রাজরানি

রাজরানি

বাবা {মিষ্টি কন্ঠে} অফিসের জরুরি মিটিং এমন ঘটনা ঘটলে সবার বিরক্ত হওয়ারি কথা।কিন্তু এ বিষয়ে আমার কোনো বিন্দুমাএ ক্ষোপ নাই,কারণ রফিক ভাইয়ের{মানে আমাদের অফিসের পিওন}হাত ধরে দাড়িয়ে আছে আমার ছোট রাজরানি। একটা হাসি দিয়ে{ওহ বলায় তো হয়নি ছোট রাজরানি যখন হাসি দেয় তখন ওর মায়ের মতো ওর গালে ও টোল পরে,কিন্তু আমি এত হতভাগা যে আমাকে হাসলে নাকি ব্রিছিরি দেখায়} দৌড়ে এসে আমার কোলে বসল।বাবা মেয়ের এরকম অত্যাচার দেখে সবাই এতোক্ষণে বিস্ফোরিত। sir এর দিকে তাকিয়ে দেখি তিনিও এটা আশা করেন নি।

আমি: সরি স্যার,

স্যার:{কিছুই বললেন না} ছোট রাজরানি কে নিয়ে বেড়িয়ে আসার সময় ম্যানেজার সাহেব বললেন,  এরকম জরুরি মিটিং কতটা ইম্পরটেন্ট তুমি কি জানো না?

আমি: হুম,কিন্তু এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে এই ছোট রাজরানিটা{আসলে ওর নাম আবৃত্তি,,আমি আদর করে রাজরানি বলি}আর কিছু না বলেই বেড়িয়ে এলাম। ক্যান্টিন থেকে আমার রাজরানির জন্য ওর প্রিয় আইসক্রিম কিনে দিলাম।তারপর,

আমি : আমার ছোট রাজরানির আজ এতো জরুরি তলব কেন?

রাজরানি: বাবা,তুমি খুব পচাঁ।কালকে রাতে তুমি বললে কাল parents day তে তুমি আমার সাথে স্কুলে যাবে।কিন্তু ঘুম থেকে ওঠে দেখি তুমি নাই।নানি ভাই বলল তুমি অফিসে জুরুরি কাজে তাড়াতাড়ি চলে আসছো।।{অনেকটা অভিমানি সুরে বলল}

আমি: {ওহ সিট,রাজরানিটা এবার ক্লাস ওয়ান এ পড়ে,parents day তে আমার যাওয়ার কথা ছিল আর আমি এতটা কেয়াল লেস,মনে মনে}।সত্যিই তোমার বাবা খুব পচাঁ।এবারের মতো মাফ করে দাও,এরকম ভুল আর হবে না,প্রমিজ।

রাজরানি: প্রমিজ!

আমি: হুম।

অফিস না করেই রাজরানিকে নিয়ে সোজা ওর স্কুলে চলে গেলাম।প্রায় সব বাচ্চারা তাদের মায়ের সাথে আসছে,কিন্তু আমার রাজরানির মা বরই স্বার্থপর।আমাকে কথা দিয়েছিল আমাকে ছেড়ে সে কোনোদিন কোথাও যাবে না।কিন্তু ঠিকই আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।পুরোনো স্মৃতি গুলো নিয়ে এখন আর তত ভাবি না,কারণ এখন আমার পৃথিবী টা জুড়ো শুধু আমার এই ছোট রাজরানি। হলরুমে শুরু হলো অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে রাজরানি কে নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে আসার সময়, শুনতে পেলাম পিছন থেকে কেউ যেন আমার রাজরানির নাম ধরে ডাকছে।পিছন ফিরে দেখি একজন সুন্দরী মহিলা {মহিলা বলা যায় না একটা মেয়ে}..

রাজরানি: আসসালামুআলাইকুম,,,,মীম ম্যাম। {মহিলার,ওহ সরি,মেয়েটির নাম হয়তো মীম।যেহেতু রাজরানিকে চিনে তাহলে উনি ওর ক্লাস টিচার}

মীম: ওলাইকুমআসসালাম। কেমন আছো তুমি??

রাজরানি: ভাল,ম্যাম। তারপর আবার বলল,

রাজরানি: বাবা, উনি হলেন আমার ক্লাস টিচার,আমাকে খুব আদর করে।আর ম্যাম, এই হলো আমার বাবা,পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল বাবা।

মীম:তাই!

রাজরানি:হ্যা।

মীম রাজরানি কে স্কুলের ক্যান্টিন থেকে আইসক্রিম কিনে দিল।আমি ভাবতে লাগলাম উনি কিভাবে জানেন রাজরানি আইসক্রিম খেতে ভালবাসে,হয়তো রাজরানিটা বলছে উনাকে।হঠাৎ উনি আমাকে বললেন,আপনার সাথে আবৃত্তিকে নিয়ে কিছু কথা ছিল।আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম।তারপর আমি রাজরানিকে গাড়িতে বসিয়ে বললাম,তুমি আইসক্রিম খাও,আমি এক্ষণি আসছি।

আমি:বলুন,কি বলবেন?

মীম: আসলে,আপনাকে বলার চাইতে আপনার wife কে বললে আরও ভাল হতো।কিন্তু উনাকে কোনদিন আবৃত্তির সাথে স্কুলেকে দেখি নাই,তাই ভাবলাম আপনাকে বলি।আপনার যদি সমস্যা হয় তাহলে আপনার wife এর ফোন নম্বর দিন আমি ওনার সাথে কথা বলে নিব।

আমি: ওর মায়ের সাথে কথা বলার জন্য এমন কোনো ফোন এখন পযর্ন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারে নাই,আর পারলে আমি ঔ ফোনের বিনিময়ে আমার সবকিছুই দিয়ে দিতাম।

মীম: মানে?আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা!

আমি:{মৃদু হাসা বৃথা চেষ্টা করলাম}আবৃত্তির বয়স যখন ৩ বছর তখন হঠাৎ একদিন ওর মা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে,ওসব বাদ দিন।

মীম: সরি।আসলে আমি জানতাম না,আর আবৃত্তি ও আমাকে কোনোদিন বলে নাই,তাই।

আমি: হুম।বলুন কি বলবেন!

মীম:আবৃত্তি পড়ালেখায় ভাল এতে কোনো সন্দেহ নেই,কিন্তু আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করছি যে ও ক্লাসের সবার সাথে মিশে না,বলা যায় কিছুটা চাপা স্বাভাবের মতো।আর এতো কম বয়সে এরকম আচারণ মোটেও ভাল না।আশা করছি আমি কি বলতে চাচ্ছি আপনি বুঝতে পেরেছেন। আমি কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না।ওর মা ঠিক এরকম ছিল।আবার কোনো সাড়া না পেয়ে উনি আবারও বললেন, কিছু বলছেন না যে!

আমি:না মানে{আমি এখন কি বলব,মনে মনে}কিছু না ভেবে বললাম,এখন আমার কি করা উচিত?
উনি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন,হয়তো আমি এরকম প্রশ্ন করব উনি আশাই করেননি।

মীম: কি করবেন মানে!আপনি ওর বাবা,আর আপনি কি করবেন তা আপনি ভাল জানেন।এতটা কেয়ারলেস আপনি ওর প্রতি(কিছুটা রাগত কন্ঠে বললেন)

আমি আর কিছু না বলে ওনার সামনে থেকে চলে আসলাম,আমাকে দায়িত্ব বোঝাতে আসছে।রাজরানি কে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম,ক’দিন পরেই ওর জন্মদিন।মজার ব্যাপার হলো রাজরানি ছোট হওয়ায় সারপ্রাইজ দিতে সুবিধাই হয় বরাবরই।রাজরানির জন্মদিনের দিন অফিস শেষ না করেই নিউমার্কেট গেলাম কারণ তা সবারই জানা হয়ে গেছে।কি কিনব আজ রাজরানির জন্য ভাবেই পাচ্ছি না,এখন নিজের উপর কিছুটা রাগ ও হচ্ছে।বুঝতে পারলাম কেউ আমাকে ডাকছে,সামনে তাকিয়ে দেখি মীম মানে রাজরানির ক্লাস টিচার।সোজা আমার কাছে এসে বলল,

মীম: I am so sorry.আসলে সেদিন আপনাকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি।আমারি বোঝা উচিত ছিল আপনি ওর কতটা কেয়ার করেন,তা না হলে আবৃত্তি যখনি আমার সাথে গল্প করত তখন আপনাকে নিয়েই ওর সব কথা।প্লিজ কিছু মনে করবেন না সেদিনের কথায়।{একটানা বললেন}

আমি: হুম।আপনি এখানে কি করছেন?

মীম: কিছু দরকারে আসছিলাম।আপনি?

আমি: আজ রাজরানির আই মিন আবৃত্তির জন্মদিন।তাই ওর জন্য গিফট কিনতে আসছি।কিন্তু কি কিনব বুঝতে পাচ্ছি না।

মীম: যদি কিছু মনে না করেন আমি হেল্প করব।

আমি :ঠিক আছে। তারপর দু’জন মিলে অনেক খোঁজা খুজির পর রাজরানির জন্য গিফট কিনলাম।তারপর আমি বললাম,

আমি: আপনি ও চলুন না আমাদের বাসায়, রাজরানি আপনাকে দেখলে অনেক খুশি হবে।

মীম: সরি,যেতে পারলে আমারও ভাল লাগত কিন্তু দেরি হলে বাসায় চিন্তা করবে,তাই।

আমি: তো কি হয়েছে,বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিবেন।

মীম:কিন্তু!

আমি: ছোট রাজরানির খুশির জন্য হলেও চলুন,প্লিজ।

মীম: ওকে। মাকের্ট থেকে বের হওয়ার সময় মাকে ফোন করে বললাম ওকে নিয়ে যেন পাশের বাসা যায়।আমি আগেই সব প্লান করে রাখছি,আর মা সব জানে।বাসায় এসে নিজের চাবিটা দিয়ে দরজাটা খুললাম,এটা দেখে মীম একটু অবাকই হলেন।

মীম:বাসায় কেউ নেই?

আমি:{সব প্লান বুঝিয়ে বললাম}

মাকে ফোন করে আসতে বললাম,রাজরানি বাসায় এসে এরকম সারপ্রাইজ পেয়ে তো মহাখুশি।এরকম খুশি হতে আমি ওকে আগে কখনো দেখি নাই।সাথে মা কিছুটা অবাক হলেন আমার সাথে মীমকে দেখে। এরপর থেকে মীম প্রায়ই আসত রাজরানির কাছে,সাথে সাথে মায়ের কাছে রান্না শিখতো প্রতিদিন।এখন মীম কে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য বলা যেতে পারে।কিন্তু আমি কখনো নিজ থেকে কথা বলি না। অনেকবার লক্ষ্য করেছি মীম কিছু বলতে চায় কিন্তু আমার কোনো রকম সায় না পাওয়ায় কিছুই বলে না। একদিন রাত গভীর হওয়ায় আমি মীমকে বললাম,চলুন আপনাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসি।কিন্তু মীমের মুখ দেখে মনে হলো কথাটা হয়তো মীমের পছন্দ হয়নি,তারপরও বলল,ঠিক আছে,চলুন।এমনসময়.

রাজরানি: না,আজ ম্যাম আমার সাথে থাকবে।

আমি: না রে মা।উনাকে বাসা যেতে হবে,নইলে বাসার সবাই উনার জন্য দুশ্চিন্তা করবে।

রাজরানি: না।ম্যাম আপনি আজ আমাদের বাসায় থাকুন,আপনি আমাকে সুন্দর সুন্দর গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবেন।

মীম: কিন্তু আমার যে থাকা যাবে না সোনা। আমাকে এক্ষুণি বাসা যেতে হবে।

রাজরানি: নাহ,আপনাকে থাকতেই হবে,আমি আর কিছু শুনতে চাই না ব্যাস।

আমি: মারে তোমার ম্যামের এখানে থাকা মানায় না। আর ভালো মেয়েরা সব কিছুতে জেদ করে না।

রাজরানি: তোমরা কেউ আমাকে ভালবাসো না,সবাই মায়ের মতো স্বার্থপর।আমার ভাল আম্মু চাই,ম্যামকে আমার ভীষণ পছন্দ।বাবা তুমি ম্যামকে বিয়ে করে আমাদের বাসায় রাখো,প্লিজ।

আমি:রাজরানি{ ধমকেরসুরে} ভয় পেয়ে কাদঁতে কাদঁতে মীমকে জড়িয়ে ধরল রাজরানি।আর মীমও কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।এমন সময় মা বলল, ওকে ধমক দিচ্ছিস কেন?ও কি কিছু ভূল বলছে।

আমি: তুমি এসব কি বলছো,মা।

মা: আমার মাঝে মাঝে ভীষন ভয় হয়,কারণ আমি চলে গেলে তোদের কে দেখবে,বিশেষ করে রাজরানির।আর শুন আমিও চাই তুই মীমকে বিয়ে করে আবার নতুন ভাবে জীবন শুরু কর।

আমি: তোমরা সবাই পাগল হয়ে গেছো।এটা কখনো সম্ভব নয়।

হঠাৎ মীম বলে উঠলো, কেন সম্ভব নয়!আমি কি দেখতে কম সুন্দরী নাকি।আর রাজরানি কে আমি আপনার চাইতে বেশি ভালবাসি,হু।

মীমের কথা শুনে আমি কিছুই বলতে পারলাম না।আর বুঝতে বাকি রইল না সবাই একই গ্রুপের মেম্বার।

রাজরানি: বাবা,ম্যাম তো বিয়েতে রাজি আছে।তুমি ম্যামকে বিয়ে করো,প্লিজ।উনি খুব ভাল(কাদোঁ কাদোঁ কন্ঠে)

মীম: আমি জানি আপনি সবসময় রাজরানির ভাল নিয়ে ভাবেন,তার কথা ভেবেই আর নতুন কাউকে জীবন সঙ্গী করেন নাই।আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি,রাজরানিকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসবো,আদর করব…রাজরানির ভালোর কথা ভেবে রাজি হয়ে যান,প্লিজ!

আমি: কিন্তু আপনার পরিবার এ বিয়েতে কখনো রাজি হবে না।

মীম: যদি বলি,আমার বাসার সবাই সম্মতি দিয়েছে আমাদের বিয়েতে।

আমি: কিন্তু!

মীম: মাএ একবার সুযোগ দিন না ওর ভাল মা হওয়ার।{কেদেঁ কেদেঁ} আমি আর কি বলতে পারি নাই।এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আজ আমার বাসর রাত।অনেক রাত হওয়ায় ঘরে ঢুকলাম, দেখি মীমের কোলে ছোট রাজরানিটা ঘুমাচ্ছে,,আমাকে দেখে মীম বিছানা থেকে নেমে এসে আমাকে সালাম করল।

আমি: সত্যি বলতে আমি খুবই ক্লান্ত জীবন যুদ্ধে পরীক্ষা দিতে দিতে।আমি ঠিক জানি না আপনাকে আপনার ভালবাসার সঠিক মযার্দা দিতে পারব কি না।

মীম: শুধুমাএ মৃত্যুর পূর্ব পযর্ন্ত আপনার পাশে থাকার অধিকার দিয়েন,আমার আর কিছু চাই না।কথা দিলাম রাজরানিকে অনেক ভালবাসা ও আদর দিব।

আমি: শুধু রাজরানিই।আপনার ভালবাসার সমুদ্র থেকে কি আমি একটু ভালবাসা পেতে পারি না?

মীমের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর সুন্দর গাল বেয়ে জল পড়ছে।আমাকে তাকানো দেখে মীম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে শুধু মাথা নাড়ালো।

মীম: আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি,অনেক।

আমি:আজ থেকে আমার সব ভালবাসা আপনাকে দিব।

মীম: একটু জড়িয়ে ধরবেন,প্লিজ।{মাথা নিচে করে বলল} আমি আর কিছু না বলে রাজরানির ম্যামকে ভালবাসার চাদরে জড়িয়ে নিলাম।ঠিক ঔ সময় রাজরানি বলল,

রাজরানি:বাবা। ঘুমাবে না তুমি??{ছোট করে হাসার শব্দে হচ্ছে} আমি ভাবছি,কি পাজিঁ মেয়ে হয়েছে আমার।বাবাকে একটু রোমান্স করতে ও দিবে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত