দরজা খুলল ঊনিশ-কুঁড়ি বছরের মাঝারি গড়নের এক তরুনী।কোঁকড়া চুল চোখ-মুখ ফোলা ফোলা।সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। পরনের আকাশী রঙের কামিজে ছোট ছোট হলুদ ফুল। সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কাকে চাই? কিছু বলবেন? জামাল সাহেব হাসলেন,
-নীতু,চিনতে পারিস নি? আমি তোর ছোটমামা।মা ছোট মামা এসেছেন চিৎকার করে নীতু ঝপ করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
-আরে করিস কি! তোর মা কোথায়?
-মা পরীক্ষার খাতা দেখছেন। আপনি তো পুরো ভিজে গেছেন।
-ও কিছু না।তুই একটা গামছা দে।ও ঘর থেকে মা ডাকল,
-নীতু, তোর মামাকে এঘরে এসে বসতে বল।
জুতা-মোজা খুলে জামাল সাহেব বোনের ঘরে প্রবেশ করলেন। দেয়ালের সাথে চৌকি পাতা, তার সাথে লাগোয়া পড়ার টেবিল, লোহার আলনা একপাশে ওয়্যারড্রোব।ফার ্নিচার গুলো এত পুরানো যে দৈন্যতার ছাপ স্পষ্ট।তবু সবকিছু খু্ব পরিপাটি। নিপুণ হাতে কেউ একজন মধ্যবিত্তের ছায়া ধরে রেখেছে। আপা বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে খাতা দেখছিলেন। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলেন।
-এই খানটায় বস।এই বৃষ্টির মাঝে কোথা থেকে আসলি?
-অফিসের কাজে এখানে আসছিলাম।ভাবলামতোমার সাথে দেখা করে যাই।
-তাই বল।নয়ত আমার কথা তোদের কারো মনে আছে নাকি?
-বাবু কোথায়?
-কই আবার! কোথাও বন্ধুদের সাথে নেশাভাঙ করছে।
তুই আছিস কেমন? কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে জামাল সাহেব আপাকে দেখতে লাগলেন।বিয়ের সময়গোলগাল ছিলেন,টকটকে ফর্সা রঙ। মেদ ঝরে গায়ের হাড় ক’টা গোণা যাবে এখন।গালে মেস্তার দাগ।
-চশমা নিলে কবে?
-চশমা! আপা মৃদু হাসলেন।
-বাম পাশের চোখে ছানি পরে কিছু দেখি না।অপারেশন করার টাকা কোথায়! চশমাই ভরসা।তোর বউ কেমন আছে?
-ভালো.. পাশের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ।
-কাঁদে কে আপা?
-নিপার ছেলে। ঘুম থেকে উঠলে ট্যাও ট্যাও শুরু করে।
বেহায়া মেয়ে দুই বছর স্বামীর ঘর করতে পারল না।ছেলে সহ আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে।এতবড় সংসার আমি সামলাই কি করে! স্কুলের চাকরিটা না থাকলে গোষ্ঠীসহ না খেয়ে মরতে হত। আপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
-তোরা কেমন আছিস?
-আছি।এই আর কি!
জামাল সাহেব নিজের কথা ভাবতে লাগলেন।তার মোটা অঙ্কের স্যালারির পাশাপাশি মাস শেষে তার স্ত্রী সীমার স্যালারি যুক্ত হয়। ছেলের ভার্সিটির সেমিস্টার ফি, মেয়ের স্কুলে খরচ, থাকা খাওয়ায় অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে যায়। মেয়েটা বড় হচ্ছে ওর জন্যে কিছু জমানো হচ্ছে না, সোফাসেট পুরানো হয়ে গেছে, মাইক্রোওভেন না কিনলেই নয় ইত্যাদি কারনে সংসারে খিঁটিমিটি লেগেই আছে।কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রীর হাল ফ্যাশনের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ না হলে কলেজে মান থাকে না। ছেলের ছয়মাস পর পর ফোনসেট না পাল্টালে বন্ধুদের সামনে মুখ দেখাতে লজ্জা হয়।জীবন প্রতিক্ষেত্রে চাহিদা নির্ভর। নীতু এসে টেবিলের বইপত্র সরিয়ে জায়গা করে খাবার প্লেট, গ্লাস ভর্তি পানি রাখল। “আপা আমি খেয়ে এসেছি ” এ অজুহাত টিকল না। বিকাল সাড়ে চারটায় জামাল সাহেব খেতে বসলেন। আলু ভাজি, বেগুন দিয়ে পুঁটি মাছের তরকারী,মাষকলাইয়ের ডাল।
-নীতু, তোর মামাকে একটা ডিম ভেজে দে।
-ডিম ভাজা লাগবে না।
-জামাল, তোর মনে আছে ছোটবেলায় ডিম ভাজা তোর কত প্রিয় ছিল? হ্যা।মনে আছে। বড় সংসার। চার ভাইবোন।মা পেঁয়াজ,মরিচ দিয়ে বড় করে ডিম ভেজে চার ভাইবোনকে ভাগ করে দিত। প্লেটে এক কোণায় ডিম ভাজা দেখে জামাল সাহেবের মন ভরত না। বড় আপা মেজ,সেজকে লুকিয়ে নিজের প্লেটের ডিমটুকু তার পাতে তুলে দিত। মেট্টিক পরীক্ষার দিবে ফর্ম ফিলাপের টাকা কই! বাবা এতবড় সংসার সামলাতে হিমসিম। দুলাভাই হাতঘড়ি খুলে দিয়ে বলেছিলেন,
-বিয়ের উপহার।শালাবাবু চাকরি পেলে যেন আমার উপহার ফেরত পাই। সে উপহার দেয়া হয় নি।দুলাভাই গত হয়েছেন বিশ বছর আগে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে জামাল সাহেবের দশটা বেজে গেল। সীমা এক পলক তাকিয়ে বলল,
– এত দেরি হল কেন?চেহারার একি অবস্থা?
-আর বলো না আজ পকেটমার হল।হারামজাদা সব টাকা নিয়ে মানিব্যাগ ফেলে গেছে।
-সেকি? কত টাকা ছিল মানিব্যাগে?
-এই পাঁচ হাজারের মত।
-সাবধানে চলাফেরা করতে পারো না? কতগুলো টাকা পকেটমার হয়ে গেল। জামাল সাহেব আপন মনে বিড়বিড় করে বললেন,
-এখন থেকে প্রায়ই পকেটমার হবে।