“জার্নি বাই ট্রেন”
– মুর্তজা সাদ
ব্যাগটা জায়গামত রেখেই সিটমত বসে পড়ল রাতুল।জানালা দিয়ে একবার বাইরে দেখে নিল;চারপাশটা কেমন যেন সবুজে ছাওয়া।এখন ইট-পাথরের মাঝে এমনটা দেখা যাওয়া বিরলই বটে। পাশে এক বুড়ো বসেছেন,হাতে পত্রিকা। স্বাভাবিক বুড়োর সাথে তার পার্থক্য বয়সটাকে পাত্তা না দেয়ার একটা প্রকাশ্য ইচ্ছা তার মাঝে। সাদা চুলগুলোকে কাল রঙ লাগিয়ে,পাঞ্জাবী পায়জামার বদলে টিশার্ট আর জিন্সে মানাচ্ছেও বটে-স্মার্ট গাই।
“যাবে কোথায়?”বুড়ো বলে ওঠে।
জায়গার নাম বলে রাতুল।
“দেরি বটে।”ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন বুড়ো।”কিন্তু ওখানে যাবে কেন?”
রাতুল মৃদু হাসি দেয়,কিছুটা লাজুক হাসি।
বুড়ো হেসে ওঠেন।”বুঝি বুঝি ইয়ং ম্যান।একটা সময় আমিও তোমার মতই ছিলাম।লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”
হুইসেল বেজে ওঠে।ট্রেন চলা শুরু করে।বুড়ো পত্রিকার দিকে নজর দেন,রাতুল জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।গাছপালা,মানুষ কিংবা ঘরবাড়ি-সব যেন পেছন দিকে দ্রুতগতিতে সরে যাচ্ছে,ঠিক চারটা বছর সময়ের মত।
সূচনার সাথে রাতুলের প্রথম কথা ভার্সিটি লাইফের প্রথম পরীক্ষার সময়।মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে খুব টেনশনে ছিল;পরীক্ষা শুরুর আগে ব্যাগ হাতড়ে বেরাচ্ছিল এক নাগাড়ে।রাতুল হা করে সেই দৃশ্য দেখছিল;ঠিক কি কারণে জানা নেই তার।
“হা করে দেখছিস কি?”মেয়েটি বলে ওঠে।
প্রথম বাক্য বিনিময়ে তুই শুনে কিছুটা হতচকিত হয়ে যায় রাতুল।
“কিছু না।”
“বাড়তি কলম আছে?”
মাথা নেড়ে সায় দেয় রাতুল।
“দে তো।”
পকেট থেকে রাতুল কলমটা এগিয়ে দেয় তাকে।তিন ঘন্টার পরীক্ষা শেষ হয়,সবাই বেরিয়ে যায়।মেয়েটি সব বাধা ডিঙিয়ে রাতুলের দিকে।
“থ্যাংকস দোস্ত।বাড়তি কলমটা না দিলে…”
“থ্যাংক্স দেয়ার কিছু নেই।কিছু পারতাম না,তাই পকেটের কলমটা দিয়ে দিলাম।পারলে দিতাম না।নাম কি তোর?”
কেমন যেন থতমত খেয়ে যায় মেয়েটা।”সূচনা।”
“আমি রাতুল।”বিদঘুটে একটা হাসি দেয় রাতুল।সিস ফুঁকতে ফুঁকতে চলে যায় উদ্দেশ্যহীন কোথাও,পেছনে দাঁড়িয়ে রয় সূচনা।
মেয়েটি ভালোবাসত বই পড়তে,ভালোবাসার বই;আর ছেলেটার মতে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই,সবই মিডিয়ার সৃষ্টি।
“উল্টা হয়ে কি দেখিস?”সূচনা বলে ওঠে।
“কি পড়িস তা দেখি।”রাতুল বলে ওঠে।
“দেখতে হবে না,যা তো।”
“ওহো,লাভ স্টোরী।তাই তো এমন রোমান্টিক ছবি কেন দেয়া।”
“হ্যা পড়ি,তোর কি?যা তো।”বইটা ব্যাগের নিচে লুকিয়ে বলে ওঠে সূচনা।
“তোরা এমন আজাইরা কেন রে?”
“কেন!”
“যার বাস্তব অস্তিত্বই নেই,তা নিয়ে কেন মেতে থাকিস?”
“কে বলেছে?”
“আমি বললাম।”
“যেদিন প্রেমে পড়বি সেদিন বুঝবি।”
রাতুল হেসে ওঠে,কুৎসিত হাসি।”প্রেম না কচু,সব সময় কাটানোর ধান্দা।”
সূচনা কিছু বলে না,মুখটা বাঁকিয়ে উঠে চলে যায়।
“দেখেছিস আমার চুলগুলো অনেক লম্বা হয়েছে।”
রাতুল একবার তাকায়।”ভাল তো।”
“তুই সেদিন বলছিলি না নীলার চুলগুলো অনেক লম্বা।তাই ভাবছি আর চুলগুলো আর কাটব না।”
অবাক হয় রাতুল।”আমি বললেই বড় রাখবি!নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেই?”
“না,নেই।”
“যত্তসব পা চাটা পাবলিক।”
সূচনা কিছু বলে না। কালো আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমে আসে।দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে সূচনা।”কি রে,তোর ছাতা কই?”
“নাই।”জবাব দেয় রাতুল।
“নে ধর।তোর না কিছুদিন আগেই জ্বর হল,শরীর খারাপ করবে।”ছাতাটা এগিয়ে দেয় রাতুলের দিকে।রাতুল ছাতাটা নিয়ে এগিয়ে যায়,পেছনে ভিজতে থাকে সূচনা।
“দোস্ত,একটা হেল্প করবি?প্লিজ?”
“কি বলবি বল?”বই থেকে নজর না সরিয়েই সূচনা বলে ওঠে।
“কাল মায়ের জন্মদিন।”
“তো?”
“কি গিফট দেব?”
সূচনা একবার রাতুলের দিকে তাকিয়ে কি যেন পরীক্ষা করে।”পেয়েছি।”
পরদিন বিকালে রাতুলের সাথে সূচনার আবার দেখা হয়।
“আন্টির ভাল লেগেছে?”
“ভাল লেগেছে কিনা জানি না।জড়িয়ে ধরে অনেকগুলা চুমু দিতে দিতে বলে উঠলো,বাপটারে আল্লাহ কত সুন্দর বানাইসে;একটা ভাল বউ জুটায়ে দিও।নাইলে পাগলটারে কে দেখবে?”
সূচনা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
“হাসিস কেন?”
“আমার মন চায়,তাই।”
“ও আচ্ছা।”
“আন্টি কিন্তু একটা কথা ঠিক বলেছে।”
“কি?”
“ক্লিন সেভ আর ভদ্র হেয়ার কাটিংয়ে তোকে আসলেও ভাল লাগে।মাঝে মাঝে কারো ভালো লাগা আর ভাল থাকার কারণ হবি।শরীর ভাল থাকবি।”
“মানে?”
“মানে কিছু না।তুই থাক,আমি আসি।”
সূচনা উঠে চলে যায়,পেছনে থেকে যায় ভাবনায় মগ্ন রাতুল।
দেখতে দেখতে চারটা বছর শেষ হয়ে আসে।সূচনার সাথে রাতুলের শেষবার দেখা হয়।
“ভাল থাকিস আর বড় হবার চেষ্টা করিস।”
রাতুল মাথা নেড়ে সায় দেয়।সূচনা ধীর পায়ে চলে যায়;চোখের অশ্রুগুলো থেকে যায় সবার কাছে গোপনীয়।
কেন যেন সব এলোমেলো হয়ে যায় রাতুলের।যে দিনটার শুরু হত সূচনার সাধারণ একটা মোবাইল কল আর গুড মর্নিং দিয়ে,সে জীবনটা কেন যেন বারবার তার মনে পড়তে থাকে।বুঝতে পারে সাধারণ চাকরীর জন্যে কোন মোজাটা পরবে তাও সে সিলেক্ট করতে পারে না।
“মা…”
“কি রে?”হাতের বই থেকে চোখ উঠিয়ে রোকেয়া বেগম বলে ওঠেন।
“প্রেম কি?”
বইটা বন্ধ করে ছেলের দিকে এগিয়ে আসেন রোকেয়া বেগম।