথেসাথে নানী বাড়ি ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা,আমার কাছে একটু আধটু আসলেই নাতিটা আমায় অপমান করে কথা বলত। এই নিয়ে বউয়ের সাথে একদিন তর্কাতর্কি হল, ছেলে মেজাজ হারিয়ে বউর গায়ে হাত তুলল আর তার খেসারত দিচ্ছি আমি এইখানে থেকে।

ফজলু কখন এসেছে তা টের পায়নি কেউ। ফজলু রাবেয়ারই আচঁল দিয়ে তার চোখটা মুছে দিয়ে বলল, চাচী কতবার তোমারে বলছি কাঁদবানা৷ ওঠো খাইতে যাই চলো। আপারা, আপনারাও আসেন। আজকে আমার সমান দুইটা কাতল আনছি।রাবেয়া ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, তুই বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলাটা আর ছাড়লিনা। লোপারাও রাবেয়ার সাথে ঠোঁট টিপে হাসে৷

রাবেয়া ফজলুর দিকে শাসনের চোখে তাকিয়ে বলল,নুর বানুরে আনতে যাবি কবে?মেয়েটা বেশ কদিন হল বাড়ি ছাড়া। ফজলু গোঁফের তলে মুচকি হেসে বলল,নুর বানুরে বিকেল বেলায় নিয়ে আসছি। এটুকু বলেই ফজলু লজ্জিত ভঙ্গিতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

রাবেয়া হাসতে হাসতে বলল। বউটারে খুব ভালোবাসে পাগলটা,মুখে শুধু তেতো তেতো ঝগড়াটে কথা তার। এই দেখ আজ বেতনের পুরো টাকা দিয়ে খাবার দাবারের বিশাল আয়োজন করেছে তোমরা কাল চলে যাবে বলে।পুরো মাসটা পাগলটা কিভাবে চলবে সে ব্যাপারে কোন ভাবনা চিন্তা নেই। লোপারা চুপ হয়ে আছে,কোন কথা বের হয়না।

জ্যোছনা রাত৷ মাঠের মাঝে কজন মানুষ বসে আছে, তাদের মুখ স্পষ্ট নয়। শারমিন চায়ের কাপটা সাবধানী ভঙ্গিতে রাখতে রাখতে বলল, এতগুলো জান্নাত পায়ে লাথি মেরে কিছু ও, এবং, কিন্তুর অজুহাত দিয়ে মানুষের বাচ্চাগুলোই দূরে সরিয়ে রেখে আবার সেই মানুষের বাচ্চাগুলোই দিন রাত জান্নাতের জন্য ছুটোছুটি করে।ভারী অদ্ভূত নারে লোপা?

লোপা ওড়নাটা ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,আমি ঠিক করেছি কোনদিন সন্তান নেব না। নিয়ে কি হবে বল তো? শীতের সারাটা রাত যার পায়খানা পরিষ্কার করব,যার শরীর একটু খারাপ হলে কেঁদেকেটে অস্থির হব,যাকে মুখে তুলে খাইয়ে বড় করব, যার জন্য জীবনের সব কিছু দিয়ে দিব সে ই তো একদিন লাথি মেরে রাস্তায় ছুঁড়ে দিবে। খুব ইচ্ছে ছিল আমার একটা বেবি হবে,যার সদ্য ওঠা দাঁতের আচঁড়ে আমার বুক লাল হবে। কিন্তু ইচ্ছেট কেমন করে যেন ঘুমিয়ে গেছে রে এই কদিনে।

নিপা লোপার পিঠে হাত রেখে বলল, এগুলা কোন সমাধান নারে৷ কত ছেলে মেয়ে আছে জীবন দিয়ে বাবা মাকে আগলে রাখছে।আবার অনেকে লাথি মেরে ফেলে দিচ্ছে৷ তবে এইখানে এসে একটা জিনিস ভাল লেগেছে, এতিম ইয়াসিন একটা পরিবার পেয়েছে। আমার ইচ্ছে আছে একদিন অনেক টাকা বানাবো। তারপর বৃদ্ধাশ্রম আর এতিমখানা এক করে দিব। বাবা মা হারা ছেলে মেয়ে গুলো বাবা মা পাবে,আর ছেলে মেয়ে হারা বাবা মা গুলো ছেলে মেয়ে পাবে।

মাইক্রোটা বৃদ্ধাশ্রমের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফজলু আর নিয়ামুল মিলে ব্যাগগুলো গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। অনেকেই এসেছে লোপাদের গাড়িতে তুলে দিতে। গাড়িতে ওঠার আগেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে লোপারা। গাড়িতে উঠে লোপা গাড়ির গ্লাস দিয়ে হাত বের করে ফজলুর হাত ধরে বলল,এই গেরাইম্মা বেডি আবার আসবে আপনার কাছে ভাই। ফজলু হাতটা বুকের কাছে টেনে এনে বলল,বইন ভাইয়ের কাছে আবার আসবা ছুটি পেলে।

মিরাচরের বৃদ্ধাশ্রম ছেড়ে গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে। লোপাদের গা জুড়ে বৃদ্ধাশ্রমের গন্ধ মেখে আছে। এই গন্ধ সহজে সরে যাবেনা, সরতে পারেনা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত