জীবনে মাঝেমাঝে এমন কিছু ঘটে যা একেবারে ভাবনার বাইরে। এই যেমন ফোনে মায়ের কাছে খবর টা শুনে সোহাগ এখনো নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এটাই বোধহয় কঠিন বাস্তব । তুমি যখন আশায় পথ চেয়ে থাকবে তখন কিছুতেই কিছু হবে না। আর যখন সব আশা শেষ ভাববে তখনই মিরাকেল কিছু ঘটে যাবে ।
দু বছর আগে সোহাগ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে ছিল। লেখা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। ইন্টারভিউ দিল। সেটা ও মোটামুটি হয়েছিল ।তারপর কত অপেক্ষা করেছে । নাহ্ কোন খবর আসেনি। ছোটবেলা থেকে এই একটা স্বপ্ন কে সোহাগ আঁকড়ে ধরে রেখেছে । যে ভাবেই হোক তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । এ ব্যাপারে বাবা মায়ের সমর্থন ও পেয়ে ছিল সে। আর আজ সুখবর টা যখন এল তখন জীবন টাই তার পাল্টে গেছে।
ইন্টারভিউর পর দেড় বছর কেটে গেল। রেজাল্ট বেরলো না। পরীক্ষার ব্যাপার টাই সকলের মাথা থেকে মুছে গিয়েছিল ।এর মধ্যে সোহাগের দিদি সোহাগের জন্য দারুণ সম্বন্ধ নিয়ে হাজির। পাত্র জামাই বাবুর বিশেষ বন্ধু শমীকদার নিজের ভাই। এয়ারফোর্স ইঞ্জিনিয়ার চন্ডীগড়ে পোস্টিং । চেনাশোনা শিক্ষিত পরিবার।বাড়ির সবাই যেন হাতে চাঁদ পেল। এক দেখাতেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল সোহাগের। রৌনকের দীর্ঘ সুঠাম চেহারা আর আন্তরিক কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়েছিল সোহাগ। শুধু একটা বিষয়ে সোহাগের আপত্তি ছিল। যেটার জন্য কিছুতেই এই বিয়ে তে রাজি ছিল না সে। তা হল তাকে কলকাতার বাইরে থাকতে হবে।তার স্বপ্ন তার কেরিয়ারের কি হবে। কিন্তু তার কথায় কেউ কোন পাত্তা দিল না।
বাবা বলেলেন,
“তোমাকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া হল। টানা তিন বছর চাকরির পরীক্ষার কোচিং নিলে। কিন্তু কি হল? আজ একটা সরকারী চাকরি যদি পেয়ে যেতে তাহলে কি আর ছাড়তে বলতাম।”
বাবার কথার অকাট্য যুক্তি ছিল।সত্যি তো টানা তিন বছর ধরে কত পরীক্ষা তো সে দিল।কিন্তু কি হল? যদিও একটা পরীক্ষার রেজাল্ট তো এখনও বাকি। কিন্তু সে কথা বলতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল।এত পরীক্ষায় কিছু হল না আর ওটাতেই হবে।
দিদি বলল ,
“তুই এত বোকা কেন রে বোন।এয়ারফোর্সের সুযোগ সুবিধা জানিস।আর চণ্ডীগড় আহা ছবির মতো সাজানো শহর । কলকাতায় থেকে কি লাভ? তাছাড়া তোর চাকরি করার দরকার টাই বা কি? রানীর মতো থাকবি। এমন ছেলে আর পাওয়া যাবেনা। ওরা যে এক কথায় রাজি হয়েছে এই কত ।নেহাত তোর জামাই বাবুর বন্ধুর ভাই নাহলে__”
দিদির সাথে সোহাগের মানসিকতা কোন দিনই মেলে না। দিদির নিজের কোন উচ্চাশা কোন দিনই ছিল না। সারাক্ষণ শুধু বর আর সংসার । বিয়ে পাশ করেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল । আর এখন দুই ছেলে মেয়ের মা হয়ে ত্রিরিশের আগেই পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে । সোহাগের বিয়ে নিয়ে ওর মাথাব্যথা সব থেকে বেশি । আর পাত্র টা জোগাড় করেছে বলে বিয়ের তাড়াটাও যেন সব থেকে বেশি।
সোহাগ জানে এ বাড়ি তে একমাত্র মা তার মনের অবস্থা কিছু টা বুঝবে। মা কে বুঝিয়ে বলল বিয়েতে তার আপত্তি নেই কিন্তু এখনই নয়। আরও একটা বছর সময় দিতে হবে।
রৌনকদের বাড়ি তে জানানো হল।কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি নয়।রৌনকের মা বললেন ,
“দেখুন নেহাত সামনে বর্ষা কাল তাই বিয়েটা পিছতে হচ্ছে । অঘ্রানের প্রথম লগ্নেই বিয়েটা দিতে চাই। ছেলে ওখানে একদম একা থাকে।সবসময় খুব চিন্তায় থাকি।বিয়েটা হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত হই।তাছাড়া সবাই যখন রাজি দেরি করার দরকার কি?”
সোহাগের মা বলার চেষ্টা করেছিলেন,
“দেখুন সোহাগের একটা চাকরির পরীক্ষায় ইন্টারভিউ হয়ে গেছে।যদি রেজাল্ট টা বেরোতো।”
রৌনকের মা রাগের সাথে বললেন,
“মানে আপনার মেয়ে মনস্থির করতে পারছেনা?তাহলে তো ভালো হয় বিয়ে টা না হলেই । ঠিক আছে আমি রৌনকের বাবার সাথে কথা বলছি।”
এরপর এক প্রবল ঝড় বয়ে গিয়েছিল বাড়ি তে। বিয়ে একপ্রকার ভেঙেই গেল। বাবা আর দিদি বাড়ি তে ভয়ঙ্কর অশান্তি শুরু করলো। জামাইবাবু এ ঘটনার জন্য শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক তুলে দেবে ঘোষনা করে দিল।শেষে পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে মা তখন বোঝালেন সোহাগ কে যে এই একটা রেজাল্টের জন্য এমন অপেক্ষা করার কোন মানেই হয় না। সরকারী পরীক্ষার কোন নিশ্চয়তা থাকে না ।
সব ঝড় থেমে গিয়ে অঘ্রানের প্রথম লগ্নে রৌনকের সাথে সোহাগের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের কয়েক দিন পর সবাই কে বিদায় জানিয়ে রৌনকের সাথে সোহাগ চলে এল চণ্ডীগড় ।শুরু হল তাদের নতুন জীবন। বড় সুন্দর চন্ডীগড় শহর টা । এয়ারফোর্স কলোনিতে সাজানো কোয়ার্টার । আর সবথেকে বড় যা সোহাগ পেল তা হল রৌনকের মত সহানুভূতিশীল স্বামী যাকে কোন কথা মুখ ফুটে বলতেই হয় না। স্বপ্নের মত কাটতে লাগল দিন গুলো।শুধু কোন কোন নির্জন দুপুরে সোহাগের মনে হয় সেও কি তাহলে তার দিদির মতোই শুধু সংসার করে জীবন টা কাটিয়ে দেবে।গৃহবধূর তকমাই তাহলে শেষ পর্যন্ত তার কপালেও বরাদ্দ হল। তিন বছর ধরে একটানা ঘাড় গুঁজে পড়াশোনা যে স্বপ্নের দিকে চেয়ে সেসব অধ্যায় কি একেবারেই মুছে গেল।
কিন্তু বিয়ের ছমাসের পর আজ মায়ের এই ফোন টা যেন আজ সবকিছু কে নাড়িয়ে দিল। মা জানালেন বাড়িতে চিঠি এসেছে চাকরি টা সোহাগের হয়ে গেছে। শুধু একটা মেডিকেল টেস্ট হবে। অপ্রত্যাশিত এই খবরে সোহাগের আনন্দে সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কতদিনের কত পরিশ্রম আজ তার সফল হল। এখনই রৌনক কে সবটা জানতে হবে। কিন্তু ফোন টা হাতে নিয়ে সোহাগের হুঁশ ফেরে, কি বলবে সে রৌনক কে ।এই স্বপ্নের সংসার এই কোয়ার্টার বালিস বিছানা রান্না ঘর বারান্দার একফালি বাগান যেখানে সবে গোলাপ কুঁড়ি ধরেছে সব ফেলে সে একা ফিরে যাবে কলকাতায়।আর রৌনক সে যে তার মনের সবটুকুর দখল নিয়ে বসে আছে।তাকে ফেলেই বা যায় কি করে।
মুহূর্তে এক চরম দোটানায় পড়ে যায় সোহাগ।কি করা উচিত বুঝতে পারছে না।একবার রৌনক কেই ব্যাপার টা জানতে হবে ।ও যদি কোন উপায় বলতে পারে।এই ভেবে রৌনক কে ফোন করে সে।ফোন ধরেই রৌনক বলল,
“কি ম্যাডাম আর তর সইছে না তো।রেজাল্ট কিন্তু হাতে এসে গেছে ।আমি এখনই বাড়ি আসছি ।”
“রেজাল্ট ?কিসের? “একরাশ বিস্ময় সোহাগের গলায় ।
“সে কি ভুলে গেলে।ইউরিন রির্পোটার কথা বলছি।”
কিছুক্ষণের জন্য সত্যিই একদম ভুলে গেছিল সোহাগ । একটু সন্দেহ হওয়ায় কাল তার ইউরিন টেস্ট হয়েছে । আজ রির্পোট পাওয়া যাবে ।একটু লজ্জার সাথে সে বলল,
“কি রেজাল্ট এসে গেছে । ”
“উঁহু এবার কেন?ভাব দেখালে তো ভুলেই গেছো।”
“আচ্ছা সরি, বলো না পজিটিভ নাকি নেগেটিভ?”
“এখনই বাড়ি আসছি ম্যাডাম ।এসব কি আর ফোনে বলা যায় ।”
একরাশ কৌতুহলে সোহাগ ফেটে পড়ে।কাতর হয়ে বলল,
“বলো না প্লিজ? ”
“আচ্ছা আচ্ছা বলছি। ম্যাডাম আপনি মা হতে চলেছেন আর আমি বাবা। উফ্ আমি ভাবতে পারছি না।ফোন টা এখন রাখো।আমি এখুনি আসছি।”
এক অপার্থিব ভালো লাগায় ভেসে যায় সোহাগ । তার দুকূল ছাপানো আবেগে মুছে যেতে থাকে সব সংশয় । তার এখন দুহাতে প্রানপনে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে এই ছোট্ট সংসার টা কে।
নতুন প্রানের সঞ্চারে সোহাগের মধ্যে জন্ম হল এক মায়ের যে অবলীলায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে নিজের সব স্বপ্ন কে। অলক্ষ্যে বিধাতা পুরুষ হাসলেন । সত্যি এই মায়াজাল থেকে কোনদিন মুক্তি নেই মেয়েদের ।