নারী যখন একজন মা
বৃষ্টিতে ভিজে না এলেই পারতিসএবার জ্বরে পড়বি আর আমার যত জ্বালা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস কবে যে বুদ্ধি হবে তোর অনেক রাত হল এবার খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর দেখি সারাবছর পড়িস না আর পরীক্ষার আগে যত পড়াশোনা আমার শরীরটা ভাল নেই চিকেনটা তুই খেয়ে নে আইসক্রিম খেলে আমার গলা ব্যাথা হয় তুই খেয়ে নে অনেক রাত হল এবার শুয়ে পড় নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিস বিদেশে যাচ্ছিস যা তবে মেমদের সাথে প্রেম করিস না যেন আমি তোর জন্যে একটা মেয়ে পছন্দ করেছি ছবি দেখে তোর মতামত জানা কলেজে ঝামেলা করে এসেছিস নাকি আবার? আমি না থাকলে বুঝবি মায়ের মর্ম মেয়েটা কে শুনি? আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিস পড়াশোনার নামগন্ধ নেই তোর বাবা আসুক আজ আমার দিব্ব্যি খেয়ে বল তুই কোনও খারাপ কাজ করিসনি তোর বাবাকে ম্যানেজ করে মানিব্যাগে ১০০০ টাকা রেখেছি বন্ধুদের খাইয়ে দিস জন্মদিনে তোর কি হয়েছে বল? ৯ মাস তোকে পেটে রেখেছি তোর মন খারাপের খবর জানবো না ধুর বোকা ছেলে কাঁদছিস কেন খেলাতে তো হারজিত থাকবেই তুই খুব ভালো খেলেছিস চুপচাপ শুয়ে থাক আমি মাথায় জলপট্টি দিয়ে দি কাল কলেজ গিয়ে কাজ নেই একটু বিশ্রাম নে তুই কিছু চিন্তা করিস না পুরো দুনিয়া তোর বিরুদ্ধে গেলেও তোর মা সবসময় তোর পাশে আছে |
প্রত্যেক মায়ের কাছে তার সন্তান সুপারস্টার | আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলোকে যে সবসময় ঠিক করে দেয়,অনুপ্রেরণা দেয় সেই মা কজন সন্তানের চোখে সুপারওম্যান হাত তুলুন দেখি | সেই ছেলেটাও আজ হাত তুলেছে যে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি বেঁচে মাকে ‘ছোট্ট নীড়ের সন্ধানে’ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে বৌ ছেলেকে নিয়ে জেনেভা চলে গেছে | হাত তুলেছে সেই ছেলেটাও যে বাবার মৃত্যুর পরে মাকে খাওয়ার খোঁটা দিত প্রতিদিন | ওই ছেলেটাও হাত তুলেছে যে বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা না করে সবসময় মৃত্যুকামনা করতো | হাত তুলেছে সেই মেয়েটাও যে জীবনবিমার প্রিমিয়াম দিতে অস্বীকার করেছিল কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে প্রথমে ছুঁটেছিল জীবনবিমার অফিসে রিস্ক কভারেজের হিসেবনিকেশ জানতে | আজ এরা সবাই হাত তুলেছে কারণ আজ যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস | নিজের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করেও আজ গলা ফাটানোর দিন | আজ যে নারী দিবস আর মা যে আমাদের চোখে ‘শ্রেষ্ঠ নারী’ যার সাথে আমাদের শৈশব,কৈশোর ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আর যৌবনে মাকে বোঝা মনে করে দূরে ঠেলে দিয়ে বার্ধক্যের সময় একাকীত্বে ভুগি আমরা | শুধু নারী দিবসে মায়েদের কৃতিত্বের ধ্বজা না উড়িয়ে আসুন নিজেদের ১ বি এইচ কে ফ্ল্যাটে মায়েদের একটু জায়গা দি আমরা |
নারী যখন একজন স্ত্রী
কি হল ফোন ধরছিলে না কেন? আমার চিন্তা হয় না বুঝি আজ কি রান্না করবো বলো তো? আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করো আজ একটু শপিং এ যাবো আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী তুমি ভুলেই গেছো তুমি আর আমাকে আগের মত ভালোবাসোনা তোমার কি আমার জন্যে একটু সময় হবে? আজ দোলের দিন অফিস ছুটি নিলেই পারতে আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যাবো এই বলে দিলাম এই যে মশাই আপনি বাবা হতে চলেছেন এখন একটু সঞ্চয় করো বাবু বড় হচ্ছে অফিসে ঠিক সময়ে লাঞ্চ করে নিও তুমি অত দুশ্চিন্তা করো না আমি তো আছি আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো আমার টিউশনির টাকা জমিয়ে আজ ব্যাঙ্কে একটা এফডি করলাম তোমার কাজের চাপ যাচ্ছে আমি বাবুর পড়াশোনাটা দেখবো চলো পুজোর ছুটিতে একটু সান্দাকফু ঘুরে আসি আমার জামদানীটা লাগবে না দাদা আপনি ওই তাঁতের শাড়ীটা প্যাক করে দিন তোমার টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে আমাকে দামী পারফিউম গিফট নাই বা করলে তোমার সহধর্মিনীর কর্তব্য পালন করতে পারলেই আমি খুশি |
স্ত্রীদের চোখে তাদের স্বামী একজন আদর্শ পুরুষ কিন্তু কতজন স্বামীর চোখে তাদের স্ত্রী একজন আদর্শ মহিলা একটু বলবেন | আজ সেই পুরুষটাও কিছু বলবে যে কাল তার স্ত্রীর সাথে বর্বরোচিত আচরণ করেছে | আজ সেও কিছু বলবে যে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে বীতশ্রদ্ধ | আজ তো তার ও কিছু বলার আছে যে সিগারেটের ছ্যাঁকাতে প্রতিরাতে স্ত্রীর স্বপ্নের আহুতি দেয় | আজ যে নারী দিবস তাই সবাই নিজের সাফল্যের কৃতিত্ব তাদের স্ত্রীদের দেবেন | এটা তো স্ত্রীদের ব্যর্থতা বাকি ৩৬৪ দিন তারা স্বামীদের চোখে একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে উঠতে পারেন না,তাই না?আজ আপনি আপনার স্ত্রীর অবদানগুলো স্মরণ করুন,স্লোগানে এইগুলো আজ হেব্বি খাবে পাবলিক | তারপর আবার বাড়ি ফিরে ৯ই মার্চ কোমরের বেল্টটা খুলুন স্ত্রীর উদ্ধত মনোভাবকে শাসন করতে আর সিগারেটের জ্বলন্ত অগ্নিশিখাকে সাক্ষী রাখুন স্ত্রীর গনতান্ত্রিক অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করতে | পুরো বছরটাই নারী দিবস হতে পারে যদি একটু সবাই মিলে স্ত্রীদের পরিপূরক বলে ভাবতে শিখি | ওদের অবদানকে খর্ব না করে চলুন গর্ব করে বলি ‘প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে এখন মহিলার হাত থাকে আর সেই মহিলা হল আমার স্ত্রী’ |
নারী যখন একজন বোন
দাদা আমার জন্যে চকোলেটটা আজ ও আনতে ভুলে গেছিস? দাদা তাড়াতাড়ি ফিরিস আজ একসাথে খেতে যাবো দাদা এইবার রাখীতে আসিসনি ভাইফোঁটাতেও না এলে তোর সাথে আড় দাদা তুই বিদেশে যাচ্ছিস আমার ঝগড়া করার পার্টনারটাও গেল দাদা বাবা তোকে বেশি ভালোবাসে আমার মোবাইলে একদম হাত দিবিনা দাদা কি রে দাদা প্রেম করছিস নাকি? দাদা আমাকে স্যামসাঙ এর নতুন সেটটা কিনে দিবি প্লিজ? আর যদি আমার বিনুনি ধরে টেনেছিস তো তোর একদিন কি আমার একদিন সারাদিন পড়ে পড়ে তো ঘুমোস খালি আমাকে আজ ফুচকা খাওয়াবি তুই ম্যান ইউ জিতলে বলেছিলি ট্রিট দিবি মনে আছে তোর? ছোটবেলার মত মেলায় গিয়ে বুড়িমার পাকা চুল খাবো দুজনে,কেমন দাদাভাই? মা আমার জন্যে পিৎজা এনেছিল তুই খেলি কেন? দিওয়ালীতে একসাথে বাজি ফাটাবো এত বছর পর দাদা আমার কিছু লাগবে না তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আয়
প্রত্যেক বোনের মতে তার দাদার মত দাদা হয় না কিন্তু কজন দাদার মতে তাদের বোনের মত বোন হয় না বলুন তো? যেই ছেলেটি কাল পাবে একটি অপরিচিতা মেয়েকে উত্যক্ত করেছিল সেও আজ বোনের চোখে সেরা দাদা | যেই ছেলেটি কলেজ রাজনীতিতে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পরে মাথা গরম করে প্রতিপক্ষের ছেলেটিকে(পড়ুন অন্য কোনও বোনের ভাই) মেরেছিল সেও আজ বোনের কাছে ভালো দাদা | যেই ছেলেটি কাল কর্মস্থানে মহিলা কলিগকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল সেও আজ বোনের চোখে বেস্ট ব্রো | আজ যে নারী দিবস | গুডি গুডি ইমেজটা মেইনটেন করা আজ ভীষণ জরুরী – ওটা আজ নেসেসিটি(লাক্সারি নয় মোটেও) | নারী দিবসের দিনে যদি প্রত্যেক ভাই শপথ নিতে পারে আর আনাড়ির মত অন্যের বোনকে উত্যক্ত করবে না সেদিন হবে নারী দিবসের আসল সার্থকতা |
নারী যখন একজন প্রেমিকা
তোর ফ্রেঞ্চকাটওয়ালা ডিপিটা দে প্লিজ ওটাই তোকে ব্যাপক লাগে তুই আজ মানি স্কোয়ারে একটু দেখা করতে পারবি? আজ কলেজ বাঙ্ক করলে কেমন হয় রে? তুই না একটা ভিতুর ডিম তুই আমার বাবাকে এই কথাটা বলতে পারবি? তোর ওপর বিশ্বাস আছে আজ শরীর খারাপ নিয়ে তোর আসতে হবেনা রেস্ট নে বাবু,সারাদিন পরিশ্রম করলে হবে বল? একটু মন দিয়ে পড়াশোনা কর দুজনের চাকরিটা হয়ে গেলে তারপর জীবনে একসাথে পথ চলার সিদ্ধান্তটা নিতে পারবো তুই আবার ওইসব ছাইপাশ খাচ্ছিস? আজ আমাকে ছুঁয়ে একটা কথা দিবি? আমাদের ভ্যালেন্টাইন্স ডে হয়তো নেই তবে আমাদের জন্যে প্রতিদিন ভালোবাসা দিবস আমার জন্যে মা বাবা সম্বন্ধ দেখছে প্লিজ কিছু একটা কর তুই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে আমাকে ভুলে যাবি না তো? আমি তোর সাথে বুড়ি হতে চাই |
প্রত্যেক প্রেমিকার কাছে তাদের প্রেমিক একসাথে পথ চলার সাথী কিন্তু কজন প্রেমিকের কাছে উল্টোটাও বাস্তব? কি বলেছেন ‘হাইলি সাসপিসিয়াস’? তবে আজ নারী দিবস | সব প্রেমিক আজ একজোটে নারী স্বাধীনতার প্রসঙ্গ তুলবেন | সেই প্রেমিক আজ গলা ফাটাবেন যে নিজের প্রেমিকার ন্যুড ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেল করেছিল,সেই প্রেমিক ও আজ স্লোগান দেবে যে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করেছিল,সেই প্রেমিক আজ নারীদের পাশে যে অ্যাসিড অ্যাটাক তরুণীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল | প্রতিটি নারী যখন তাদের যোগ্য প্রেমিক পেয়ে যাবে সেদিন আলাদা করে আর নারী দিবসের প্রয়োজন হবে না |
৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘হ্যাপি ওমেন্স ডে’ গ্রিট না করে চলুন বছরের বাকিদিনগুলোকেও নারীদের বসবাসের বাসযোগ্য করে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করি সবাই | অধিকারের জন্যে লড়াই নয় বরং বড়াই করুক সবাই – কখনও মায়ের রূপে,কখনও স্ত্রীর রূপে,কখনও বা বোনের রূপে আবার কখনও বা প্রেমিকার রূপে |
(সমাপ্ত)