বৌ আমার হাতে ফিডার ধরিয়ে দিয়ে বললো,”এই ধরো রাতের খাবার, সিরিয়ালের মাঝপথে আর ডাকবা না আমাকে”। আমি হতভম্ব হয়ে আমার ছোট মেয়ের নীল ফিডার হাতে নিয়ে বসে রইলাম। তারপর অনেকটা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,”এটাই কি আমার রাতের খাবার?। মীরা সিরিয়াল থেকে চোখ না সরিয়ে বললো,”হ্যা তাতে সমস্যা কি?”। গলায় যথেষ্ট মধু ঢেলে বললাম, “”এই ফিডারটা আমার রাতের খাবার? তোমার মাথার তার কবে ছিঁড়ে গেলো?”
এতক্ষনে মীরা চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। তারপর আবার সিরিয়াল দেখতে দেখতে বললো,”সরি বাবুর ফিডারটা ভুলে তোমাকে দিয়ে দিছি। যাও তো বাবুকে ফিডারটা খাইয়ে দাও। আমি ভেজা বিড়ালের মতন ছোট মেয়ের কাছে গেলাম। মুনা গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করতেছিল তখন। আমি ফিডারটা মুনার মুখে তুলে দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে দশটা বাজে। কবে জানি মীরার সিরিয়াল শেষ হবে আর কবে খেতে দেবে। ক্ষুধায় পেটের ভেতর গুড়গুড় করে কে যেন ডেকে বলেতেছে “আরে শালা জলদি খাবার দে”। বিছানায় বসা আমার চার বছরের বড় মেয়ে রাইসা তখন মনোযোগ দিয়ে ইংরেজি পড়ছে। কৌতুহলী হয়ে ওর দিকে মনোযোগ দিলাম।
রাইসা সুর করে পড়তেছে, ” E তে Elephant , Elephant মানে জিরাফ”। এতটুকু শোনামাত্র আমার স্মৃতি হাতড়াতে থাকলাম। যদিও গাধা স্টুডেন্ট হিসেবে সবখানে আমার দূর্নাম ছিল তবু মনে পড়লো Elephant মানে হাতি।
— “মামনি, Elephant মানে জিরাফ নয়, হাতি।
— “কিন্তু আম্মু যে বললো জিরাফ”। রাইসা চটপট জবাব দিলো।
এবার আমার ঘোরতর সন্দেহ হতে লাগলো। টপ স্টুডেন্ট মীরা যদি হাতি আর জিরাফের ইংরেজি না জানে তবে নিশ্চিতভাবেই মীরা “I am GPA 5” টাইপ স্টুডেন্ট। বিমর্ষমুখে ভাবতে লাগলাম এত বড় জোচ্চুরি করে বকলম মীরাকে আমার সাথে বিয়ে দিলো ওর বাপ? চকিতে একটা সম্ভবনার কথা মাথায় এলো। রাইসাকে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা মামনি, পড়াবার সময় কি তোমার আম্মু সিরিয়াল দেখতেছিল?”। মাথা নেড়ে রাইসা সম্মতি দিলো, ওর আম্মু তখন “তুম কাব আওগে মেরে জানেমন” সিরিয়াস দেখতেছিল। হাতি জিরাফ হয়ে যাবার কারন অনুধাবন করলাম।
অবশেষে রাত ১১টায় ক্ষুদার্থ পেটে খাবার দিতে পারলাম। মীরা প্লেটে ভাত বেড়ে দিচ্ছিলো আর গদগদ সুরে আমার প্রশংসা করতে লাগলো, অামি নাকি খুব ভালো, কেয়ারিং, ড্যাশিং, হট হাসবেন্ড। হটাৎ মীরার এমন সমাদরে সন্দেহ হলো প্রচুর। এত প্রশংসায় পেটের ভাতগুলো হজম হতে আপত্তি জানাচ্ছিল। নিশ্চিত কোথাও ঘাপলা আছে। একটু পরেই ঘাপলা কোথায় সেটা পরিষ্কার হলো। “শোন আমার ময়নাপাখী, “এক বৌ দুই জামাই” সিরিয়ালের নায়িকা টুনটুনির ড্রেসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ভাবছি একটা ড্রেস আমিও বানাবো। পাশের ফ্ল্যাটের রাধিকা ভাবী গত সপ্তাহেই বানিয়ে ফেলেছে। আমি যদি না বানাই তবে পেস্টিজটা থাকবে? ভাবছি কালই মার্কেটে যাবো। তোমার মানিব্যাগ থেকে চার হাজার টাকা নিয়ে নিছি। তুমি আরাম করে খাও এখন”।
আরাম করে আর কি খাবো? মুহুর্তের মধ্যে চার হাজার টাকা হাইজ্যাক হবার শোকে আমার হার্ট অ্যাটাক হবে কিনা ভাবছিলাম। আর কিসব সিরিয়ালের নাম। “এক বৌ দুই জামাই”!!! ছিঃ ছিঃ ছিঃ। বেদনা গোপন করে মীরাকে বললাম, “পাশের ফ্ল্যাটে মিসেস রাধিকা আবার কে? নতুন এসেছে বুঝি?”। “আরে হাদ্দাদ সাহেবের বৌ তার নাম চেঞ্জ করে ফেলছে। তার প্রিয় সিরিয়াল “লাল বধূ” সিরিয়ালের নয়িকার নামে তার নাম রেখেছে। মীরা যদি হাদ্দাদ সাহেবের বৌয়ের মতন নাম চেঞ্জ করার প্রস্তাব রাখে সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি ভাতের প্লেট ফেলে আমি বাথরুমে ঢুকে পেট খালি করতে লেগে পড়লাম।
পরদিন সকালে অফিস যাবার পথে টং দোকানে হাদ্দাদ সাহেবকে দেখলাম চা রুটি ভিজিয়ে খাচ্ছে। রাগে সারা শরীর জ্বলতে লাগলো। ব্যাটার বৌয়ের সঙ্গদোষে আমার নিষ্পাপ বৌটা আজ সিরিয়াল নেশায় আক্রান্ত।
— “কি মিয়া? সকালে নাস্তা করেননি? ভাবী খেতে দেয়নি বুঝি?” জানতে চাইলাম। কথা শোনামাত্র আমাকে হতভম্ভ করে দিয়ে হাদ্দাদ সাহেব কাঁদতে লাগলো। তারপর তিনি ফুল স্পিডে বলে যেতে লাগলেন, “দুঃখের কথা আর বলুম ভাই। সারারাত সিরিয়াল দেখে সকালে ঘুমায়। নাস্তা বানায় না। কিছু বলতে গেলে বলে সিরিয়ালের বৌরা কাজের বেটি দিয়ে কাজ করায়। কাজের মানুষ এনে দিতে। মাসের বেতন আসতে দেরি হয়। সেই বেতন খরচ করতে দেরি হয়না। এই নায়িকা ঐ নায়িকার ড্রেস বানাইতে সবটাকা শেষ। ডেইলি ফোন চেক করে। সিরিয়ালের ছেলেরা নাকি বৌ রেখে পরকিয়া করে। আচ্ছা বলেন তো এই আধা টাকলা আমার কি পরকিয়া করার বয়স আছে?”, দুঃখের সাথে বিলাপ করতে লাগলো হাদ্দাদ সাহেব। রুটি আর চা দেখে আমারো ক্ষুধা পেয়ে গেলো। মীরা যে সকালে আমাকেও খেতে না দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
চা স্টলে বসে হাদ্দাদ সাহেবের সাথে বেশ খাতির হলো। সমগ্র নির্যাতিত পুরুষের মুক্তির লক্ষ্যে আমরা শপথ নিলাম, “সিরিয়াল মুক্ত ঘর, হবেনা স্বামী স্ত্রী পর”। সমাধানের লক্ষ্যে এলাকার ডিশ লাইনের অফিসে গেলাম। বিশ বাইশ বছর বয়সী চ্যাংড়া পোলারে মাসে ১ হাজার টাকা বখশিশের বিনিময়ে রাজি করালাম, প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় এসব সিরিয়ালের চ্যানেলগুলা বন্ধ করে দিতে হবে। ছোকরা রাজি হলো। খুশির ঠ্যালায় হাদ্দাদ সাহেব আর আমি কোকাকোলার বোতল দিয়ে চিয়ার্স করে আনন্দ উদযাপন করলাম। অবশেষে এই এলাকা সিরিয়াল মুক্ত হতে চলেছে।
দুদিন ধরে মীরা কাতর প্রেমিকার ন্যায় সিরিয়াল দেখার জন্য তাপড়াচ্ছে। হায়, আমার জন্য যদি এভাবে তাপড়াতো! টিভিতে চ্যানেল নাই। মনে মনে ডিশ অফিসের ছেলেটাকে ধন্যবাদ দিলাম। সাক্ষাৎ দেবদূত ছেলেটা। তৃতীয়দিন হাদ্দাদ সাহেব আর আমি অফিস থেকে ফিরছিলাম। ডিশ অফিসের সামনে দিয়ে যাবার সময় ভেতরে বেশ মানুষজন দেখে এগিয়ে গেলাম ঘটনা দেখতে। গিয়ে দেখতে পেলাম আমাদের দেবদূত ছেলেটা বেন্ডেজে মোড়ানো। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে আমাদের দেখতে পেয়েই বললো, “আইজ সকালে বিশটা দামড়া বেডি আইসা আমারে এমুন ঘোলাই দিছে রে ভাই। কইলো আমি বিটলামি কইরা সিরিয়ালের চ্যানেল অফ কেন করলাম। চোরেরেও এমুন কইরা মারে না ভাই। দজ্জাল বেডিগুলা আমারে মাইরা চইলা গেছে। এইবার জলদি আমারে ৫ হাজার ট্যাকা দেন। নইলে বেডিগুলারে বইলা দিমু আমারে দিয়া এসব আপনারা করাইছেন”।
দেবদূত থুক্কু শয়তান ছেলেটা এভাবে আমাদের থেকে ৫ হাজার টাকা খসালো। হাদ্দাদ সাহেব আর আমার মানিব্যাগ পুরা ফাঁকা। মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। মীরা আনন্দের সাথে টিভি দেখতেছে। ১১টার সময় খেতে বসলাম। মাছের তরকারিতে কেমন চেনা চেনা গন্ধ লাগতেছিল। ক্ষুধায় সাতপাঁচ না ভেবে খেতে লাগলাম। খাওয়া অর্ধেক শেষ হবার পর চিনতে পারলাম, আরে! মাছের তরকারিতে কেরসিনের গন্ধ কিভাবে?। ছুটে গিয়ে রান্নাঘরে দেখলাম কেরসিনের বোতল খোলা। অবশেষে সিরিয়ালের ঠ্যালায় মীরা আমাকে কেরসিনের মাছ ভুনা খাওয়ালো। বমি করতে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম।