নাক ডাকা

নাক ডাকা

আব্বার নাক ডাকা নিয়ে আম্মার বিরক্তি আর বিড়ম্বনা দু’টোই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আজকাল।আম্মা আর কিছুতেই সহ্য করতে পারছেনা। আম্মার ব্লাড প্রেসার,ডায়াবেটিস সাথে এখন রাতে একদমই ঘুম না হওয়া।আম্মার কথামত আব্বার নাক ডাকার জ্বালায় সে কিছুতেই রাতে ঘুমাতে পারেনা।আগে কম ছিলো কিন্তু ইদানিং আব্বার নাক ডাকা খুবই বেড়ে গেছে। এইটা নিয়ে বাসায় রোজই আম্মা-আব্বার কথা কাটাকাটি হচ্ছে।আম্মা সেদিন মন খারাপ করে আমায় বলেই ফেললো,

“বুঝলি ইশতিয়াক জীবনে কিছুই পাইলাম না সেটা নিয়ে নাহয় দুঃখ নাইবা করলাম কিন্তু তুই বল একটা মানুষ সারাদিন খাটা খাটনির পর যদি রাতে শান্তিতে একটু ঘুমাতে না পারে সে কিভাবে বাঁচবে বল!”

আমি ভেবে দেখলাম আম্মার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে এমনিতেই আম্মা অসুস্থতা নিয়ে সংসারের জন্য সারাদিন কাজ করে একটু শান্তির ঘুম অবশ্যই তার মৌলিক অধিকার।কিন্তু জীবনে কিছুই পাইলাম না এটা তার কমন ডায়ালগ দুঃখের সময় তিনি এটা বলেন আর অন্য সময় সবার সামনে বলেন জীবনে কি কিছুর অভাব আছে আমার আল্লাহর দোয়ায় সবই পাইছি আমি।সমস্যাটা অন্য জায়গায় আসল সমস্যা হচ্ছে আব্বা বিশ্বাস করতে চায়না যে সে নাক ডাকে আর ডাকলেও সেটা অল্প ডাকে তার মতে এতে নাকি আম্মার ঘুমের সমস্যা হবার কথা নয়।

এদিকে একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমার হয়েছে যত ঝামেলা।এক দিকে আম্মার অভিযোগ শুনতে হচ্ছে অন্যদিকে আব্বার।যেকোনো এক জনের পক্ষ যে নিবো সেটাও পারছিনা।কারণ আমি নাকি তাদের দুজনার সমান অধিকারের সন্তান।আর আব্বাও আমার আর আম্মাও তাই কি যে করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

আজ ঠিক করছি আব্বা ঘুমালে আব্বার নাক ডাকার ভিডিও করবো।যাতে আব্বা হাতেনাতে প্রমাণ দেখতে পায় সে আসলে নাক ডাকে কিনা আর ডাকলেও কতটা ডাকে।আম্মাকে বলায় তিনি খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,এতদিনে তুই একটা কাজের মত কাজ করবি বাপ।আজ এই বুড়োটাকে বুঝাবো আমি কত ধানে কত চাল।বলে কিনা আমি মিথ্যা বলি আজ প্রমাণ সহ জবাব দেব।

রাতে আব্বা ঘুমানোর পর আম্মা আমায় ডাকলো আমি গিয়ে আব্বার নাক ডাকানিসহ ঘুমের ভিডিও করলাম।তারপর সেটা আম্মাকে দেখালাম।আম্মা বললো দেখলি তো নিজের চোখে শুনলি তো নিজের কানে।বল কিভাবে ঘুমাবো আমি না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মেজাজ আমার দিন দিন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ খাওয়ার পরও প্রেসার বাড়তি থাকে।আম্মাকে বললাম শান্ত হও আর আব্বা তো ইচ্ছে করে করেনা তাইনা বলো!ঘুমের ভিতর অবচেতন অবস্থায় করে।আর যারা নাক ডাকে তারা আসলেও বুঝেনা আম্মা তারা যে নাক ডাকে।

পরদিন সকালে খাবার টেবিলে আম্মা নাস্তা না দিয়ে আব্বাকে আমার ফোন ধরায়ে দিলেন।আব্বা অবাক হয়ে আম্মারে বললেন,

“তোমার কি আজকাল মাথাতেও সমস্যা হচ্ছে নাকি!ফোন কেন দিচ্ছো আমায়। ফোন কি খাব আমি নাস্তায়।ফোন তো ইশতিয়াক খায়।সারাদিন ফোনের সাথে লেগে থাকে।”
আম্মা এবার রেগে গিয়ে বললেন,

” ছেলে তো খায় আজ থেকে ছেলের বাপও খাবে সমস্যা কি!”

পরস্থিতি নাক ডাকা থেকে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে আমার ফোন টিপায় চলে যাচ্ছে দেখে আমি বলে উঠলাম থামবা তোমরা আর আব্বা এটা দেখেন আপনার নাক ডাকা কাল আপনি ঘুমালে এই ভিডিও করা হইছে।আব্বার দেখার পর হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,

“এ কিছুতেই হতে পারেনা। সব ষড়যন্ত্র আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।ইশতিয়াক শেষ অবধি তুইও তোর মায়ের দলে চলে গেলি!এই ফোন এত টাকা দিয়ে তোরে গত মাসে কিনে দিছিলাম এই দিন দেখার জন্য?”

আব্বার কথার মাঝেই আম্মা ডাবল হুংকার দিয়ে বললো,

“একদম চুপ থাকো বললাম, নিজের চোখে দেখলা তো কেমন নাক ডাকো।আর এই বুড়া বয়সে তোমারে ফাঁসানোর ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটাই আমার নাই।ফাঁসাইছিলা তো তুমি আমারে আর আমিও ফেঁসে গেছি ভালমত তোমারে বিয়ে করে”

আব্বা আম্মা দুই জনই রাগ করে যে যার মত চলে গেলো।কেউ খায়নি।এইদিকে ওনারা না খেলে আমিও খেতে পারছিনা।আম্মার ওষুধ খেতে হবে আর আব্বারও গ্যাসের সমস্যা সাথে বাতের।অগত্যা দুই জনরে বুঝায়ে সুজায়ে দুই ঘরে গিয়ে অনেক কষ্টে খাওয়ালাম।আর ঠিক করে দিলাম আজ থেকে আম্মা অন্য ঘরে থাকবে।কিন্তু সমস্যা হলো আম্মা আবার একলা থাকতে পারেনা।তার নাকি ছোট বেলা থেকেই জ্বীন-ভুতের ভয়।এখন আম্মা যায়ে আমার ঘরে শুবে আমি শিউর।এদিকে তিথির সাথে আমারো আজকাল ঝগড়া চলতেছে। রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলে তার ঝগড়া ভাঙ্গাতে হয়।আম্মার সামনে তো ফোনেও কথা বলা যাবেনা।কি যে এক মুসিবতে পড়লাম।

রাতে আম্মারে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা আম্মা আগেও তো আব্বা নাক ডাকাইতো কই আগে তো এত চিল্লাচিল্লি করতানা। আম্মা এবার রেগে গিয়ে বললেন আমি চিল্লাচিল্লি করি!কি বলতে চাস তুই!একমাত্র সন্তান তুই আমার আর তুই বলিস আমি চিল্লাচিল্লি করি।উফফ আম্মা কথায় কথায় তোমরা দুইজন একমাত্র সন্তান একমাত্র সন্তান কেন করো বলতো!আমি তো জানি এটা বার বার বলতে কেন হবে।এদিকে আব্বা একটু পর পর আমার রুমের সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন আর কাশি দিচ্ছেন।আম্মাও আড়চোখে দেখছেন।আমি এসব দেখে মুচকি হাসছি।আমি বাইরে গিয়ে বললাম, আব্বা তোমার কি কিছু লাগবে!এখনো ঘুমাওনি কেন?

আব্বা বললো আমার ইচ্ছে আমি ঘুমাইনি।আর আমার বাতের ব্যাথ্যার ওষুধ কোথায় রাখছে তিনি জিজ্ঞেস কর! খুঁজে পাচ্ছিনা। আব্বার বাতের ব্যাথ্যা সেই জন্য আম্মা প্রতিদিনে ঘুমানোর আগে হাতে পায়ে নিজ হাতে মালিশ করে দেয় নাহলে নাকি আব্বার ঘুম হয়না।আম্মা গলা উঁচিয়ে বললেন,ওয়ারড্রবের ডান পাশে ওষুধ রাখা আছে।এদিকে তিথি সমানে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। ওরে টেক্সট করে বললাম,আজ কথা বলতে পারবোনা ফ্যামিলি প্রবলেমে আছি।রিপ্লাই আসলো কয়েকটা মুখ ভেংচানো আর রাগের ইমো।এদিকে আম্মাও দেখি আব্বার রুমের সামনে দিয়ে হাটাহাটি করতেছে।আমি বললাম আম্মা ঘুমাতে আসো আর আব্বা আপনিও ঘুমাতে যান।এভাবে রাতে এত

হাটাহাটি না করলেও চলবে।দুজনেই হনহন করে যে যার ঘরে গেলো।আম্মা এসেই আমার বিছানায় শুয়ে পড়লেন।আমি গিয়ে শুইলাম সোফায়।

হঠাৎ করে রাত দুটার সময় দেখি আম্মা উঠে বসে আছেন আর বাচ্চাদের মতন ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।আমি তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“কি হইছে আম্মা,শরীর খারাপ লাগছে নাকি তোমার!প্রেসার বাড়ছে নাকি আসো মেপে দেখি।তোমার কিছু হলে আমি কি করে থাকবো আম্মা।আমি তোমার একমাত্র সন্তান। আমার আর আব্বার কি হবে আম্মা!”

আম্মাঐ তুই চুপ করবি বলে ধমকে আমাকে চুপ করালেন।আরো বললেন আমি ঠিক আছি তোর আব্বার বাতের ব্যাথ্যার কি খবর যা গিয়ে দেখে আয়তো।ঘুমিয়েছে কিনা!

আমি এত্তক্ষণে বুঝলাম আসল কাহিনি।

আম্মা তুমি না রেগে আছো আব্বার উপর তাহলে তার এত চিন্তা কেন করছো!আম্মা চোখ রাঙিয়ে এমন ভাবে তাকালো আমার দিকে আমি বাধ্য ছেলের মতন বললাম আচ্ছা যাচ্ছি।তারপর আব্বার রুমে গিয়ে দেখি টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো মানে আব্বাও ঘুমায় নাই।যে মানুষ এত্তক্ষণে নাক ডেকে ঘুমে বিভোর থাকে সেও জাগনা।গিয়ে আব্বারে বললাম,

“কি ব্যাপার ঘুমাও নাই কেন এখনো”
আব্বা যেন আমারে দেখে পূর্ণিমার চাঁদ হাতে পাবার মতন খুশি হলেন।বললেন,
“ইশতিয়াক তোর মা কি ঘুমিয়ে গেছে!রাগ কি কমেছে তার!প্রেসারের ওষুধ ঠিকমত খাওয়াইছিস তো!”
আমি হেসে দিয়ে বললাম,

“আচ্ছা তোমারা কি বলতো!যখন একে অপরকে ছেড়ে থাকতেই পারবেনা তখন কেন রাগ করো বলতো!”
আম্মা পাঠাইয়ে তুমি ঘুমাইছো কিনা দেখতে,বাতের ব্যাথ্যা কেমন তোমার আর এইদিকে তুমি তার চিন্তায় বিভোর।
হুট করে দেখি আম্মা রুমে এসে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বললো,

“কিরে এতক্ষণ লাগে!তোরে কি জন্য পাঠায়ছি আমি?”
আমি বললাম শোনো তোমরা নিজেরাই মিটায়ে নেও তো। শেষ করো এবার সব রাগ-ঝাল।আজ সারাদিন অনেক হইছে আর না।এরপর শুরু হলো একে অপরের উপর দোষ দেয়া।এবার আমি চেঁচিয়ে বললাম, থামবা কি তোমরা! আমি না তোমাদের একমাত্র সন্তান শুনবানা আমার কথা?”

আরো বললাম শুনো আম্মা কাল আব্বারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। এখন নাক ডাকার অনেক আধুনিক চিকিৎসা আছে আশা করি তোমার অভিযোগ কমবে।এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।কিন্তু শুনতে পেলাম তারা আবার শুরু করছে।করুক একটু পর এমনিতেই ইমোশনাল হয়ে যাবে। আমার আম্মা-আব্বা সো আমি জানি।

এদিকে রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখি তিথির কলের উপর কল আর মেসেজ।সে আমাকে রীতিমতো হুমকিও দিছে।এইমাত্র একটা মেসেজ আসলো,

“ওই ফোন ধর কইতাছি!কি ফ্যামিলি প্রবলেম এমন বল তোর ফ্যামিলি মানেই আমার ফ্যামিলি।তোর দ্বারা যখন হচ্ছেনা আমিই সলভ করতেছি”

ইশতিয়াক হাই তুলতে তুলতে ফোন ব্যাক করলো ভেবেছিলো আজ রাতে একটু শান্তি মত ঘুমাবে কিন্তু না এখন তার ঝগড়ার অবসান করতে হবে।আম্মা-আব্বার ঝগড়া কমছে কিনা তাও বুঝার উপায় নেই।তবে এখন আর চিল্লাচিল্লি শোনা যাচ্ছেনা। কিন্তু ফোন রিসিভ করে তিথি শুরু করে দিয়েছে ননস্টপ রেডিও।ইশতিয়াক মনে মনে বললো,
“জীবন সুন্দর বড়ই সুন্দর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত