ক্লাস শেষ করে একটু ঘোরাঘুরি করার অভ্যাস আমার অনেকদিন থেকে।তাই যখন তখন ঘুরতে বের হয়ে পড়ি।
একবার খুব রাত হয়ে গিয়েছিলো বাসায় ফিরতে।
কোন গাড়ী রিকশা কিচ্ছু পাচ্ছিলাম না।হঠৎ ছিনতাই কারীর হাতে পড়ে সব হারাতে হলো।তারপর এক রিকশাওয়ালা আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলো।
আমার মুখে এসব শুনে বললো,,, এই এলাকা ভালো না।
কেন আসছি জিজ্ঞেস করলো?বললাম একটু কাজ ছিলো।
সেদিন ওনার উপকার ভুলতে পারিনি।
বয়স মোটামুটি ৪০/৪৫ বছর হবে।দেখে মনে হলো বয়সের আগেই বুড়ো হয়ে গেছে।
কি করবে অভাব অনটন এদের নিত্যসঙ্গী।
এরপর আমার সাথে ওনার আরেক বার দেখা হয়েছিলো। তখন কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেনি।
ওনি হাসি মুখে বলেন।
– কি যে কন?আপনি আমার পোলার মতন।
সেদিনের পর থেকে আমি ওনার রিকশা করে প্রায় ঘুরতাম।ওনার নাম্বার টা ছিলো আমার কাছে।যখনি আমার ঘুরতো মন চাইতো ফোন দিলে চলে আসতো।
ওনার রিকশায় চড়তাম।আর ওনার সাথে অনেক কথা হতো।
প্রত্যকটা মানুষের একেকটা জীবনের গল্প থাকে।আর খেটে খাওয়া মানুষ দের জীবনের গল্প সাধারন মানুষের গল্প থেকে একটু ভিন্ন হয়।এদের গল্পগুলো বেশীরভাগ অপ্রকাশিত থাকে।
অভাব অনটনে জীবন থাকে জর্জরিত। দিন শেষে পরিবারের সাথে এদের মুখে যে হাসিটা ফুটে উঠে সেটাই বিশুদ্ধ হাসি। অনেক টাকা পয়সায় সুখ থাকেনা।
অল্প টাকায় হয়ত জীবন চালানো কঠিন হয়।কিন্তু সুখ থাকে।
রহমান চাচা ছিলো সেই এমন একজন মানুষ।দিনরাত পরিশ্রম করতো পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে।
হয়ত সব অভাব পূরণ করতে পারে না। একদিন রিকশায় করে ঘুরছিলাম।
– চাচা মিয়া একবার বলছিলেন।আপনার নাকি একটা ছেলে আছে।ছেলেটারে কি পড়াশুনা করান?
– হ আছে।আমার পোলাডার মাথা বালা।লেহাপড়ায় বালা।
তয় আমরা গরীব মানুষ। আপনেগো মতন স্বপ্ন দেখতে ডর করে।
– কি যে বলেন।স্বপ্ন কি গরীব আর ধনী বুঝে?
– বুঝে বুঝে।
তয় ইচ্ছা আছে পোলাডারে বিরাট পাশ করামু।আপনের চাচীর ইচ্ছা পোলা যেন মাইনষের সেবা কইরতে পারে।
– চাচীরে বুঝি খুব ভালোবাসেন? খেয়াল করলাম রহমান চাচা লজ্জা পেল।আর মিটিমিট করে হাসে।
– আপনের চাচীরে যহন বিয়া কইরছি।ওই অনেক ছোড আছিলো।দেইক্ষা খুব মায়া লাগছিলো।
জানেন ওই তো ঠিকমত শাড়ীখানা পরতে পারতো না।
আমি তারে শিখাইয়া দিতাম।
কাম কাজে হাত লাগাইতাম।
গেরামের মাইনষে কইতো আমি নাকি বউ পাগলা।
আইচ্ছা আপনেই কন,,,,,টাকা পইসা না থাকলে কি বউরে ভালোবাসন যায় না।
– কে বলেছে?
গ্রাম থেকে শহরে আসলেন কেন?
– কি কমু আর গেরামে কাম কাজের অভাব।ঠিকমত পরিবার দেখবার কইরতে পারি না।
তাই চলে আইলাম।টেকার অভাবে বাপের চিকিৎসা করাইতে পারলাম না।বাপ টা মইরা গেলো।
শহরে আইসা মেলা কষ্ট করতাছি।পোলাডারে মানুষ করুম।তাইলে কষ্ট টা আমার একটু কমবো।
– ভালোই করেছেন।
– কি আর ভালা। আইসা আরও কষ্টে আছি।এহান কার সবকিছু র দাম।
ভালা ভাবে চলতে পারিনা।
আপনের চাচীরে ভালা মন্দ কিছু খাওয়াইতে পারিনা।পরাইতে পারিনা।পোলাডারে ভালা মত হাত খরচ দিবার পারিনা।
– সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনের ছেলে যখন বড় চাকুরী করবে।
সব অভাব মিটে যাবে।
– দোয়া কইরেন।
এরপর বেশ কয়দিন রহমান চাচার সাথে দেখা হয়নি।আমার সেমিস্টার পরীক্ষা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম।খোঁজও নিতে পারিনি। খেটে খাওয়ার মানুষের মনে জটিল চিন্তা থাকেনা।এরা আমাদের কটিল হয়না।যা ভাবে যা বলে সবকিছু সহজ করে। প্যাঁচগোজের ধার ধারে না।রহমান চাচা সবার চেয়ে আলাদা।রিকশা চালিয়ে নিজের পরিবার কে সুখে রাখতে চাশ।নিজের কষ্ট কখনো অন্যকে বুঝতে দেয় না।
এমনটাই সবার হওয়া উচিত।
– আরে চাচা আপনি এখানে।ভাড়া নিয়ে আসছেন?
– না। আপনে ভালো আছেন?
– জ্বি।আমার পরীক্ষা ছিলো।তাই আপনার খবর নিতে পারিনি।
ভাড়া নিয়ে না আসলে কি জন্য আসছেন?
কোন আত্মীয় কে দেখতে আসছেন? মেডিকেল এ ভর্তি আছে?
– জ্বে না।
– তাহলে? চুপ কেন?
– আমার পোলাডায় এইখান টায় লেহাপড়া করে।
– তার মানে আপনার ছেলে ডাক্তারি পড়ে?
– জ্বে।
– আপনি তো আমাকে কখনো বলেন নি।
আর আমিও জানতে চাইনি।
– পোলাডার মাথা ভালা।আপনের চাচীর ইচ্ছা।পোলাডা মাইনষের সেবা কইরবে।
– খুব খুশি হলাম।
তাই তো আপনার এতো পরিশ্রম। এটা কখনো বৃথা যাবে না।
– আইজা পোলাডার পরীক্ষা।
আমি তো মূক্কু সুক্কু মানুষ। ওতো কিছু বুঝি না।তয় মেলা টাকা লাগতাছে।
আমি আর আপনের চাচী একবেলা খাই আরেক বেলা না খাই থাহি।পোলাডার লাই মাঝে মইধ্যে খারাপ লাগে।
ভালা কিছু দিবার পারি না।
– কে বলেছে ভালো কিছু দিতে পারেন না?
ওকে যে ডাক্তার বানাচ্ছেন এটাও তো অনেক বড়।
– আমাগো একখান ছোড ম্যাইয়া আছিলো।
ছোড থাকতে কঠিন রোগ হইছে।টেকার অভাবে তারে বালা চিকিৎসা করাইতে পারি নাই।ছোড ম্যাইয়াডা মইরা গেলো চোক্ষের সামনে।কিচ্ছু করবার পারি নাই।
তাই পোলাডারে কইছে বড় পাশ দিয়া মাইনষের সেবা কইরো।
টেয়া পইসা কম নিও।
ওনার কথা গুলো শুনে ভিতর টা কেমন করে করে উঠলো।
ওরা তো অশিক্ষিত কিন্তু ওরা ঠিকই মানুষের ভালো টা বুঝে।এদের একটা বিশুদ্ধ বিবেক আছে যা আমাদের শিক্ষিত বিবেকে হার মানায়।
কথা গুলো শুনছিলাম এক দৃষ্টি তে।খানিকের জন্য হারিয়ে গেলাম।
আমরা এদের কত ভাবে অপমান করি।ছোট লোক ভাবি।
আর ছোট লোক রাই আমাদের মত শিক্ষিত মানুষের কথা ভাবে।হায় সমাজ হায় সমাজের মানুষ গুলো।
আমরা সবাই ঠিকই মানুষের মত হয়েছি কিন্তু মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।
– চলেন চাচা।আজকে আপনাকে নিয়ে সুন্দর একটা জায়গায় যাবো।
– জ্বে চলেন।
– ছেলে কি আপনাদের দেখতে আসে?
– লেহাপড়ায় ব্যস্ত থাহে।তাই বেশী আইবার পারে না।
– আচ্ছা।
– একখান কথা জিগামু?
– বলেন?
– আপনের বাপ মায়ে কই থায়ে?
– চাচা।আমার তো বাবা মা নেই।আমার ছোট চাচা আমাকে বড় করেছে।আমি তাদের সাথে থাকি।খুবই ভালো মানুষ আমার চাচা চাচী।
– আপনের কথায় দুঃখ পাইলাম। বাপ মায়ে নাই।তয় আপনে খুব বালা মানুষ। বালা মাইনষের আল্লাহ্ ও বালা করে।
– হা হা হা হা।
– হাসেন ক্যান?
– এমনি তে।
চলেন। রহমান চাচা রে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরলাম।দুপুরে খেয়ে তারপর বাসায় ফিরলাম।বিকেলে নিজের ডায়রি নিয়ে বসলাম। কিছু লিখবো ভাবলাম।কিন্তু কোন লিখায় আসলো না। বারবার আজকের ঘটনা মনে পড়ছে। রহমান চাচার কষ্টের কথা।কত মানুষ কত কষ্টে থাকে।আমরা কখনো মনের চোখ দিয়ে দেখি না। বাহিরের রূপ টাই দেখি। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি। বেশ কিছুদিন পর, ক্লাসের জন্য রেডি হচ্ছিলাম।হঠাৎ রহমান চাচার ফোন। কোন সমস্যা হলো কিনা কে জানে। ফোনটা ধরি।
– হ্যালো রহমান চাচা বলেন।
– আপনে কেমন আছেন?
– ভালো।কোন সমস্যা?
– না না।আপনের সাথে একটু দেহা করতাম।
– আচ্ছা। আমার ক্লাস শেষ হলে আপনাকে ফোন দিবো।
– জ্বে আইচ্ছা।
জানি না কি হয়েছে? গলাটা কেমন কেমন লাগলো। যাই হোক দেখা হলে তো শুনবো। ক্লাস শেষে অপেক্ষা করতে লাগলাম।এখনো তো আসলো না।ভাড়া নিয়ে এদিক ঔদিক ছুটতে হয়।দেরী হবে।কি আর করবে।পেটের দায়ে এই গরমেও দুদন্ড শান্তি নেই।বসে থাকার জো নেই।বসে থাকলে সেদিন আর চুলায় আর হাঁড়ি উঠবে না।তাছাড়া ছেলেটাকে ডাক্তারি পড়ানো তো কম খবচ না।তাই যতই ঝড় বৃষ্টি তুফান শীত গরম হোক।কাজ তো করতে হবে।খেটে খাওয়া মানুষ দের এটাই কষ্ট। মনে হয় আসতেছে।
– আপনে মেলা ক্ষণ দাঁড়ায় আছেন।
– ব্যপার না।
– একখান ক্ষেপপ নিয়া দূরে গেছিলাম।বালা ভাড়া পাইলাম।
– আচ্ছা এবার বলেন। কেন ফোন দিলেন?
– এই হানে কমু?
– তাহলে?
– আপনে যে পার্কে যান ওইহানে চলেন।
– আচ্ছা চলেন যাই।
– এখানে বসেন।
– আইচ্ছা।
– বলেন।কি হয়েছে?
– পোলাডায় আমার বড় পাশ দিছে।কাইলকা আইসা বইলা গেছে। তয় আপনেরে এই খবর না দিয়া শান্তি লাগে নাই। ফোন কইরা আপনেরে আইতে কইছি।
– খুব ভালো খবর।আমি খুব খুশি হয়েছি।
– লন মিষ্টি খান।
– এতো ঝামেলা কে করতে বলেছে।
– ইচ্ছা ছিলো আপনেরে বালা কিছু খাওয়ানের। সাধ আছে সাধ্য নাই।
– চাচা আমি এমনিতে মহাখুশি হয়েছি। আমার কিচ্ছু চাই না। আপনি খুশি?চাচী খুশি?
– মেলা খুশি।হু আপনের চাচী খুশিতে কান্দন করছে। পোলাডা থাহে নাই।চইল্লা গেছে।
– হয়তো ক্লাস আছে।
– হেইটাই কইলো।কেলাস আছে। পরে আবার আইবোনি।আর থাহনের জাগা তো নাই।এক্কান রুম।কই থাকতে কই?
– ভাববেন না।ছেলে বড় ডাক্তার হলে আপনাদের জন্য বড় বাড়ী নিবে।ওখানে থাকবেন।সব কষ্ট শেষ হবে আপনাকে আর রিকশা চালাতে হবেনা।
– দোয়া কইরেন।পোলাডা যেন মানুষ হয়। আমার যেন স্বপ্ন পূরণ হয়।
– অবশ্যই। চলেন।আমাকে বাসায় নামিয়ে দিবেন।
– জ্বে।চলেন। আজকে খুব ক্লান্ত লাগছে।যা গরম পড়ছে।
– কি রে কোথায় ছিলি ততোক্ষণ?
– ছোট চাচা তোমাকে যে বলেছি রহমান চাচার কথা।
– হ্যাঁ। তোর তো আবার বন্ধু।
– হুম।ওনার ছেলে ভালো রেজাল্ট করলো। তাই আজকে ওনি আমাকে মিষ্টি খাওয়ালো।আর কিছুটা সময় ওনার সাথে কাটালাম। বেশ খুশি রহমান চাচা।
– ভালো তো।আচ্ছা শুন তোর নামে একটা অফিসিয়াল চিঠি আসছে। আমরা খুলিনি।দেখ তো কিসের চিঠি।
– দাও।
– নিয়ে আসছি। এই নে চিঠি টা।
– পড়ছি।ওয়েট করো।
– কিরে চুপ কেন?
– ছোট চাচা ভালো খবর আছে।
– কি খোকা।
– তোমাদের আগে বলেনি।লন্ডনে একটা ভার্সিটি তে এপ্লাই করেছিলাম স্কলারশিপের জন্য।ওরা আমাকে সিলেক্ট করেছে। আগামী মাসে যেতে হবে।
– এ তো খুব ভালো খবর। তুই তাহলে সব গুছিয়ে নে।
– ঠিক আছে।
সবাইকে ছেড়ে যেতে তো কষ্ট হবে।বিশেষ করে রহমান চাচাকে ছেড়ে যেতে।ওনার সাথে কাটানো সময় গুলো খুব মিস করবো। ওনিও খুব মিস করবে হয়ত।ওনার সুখ দুঃখের কথা শুনার মত কেউ তো আর থাকলো না। বিদেশ থেকে ফিরে দেখবো।ওনার ছেলে বড় ডাক্তার হয়ে গেছে। ওনাদের সুখের দিন দেখবো। এটা ভেবে খুব ভালো লাগছে।একজন সংগ্রামী মানুষের জীবন কাহিনী শেষ পর্যন্ত শেষ হবে।
– কি রে তাড়াতাড়ি বের হ। ফ্লাইট মিস করবি তো।
– এই তো আমি রেডি। ছোট চাচী গেলাম। নিজের খেয়াল রেখো। আর শুন তোরা চাচীর কথা শুনবি।
– ঠিক ভাইয়া।
– ছোট চাচা চলো।এবার বের হই।
– আচ্ছা তোর রহমান চাচাকে বলেছিস?
– হ্যাঁ। কালকে দেখা করে এলাম। খুব মন খারাপ হয়েছে। কি করবো বলো।ওনি আমার সাথে অনেক সময় কাটাতো। ওনার রিকশা করে কত জায়গায় ঘুরতাম।
– জানি।চল তাহলে।
অজানা দেশে পাড়ি দিচ্ছি। চেনা শহর ছেড়ে। রহমান চাচা ভালো থাকবেন। ছেলেকে ভালো ভাবে মানুষ করবেন। এটা ভেবে খুব ভালো লাগছে। প্রায় তিন বছর পর দেশে ফিরছি।জানি সবকিছু আগের মত নেই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে।এতদিনে চাচার ছেলে ডাক্তার হয়ে গেছে।এত ব্যস্ত থাকতাম।খুব একটা কথা বলা হয়ে উঠতো না ফোনে।রহমান চাচার সাথে। যাক,,,, গেলে তো দেখতো পাবো। রাতেই ফ্লাইট আমাকে এখুনি বের হতে হবে। নিজের প্রিয় শহরে এলাম।মনটাই ভরে গেলো।
– তোমরা সবাই কেমন আছো?
খুব মনে পড়তো তোমাদের।
– আমরা সবাই ভালো। তুই শুকিয়ে গেছিস।
– সব মায়েদের কাছে সন্তানরা শুকনাই থাকে ছোট চাচী।
– ভাইয়া তুমি কয়দিন থাকবা?
– প্রায় দু’ মাস।বেশীদিন ছুটি নেই রে।
– তুই ফ্রেশ হয়ে নে।
– ছোট চাচী একটু পরে।সারা পথ তো রেস্টে আসলাম। আগে সবার জন্য গিফট এনেছি ওটা দেখো। তারপর রেস্ট। কি রে তোদের পছন্দ হয়েছে?
– হ্যাঁ ভাইয়া।খুব পছন্দ হয়েছে।
– এটা কি রে খোকা?
– এটা রহমান চাচার জন্য।
– ওমা তুই এখনো ওনাকে ভুলিস নি।
– কেমন করে ভুলবো?
– এবার তাহলে যা রেস্ট নে।
– ঠিক আছে।
শুয়ে শুয়ে ভাবছি।কালকেই ওনার সাথে দেখা করবো। না একবার ফোন দিয়ে দেখি। “কি ব্যপার ফোন টা বন্ধ পাচ্ছি কেন”?বুকটা কেঁপে উঠলো অজনা সংশয়ে। কি হয়েছে? না থাক এতো চাপ নিবো না।কালকে সকালেই ওনার বস্তিতে যাবো। এখনো কি বস্তিতে থাকবে? ছেলে টা নিশ্চয় বাসা নিয়েছে।একসাথে থাকে হয়ত। তাহলে ঠিকানা পেতে তো সমস্যা হয়ে যাবে।এতকথা না ভেবে কালকে যাই। সকালবেলা,,,,
-চাচী আমি একটু বের হচ্ছি।
– আসতে না আসতে বের হওয়া শুরু হয়ে গেলো।
– একটু রহমান চাচার কাছে যাবো।
– তাড়াতাড়ি ফিরিস।
– আচ্ছা।
হায় ওনারা তো দেখছি নেই।আশেপাশে র লোকজন রা বললো ওনারা একবছর আগে চলে গেছে।
কোথায় গেছে জানে না। কোথায় খুঁজবো আমি তাদের। কখনো ছেলেটার নাম ও জিজ্ঞেস করিনি।তাহলে তো মেডিকেল গিয়ে খুঁজতে পারতাম। আচ্ছা ওনার রিকশা গ্যারেজ টা তো চিনি।ওখানে একবার। কিছু না কিছু পাবো।
– কি রে এতো দেরী করলি।সেই সকালে বের হলি। চেহারা কেমন শুকনা হয়ে আছে।তোর জন্য কতকিছু রান্না করলাম।আর তুই বাহিরে বাহিরে।
– হুম।
– কি হুম করছিস? কি হয়েছে রে।
– ছোট চাচী রহমান চাচা কে পেলাম না।
– কি বলিস।
– ওরা বস্তিতে থাকে না।ওনার নাম্বার টাও বন্ধ। তাছাড়া ওনার রিকশা গ্যারেজে গেলাম। গিয়ে দেয়ে নতুন মালিক।তারা কিছু জানে না। খুব খারাপ লাগছে।
– আরে কাঁদছিস কেন।বোকা ছেলে।
– না ছোট চাচী।দোষ টা আমার। ব্যস্ততার জন্য খুব একটা ফোন দিতে পারতাম না। আমি খোঁজ নিতে পারিনি।এজন্যই আরও বেশী খারাপ লাগছে।
– তোর কাছে কোন ঠিকানা নেই?
– না।
– তাহলে কি করে খুঁজবি?
– সেটাই ভাবছি।
– আচ্ছা এখন যা।কিছু খেয়ে নে। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবা যাবে।তোর চাচা আসুক।
– ঠিক আছে।
বেশকিছু দিন চলে গেলো। কত খুঁজেছি রহমান চাচাকে পেলাম না।মেডিকেলও গেলাম। কিন্তু নাম ছাড়া কেউ চিনলো না।তাছাড়া বর্ণনা দিলাম।তাও লাভ হলো না।
আমার আবার যাওয়ার সময় হয়ে এলো।
না না এভাবে হাল ছেড়ে বসে থাকলে হবে না।কিছু তো বের করতে হবে।
কিন্তু কি করবো?
সোশ্যাল সাইট,পত্রিকা এসবে দিলে কিছু কি হবে?ওনার ছবি তো আমার কাছে আছে।মনে হয় না এসবে কিছু হবে।
মনে পড়েছে রহমান চাচা একবার আমাকে একটা কাগজ দিয়েছিলো।যাতে গ্রামের নাম লিখা আছে।কাগজ টা কোথায় খুঁজবো?
পুরানো ফাইলে খুঁজি।পেতেও পারি হয়ত।ড্রয়ারও থাকতে পারে।
এই তো পেলাম।আল্লাহ্ কি যে খুশি লাগছে।
শুধু গ্রামের নামটা লিখা।সমস্যা নেই ইন্টারনেট কেন আছে।
শেষ পর্যন্ত সব খুঁজে পেলাম।
যাক সব ঠিকটাক।কালকে সকালে বের হবো।ওনার গ্রামের বাড়ী যাবো। এবার একটু শান্তিমত ঘুমাই। সকালবেলা,এখুনি বের হয়ে পড়ি।তা নাহলে দেরী হয়ে যাবে।
– ছোট চাচী আমি বের হচ্ছি।
– কোথায় যাচ্ছিস এতো সকাল সকাল।
– আমি রহমান চাচার ঠিকানা পেয়ে গেছি।
ওনার গ্রামের বাড়ী যাচ্ছি।
– কি বলিস? পাগল নাকি তুই।তোর চাচা শুনলে খুব রাগ করবে।
– তুমি কিছু বলবে না। বলবে আমার এক বন্ধুর বাড়ী গেছি।আর চাচা তো জানে আমার ঘোরাঘুরি র অভ্যাস।ওনি ঠিকই বুঝবে।
– শুন বাবা। সাবধানে থাকিস। আর আমাকে ফোন করিস।
– তুমি চিন্তা করো না। আমি গিয়ে ফোন দিবো।
– গ্রামের বাড়ী কোথায়?
– রংপুরে।একটা গ্রামে।নাম সখিপুর।একটু দূরে আছে। আমি ঠিক বের করে নিবো।
– আচ্ছা। ফী আমানিল্লাহ্
অজানা পথে বের হলাম।জানিনা সঠিক গন্তব্যে যেতে পারবো কিনা।
কিন্তু যেতে তো হবেই।নিজ চোখে রহমান চাচার সুখ টা দেখতে চাই।হয়ত আমার একটু কষ্ট হবে।ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম এসে গেলো।
হঠাৎ বাসের হেলপার এসে বললো।
স্যার নামবেন না।রংপুর বাসস্ট্যান্ড চলে এসেছে।
আমি তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লাম।
একটা হোটেল এ ঢুকে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে বের হলাম।এবার গন্তব্য সখিপুর।
ওখানকার লোকাল বাস করে সখিপুর এলাম।উত্তর অঞ্চলে ভ্যানগাড়ী বেশী চলাচল।কাঁচা রাস্তা গিয়ে আমার ভ্যানগাড়ীটা এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এসে গেলাম।ঠিকানা টা অনেক কে জিজ্ঞেস করে বের করতে হলো না।কারণ ডাক্তারের বাড়ী সবাই চিনে।এই গ্রামে একজনই ডাক্তার হয়েছে।সে রহমান চাচার ছেলে।
ঠিক বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
দূর থেকে রহমান চাচা দেখে এগিয়ে এলো।
– আপনে এখানে।
এটা বলে আমাকে বুকে টেনে নিলো। এতো ভালো লাগা আগে কখনো ফিল হয়নি।সব কিছু খুলে বললাম।শুনে বেশ অবাক হলো।চোখ বেয়ে জল পড়ছে।
– কি হলো চাচা।কাঁদেন কেন?
– আপনে আমারে ভুলেন নাই।এটা সুখের কান্দন।
– আচ্ছা আপনারা এখানে কেন?
– আপনে কিছু আগে খাইয়া লন।তারপর সব কমু।
আসলে তখন মনে হলো রাজ্যের খিদা লেগেছে।অনেকদূর আসতে হলো। তারপর খেয়ে ওনার ঘরের বারান্দায় পাটি বিছিয়ে আমি রহমান চাচা চাচী বসে আছি।
– চাচা আমি তো এসেছি আপনাদের সুখের দিন দেখতে।
– আমরা সুখে আছি। আপনের চাচী আর আমি।
– ছেলেটা????
– ছেলে আমার মেলা বড় ডাক্তার হইছে।তার মেলা নাম ডাক। হগলে তারে চেনে।
– তাহলে আপনাদের চোখে জল কেন? গ্রামে কেন আসলেন?
– ইট পাথরের শহর আমাগো থেইক্যা সব কাইড়া নিছে।পোলাডারেও কাইয়া নিছে।ওই শহরে থাহি আর কি লাভ।
রিকশা চালায় পোলাডারে ডাক্তার বানাইছি।পোলায় ওহন আমাগোরে চেনে না।পরিচয় দিতে পোলার শরম লাগে।বাপে রিকশা চালায়। এটা বলেই রহমান চাচা হু হু করে কেঁদে উঠলো।কি বলে সান্তনা দিবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
– তয় পোলাডারে অভিশাপ নেইনা। পোলায় আর কি করবে।বড় বড় মাইনষের লগে তার উঠন বসন।আমি মুক্কো শুক্কো মানুষ। ঠিক মত কথা কইবার পারি না। চলবার পারিনা।আমগোরে লইয়া পোলা ক্যামনে চলবো। তাই গেরামে আইসা পড়ছি।বাপ দাদার বিটা মাটি আমগোর লাই এইটাই বালা। আমাগো কোন কষ্ট ওয় না।দুজনে বালাই চলবার পারি।
– চাচা আপনারা আমার সাথে চলেন।
– জ্বে না বাবা।আপনে বড় বালা মানুষ।
বেশী কষ্ট লাগে আপনের চাচীর লাইগা। নামাজে বসলে পোলাডার কথা কইরা খুব কান্দন করে। তহন মন চায় পোলাডারে আপনের চাচীর সামনে আইনা দেই। কিন্তু পারিনা।এটাই কষ্ট। পোলাডা সুখে থাকুক।আর কিছু চাই না।
– এতো কিছুর পরও ছেলেটারে দোয়া করেন।
– ওই যে আমরা বাপ মায়ে হইছি। আপনে বাপ হইলে বুঝবেন।
– চাচা ছেলে ফোন দেয় না?
– এসব কথা কইয়া আর কি হইবো।
পোলাডারে কখনো জোর করুম না।হেয় যদি বাপ মায়ের লাই মায়া থাহে।একদিন ফিরবো আমাগো কাছে। তয় একটা কথা পোলাডারে ডাক্তার বানাইয়া আমাগো স্বপ্ন পূরণ হইলো।
– স্বপ্ন পূরণ! হয়ত। চাচা আমিও সেই অপেক্ষায় রইলাম।ছেলে একদিন ফিরবে আপনাদের কাছে। চাচা আমাকে আজই ফিরতে হবে।
– ক্যান? দু একদিন থ্যাইকা যান।এই গরীবের ঘরে।
– চাচা সময় নেই। আমাকে বিদেশ চলে যেতে হবে।তাই অনেক কাজ আছে।আমার নাম্বার দিয়ে যাবো। যখন যা সহযোগিতা দরকার আমাকে বইলেন।
– আপনে মেলা কিছু আনছেন।আমারে আর ঋনী কইরেন না। তয় যোগাযোগ থাকবো।
বিদায় নিয়ে পথ ধরলাম।সেই ইট পাথরের শহরে।
একবুক কষ্ট নিয়ে ফিরতে হচ্ছে।কি ভাবলাম কি হলো।আর কি দেখলাম।
আবার যদি ফিরি হয়ত রহমান চাচার সুখ দেখবো।হয়ত দেখবো না।হয়ত অন্যকিছু দেখবো।এই হয়ত এর মধ্যে সব সীমাবদ্ধ। হয়ত এর কখনো শেষ নেই।
যে রহমান চাচা রাত দিন পরিশ্রম করে ছেলেকে মানুষ করলো।সেই ছেলে তাদের আর চিনে না।
খেটে খাওয়ার মানুষ গুলো র কষ্ট আমরা বুঝি না।
রিকশাওয়ালা রহমান চাচা সমাজে ঘৃণিত। এই ঘৃণিত খেটে খাওয়া মানুষ রা আমাদের সাথে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত।
সমাজের কাছে তারা মূল্যহীন।
অথচ তারাই সমাজের উন্নয়নে সবার আগে।
রহমান চাচাকে পরিচয় দিতে ছেলের লজ্জা লাগে। “আরে ডাক্তার মশাই তোমার কোন মূল্যই নেই”। যে বাবা মাকে সম্মান করে না। তার কি করে মূল্য হয় আমি জানিনা।সে যতবড় ডাক্তার ই হোক। রহমান চাচা রিকশাওয়ালা। আমি মনে করি তিনি শ্রেষ্ঠ বাবা।শ্রেষ্ঠ মানুষ। আর শ্রেষ্ঠ মনের।যে কিনা কিছু পাওয়ার আশা না করেই ছেলেকে নিঃসার্থ ভাবে মানুষ করলেন। স্বপ্ন পূরণ করলেন। স্বপ্ন পূরণ হলো চাচার।
সমাপ্ত