একটু আগে যখন আদনানকে ফোন করে বললাম “কোথায় তুমি?” সে আমাকে একটা হাসি দিয়ে বললো “বিয়ে খাইতে আসছি বুঝছো।অপরিচিত মানুষের বিয়ে খাওয়া য্যান ত্যান ব্যাপার না। এটা একটা শিল্প।” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বিয়ের দাওয়াত না পেয়েও অপরিচিত মানুষের বিয়ে খাওয়া লোকগুলোকে আমার ভয়ংকর মনে হয়। এই ছেলেটা প্রায় এমন করে। তাকে কতবার বুঝিয়েছি এই ব্যাপারটা খুব খারাপ। কেন এমন করো?” সে হাসতে হাসতেই বলে “এই মনে করো ভাল্লাগে, খুশির ঠ্যালায়, ঘুরতে।”
আমি ওকে আর কিছুই বলি না। আমার প্রচন্ড রাগ হয়। তার এই ভাল্লাগে, খুশির ঠ্যালায়, ঘুরতে শব্দগুলা আমার মোটেও পছন্দ না।খুব বিরক্ত লাগে শব্দ গুলাতে। আমি তারপরো এই শব্দ গুলার জন্য তার প্রতি কোন রাগের রিয়েক্ট প্রকাশ করি না। করতে মন চায় না। কিছু না বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। কারন আমি জানি তাকে বলে কোন কাজ হবে না। সে বিয়ে খেয়েই বের হবে। কিছু কিছু মানুষের জন্য বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা বেড়ে যায়। আদনান হচ্ছে সেই মানুষ গুলোর মধ্যে একজন। আর বাকি মানুষ গুলো হচ্ছে আমার বাবা মা আর নিশি। আমার বাবা মা প্রায় আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকে। এই ভয়ে থাকার কারণ হচ্ছে আমি যদি সেই আগের মত গলায় ফাস দেওয়ার চেষ্টা করি বা অন্য কিছু একটা করে বসে থাকি।এসব ভাবতেই আমার খারাপ লাগে। এক বিষন্নতা আমাকে ছুয়ে দিয়ে যায়।
জানালা দিয়ে আমি রুপালি আকাশটার দিকে তাকাই।মাঝে মাঝে যখন আকাশটার দিকে তাকাই তখন আমার আশ্চর্য রকমের ইচ্ছা জাগে। কালো মেঘের এই রুপালি আকাশে কবিতা উড়ানোর ইচ্ছে । বিষন্নতার কবিতা।আচ্ছা আকাশে কি কবিতা উড়ানো যায়? আমি অনুধাবন করি এই শহরের বেড়াজালে প্রাক্তনের নিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। সেই নিশ্বাস হয়তো আমার দরজায় মাঝে মাঝে এসে কড়া নাড়ে।ওপাশ থেকে বলে “ফাইরুজ দরজাটা একটু খুলবে? আমি তোমার প্রাক্তন।তুমি এখন ভিতরে ভিতরে কেমন দুঃখবোধ করছো একটু দেখার জন্য আসছি। আচ্ছা তুমি কি মাঝে মাঝে আমাকে ভেবে কান্না করো?” আমার ভিতর জুড়ে তখন নদীর স্রোতের মত কান্নার স্রোত বয়ে যায়।সেই নদীর স্রোতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।
আমাদের গ্রামের মাঝে যে নদীটা বয়ে গেছে তার শিতল গন্ধটা এখনো আমার নাকে আসে।আকাশের বুক থেকে মেঘরা বৃষ্টি হয়ে যখন নদীর বুকে ঝিরঝির করে ঝরে পড়তো আমার মাঝে এক ভালো লাগা ছুয়ে যেত। সেই ভালো লাগা নিয়ে বাড়ির পিছনে বাতাবি লেবুর বাগান থেকে বাতাবি লেবু কুড়াতাম। সারাদিনের বৃষ্টির ছায়া কেটে রাতে যখন বাঁধ ভাঙ্গা জ্যোৎস্না আছড়ে পড়তো আমি সেই বাতাবি লেবুর সুগন্ধে সারা রাত ধরে ভাবতাম এক রাজকুমারের কথা। সে রাজকুমারের নাম ছিল আহনাফ।সে আমাকে পড়াতো।আর এই আহনাফ ছেলেটাই আমার প্রাক্তন।আমি বিষন্নতার মন নিয়েই আকাশে তাকিয়ে আছি। এই তাকিয়ে থাকার মাঝে আমি কোন কিছুই উপলব্দি করতে পারি না।
ঘন্টাখানেক বাদে আদনান আমাকে ফোন দিয়ে বললো “এই নিচে আসো। আর না হয় আমি উপরে চলে আসবো।” আমি কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললাম “নিচে কেন নামতে বলছো? নিচে কি?” সে বললো “তোমাকে দশটাকার কোরমা খাওয়াবো। জলদি নামো।” আমি একটু অবাক হয়ে বললাম “মানে?” সে একটু হেসে বললো “খাওয়া শেষে আসার সময় টিস্যুতে করে এক টুকরা গরুর কোরমা নিয়ে আসছি।অনেক মজা হয়েছো বুঝছো।এটা নেওয়ার সময় ওয়েটার বেটার কাছে ধরা পড়েছি।একটা হাসি দিয়ে যখন দশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিছি সে নিজেই সুন্দর করে টিস্যুতে মুরিয়ে দিয়েছে।
এক টুকরা কোরমার দাম দশটাকা।” আমার কি বলা উচিৎ আমি জানি না।আর দশটা সাধারন মেয়ের মত আমার কল্পনাগুলোও খুব সাধারণ।এই সাধারণের মাঝে কি করে আদনান নামের এই অসাধারণ ছেলেটা আমার বেদনার অনুভূতির গভীরে শরতের কাশফূল ফোটায় কিংবা গৌধুলি রং এ সাজায় আমি বুঝতে পারি না।আমি ফোনটা আবার কেটে দেই। তার উদ্ভট কর্মকান্ডে আমি মাঝে মাঝে খুব অবাক হই।প্রতিটা মন খারাপের সময় এই ছেলেটা আমার আপন আঁধারে প্রদীপ জ্বালিয়ে একটা আলোকসজ্জা তৈরি করেছে। কিন্তু এই প্রদীপের আলোটা নিজের ছায়াকে ছুয়ে দেওয়ার এই যোগ্যতা কি আমার আছে? ছেলেটাকে যত অবজ্ঞা করি তার থেকেও ভিতরে ভিতরে আমি নিজে অনেক কান্না করি।
একজনকে ভালোবেসে যে কষ্ট অনুভব করেছি দ্বিতীয় বার সে কষ্টটা অনুভব করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এই ছেলেটা কেন এমন করে আমাকে আচ্ছন্ন করে? কেনই বা তার সাথে কথা বলতে মন টানে। এই কথা বলা বা তাকে প্রশ্রয় দেওয়া এটা কি ঠিক হচ্ছে? সে আবার আমাকে ফোন করে একটু সময় নিয়ে বললো “জানি তুমি কেন আমাকে এমন করে অবজ্ঞা করো।মানুষের অনুভূতি গুলো কেমন হয় আমি জানতাম না।বড় হয়ে যখন চারপাশের জগৎটাকে একটু একটু করে চিনতে পারলাম, বুঝতে পারলাম মানুষের অনুভূতিগুলো তখন ভাবতাম এই অনুভূতির গল্পগুলো মানুষ কি করে নিজের মাঝে সাঁজায়? যে গল্পের নামটাও আমি জানি না তবু সে গল্পের ভাবনা গুলো নিয়ে আমি ভাবি। তোমার ভার্সিটির গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে অথবা মাঝে মাঝে ছাত্র সেজে তোমার লাইব্রেরির বুক সেলফের বইয়ের ফাঁকে কতবার লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে আমার চোখে এঁকেছি।
আমার খুব ইচ্ছে জাগে শহরটায় যখন বৃষ্টি নামে বৃষ্টির ফোটাগুলো মুঠৈায় বন্ধি করে তোমার মুখটায় ছিটিয়ে দিতে।দেখতে ইচ্ছে করে তুমি কেমন করে তখন চোখ গুলো বন্ধ করো।মাঝে মাঝে মুঠোফোনে বিষন্ন মন নিয়ে যখন আমার সাথে কথা বলো আমি তখন অনুভব করি শহরজুড়ে তখন ঝড় বইছে।আমার তখন একটুও ভালো লাগে না বুঝলে মেয়ে?” এটা বলেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। আদনান আবার বলতে থাকে “আমাকে ভালোবাসতে হবে না মেয়ে।তোমার আশে পাশে এমন করে থাকতে দিও কেমন?” এটা বলেই সে ফোনটা রেখে দেয়।আমার ভিতরটা কেমন করে উঠে।আমি অনুধাবন করি এটা কি শুধু একটা দশটাকার কোরমা নাকি ভালোবাসা? আমার কি উচিৎ ছিল না ওর এই ভালোবাসাটা একটু করে মুখে দিয়ে ভালোবাসার স্বাধটা গ্রহণ করার? আমার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না।এই ভাবার মাঝে কেন যেন আমার অশান্তি অশান্তি লাগে।
ক্লাস শেষ হতেই রুম থেকে যখন বের হলাম আদনান আমার সামনে এসে বললো “আজকে কি তুমি নিশিকে দেখতে যাবে?” আমি আদনানের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। প্রতি বৃহস্পতিবার আমি ভার্সিটির ক্লাস শেষ করেই বাসায় চলে যাই। এখানে পড়ালেখার জন্য কয়েকজন সিনিয়র আপুর সাথে আমি মেসে থাকি।সাত দিনের মধ্যে ছয়টা দিন আমার কোন দিকে দিয়ে কেটে যায় আমি বুঝতে পারি না।এই ছয়টা দিন অপক্ষোর পর যে দিনটা আসে সে দিনটা আমার কাছে অতি মূল্যবান। অপেক্ষা ব্যাপারটা অনেক বিরক্তিকর।এটা মানুষের ভিতরটাকে একদম মেঘময় আকাশের মত করে ফেলে। কিন্তু নিশির জন্য অপেক্ষা করতে আমার একটুও খারাপ লাগে না। তবে মাঝে মাঝে খুব অবাক হই আদনানকে আমার ভার্সিটিতে দেখলে। ছেলেটা কাজ বাদ দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ভার্সিটতে চলে আসে। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম “কি চাই? আপনি এখানে কেন আসেন?” সে ইতস্তত হয়ে বললো “দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই চলে আসছি। ভুল করেছি?’ সেদিন আমি আর কিছু বলিনি। কথাটা কেন যেন আমার খুব মায়া মায়া লেগেছিল।
সে আমার হ্যাঁ সূচক ইশারা দেখে বললো “আমি কি তোমার সাথে যেতে পারি? ওর কথা তুমি প্রায় বলোতো সে কারণে দেখার ইচ্ছেটা বেড়ে যায়।তারচেয়ে বড় কথা ও কথা বলতে শিখেছে তুমি বলেছো। নতুন কথা বলা মানুষটাকে ভালোবাসা জানাতে হয়।” আমি ওর কথার কি প্রত্যুত্তর দিব বুঝতে পারি না।কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললাম “তোমার যখন ইচ্ছা হয়েছে আমি না বললেও তুমি যাবে।শুধু শুধু জিজ্ঞেস করো কেন হ্যাঁ।” সে একটা হাসি দিয়ে বললো “ভদ্রতা বলতে একটা কথা আছে না? আমি কি অভদ্র? আমাকে কি ভদ্র মনে হয় না?” আমি ভ্রু কুচকে বললাম “না তুমি একটা অভদ্র।অভদ্রের মত সারাক্ষন আমার পিছনে লেগে থাকো। আজ এতো বছর কি করে আমার অবজ্ঞা সহ্য করে আসছো? এমন পাগলামো কেন করো?” আমার কথা শুনে সে হাসতে থাকে কিন্তু ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললো “সেদিনের দশটাকার কোরমা কিন্তু তুমি মিস করেছো মেয়ে।” আমি কিছু না বলে হাটতে থাকি। লুবনা আপাকে বাসার চাবিটা বুঝিয়ে দিয়েই বাড়িতে চলে যাবো।
বাসায় পৌছাতে পৌছাতে আকাশটা অন্ধকারে রুপ নেয়। সন্ধ্যার আকাশ জুড়ে তখন তারার মেলা। এমন সন্ধ্যা বেলায় আমি কতবার আহনাফের হাত ধরে আকাশ দেখেছি। আমাদের ভালোবাসার গল্প সাজিয়েছি এসব মনে হলেই আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠে। বাসার দরজা খুলতেই দেখি আম্মার কোলে নিশি।আদনান আম্মাকে সালাম জানায়। নিশি আমাকে দেখেই মুখে একটা হাসির রেখা দিয়ে ছটফট করতে থাকে আমার কোলে আসার জন্য। আদনানকে বললাম “আমার ব্যাগটা ধরোতো।” এটা বলেই আম্মার কোল থেকে নিশিকে কোলে নিয়ে কয়েকটা চুমু দিয়ে বললাম ”এইযে আম্মু এসে পড়েছে। আমার মামুনিটা আমার জন্য কি কান্না করে?” আদনান আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর সাথে আমার মেয়েটাকে পরিচয় করিয়ে দেই। আদনান নিশির সাথে ইশারা দিয়ে কথা বলতে থাকে। হাসতে থাকে। আমার কোল থেকে নিশিকে কোলে নিয়ে আদর করে। এই কথা বলা বা আদরের মাঝে আমি অনুভব করি পৃথিবীটা হয়তো এই মানুষগুলোর জন্য অনেক সুন্দর। কিন্তু এই সুন্দর পৃথিবীটা থেকে মানুষগুলো যখন কেউ হারিয়ে যায় তখন একদম ভালোলাগে না।
রাত যত গভীর হয় আমাদের মানুষের অনুভূতিগুলোও তত ভয়ানক ভাবে সামনে আসে। আমি ভাবি সে ভয়ানক দিন গুলোর কথা। ভালোবাসা মানুষকে যে ছন্নছাড়া করে দিতে পারে আমার জানা ছিল না। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আহনাফ তখন ভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। আমি তার ছাত্রী ছিলাম।এই ছোট্ট জীবনে কেনই বা এই ছেলেটাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল আমি বুঝতে পারছিলাম না। বুঝতে পারতাম না এই ভালোলাগার কারনটা। আমার মনে হতো শুধু আকাশের নীল রংটার মাঝে সাদা মেঘ গুলো আমার। মানুষটা কি সুন্দর করে কথা বলতো। সে যখন কথা বলতো বা আমাকে পড়া বুঝাতো আমি তখন আমার ছোট্ট চোখগুলো দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
একদিন আমি তাকে ইতস্তত করে বললাম “আপনি কি সব সময় এমন করে কথা বলেন?” ও একটু অবাক হয়ে বললো “কেন বলো তো?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। অনেকটা সময় নিয়ে বললাম “এমন করে শুধু আমার সাথেই কথা বলবেন। অন্যকারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই কেমন? আর মেয়ে স্টুডেন্ট পড়া বাদ দিয়ে দিবেন।শুধু আমি ছাড়া।” সে শুধু চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর একটা হাসি দিয়ে বললো “তুমি কি রাতে ভুত এফএম শুনো মেয়ে?” আমি মাথা নেড়ে বুঝাই জ্বি না। এসব শুনি না, ভয় লাগে।” তারপর সে বললো “আমারো ভয় লাগে ভালোবাসার কথা শুনলে বুঝছো মেয়ে?তোমার সামনে পরীক্ষা। অনেক পড়তে হবে অনেক। এই গুলা নিয়ে আর ভাববে না।ঠিকাছে?” আমি কিছুই বলিনি। শুধু মাথা নিচু করে ফিজিক্স বই এর দিকে তাকিয়েছিলাম।
আমার দিনগুলো কেমন করে যেন কেটে যাচ্ছিল।যতবার আমি ওর কথা বা ওকে ভালো লাগার বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে চেষ্টা করেছি ঠিক ততবার কল্পনার মাঝে একটা যন্ত্রনা আমাকে আকড়ে ধরতো। আমি পারতাম না আহনাফকে ভালো লাগার বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে। ঠিক একমাস পর ও নিজেই বললো “তুমি এখন কেমন করে যেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকো। এই তাকানোর মাঝে আমি অন্য কিছু দেখতে পাই। তোমাকে একটা কথা বলি শুনো। আমরা জীবনকে যেভাবে আঁকতে পছন্দ করি, জীবনের মাঝে কিন্তু বাস্তবে সে রং গুলো থাকে না। তবে তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি আগে পরীক্ষাটা দাও তারপর তোমাকে নিয়ে আমি ভাববো।” সেদিন আমি একটুও ঘুমাইনি।চোখ বুঝলেই আহনাফের কথাগুলো আমার কানে বাজতো।
এর একমাস পর আমি পরীক্ষা দিলাম। আমার রেজাল্টও অনেক ভালো হলো। আমার জীবনের প্রথম ভালো লাগাকে আমি নতুন করে আঁকা শুরু করলাম। সে আঁকার মাঝে সবকটি রং ছিল। প্রতিটা রংকে আমি যত্ন করে আমার দেয়ালের চারপাশে ছড়িয়ে দিলাম। আহনাফের প্রতিটা কথা আমি শুনতাম।ভালোবাসার মাঝে এই ভাবে জড়িয়ে যাবো আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি।দেড় বছর ধরে আমি ওকে একটু একটু করে ভালোবেসে আমার মনের ভিতর একটা ভালোবাসার পাহাড় তৈরি করেছিলাম। কিন্তু কে জানতো সেই পাহাড় থেকেই আমি পা পিছলে পড়ে যাবো? ইন্টার ২য় বর্ষের মাঝামাঝি সময় এসে সে আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো।আমি ফোন করলে রিসিভ করে না বা ফোন ওয়েটিং থাকে।
আমি বুঝতে পারছিলাম না সে কেন এমন করছে।তার সাথে দেখা করে যখন জিজ্ঞেস করলাম “আমার সাথে কেন এমন করছো?” সে একটু সময় নিয়ে বললো “আমি বাবা মায়ের বড় সন্তান। আমার উপর অনেক দায়িত্ব।আমাকে অনেক দুর যেতে হবে। আপাতত ভালোবাসাটাকে নিয়ে আমি ভাবছি না।” ওর এমন কথা শুনে আমি বললাম “আমি কি তোমাকে প্রেসার দিচ্ছি? বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছি? কই করিনি তো?তোমাকে তোমার মত চলতে দিয়েছি। বরং তুমি যেভাবে চেয়েছো আমি ঠিক সেই ভাবে চলেছি। আমাকে কষ্ট দিও না প্লিজ।আমার কষ্ট সহ্য হয়না আহনাফ।” সে শুধু এইটুকুই বললো “আমি রিলেশনে থাকতে চাইনা।” আমার আকাশটা হঠাৎ করে কেপে উঠলো। এই আকাশের মেঘগুলো ঝড় ঝড় করে যেন পড়তে শুরু করলো।আমি তাকে বুঝাই এমন করো না। দিন গিয়ে রাতের আলো আসে। রাতের আলো শেষে দিনের আলো আসে কিন্তু এই রাত দিনের মাঝে আমি তাকে পুরানো সুরের মত পাই না।
আমার সুরের মাঝে কোন মায়া আমাকে গভীরে নিয়ে যায় না।রাত যত গভীর হয় আমার চোখে সমুদ্র দেখা যায়। আমি জানতে পারলাম সে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আমার তখন কি করা উচিৎ আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে বলতো “মা তোর কি কিছু হয়েছে?” আমি কিছু বলতে পারতাম না। বলতে পারতাম না বাবা তোমার মেয়েটা ভালো নেই একদম ভালো নেই। আমি ইন্টার পরীক্ষায় তেমন একটা ভালো রেজাল্ট করলাম না। যদিও আমি পাস করেছিলাম। আমি বাসায় কাঁদলাম ভয়ংকর ভাবে কাঁদলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম এই শহরের আলো আমি আর দেখবো না।রাতে এই শহরটা নিরবতায় ভর করে। এই নিরবতার মাঝে আমিও চেয়েছি নিরব হয়ে যেতে। মাঝ রাতে আমি যখন গলায় ফাস দিতে চেয়েছিলাম মা আমাকে দেখে ফেলেছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম দরজাটা লক করতে। মা ওয়াশ রুমে গিয়েছিল। আমার রুমের লাঈট জ্বলতে দেখে একবার আমাকে দেখতে আসছিল।
যখন মাথাটা ফেনে বাধার রশির মাঝে ঢূকাতে যাচ্ছিলাম তখনি মা আমাকে দেখে ফেলে। দেখার সাথে সাথে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে। এই শহরটা ছেড়ে সেদিন আমি যেতে পারিনি। আমার একটা দিনও ভালো কাটতো না। সেদিনের পর থেকে মা আমার সাথে সারাক্ষন থেকেছে। কোন দিক দিয়ে সাতটা মাস কাটিয়ে দিলাম বুঝতে পারিনি। আমি জানালা ধরে আকাশটাকে দেখতে থাকি। বাবা বুঝায় জীবনে হাল ছেড়ে দিতে নেই মা। তাকে দেখিয়ে দাও তুমি ভালো আছো। জীবনে যে তোমার হতে চায়নি তাকে নিয়ে ভেবে না।তার জন্য তোমার জীবন আটকে থাকবে কেন?এই জীবনটা তোমার। এই জীবনটাকে শেষ করে দিতে যেমন তোমার ইচ্ছে হয়েছে ঠিক তেমনি এমন একটা ইচ্ছা জাগিয়ে তুলো জীবনটাকে বদলে দিতে। যে চলে গেছে তাকে চলে যেতে দাও। যে চলে যায় মিথ্যা আশা দেয় সে কখনো তোমার না। তোমার হতে পারে না।” আমি সেদিন বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম।
আমার কান্না দেখে বাবাও কেঁদে দিয়েছিল। আস্তে আস্তে আমার জীবনের রঙটাকে বদলাতে শুর করলাম। এই জীবনের রঙটা যখন বদলে যেতে লাগলো ঠিক তখনি হঠাৎ করে আদনানের সাথে আমার পরিচয়। আমি তখন ভার্সিটির প্রথম বর্ষের শেষের দিকে। তারসাথে পরিচয় হয় ব্লগে। আমার মন খারাপের অনুভূতি গুলো , আমার ভিতরের কষ্ট গুলো ব্লগে লিখে রাখতাম। আদনান প্রতিটা পোস্ট পড়ে মন্তব্য করতো। আমাকে প্রায় বলতো আপনার কি অনেক কষ্ট ফাইরুজ?” আমি কোন রিপ্লে দিতাম না। ইচ্ছে করতো না। কিন্তু একটা সময় দিতে বাধ্য হলাম। আদনান চাকরি করে। একই শহরের ছেলে আদনান। যখন তার সাথে পরিচয় হলাম, আমি কি করি জানালাম তার পর থেকেই সে কি করে যেন আমাকে খুজে বের করেছে। ব্লগে আমার ছবি ছিল না। আমার সাথে হঠাৎ করে একদিন দেখা করে বললো “আপনি কি ফাইরুজ?” আমি ওকে দেখে চিনে ফেলেছিলাম। একটু সময় নিয়ে বললাম ”জ্বি না আমি ফাইরুজ না।”
ও হাসতে লাগলো। তারপর বললো “আপনি দেখছি মিথ্যাটাও ঠিক মত বলতে পারেন না। যে এতো এতো দুঃখের কথা লিখতে পারে তার মনটা কেমন তার আকাশটা সব সময় এমন মেঘময় কি করে থাকে তা দেখার ইচ্ছে হয়েছে। তার এতো দুঃখ কেন?” আমি কিছুই বলতে পারিনি। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সামনে থেকে চলে গিয়েছিলাম। এরপর সে প্রায় আমার সাথে হঠাৎ হঠাৎ করে দেখা করতে আসতো। প্রথম প্রথম খুব কড়া ভাষায় তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম এমন না করতে। একটা সময় আমি তাকে আমার জীবনের কথা জানাই এটাও জানাই এই ভালোবাসা এখন আমাকে কাছে টানে না। কিন্তু সে তারপরো আমার এতো অবজ্ঞা এতো বছর ধরে কি করে সহ্য করছে আমি বুঝতে পারি না। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে খুব মায়া লাগে। এই মায়াটা একদিনে আসেনি। কিন্তু আমি কিছু বুঝতে দেই না। প্রকাশ করি না।প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না।
আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ইবনাতের মেয়ে হচ্ছে নিশি।যদিও সে আমার মেয়ে না কিন্তু এই শহরের বেড়াজালের ছায়ায় এই ছোট্ট মেয়েটাকে আমার মেয়ে বলেই পরিচয় দেই।এই শহরে হাজার হাজার অনুভূতি ঘুরে বেড়ায়। সেই হাজার হাজার অনূভূতির কালো ছায়াটা যেন নিশিকে ছুয়ে দিতে না পারে তার জন্য আমি অনেক আগেই এই শহরের আকাশ আর সূর্যকে চিনিয়ে দিয়েছিলাম সে আমার মেয়ে। তোমারা ওকে চিনে রেখো। আমার প্রিয় বান্ধবীটা রিলেশন করে পালিয়ে বিয়ে করেছিল তার এলাকার একটা ছেলের সাথে। তখন ও ভার্সিটির প্রথম বর্ষের শেষের দিকে। ভালোবাসাটা কখন কিভাবে মানুষকে উন্মাদ করে দেয় কেউ বুঝতে পারে না। তাদের এই পালিয়ে বিয়ের ব্যাপারটা কেউ মেনে নেয়নি। বিয়ের ছয় মাস পর সে আমাকে একদিন ফোন করে বললো “জীবনটা অনেক কঠিণরে। বৃষ্টি হলেই যেমন আকাশটা গর্জন দেয় তেমন করে আমার মনের ভিতরেও আজকাল এমন গর্জন হয়। কষ্টের গর্জন। আমার এই গুলা কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করে না। আমি নিজের ভিতর দমিয়ে রাখি।চারদিন পর পর সে আমাকে দেখে যায়।রাতটা থেকে আবার চলে যায়।
আমি কিসের মধ্যে আছি জানি নারে।আমার ভীষন ভয় লাগে। আমাদের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। সে আমাকে বলেছিল সোজা ওর বাসায় নিয়ে যাবে কিন্তু ও আমাকে ওর বাসায় নিয়ে আসেনি। একটা এক রুম ওয়ালা ভাড়া করা বাসায় নিয়ে আসে। যখন আমি বললাম এখানে কেন? ফারাবী আমাকে বলেছিল বাসায় কিছুটা ঝামেলা চলছে কিছুটা দিন এখানে থাকি? আমি ভরা চোখে শুধু তাকিয়েছিলাম। আর নিজেকে শান্তনা দিচ্ছিলাম বিয়ে যখন করে ফেলেছি এইটুকু তো মেনে নিতে হবেই। আজ পনেরো দিন হলো সে আসে না। তার ফোন অফ।পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আমি।” কথা গুলো বলেই ও কেমন করে যেন উঠলো।আমি ওকে কি বলে শান্তনা দিব বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমিও এমন একটা অবস্থার মধ্যে ছিলাম আমার দিন কাটতো না, রাত কাটতো না। তবু আমি এর পরদিনই ওর সাথে দেখা করে ওকে নিয়ে ওর স্বামীর বাড়ি গেলে তারা আমাদের সাথে খুব খারাপ আচরন করেছিল। ওর স্বামী ফারাবী কোথায় তারা নিজেরাও জানে না। ইবনাত শুধু আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। আমি ওকে বললাম “তুই একদম চিন্তা করবি না। ইবনাতের বাবা মায়ের বাসায় পৌছাতেই বিকেল হয়ে যায়।
ইবনাতকে যখন ওর বাবা দেখলো উনি খুব রেগে ইবনাতের মাকে বলেছিল “এই বেয়াদবটা কেন আমার বাসায় আসছে? মান সম্মান কি সব তো শেষ করে দিয়েছে। চলে যেতে বলো ওকে। ওর এই নোংরা মুখটা আমি দেখতে চাইনা।” সেদিনের পরথেকে ইবনাত আমার বাসায় থেকেছে। আমি নিজেও একটা বিষন্নতার মাঝে থেকে বুঝাতাম হতাশ হবি না। একটু শক্ত হ। নিশি পৃথিবীর মুখ দেখার আগে ইবনাত আমার হাত ছুয়ে খুব গভীর ভাবে বলেছিল “আমার যদি কিছু হয়ে যায় আমার বাচ্চাটাকে দেখিস। আমার বাচ্চাটাকে অনেক ভালোবাসা দিবি কেমন?” আমি শুধু হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়েছিলাম। এই একটা লাইন যে এতো গভীর হবে আমি বুঝতে পারিনি। নিশি জন্ম নেওয়ার তার পরদিনই ইবনাত ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মারা যায়। আমি খুব দুঃখিত ইবনাত তোর কথাটা আমি বুঝতে পারিনি।বুঝতে পারলে আমি তোকে এইভাবে যেতে দিতাম না। ফারাবী কোথায় এখনও খুঁজে বের করতে পারিনি। যদিও তার হাতে নিশিকে আমি কখনো তুলে দিব না।
ভার্সিটি শেষ করে মেসে এসে কিছুক্ষন যখন শুয়ে ছিলাম লুবনা আপা আমায় বললো “তুই যখন সেদিন চলে গিয়েছিলি সেদিনই আমাকে বাড়িতে যেতে জরূরি তলব দেয়। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। পরে জানলাম আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। সবে মাত্র মাস্টার্স শেষ করে চাকরিটা পেলাম। আর এখনি আমাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে পর করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।মেয়ে মানুষের কপালে এই নিয়মটা লেখা থাকেই থাকে। তবে ছেলেটা দেখতে ভালোরে। আমাদের দুজনকে যখন আলাদা ভাবে কথা বলতে দিল আমি তো চোখ টিপ মেরে দিছি। ছেলে একটু ভয় খাইছে।
ছ্যামরা তো নার্ভাসে আমার সাথে প্রথমে তেমন কথাও বলে নাই। পরে আমি যখন বললাম কয়টা মেয়ে দেখা শেষ করে আমাকে দেখতে আসছেন? আমি কত নাম্বার বলুনতো?” ছেলে আমতা আমতা করে বললো “জ্বি দুইটা। আপনি তিন নাম্বার।” আমি আফসোসবোধ করে বললাম “ঐ দুইটা মেয়েকে কি পছন্দ হয়নি?” সে একটু সময় নিয়ে বললো “কাউকে বলবেন না কেমন? প্রথম মেয়ের নাক বোচা ছিল। আর দ্বিতীয় নাম্বার মেয়েটার সাথে অন্য ছেলের রিলেশন আছে। মেয়েটাকে অবশ্য পছন্দ হয়েছিল কিন্তু রাতে ফোন করে বলেছে ভাইয়া আমার না একজন কলিজা আছে।তার সাথে কথা না বললে আমার ঘুম হয় না।আপনি আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েন কেমন?” আমার কি বলা উচিৎ ছিল বুঝতে পারছিলাম না। কেমন যেন একটু খারাপ লাগলো।
একটু চুপ করে থেকে শুধু বললাম আচ্ছা। তারপর মেয়েটা বললো “একটা কথা বলি? আমি হুম শব্দ করাতেই বললো “আপনার বিষয়ে না আমি বাসায় হাবিজাবি বলেছি। বলেছি আপনি ছেলে ভালো না খাটাশ একটা।আপনার সাথে অন্য মেয়ের লাইন আছে।মিথ্যে বলেছি বানিয়ে বানিয়ে কিছু মনে করবেন না, কেমন ভাইয়া।” আমি লাইনটা কেটে দিয়েছিলাম।” ছেলের কথা শুনে অনেকক্ষন হেসেছিলাম বুঝছিস ফাইরুজ।” লুবনা আপার কথা শুনে আমি একটা হাসি দেই। লুবনা আপাও হাসতে হাসতে বললো “ওর নাম ফাহীম। রাতে ফোন করে কি বললো জানিস? আপনি আমাকে চোখ টিপ মারা শিখাবেন? আমি না পারি না।” আমি বললাম “শিখে কি করবেন?” ওপাশ থেকে বললো “আপনার সাথে বিয়ে হলে আপনাকে আমি দিনে দুবেলা, সকালে একবার আর রাতে একবার চোখ টিপ মারবো। ভালো হবে না?” আমি হাসতে থাকি আর ভাবি এমন সুন্দর সুন্দর অনুভূতিটার জন্যই পৃথিবীটাকে সুন্দর লাগে।
এর তিন দিন পর আমি জানতে পারলাম ফারাবী আর বেঁচে নেই। সে রাজনীতি করতো। রাজনৈতিক জের ধরেই তার কিছু বন্ধুরা তাকে খুন করেছে। আমার কেমন যেন লাগলো খবরটা পেয়ে। নিশির কথা মনে পড়লো। আমি কাঁদলাম এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য কাঁদলাম এবং মনে মনে বললাম মা তোর আর কেউ না থাকুক আমি আছি তোর এই মামুনিটা আছে।
ভার্সিটি থেকে বের হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আদনান হঠাৎ করে আমার সামনে এসে বললো “চলো তো জলদি চলো” ও হঠাৎ এমন করে কেন বললো আমি বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম “কোথায়? আর হঠাৎ এমন করে কেন বলছো? আজ তোমার অফিস নেই? তোমার এই অভ্যাসটা বদলাবে না? যখন তখন ভার্সিটিতে চলে আসো।” সে অস্থির মুখ নিয়ে বললো “আগে আমার সাথে চলো। একটা কথাও বলবা না। নিজের ভিতরে ভিতরে অনেক জ্বলেছো আর না। এটা বলেই আমার হাতটা ধরে টানতে টানতে হাটতে লাগলো। আমি শুধু অবাক হয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে হাটতে লাগলাম।
আর ভাবতে লাগলাম “এই হাত ধরার অধিকারটা কি ওর আছে?” কিন্তু কেন যেন তারপরও আমি ওকে কিছু বললাম না। তারপর একটা রিকশায় উঠলাম। কি হতে চলছে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাকে বললাম “কি হচ্ছেটা কি আদনান? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো।” সে বললো “চুপচাপ চলো মেয়ে, গেলেই দেখতে পারবে।” আমি আর একটা শব্দও করলাম না।শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এর দশ মিনিট পর একটা রেস্টুরেন্টের ভিতরে নিয়ে গিয়ে দুজন মানুষের সামনে আমাকে দাঁড় করায়। যখন আমি আহনাফকে দেখলাম আমার ভিতরটা কেমন ছটফট করতে লাগলো। আমাকে দেখে হয়তো সে বেশ অবাক হয়েছে। আমি চোখ সরিয়ে আদনানের দিকে তাকিয়ে বললাম “কেন নিয়ে আসছো এখানে?” আহনাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আহনাফের পাশের মেয়েটা কি হতে চলছে কিছুই বুঝতে পারছে না।”
আদনান একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “এই মানুষটাই তো তাই না? এই মানুষটার জন্যই তো কষ্ট পেয়েছো? এই মানুষটার কথাই বলতে?” আমি কিছু বললাম না। আদনান আমার চুপ থাকা দেখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললো “ভালোবাসা বিষয়টা অনেক গভীর।এটাকে মন থেকে আঁকতে হয়।ভালোবাসা একটা স্বপ্ন।স্বপ্ন যে কেউ দেখতে পারে না।এই স্বপ্নটা যখন সামনে আসে তখন এটাকে বাস্তবে রুপ দিতে হয়।আর না হয় এই স্বপ্ন দেখার কোন অধিকার নেই।এই অধিকারটাকে ধরে রাখতে হয়।নিজের মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে হয় বুঝলেন আহনাফ সাহেব।আজকে জানুয়ারীর ২৩ তারিখ। আপনার জন্মদিন। আপনি কি জানেন এই দিনটার কথা এই মেয়েটা ভুলে না।আপনি এখানে প্রিয়জনের সাথে জন্মদিনের সময় কাটাতে আসছেন। বেশ ভালো।এই যে এতো কিছু বলছি, কেন বলছি? এইটুকুই আপানাকে জানাতে আসছি। ও এখন ভালো আছে। বেশ ভালো আছে। আর আমি যতদিন থাকবো এই মেয়েটার চোখে একটু পানিও আনতে দিব না। ভালোবাসলে কাউকে ধোকা দিতে নেই আহনাফ সাহেব।ভালো থাকুন।”
এইটা বলেই আদনান ফের আমার হাতটা ধরে বললো চলো।আহনাফের পাশের মেয়েটা বসা থেকে উঠে কেমন একটা রাগ রাগ মুখ নিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি বোবার মত আদনানের দিকে তাকিয়ে থেকে হাটতে লাগলাম। এই মুহুর্তে আহনাফের সাথে মেয়েটা কি নিয়ে কথা বলাবলি শুরু করেছে সেদিকে আমার খেয়াল নেই। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আবার রিকশায় উঠলাম।আমি শুধু ভাবতে লাগলাম আদনানের একটা কথা সে যতদিন থাকবে ততদিন আমার চোখে পানি আসতে দিবে না।এই কথাটায় আমার ভিতরে একটা ভয়ংকর ভালো লাগা কাজ করলো।সে আমাকে বললো “আমাকে জিজ্ঞেস করবে না কেন এমন করলাম?” আমি তারপরও চুপ করে থাকি। সে বললো “যে অন্যায় করে তাকে একটা জবাব হলেও দিতে হয়।এই জবাবটা তুমি দিতে পারোনি মেয়ে।
এই জবাবটা না হয় আমি এতোবছর পর দিলাম।” এটা বলেই সে থামে। আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে চায়।আমি কান্না করতে লাগলাম।আদনান আমার কান্না দেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো “বলেছি না আমি থাকতে তোমার চোখে পানি আসতে দিব না। তারপরও কেন কাঁদছো মেয়ে? আর আমরা কিন্তু দুজন না। আমরা তিনজন। আমি তুমি আর নিশি।কি হবে আমার বিষন্ন সুন্দর?” আমি আবার কান্না করি। কান্না করতে করতে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে তার হাতটা আকড়ে ধরি। আমার এই কান্নাটা কষ্টের না। এই কান্নাটা কারও হাত ধরে আকাশ দেখার ভরসা পাওয়ার কান্না।যে আকাশটার মাঝে বিষন্ন সু্ন্দর সাদা মেঘগুলো ভেসে বেড়ায়।আমি বিশ্বাস করি সেই মেঘ থেকে আমাদের বিষন্ন সুন্দর ভালোবাসা গুলো এই সুন্দর শহরটার মাঝে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে শহরটার মাঝে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিবে…