বাম পাঁজরের হাড়

বাম পাঁজরের হাড়

মাঝে মাঝে জীবন আমাকে ভাবায়!তিব্রভাবে ভাবায়।কেনো জীবনটা এতো জটিল।কেনো সবদিকে এতো চঞলতা,এতো ব্যাস্ততা।কি হবে এতো চঞলতা দিয়ে!জীবন যুদ্ধে এতো চঞলতা সহ্য হয় না আমার।একদম সহ্য হয় না। স্থিরতা আমায় টানে।ম্যাগনেটাইটের মতো টানে।যে টানকে আমি অবজ্ঞা করতে পারি না।মাঝে মাঝে মনে হয়, মানব জীবন আমার জন্য নয়।ভূল করেছি আমি মানব হয়ে জন্ম নিয়ে।মানবেরা বড়ই নিষ্ঠুর,বড়ই অদ্ভুত! জীবন যুদ্ধে তারা কতো কিছুকেই না পেছনে ফেলে আসে অবলিলায়।একটি বারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না।আমি পারি না!পেছনের সব কিছু আমাকে ডাকে!আমি পারি না চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।আমি পারি না চোখে দেখা কোনো কিছু না দেখার ভান করে ফেলে আসতে।

নিতু মেয়েটা প্রায়ই আমায় জীবন সম্পর্কে বুঝায়।সময় সম্পর্কে, পরিবার সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে।আমি তার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকি।তার কোনো কথাই আমার শ্রবণগত হয় না।আমি ভাবি অন্য বাপারে।আমি ভাবি,এই মেয়ে কেনো আমার মতো একজন মানুষকে ভালোবাসতে যাবে। কেনো আমার মতো শৃঙ্খলাহীন, স্থির মষ্তিষ্কের মানুষকে নিয়ে নিজের কল্পনার রাজ্য সৃষ্টি করবে।আমি তো এই মেয়ের নখের যোগ্যও নই!!

সে আমার মনের কথা পড়ে ফেলে।আমি অবাক হই তার পর্যবেক্ষন ক্ষমতা দেখে।মুহুর্তেই তার মুখে তিব্র রাগের আভা ছড়িয়ে পড়ে।সে আমায় কড়া শাসনের সুরে বলে,

– এমন কথা ভূলেও মাথায় আনার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম!তোমার মাথায় কি এসব আজেবাজে চিন্তা ভাবনা ছাড়া অন্য কিছুই আসে না?তুমি কি জানো, যারা নিজেকে সব সময় ছোট করে কথা বলে।নিজেকে নিজে সম্মান করতে জানে না,তারা অন্যকেও সম্মান করতে ভূলে যায়।অন্যকেও ছোট করে কথা বলতে দুবার ভাবে না!জানো এটা?
আমি পুনরায় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।ভাবি,মেয়েটার কথা বলার সাধারন ভঙ্গিমাটাও কত সাবলীল,মনোমুগ্ধকর।আল্লাহ তা’আলা যেনো তাকে সব কিছু দিয়ে নিঁখুত করে সৃষ্টি করেছেন।কোনো খুঁত নেই তার মাঝে।নিঁখুতের কথা ভাবতেই কবির ভাইয়ের কথা মনে পড়ে।আমাদের এলাকার বেশ পরিচিত একটা মুখ।ওনার পরিচিতির কারন,ওনি বেশ ভালো ভালো কথা শুনিয়ে থাকেন মানুষকে বিনা পয়সায়।কবির ভাই অনেক আগে এক সন্ধায় আমায় ঢেকে বলেছিলেন,বুঝলি প্রত্যয়!আল্লাহ তা,আলা আমাদের সবাইকেই কোনো না কোনো ভাবে খুঁত দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।

আমাদের সবার মাঝেই কোনো না কোনো খুঁত রয়েছে।আমরা কেউই নিঁখুত নই।সেদিন আমি ওনার কথাগুলো শুধু শ্রবণ করেছিলাম।কিছুই বলতে পারি নি।প্রথমত, বলার মতো কিছু আমার কাছে তখন ছিলো না।দ্বিতীয়ত, বড়দের কথার বিরুদ্ধে কথা বলা আমাদের সমাজে এক ধরনের অপরাধ।বড়দের বলা কথাটা যুক্তিগত হোক বা অযোক্তিক,আমাদের চুপচাপ সব কথা যোক্তিক হিসেবে মেনে নেওয়ার শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছে আদি সমাজ।
কিন্তুু আমি এখন দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, কবির ভাই ভূল বলেছিলেন।ওনার ধারনা ভূল ছিলো।নিতু নিঁখুত।সব দিক দিয়েই সে নিঁখুত। আমি শত চেষ্টা করেও তার খুঁত বের করতে পারি না।আমজাদ চৌধুরী ঠিকই বলেন।আমি যে তার মেয়ের সঙ্গ পেয়েছি এটাই আমার সাত কপালের এক কপাল।এর থেকে বেশি কিছু চিন্তা করাও আমার জন্য পাপ।আমজাদ চৌধুরী কথায় আমি প্রত্তুত্যর দিতে পারি না।আমি জানি ওনি ওনার দিক দিয়ে ঠিক।যে কোনো বাবার পক্ষেই এটা মেনে নেওয়া কষ্টের যে তার মেয়ে আমার মতো একটা ছেলের প্রতি দূর্বল।আমজাদ চৌধুরীর কথায় আমি কিছু মনে করি না।ভদ্রলোক এমনি মানুষ হিসেবে খারাপ নন।

রাতের আকাশ আমার বরাবরই ভালো লাগে।আমার যখনই মন খারাপ হয় তখনই আমি মাঝ রাতে একা হাঁটতে বের হই।রাতের নিস্তব্ধতা আমার মনকে নাঁচিয়ে তুলে।আমার মন ভালো হয়ে যায় মুহুর্তেই।যদিও মাঝ রাতে শহরের রাস্তাগুলোতে একা একা হাঁটা একটু রিস্ক হয়ে যায়।তবুও আমি বের হই।আমি মনে করি,আমার কাছে এমন কিছু নেই যার জন্য আমি সমস্যায় পড়তে পারি।আজ আমার মন খারাপ।কোনো কারন নেই।আমার মন খারাপের কোনো কারন লাগে না।হঠাৎ করেই হয়ে যায়।মন ভালো করতে আমি অন্যান্য দিনের মতোই হাঁটতে বের হই।আজকের রাতটা অন্যান্য রাতের তুলনায় অধিক জোঁসনাময়।আমি নিচেঁর দিকে তাকিয়ে,আপন মনে হাঁটতে থাকি।মাঝে মাঝে দ্রুতগামী বড় বড় জাহাজের মতো বাস,ট্রাকগুলোর হর্নের শব্দ কাঁপিয়ে তুলে আমায়।তারা বাতাসের ন্যায় পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমি ওভার ব্রিজের উপর এসে পৌছাই।আমার ভেতরের স্বত্বা আমায় ছোট করে জানায়,একটু বসলে মন্দ হতো না কিন্তুু।বরাবরের মতোই আমি আমার ভেতরের স্বত্বাকে সায় দেই।ঠিক তখনি একটা কালো চকচকে প্রাইভেট কার আমার পাশ ঘেষে দাঁড়ায়।আমি উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি।কালো চকচকে কার থেকে আমজাদ চৌধুরী বেরিয়ে আসেন।হাল্কা সোডিয়ামের আলোয় ওনার চোখের চশমাটা কেমন একটা ভিন্ন রঙ্গ ধারন করে।আমি চশমাটার রঙ বদলকে উপভোগ করি।ওনি ব্রিজের রেলিং এর উপর এসে বসে।সাথে আমাকেও ইশারা করে পাশে বসতে।ওনার কথা মতো ওনার থেকে কিছুটা মৌলিক দূরত্ব বজায় রেখে বসি আমি।বেশ কিছুসময় ওনি চুপ করে থাকেন।আমি বুঝতে পারি ওনি কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন।আমার একটু হাসি পায়।ওনি কোনো কালেও আমার সাথে বিশেষ ভাবে ভেবে চিন্তে কথা বলেন নি।কিন্তুু আজকের ব্যাপারটা আলাদা মনে হচ্ছে।ওনি কি কি বলতে পারেন তা আমি আগেই ধারনা করার চেষ্টা করি।
এমন সময় আমজাদ চৌধুরী ছোট করে কাঁশির মতো দেন।ওনি গলায় যথেষ্ঠ নমনীয়তা এনে বলেন,

– প্রত্যয়,আমি মনে করি তুমি বেশ বুদ্ধিমান একটি ছেলে।বাস্তব জীবন সম্পর্কে তোমার সমবয়সিদের তুলনায় তোমার ধারনা এবং অভিজ্ঞতা দুটোই অনেক বেশি।
এখন আমি তোমায় যে প্রশ্নটা করবো আশাকরি তুমি তার সোজা,শাপ্টা উওর দিবে।
আমি বেশ মনোযোগ সহকারে ওনার প্রতিটা কথা শ্রবণ করতে থাকি।আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় আমায় জানান দেয়,আজ আমায় বেশ কিছু তীক্ষ্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে।

– নিতুর ভালোবাসায় কি তোমারও সায় রয়েছে?তুমিও সমভাবে ভালোবাসো ওকে?
এমন প্রশ্নে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই।প্রশ্নের প্রত্তুত্যরে কি বলা উচিত আমার মাথায় আসে না।আমি ভেবে পাই না এই প্রশ্নের উওর দেওয়া আদৌ ঠিক হবে কি না।মাথা নিচুঁ করে চুপচাপ বসে থাকি।আমার নিশ্চুপ থাকাকে আমজাদ আহমেদ কি হিসেবে গ্রহণ করে,তা আমি বুঝতে পারি না। ওনি ছোট খাটো একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো ফেলেন।বলেন,

– হুমম!আসলে কি জানো,এখানে তোমাদের কারোরই কোনো দোষ নেই।সব দোষ তোমাদের বয়সের।যদিও ম্যাচিউরিটিতে তোমাদের কোনো কমতি নেই,তবুও আবেগ,ভালোবাসা,অনুভূতি, এগুলোর সামনে ম্যাচিউরিটি ঠিকঠাক মতো কখনোই দাঁড়াতে পারে না।আর তখনই ছেলেমেয়েরা ভূল করে ভূল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।তোমার কি মনে হয়!তোমাদের বেলায় সিদ্ধান্ত টা সঠিক?
আমি পুনরায় চুপ করে থাকি।আমি জানি ওনার কথা শেষ হয় নি।ওনি খানিক বাদে আবার বলেন,

– তুমি খুব ভালো করেই জানো আমার মেয়েকে আমি কিভাবে বড় করেছি!কতটা ভোগ, বিলাসিতার মাঝে ও বড় হয়েছে।তোমার কি মনে হয় তুমি আমার মেয়েকে সুখে রাখার জন্য পারফেক্ট? একটা দুটো দিন নয়। সারাটা জীবনের দায়িত্ব!নিতে পারবে তুমি?রাখতে পারবে আমার মেয়েকে সব ধরনের দুঃখ কষ্ট থেকে দূরে?আমি জানি তুমি পারবে না!বাস্তবতা খুবই কঠিন প্রত্যয়।যেখানে আবেগ একটা মরীচিকা মাএ।আবেগ সাধারনত আমাদের সবার মাঝেই উপস্থিত।কিন্তুু বড় বড় সিন্ধান্ত নেওয়ার সময় আমাদের আবেগ থেকে বের হয়ে আসতে হয়।এবং আমাদের সেই সিদ্ধান্তকে বিচার করতে হয় নিজেকে যেকোনো একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে।যেখানে সাধারনত কোনো মানুষই নিজ ইচ্ছায় দাঁড়াতে চায় না।

এতটুকু বলেই ওনি ব্রিজের রেলিং থেকে নেমে দাঁড়ায়।কালো চকচকে প্রাইভেট কারটাতে উঠার আগে আমার দিকে পুনরায় ফিরে তাকায় ওনি।বলেন,

– তুমি খুব ভালো করেই জানো তোমার কি করা উচিত!আশাকরি আমার মেয়েটাকে আমি সামলে নিতে পারবো।

সাধারনত অচেনা নাম্বার থেকে আমার ফোনে খুব কমই কল আসে।আর যদি কখনো আসেও আমি সময় নিয়ে তা রিসিভ করি।কিন্তুু আজ ফোন স্কিনে অচেনা নাম্বার দেখে মনের ভেতর কেমন খুতখুত করে উঠে।আমি ফোন রিসিব করতে খুব বেশি সময় নিই না।ফোন রিসিব করতেই ওপাশ থেকে কেমন একটা ফুঁপানির শব্দ শুনতে পাই।পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আমি আমার শ্রবণশক্তির উপর তিব্র চাপ প্রয়োগ করি।যদিও পুরোপুরি ভাবে স্বর সনাক্ত করতে পারি না,তবে এটা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি ফোনের ওপাশে কেউ কাঁদছেন।আর সম্ভবত তিনি বেশ বয়স্ক ব্যাক্তি হবেন।
বেশ কিছুক্ষন পর ওপাশ থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় ভেসে আসে,

– প্রত্যায়!নি..নি..নিতু , সু….সুইসাইডের এটেম্পট নিয়েছে।আমি পারি নি আমার মেয়েটাকে সামলাতে।পারি নি আমি।

এতটুকু বলে আমজাদ চৌধুরী হুহুহু করে কেঁদে উঠেন।আমার বুকটা ধক করে উঠে।মনে হয় শূন্যের মাঝে ভেসে আছি আমি।আমার পুরো শরীর ঘামতে শুরু করে,মনে হয় কি যেনো একটা চারোদিক থেকে চেপে ধরছে আমায়।আমজাদ চৌধুরীরও কথা আটকে আসে। বেশি কিছু বলতে পারেন না তিনি, ফোন রেখে দেন।ফোন রাখার পর কিছু সময় এক জায়গায় ঝিম মেরে বসি থাকি আমি।সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসে।আমার সকল চিন্তাশক্তি লোপ পায়।নিতুকে যে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে আমজাদ চৌধুরী সেই হসপিটালের নাম কি যেনো বললেন সেটাও ঠিকঠাক মনে আসে না।অথচ আমার এটা ভালো করেই মনে আছে, ফোন রাখার আগে ওনি স্পষ্ট ভাবে সব ডিটেইলসে বলেছিলেন আমায়।আমার বাজে দিকগুলোর মধ্যে একটি এটা।আমি কখনোই প্রথম বলাতে কারো নাম বা কোনো সংখ্যা মনে রাখতে পারি না।খুব মনযোগ সহকারে শুনলেও না।এ নিয়ে অনেক বাজে কিছু পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে হয়েছে আমায়।

নিজেকে নিয়ে এই প্রথম আজেবাজে চিন্তা করতে ইচ্ছে করে।মনে হতে থাকে আমি সত্যিই ভূল মানুষ।আমার কিছুই সঠিক না।আমি যে মানবতা নিয়ে, মানব জীবন নিয়ে এতো চিন্তা করি সবই ভূল।মানবতার চিন্তা আমাকে দিয়ে সাঁজে না।

হঠাৎ সুমির কথা মাথায় আসে।নিতুর মামাতো বোন সুমি।নিতুর মারফতেই মাঝেমাঝে সুমির সাথে কথা হতো।যদিও মাঝেমাঝে কথা হতো,তবুও তার নাম্বার কন্টাক্ট লিষ্টে সেভ করা হয়ে উঠে নি কখনো।আমি দ্রুত কল লিষ্ট চেক করতে থাকি।একদম নিচের দিকে একটা অচেনা নাম্বার মিলে।যদিও আমি সিউর না এটা সুমির নাম্বার কিনা।তবে মন বলছিলো এটাই সুমির নাম্বার।আমি দ্রুত ডায়েল করি সেই নাম্বারে।ওপাশ থেকে আসা সুমির স্বর কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করে আমায়।একটা সময় সুমি ফোনেই নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে।হুহুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি তার বোনের যোগ্য না।

আমি কারোরই ভালোবাসা ডিজার্ব করি না।আমি একটা স্বার্থপর মানুষ।আমার কখনোই ভালো হবে না।আরো অনেক কথা।চুপচাপ শুনি আমি।মন খুলে বলতে দেই তাকে,হালকা হতে দেই।কষ্টকে হালকা করার অধিকার সবারই আছে।নেই আমার!যাইহোক,অনেক কাঠখড় পুঁড়িয়ে সুমির থেকে জানতে পারি নিতুকে ল্যাবএইড হসপিটালের তিন তলায় ভর্তি করা হয়েছে। ল্যাবএইডের তিন তলায় পৌছাতে সিড়ি দিয়ে হুরমুরিয়ে উঠতে থাকি আমি।তিন তলায় পৌছে প্রথমেই আমজাদ চৌধুরীকে চোখে পড়ে।কপালে হাত দিয়ে স্টেইনলেস স্টীলের চেয়ারে বসে আছেন।শক্ত পুক্ত মানুষটাকেও কেমন অসহায় দেখাচ্ছে।আমি ধীর পায়ে হেটে ওনার পাশে গিয়ে বসি।পাশে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে কিন্চিৎ সোজা হয়ে বসেন ওনি।কিছুসময় অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বাচ্চাদের মতো করে ঢুকরে কেঁদে উঠেন, আমার সম্মুখেই।কান্নাজড়িত অস্ফুট স্বরে বলেন,

– মেয়েটা আমার বাঁচবে তো?আজ আমার জন্যই……!

এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারেন না তিনি।ফের ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে উঠেন।আমি বুঝতে পারি এই মুহুর্তে আমার উচিত ওনাকে সান্তনা দেওয়া,কিছুটা আস্থা দেওয়া!কিন্তুু কিভাবে?আমি পারি না।আমি শুধু পারি কষ্টকে তিব্রভাবে অনুভব করতে।
ওটি থেকে ডক্টর বেরিয়ে এসে জানায় “আপাদত চিন্তার কিছু নেই।পেশেন্টকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে।কেবিনে দেওয়ার পরই আপনারা দেখা করতে পারবেন”।আমি আমার দুনিয়া ফিরে পাই।খুশিতে ডক্টরকে জড়িয়ে ধরা থেকে কোনো মতে নিজেকে সংবরণ করি।
নিতুকে কেবিনে দেওয়া হলে আমজাদ চৌধুরী কি যেনো একটু ভাবেন আমার দিকে তাকিয়ে।বলেন,

– যাও!ভেতরে গিয়ে দেখা করে এসো মেয়েটার সাথে!

নিতু সাদা ধবধবে বেডের বিছানায় শুয়ে আছে।বলতে গেলে কেবিনটার সব কিছুই ধবধবে সাদা।একটু দাগের আচরও নেই কোথাও।আমি একটা টুল টেনে নিতুর বেডের পাশে বসি।এই মুহুর্তে নিতুকে আমার সাদা গোলাপ মনে হচ্ছে।মেয়েটাকে এই প্রথম সাজসজ্জা ছাড়া ঘুমন্ত অবস্থায় দেখছি।মনে হচ্ছে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছি আমি।যে প্রকৃতির সুন্দর্য বলে, লিখে কোনো ভাষায়ই প্রকাশ করা সম্ভব না।শুধু অনুভব করা সম্ভব।হঠাৎ নিতুর ঠোঁটের দিকে চোখ পড়ে আমার।শুষ্ক গোলাপি ঠোঁট জোড়া ব্যাপকভাবে কাছে টানতে থাকে।নিজেকে সংবরণ করতে আমি টুল থেকে উঠে সামান্য ঝুকে ওর কপালে ছোট করে চুমু আঁকি।ওর এক হাত নিজের দু হাতের মুঠোই নিয়ে আবার টুলে বসি।নিতুর চোখের পাতা সামান্য নড়ে উঠে।পিটপিট করে আমার দিকে তাকায় সে।মুহুর্তেই তার চোখ জলে ভরে যায়।প্রচন্ড অভিমানে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে।নিস্তেজ শরীরে যতটুকু শক্তি আছে ততটুকু দিয়েই চেষ্টা করে আমার হাতের মুঠোয় থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে।আমি সমস্ত আবেগ নিয়ে তাকে লাগাতার সরি বলতে থাকি।সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

– ছাঁড়ুন আমার হাত!কেনো এসেছেন এখানে?কি দেখতে এসেছেন?আমি মরে গেছি কিনা?দেখা হয়েছে?
আমার চোখে জল জমতে শুরু করে।গলা ধরে আসে।বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হয়।ধরা গলায় বলি,

– আমার নিজের দুনিয়াটাও যদি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আমি কার কাছে যাবো?কার দুয়ারে গিয়ে দঁড়াবো আমি?আমার যে নিজস্ব আর কোনো দুনিয়া নেই।যে দুনিয়াকে আমি আমার বলতে পারি।আমি যে বড়ই অভাগা এক…….!
সে আমার দিকে ফিরে তাকায়।আমার পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই সে বলে,

– একদম আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবে না!তুমি খুব খারাপ মানুষ!খুব খারাপ!পাশুন্ড তুমি!আমাকে কষ্ট দিতে তুমি দুবারও ভাবো না।নাহলে তুমি পারতে না আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে।কখনোই পারতে না।তুমি একটা……..!
নিতু শেষের কথাগুলোর দিকে প্রায় শব্দ করে কেঁদে উঠে।আমি কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে হাত দিয়ে ওর মুখ চেঁপে ধরি!
বলি,

– কেঁদো না মেয়ে।তোমার চোখের জল যে আমার বুকে রক্তক্ষরণ করে।কষ্ট হয় আমার।এরপর থেকে আমি তোমার সব কথা শুনবো,দেখো।ঠিক তোমার কল্পনার রাজ্যের মতোই আমাদের একটা ছোট সংসার হবে।ছোট একটা পরিবার হবে।সেই পরিবারের কর্তা-কর্তী হবো আমরা।তারপর যখন আমরা বুড়ো-বুড়ী হয়ে যাবো,তখন আমরা দু’জনে বেলকনিতে গিয়ে বসবো একসাথে চাদর মুড়ি দিয়ে।গাছের ঢালের ফাঁক দিয়ে চাঁদটাকে দেখতে দেখতে আমি তোমায় বলবো,”তুমি কি জানো, আমার কাছেও একটা চাঁদ আছে!যে চাঁদটা ঐ দূর আকাশের চাঁদের থেকেও বেশি জোঁসনা ছড়ায়।তখন তুমি কপাল খানিকটা ভাঁজ করে আমার দিকে তাকাবে।আমার কথার তাৎপর্য বুঝার পরক্ষনেই কিছুটা লজ্জায় লাল হয়ে বলবে,”বুড়ো বয়সেও রঙ, ঢং গেলো না তোমার।

জোঁসনাবিলাস করতে করতে যখন তুমি আমার বুকের উপরই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বে,তখন আমি চাঁদের আলোয় তোমায় সেই ১৯ বছরের কিশোরী হিসেবে আবিষ্কার করবো।একসময় তোমাকে দেখতে দেখতে আমিও ঘুমের রাজ্যে পারি জমাবো।আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে আমাদের জীবন থেকে আরো একটি জোঁসনারাত ফুরিয়ে যাবে।

নিতু আমার দিকে গভীর চাহনিতে তাকিয়ে থাকে।আহা,কত দরদ নিয়েই না তাকায় মেয়েটা মাঝেমাঝে।আমার কথায় ভরসা খুঁজে পায় সে!তার চোখ আবারো জলে ভরে উঠে।তিব্র আনন্দের জোয়ারের জলে।হঠাৎ আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে।
বলি,

– তাছাড়া ভেবে দেখলাম।তোমার দায়িত্ব নেওয়া এ আর এমন কি!তুমি তো আর কোনো রাক্ষসী,বা রাক্ষস,খক্ষস ধর্মী মেয়ে নও যে, তোমাকে খাওয়াতে পড়াতে আমার রক্ত, কিডনি পর্যন্ত বেঁচতে হতে পারে।অবশ্য তোমার বাপকে দেখলে আমার মনে যে এ নিয়ে কিছুটা সন্দেহ জাঁগে না তা কিন্তু নয়।
এ কথা শুনে নিতু আমার দিকে কপট রাগ নিয়ে তাকায়।
বলে,

– একদম বাজে কথা বলবে না।নাহলে কিন্তুু তোমার কপালে সত্যিই খারাপ আছে বলে রাখলাম!আমাকে আগে সুস্থ হতে দাও,আমাদের বিয়েটা হোক একবার।এরপর তোমাকে মানুষ করতে আমার খুব বেশি সময় লাগবে না!
আমি চুপচাপ তার শাসন শুনি।মনে মনে বলি,”মেয়ে!আমি আমার বাম পাঁজরের হাড় কে পেয়ে গেছি।এবার যে আমায় সত্যিই মানুষ হতে হবে”।অদ্ভুত,কুৎসিত, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর মানুষ নয়।সহজ, সরজ, সাদাসিধে সংসারী মানুষ।যে মানুষকে প্রতিটা নারীই স্বামী হিসেবে কাম্য করে!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত