কখন যে পৌছে গেছে ট্রেন তা প্রলয় জানে না।খুব ঘুম পাচ্ছিল তার।আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, ট্রেন একেবারেই ফাঁকা।কেউ তাকে ডাক দিল না একটিবারের জন্যে!! কেন-ই বা দেবে সে তো ট্রেনে করে একা যাচ্ছিলো।এমন তো নয় যে, তার সাথে পরিচিত কেউ ছিল।ট্রেন থেকে নেমে প্রলয় একদম চমকে গেল।কারণ, এটাকে কোন স্টেশন বলে তার মনে হচ্ছে না।চারদিকে এতসুন্দর ফুলের বাগান দেখে মনটা ভরে গেল।ছোট ছোট নীল রংয়ের কিছু ফুল ; নজরে পড়লো প্রলয়ের।কি নাম ফুলটার? নাহ্ , নামটা জানা নেই।তাহলে এই ফুলের এই নামই দেয়া যাক – নাম না জানা ফুল ; ক্ষতি কি!! কোথায় যেন আরো দেখছি এই ফুলগুলো! প্রলয় ভাবতে লাগলো।সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল তাদের ছাদেই এই গাছগুলো ছিল একসময়।
প্রলয় আশেপাশে তাকালো। কোন মানুষজন দেখা যাচ্ছে না।আর বেশিদূর দেখাও যাচ্ছে না।কুয়াশায় ঢাকা এক শান্ত সকাল।ভোরের পাখিরাও যেন ঘুমিয়ে আছে।যেন এক রহস্য ঘেরা মায়ার নগরী।কি নাম এই জায়গার! আর ট্রেনটা এখানে কেন-ই বা এলো!
প্রলয় সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো, যদি স্টেশন মাস্টার বা কাউকে পাওয়া যায়।কিছুদূর যাবার পর দেখলো একটা দোলনায় দুজন মহিলা বসে আছেন।তাদের মধ্যে একজনকে তরুণী বললে অবশ্য ভুল হবে না।
প্রলয় তাদের পেছন দিকটা কেবল দেখতে পাচ্ছে। কাছে যেতে একজন অবশ্য দোলনা ছেড়ে চলে গেল।কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে তাকালো,
– ‘ কি যাবেন না,চলুন। ‘
যিনি দোলনায় বসা ছিলেন, এবার তিনি উওর দিলেন।
– ‘ তুমি যাও, আমি আসছি।’
প্রলয় এবার দোলনার পেছনে এসে দাঁড়ালো।
-‘এই জায়গাটার নাম কি, বলতে পারেন? ‘
-‘ প্রলয় কেমন আছিস? আয়, আমার কাছে আয় বাবা। ‘
প্রলয়ের সমস্ত শরীর যেন বরফের মতন জমে যাচ্ছে।না কোন ভয়ে নয়,অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে।কিন্ত কি করে সম্ভব! এখন তো শীতকাল না! এগুলো কিভাবে হচ্ছে!
-‘ চুপ করে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি? বললি না, কেমন আছিস? ‘
প্রলয় একদম ছোট্ট শিশুর মতন কাঁদতে লাগলো।
– ‘ মা তুমি সাদা শাড়ি কেন পড়েছো? ‘
– ‘ তারজন্যে কাঁদছিস! ‘
– ‘ না, মা তুমি ফিরে এসো।না হলে,আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো। আমি বাবার সাথে আর পারছি না।’
– ‘ বোকা ছেলে ! তোর পরীক্ষা শেষ হলে আসিস।’
-‘ তোমার সাথে উনি কে ছিল? ‘
হঠাৎ প্রলয় কেঁপে ওঠে।তার দরজায় বার বার কড়া নাড়ছে
– ‘টেবিলে এসো প্রলয়। ‘
আর, সেইসাথে প্রলয়ের স্বপ্নও ভেঙ্গে গেল।কারো সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার।তারপরও উত্তর দিতে হলো,
– ‘ আপনি যান, আমি আসছি।’
প্রলয়ের মা মারা গেছেন প্রায় এক বছরের মত হলো।মা মারা যাবার তিন মাসের মাঝেই বাবা আবার বিয়ে করেন।আর, কিছুক্ষণ আগে মতিন সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী মিসেস তরুই প্রলয়ের দরজায় কড়া নাড়ছিল।
প্রলয় দু- তিনটা টিউশনি করে।তাই অধিকাংশ সময় সে বাড়িতেই থাকে।তবে ইদানীং মিসেস তরুর নানা রকম আপত্তির আচরণের কারণে তার বাড়ি ফিরতে মন চায় না।তাই, বাকি সময়টাতে বাড়িতে থাকলেও সে দরজা লক করে থাকে।সত্যিই জীবনটা বড় অদ্ভুত! নিজের বাড়িতেই তাকে এমন বন্দী জীবন বেছে নিতে হবে, তা কি সে জানতো!
এখন শুধুই একটা ভাল চাকরির অপেক্ষা।তারপর এখান থেকে অনেকদূরে চলে যাবে সে।
প্রলয় গান খুব ভালবাসে, সেইসাথে খুব ভাল গান গাইতেও পারে।তবে তার গানের একমাএ শ্রোতা হচ্ছে পদ্ম ; প্রলয়ের একমাত্র বন্ধু।তবে মতিন সাহেবের পছন্দ নয় বলে, পদ্ম এ বাড়িতে এখন তেমন একটা আসে না।তাছাড়া পদ্ম নতুন চাকরি নিয়েও আজকাল কিছুটা ব্যস্ত।তাই প্রলয়ের সাথে তেমন কথাও হয় না।প্রলয়ের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় সেই অব্যক্ত কথাগুলো চিৎকার করে পদ্মকে বলতে।তার ভাললাগার একান্ত কিছু কথা,যা আজও কাউকে বলা হয়নি।অথচ, যতবার সে চেষ্টা করছে বলার,
এক দ্বিধা তাকে যেন বেঁধে রেখেছে পদ্মের কাছ থেকে।মাঝে মাঝে পদ্মকে হারিয়ে ফেলার এক অজানা ভয়ও তার মনে জাগে।
পদ্ম খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে।ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছে।এখন পদ্ম আর, তার ছোট ভাই পলাশ দুজনে মিলে সংসারটা চালাচ্ছে।পদ্ম, আর তার চাচাতো ভাই ইমরান একই অফিসে চাকরি করে।পদ্মের ইমরানকে খুব ভাললাগে লাগে ; সেই ছোটবেলা থেকেই।কিন্ত কোনদিনই বলার সাহস হয়নি।ইমরান একসময় মিথিলাকে ভালবেসে জীবনসঙ্গী রূপে সংসার শুরু করে।এরপর পদ্ম নিজেকে ইমরানের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে বহুবার।যদিও তা সে পারে নি।কারণ, মিথিলা ছিল পদ্মের খালাতো বোন।মিথিলা ছিল খুব হাসিখুশী আর চঞ্চল স্বভাবের।যদিও পদ্ম শান্ত স্বভাবের,তবে দুজনে মনের মিল ছিল অনেকবেশি।আর,ইমরানের সব সুখটুকুন ছিল যেন মিথিলাকে ঘিরে।যদিও ওদের সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।দেড় বছর হলো মিথিলা রোড-আ্যকসিডেন্টে মারা যারা।ইমরান সেইসময় একদম দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল।ছেলের এমন অবস্হা দেখে ইমরানের বাবা – মা অনেকবার তাকে বিয়ে করে নতুনভাবে জীবন শুরু করার কথা বলেছে।অথচ ইমরানের ভুবনজুড়ে ছিল শুধুই মিথিলা।এই অনুভূতিটুকু বাবা কিংবা মাকে বোঝানো সম্ভব নয়।তাই সে এখন বাবা-মাকে ছেড়ে নতুন ফ্লাটে একাই থাকছে।তবে ছুটির দিন গুলোকে তাদের সাথে গিয়ে দেখা করে।
পদ্ম আজ অফিসে যাবার আগে একটু সুন্দরভাবে তৈরি হয়ে নিলো।কপালে নীল টিপ পড়লো।আর, নীল শাড়ির সাথে নীল কাচের চুড়ি পড়ে নিলো দুহাতে।পথে কিছু সাদা গোলাপ কিনলো।অফিসে গিয়েই পদ্ম সরাসরি ইমরানের কেবিনে ঘুকলো,
-‘ শুভ জন্মদিন। ‘
পদ্ম ফুলগুলো ইমরানের হাতে দিল।ইমরান ফুলগুলো নিয়ে টেবিলে রাখলো।তবে পদ্মের দিকে একটিবারও তাকালো না।মনযোগ দিয়ে কিছু লিখছিলো।কিছুক্ষণ পর বললো,
-‘ তুমি তো জানো পদ্ম, মিথিলা যাবার পর থেকে আমি এসব পালন করি না।আমার প্রতি তোমার এসব অহেতুক আগ্রহের কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।কারণ, আমি মিথিলার জায়গাটা অন্য কাউকে দেব না পদ্ম। ‘
-‘ আমি মিথিলার জায়গাটা কেন নেব! আমি কি নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পারি না।হারিয়ে যাওয়া ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরে আর কত একাকী নিজেকে কষ্ট দেবে ইমরান!’
– ‘ ভালাবাসা বা ঘৃণা যা-ই বলো না, কোনটাই হারিয়ে যায় না।হয়ত সময়ের সাথে কখনো কখনো চাপা পড়ে।আর আমার ভালবাসা আমার সাথেই আছে এবং থাকবে সারাটাজীবন।আর সুখের কথা যদি বলো পদ্ম, সেটাতো আপেক্ষিক।আমি একা কষ্টে আছি কে বলেছে তোমাকে।অনেক তো হলো পদ্ম ; তুমি এখন একটু যাও। আমি কিছু সময় একা থাকতে চাই।’
পদ্ম নিঃশব্দে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো।
কিছুক্ষণ পর প্রলয়ের ফোন এলো।
– ‘ আজ কি দেখা করবি পদ্ম, আমার খুব একা একা লাগছে।মনটা ভাল না। ‘
পদ্মের কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না একদম।শুধু ঠিক আছে, বলেই ফোন রেখে দিল সে।
প্রলয়ের একটা চাকরি হয়েছে।তাই ভেবে রেখেছিল, কিছুদিন পরেই সে বাবা কাছ থেকে আলাদা কোথাও থাকবে।তবে কিছুদিনের জন্য আর অপেক্ষা করতে হলো না তাকে।কারণ, রাতে বাড়ি ফিরার পর মিসেস তরু প্রলয়ের বাবার কাছে তার নামে মিথ্যা অভিযোগ করে এই বলে যে – প্রলয় তার সাথে অশ্লীল আচরণের চেষ্টা করছে।যদিও বাস্তবে ঘটনাটা ছিল এর পুরো উল্টো।প্রলয় কখনো ভাবেনি মিসেস তরু তার সাথে এতটাই নোংরা খেলায় মেতে উঠবেন।এরপর প্রলয় বাড়ি ছেড়ে চলে আসে ছোট এক মেসে।
বিকেলে পদ্মের সাথে দেখা হলো প্রলয়ের।পদ্মকে খুব বিমর্ষ লাগছিল।যদিও তার কারণ প্রলয়কে প্রশ্ন করতে হলো না।পদ্ম নিজ থেকেই প্রলয়কে ইমরানের সব কথাগুলো বলছিল।প্রলয় ইমরানকে নিয়ে পদ্মের এই অনুভূতির কথা জানতো না।তবে এসব শুনার পর পদ্মকে আর কিছু তারও বলার ছিল না।
জীবন বড়ই বিচিত্র।প্রলয়, পদ্ম কিংবা ইমরান কেউ কি এমন একাকী জীবন চেয়েছিল! মানুষ তার জীবনকে ঘিরে নানা স্বপ্ন সাজায়।কিছু স্বপ্ন পূরণ হয়, আবার কিছু মাঝ পথেই থেমে যায়।কিন্ত জীবন থেমে যায় না।হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নকে সাথে নিয়েও কেউ কেউ বেঁচে থাকে।