জেমি ফেসবুকে ছবি আপলোড করলেই নাকি বৃষ্টির মতো ‘লাইক’ আর কমেন্ট পড়তে থাকে। শেষ ফাগুনের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নয়, একেবারে শ্রাবণের মুষলধারা। আমি অবশ্য ‘আপলোড’, ‘লাইক’, ‘স্ট্যাটাস’ শব্দগুলো কিছুদিন আগেও জানতাম না। ফেসবুকে যে ছবি, মনের কথা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটাও ছিল অজানা। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা একেবারেই সাম্প্রতিক। আর মাত্রই গত মাসে কেনা চার সংখ্যা মূল্যের এই ‘স্মার্টফোন’। হোক ধার-কর্জ করে কেনা। আমার জন্য খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল সেটা। যদিও বিলাসিতা নয় মোটেও।
তপু একবার একটা বিড়ালের ছবি তুলে সবার কাছে নাম চাইল। কী উত্তেজনা বন্ধুদের! বিড়ালটার একটা আদুরে নাম লাগবে। নতুন ঢাকার ‘মডার্ন’ সহপাঠীদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। আমি যেন ভাইভা বোর্ডে উত্তর না-জানা ছাত্র। আজ খুব অবাক লাগছে। এই মেডিকেল কলেজটায় আমার নামই বা কয়জন জানে? আমাকে কেউ চেনে? বড়জোর আট-দশজন। কিন্তু তপুর বিড়ালটার মতো আমার নামটাও সবাইকে জানাতে হবে।
একটা সময় আমি খুব সুন্দর চিঠি লিখতাম। এসএসসির সময়ে মফস্বল শহরে এক ব্যবসায়ীর বাসায় জায়গির থেকে তাঁর বাচ্চাকে পড়াতাম। স্কুলের পড়া, ফরমায়েসি বাজার শেষ করে রাতে মাকে চিঠি লিখতাম। ‘মা, এ শহরে বড় বড় বাড়ি আছে। তিন-চার চাকার গাড়ি আছে। ধোঁয়া, জ্যাম, মানুষের ভিড়ে ঠাসাঠাসি। শুধু মাথায় হাত দিয়ে “কেমন আছিস বাবা” বলার কেউ নেই…।
তোমাদের দেখতে ইচ্ছে করছে। সবুজ গ্রাম, কাঁদায় ভরা মাঠ, হাঁটুজল নদী, কত দিন দেখি না। আজকেও তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার আগে আমাকে যে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য এই যে সুন্দর করে চিঠি লিখছি, টাইপ করছি। এই চিঠি কতজনকে মেইল করতে হবে! আমাকে না চিনলে তারা বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করবে কেন? বন্ধুর কাছেই তো আমাকে সাহায্য চাইতে হবে। বন্ধু কি বন্ধুকে মরতে দিতে পারে, মা?
’আমি কৃষকের সন্তান। বৃত্তির টাকায় পড়ালেখা করেছি সারা জীবন। কখনো ভাবিনি সরকারি মেডিকেলে ডাক্তারি পড়তে পারব। পড়তে পড়তে শেষ বর্ষে পড়ব রক্তের ক্যানসারের কথা। যেখানে শরীরের রক্তের কারখানা অচল হয়ে যায়। শিরায় শিরায় চলাচল করে নষ্ট কোষ, অকার্যকর কোষ। আমরা এর গালভরা নাম দিই—এএমএল। একিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া। মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। তবু কয়েকটা দিন বেঁচে থাকতে হলে চাই চিকিৎসা। এর জন্য চাই টাকা। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এত টাকা আমি কখনো দেখিনি। আমার পুরো গ্রাম দেখেছে কি না সন্দেহ। ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, এই কর্কট বাসা বাঁধবে আমার শরীরে। দিন দিন শরীর ভেঙে পড়বে। শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাব আমি। জ্বর, কাশি লেগে লেগে ‘ইন্টারেস্টিং’ একটা ‘কেস’ হয়ে যাব।
ছুটিতে বাড়িতে গেলে মা আঁতকে উঠবে। ‘খোকা, এ কী হয়েছে তোর!’ আমি মিথ্যা বলব। ডাক্তারি পড়ার চাপ মা। হুম, খুব ভয়ংকর চাপ। যে সত্যটা বলতে পারব না, এত চাপ আর সহ্য হচ্ছে না, মা। আর পারছি না। কিন্তু পারতে আমাকে হবেই।জেমি, তপুরা প্রায়ই দেখি ফোনটাকে সামনে ধরে হাসিমুখে নিজেদের ছবি তোলে। এটা নাকি সেলফি। আমার অ্যাকাউন্টটাতে একটা প্রোফাইল ছবি দিতে হবে। আমার ছবি আবার কে তুলবে! নিজের ছবি তাই নিজেই তুলি। তবে বন্ধুরা, আমি হাসতে ভুলে গেছি। আমার ফোনের লেন্সটাও খুব দুর্বল। আমাকে চিনবে তো? এটা আমারই ছবি। এটা জেমিদের মতো হাসিমুখের কোনো সেলফি না। কী বলব এটাকে? আবেদন, আত্মবিজ্ঞাপন, আকুতি? বন্ধুরা, ফেসবুকে টাকা তুলে শীতে অসহায়দের হাতে তুলে দেয়। বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষদের বাঁচতে সাহায্য করে। নেপালে ভূমিকম্পে আক্রান্তদের সাহায্য করে।
আমার এই চিঠি তারা পড়বে? এই রুগ্ণ, ফ্যাকাশে মুখটার দিকে তাকাবে? বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত? আমি কি বাঁচতে পারব? আরও কয়েকটা দিন, মাস, বছর?বন্ধুরা, এটা কোনো সেলফি না। এটা মানুষের কাছে মানুষের দাবি।
(গল্পটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা)