ভালবাসা তোমার জন্য

ভালবাসা তোমার জন্য

সায়মন একঘণ্টা ধরে কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছে।প্রচন্ড গরমে তার ধৈর্য্য প্রায় হারাবার পথে।তবে রাস্তায় কোন অটোর ( সি এন জি ) দেখা নেই।এর মাঝে সে ড্রাইভার জলিলকে মনে মনে গালমন্দ করলো দুবার।কারণ, জলিল হঠাৎ করে ছুটি না নিলে তাকে এখানে অপেক্ষা করতে হতো না।যাই হোক, এভাবে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ?ওই পথে তো রিক্সার কথা ভাবা যাচ্ছে না, তাহলে বাকি থাকলো কি বাস!! না, তা সম্ভব নয়।কারণ, সায়মন আর বাস এ দুটো হলো বিপরীত শব্দ।কত মানুষ তো পায়ে হেঁটে চলাচল করে তাই না। তাহলে সেও পারবে।কিছুদূর হাঁটার পর পুনরায় জলিলের কথা মনে হলো তার – সব তোর জন্য হচ্ছে জলিল, তোর জন্য!

এরপর রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে ঠান্ডা পানি কিনে নিলো সে।সেই ছোটবেলা থেকেই আরাম – আয়েসের মধ্যে বেড়ে ওঠা একজন যুবকের পক্ষে হঠাৎ একদিন হেঁটে অফিসে যাওয়াটা খুব সহজসাধ্য কোন বিষয় নয়।এখন সায়মনের দুটো জিনিস খুব ইচ্ছে করছে –

এক. জলিল ব্যাটাকে কাছে পেলে আচ্ছা করে পেটানো যেত!

দুই. নিকোটিনের দুটো টান।প্রথমটা যদিও এখন সম্ভব হচ্ছে না, তবে দ্বিতীয়টা সম্ভব।

সায়মনের তার বন্ধু রকির কথা মনে পড়ে গেল।রকি সবসময় বলতো, যখন মানুষ সুখে এই নিকোটিনের টান নেয় তা হলো- সুখটান ; আর যখন দুঃখে টান নেয় তখন তা হলো – দুখটান।সায়মন ঘড়ি দেখলো। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে, আর মেজাজটাও বেশ খারাপ। তাহলে তারটা কি হবে – রাগটান!!

এভাবে তো আর হচ্ছে না।বাসে করেই যেতে হবে তাকে এবং শুধু আজ না, কাল পরশু যতদিন প্রয়োজন।ভাবতে ভাবতে বাসে উঠলো সায়মন।একদম সামনের দিকে সিট খালি ছিল না।সায়মন একটু এগিয়ে একটা সিটের কাছে গেল,

– “এক্সকিউজ মি, একটু বসতে পারি আমি এখানে?”

ওই সেটে বসা মেয়েটি ফোনে কথা বলা থামিয়ে বিরক্তি চোখে সায়মনের দিকে তাকালো,

– “আমার পিছনের সিটটা পুরোই খালি।তা রেখে আমার পাশেই আপনাকে বসতে হবে! মেয়ে দেখলেই শুরু হয়ে যান! ”

সায়মন চুপচাপ পেছনের সিটে বসলো।পেছনের সিট যে খালি ছিল তা সে লক্ষ্য করে নি।তবে মেয়েটির কথা আংশিক ঠিক ছিল।কারণ, আসলেই তাকে দেখেই চোখ ফেরাতে পারছিল না সায়মন।আর, এত সুন্দর করে মানুষ কিভাবে বিরক্তি প্রকাশ করে! অদ্ভুত মায়া জড়ানো বাচনভঙ্গি! একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে মেয়েটির সাথে।তবে সে ফোনে বেশ ব্যস্ত।তাছাড়া ব্যস্ত না থাকলেও সায়মন যে কথা বলতে পারতো না, তা সে নিজেও জানে।

সায়মনের বস সুরভী তাকে খুব পছন্দ করে।সারাদিন নানা কাজের অজুহাতে সায়মনকে তার কেবিনে ডাকে।এই রমণীকে এড়িয়ে চলতে সায়মনকে নানা ঝামেলা পোহাতে হয় মাঝেমধ্যে।তবে, সে নিজেও আজ সুরভীর মতো কিছুটা বেহায়াপনা করবে কি ওই মেয়েটির সাথে?

অভিলাষী মনটা বোধহয় নেই তার আয়ত্তে আজ! তবে এমন আচরণ তার স্বভাবের সাথে একদমই যায় না।

মেয়েটি একসময় বাস থেকে নেমে গেল।সায়মন উঠে দাঁড়াবার সাথে সাথেই দেখলো, মেয়েটি বাসে তার ফোন ফেলে গেছে।মনে মনে খুশি হলো এই ভেবে যে ; এখন পিছু নেবার ভাল বাহানা পাওয়া গেল।সায়মন এক দৌড়ে বাস থেকে নামলো।এরপর মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো।হঠাৎ রেশমি বলে পেছন থেকে কে যেন ডাক দিল।সায়মন এবং সেই মেয়েটি দুজনেই পিছনে তাকালো।মেয়েটি এবার জবাব দিল,

– “কি অঞ্জলি! এত দেরি করলে যে? এদিকে জানো কি হয়েছে, আমি তো রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

সায়মন রেশমির দিকে এগুতে নিলো ; ঠিক তখনি সায়মনের সামনে রকি এসে দাঁড়ালো।

– “একি সায়মন! তুই অফিস বাদ দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের চাকরি নিয়েছিস! রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করিস তুই?”

সায়মন দেখছে মেয়েদুটো রাস্তাপার হয়ে চার্চের দিকে যাচ্ছে।এরমাঝে রকির কথা তার কানে যায় নি।

– “রকি তোকে রাতে ফোন দেব।জরুরি কাজ আছে, গেলাম।”

সায়মন চার্চের সামনের বাগানে রেশমির জন্য অপেক্ষা করছে।কিছুক্ষণ পর সায়মন ওদের দেখলো।রেশমি বলে দুবার ডাকলো সে তবে, রেশমি বা অঞ্জলি কেউই একটিবার পেছনে ফিরে তাকালো না।তাই সায়মন এবার নাম প্লাটে ডাকলো,

– এই যে পশমী অ্যান্ডারসন, শুনতে পাচ্ছেন?

এবার রেশমি কিছুটা ক্ষেপে গেল।

– “আমার নাম রেশমি রোজারিও, বুঝেছেন।আর আপনি তখন থেকে আমাদের ফলো করছেন কেন!”

– “আপনার মোবাইল নিন।বাসে ফেলে এসেছিলেন।”

এরপর সায়মন খুব দ্রুত চলে গেল।রেশমি একটিবার ধন্যবাদ দেবার সু্যোগও পেল না।যদি কোনদিন দেখা হয়, লোকটির সাথে ; তবে অবশ্যই তাকে স্যরি বলতে হবে তার।তবে সিনেমার মত অপরিচিত মানুষদের সাথে কাকতালীয় ভাবে হয়ত বার বার দেখা হবে না।মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই রেশমি খারাপ আচরণ করে সবার সাথে।নিজেকে একটা অদৃশ্য খোলসে আবৃত রাখতে চায় সে। আর, চায় না কেউকে মায়ার বাঁধনে বাঁধতে।কারণ,প্রিয় মানুষের পাশে থাকবার সুখের চেয়ে তাদের হারাবার কষ্ট অনেক বেশি হয়।মাকে হারাবার পর রেশমি তা বুঝে গিয়েছে।

মজার ব্যাপার সায়মনও ভেবেছিল ফোনটা ফেরত দেবার পর তাদের আর কোনদিন দেখা হবে না।আর এভাবেই সে রেশমিকে হারিয়ে ফেলবে।তাই বুদ্ধি করে সে ফোন নাম্বার নিজের ফোনে নিয়ে রেখেছে।তবে তাতেও খুব বেশি কাজ হলো না।দুদিন যাবত রেশমির ফোন বন্ধ।সায়মন কিছুটা নিরাশ হলো।পরদিন অফিসে কাজের ফাঁকে আবার ফোন করলো।দুটো রিং বাজতেই সায়মন ফোন কেটে দিয়ে, তারপর টেবিলে রাখা ফাইলগুলোতে মনযোগ দিল।তবে বেশিক্ষণ মনোনিবেশ করতে পারলো না।এমন তারল্য তার মনের মাঝে কিভাবে সৃষ্টি করেছে রেশমি! সামান্য একদিনের কথায় যে এমনটা অনুভূত হতে পারে – একথা ভেবে সায়মনের সত্যিই অবাক লাগছে।

বাড়ি ফিরে তার মনে হলো সেই সময় রেশমির ফোনে রিং বেজেছিল।তাই দেরি না করে আবার সে ফোন করে।

– “হ্যালো।”

– “কেন ফোন বন্ধ রেখেছিলে? ”

রেশমি এই অপ্রত্যাশিত ধমকের জন্য প্রস্তুত ছিল না।

-“মনে হয় ব্যাটারি লো ছিল।কে বলছেন?”

সায়মন নিজের পরিচয় দিল।

– “আপনি তো দেখছি দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ। আমার নাম্বারটা আবার রেখে দিয়েছেন।তা, কেমন আছেন আপনি?”

-” থেমে গেলেন যে! আমি তো ভেবেছি আরও কিছুক্ষণ বকাবকি করবেন।”

রেশমি হেসে ফেললো।এভাবে মাঝেমাঝে রেশমির সাথে সায়মনের কথা হয়।কথায় কথায় সায়মন জানতে পারে – রেশমির মা মারা যাবার পর থেকে সে তার খালার সাথে গ্রীসে থাকে।রিনা খালা তার আপন খালা নন।তবে রেশমিকে তার নিজের মেয়ের মতো ভালবাসে।রেশমির মায়ের মৃত্যুটা কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। তখন এত কিছু বোঝার মতো বা যাচাই করার বয়স তার হয়নি।তবে তার মনে হয়, মায়ের আত্মহত্যার জন্য বাবাই দায়ী ছিল।বাবার কাছে অনেক বারই মায়ের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে চেয়েছে রেশমি।যদিও সে প্রশ্নের কোন উত্তর সে পায়নি।তার বাবা শুধু একটি কথাই বলেছে,

– “মারে, আমি আসলে অনেক বড় একটা ভুল করেছি জীবনে।এর শাস্তি হয়ত আমাকে বাকি জীবনটা বয়ে বেড়াতে হবে।আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস।”

রেশমি গ্রীসে যাবার পর বাবার সাথে আর যোগাযোগ করেনি।তবে খালা কি রেশমির খবরাখবর তার বাবাকে দেয় কি না ; তা সে জানে না।

কিছুদিন পরের কথা।সায়মন কাজের চাপের কারণে রেশমির খোঁজ নেবার তেমন সু্যোগ পাচ্ছে না ইদানিং।তাই রেশমি হঠাৎ ফোন দিয়ে তাকে কিছুটা হলেও চমকে দিল।অবশ্য ফোন দেবার পেছনে একটা কারণ ছিল।কিছুদিনের মধ্যে তারা আবার গ্রীসে ফিরে যাচ্ছে, তাই সায়মনের সাথে একবার দেখা করতে চায় সে।হয়ত এটাই শেষবারের মতো দেখা হবে।রিনা খালা তার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে মূলত রেশমিকে নিয়ে দেশে এসেছিলো।আর,এখন তার মায়ের অবস্হাও আগের চেয়ে ভাল।

রেশমি ফোন রেখে দেবার পর সায়মন বড় রকমের চিন্তায় পড়ে গেল।রেশমির সাথে এতদিন কথা হবার পরও সে তার অনুভূতির কথা তাকে বলেনি।অথচ সে জানতো কিছুদিন পর রেশমি এদেশ ছেড়ে চলে যাবে।

পরদিন দেখা করবার আগে সায়মন একটা সুন্দর লাল গোলাপের তোড়া নিলো রেশমির জন্য, সেই সাথে আরো একটি উপহার।রেশমিও সায়মনকে তার প্রিয় লেখকের দুটো বই উপহার দিল।তবে নিজের উপহারটি পেয়ে বেশ চমকে গেল।

– “কি ব্যাপার!! এত কিছু থাকতে আপনি আমাকে রেড গাউন উপহার দিলেন যে! ”

– “আমার মাকে কি বলেছি জানো? কে তোমার বউ হবে ; তা খুঁজতে হবে না।একদিন একটা লাল টুকটুকে গাউন পরিয়ে তোমার সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেব।তখনই দেখতে পারবে।বিয়ের দিন ওসব সাদা পোষাক আমার ভাল লাগে না।রেশমি তুমি কি যাবে আমার মায়ের সাথে দেখা করতে? ”

Ads by BEING WOMEN

BEST INTERIOR DESIGN COMPANY IN BANGLADESH

রেশমি সায়মনের কাছ থেকে এ ধরনের কথা শোনার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিল না।তাই সে কোন উত্তর দিতে পারছিলো না।

– “রেশমি, কিছু বলছো না যে? ”

সায়মনের দৃষ্টিতে শঙ্কার ছায়া।

হঠাৎ রেশমি দৌড়ে সায়মনের সামনে থেকে চলে গেল।রেশমির কান্ড দেখে সায়মন হতভম্ব হয়ে গেল।যদিও সে রেশমিকে পেছন থেকে দুবার ডাক দিয়েছে।তবে রেশমি পেছনে ফিরে তাকায় নি।সায়মনকে ভালবাসে কি না,এসব নিয়ে ভাবতে রেশমির ভয় হয়।

যদি সায়মনও তাকে ছেড়ে একদিন চলে যায়।এক অজানা আতঙ্ক তাকে তাড়া করে বেড়ায়।কিছুদূর দৌড়ে একটা রিকসা নিয়ে রেশমি বাড়ি ফিরলো।সিঁড়িতে ওঠার সময় সে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল।তারপর দেখলো বাড়ির দরজাটা খোলা এবং ওখান থেকেই কান্না শুনতে পাচ্ছে সে।রেশমি নিঃশব্দে ভেতরে এলো।রিনা খালা কাঁদছিলেন।

– “বিয়ে করে সংসারী পর্যন্ত হলি না।এভাবে নিজেকে আর কত শাস্তি দিবি রিনা? ”

-“আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি মা।আমার জন্য রেশমি মায়ের ভালবাসা টুকুন পায়নি।রেশমির বাবার সাথে সংসার করার যে লোভ আমি লালন করেছিলাম ; তার প্রায়শ্চিত্তটা আমাকে করতে দাও মা। ”

রেশমি মনে প্রচন্ড আঘাত পেল এ কথা জানার পর।রিনা খালা তাকে মায়ের মতো ভালবাসে।তবে এসব শোনার পর আজ ঘৃণা করতে মন চাইছে তাকে।রেশমি দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।তারপর সায়মনকে ফোন দিল,

-“আপনি কি একটু আসতে পারবেন? ”

-“কোথায় বলো? আমি আসছি।”

রেশমি সায়মনকে সব কিছু জানালো।

– “আপনি কি আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাতে পারেন, যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না।রিনা খালার কাছে আমি আর ফিরে যাবো না। এটাই হবে ওনার শাস্তি। ”

-“রেশমি তোমার এসব শিশুসুলভ কথা আর ভাল লাগছে না।সকালে এমন দৌড়ে পালালে কেন! তুমি হয়তো এখনো আমার ব্যাপারে সিধান্ত নিতে পারছো না।তাতে কি! সময় চাইতে পারতে।কি ভাবছো, আমি বুঝলাম কিভাবে? তোমার সাথে এতদিন কথা বলছি, আর এতটুকু কি বুঝবো না আমি!

রেশমির চোখে নির্বাক দৃষ্টি।

-” সবাইকে শাস্তি দেবার দায়ভার কি তুমি নিয়েছো? একবার বাবাকে ছেড়ে এসেছো, এবার রিনা খালাকে।তাছাড়া উনি তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত।একা থাকার মাঝে কোন আনন্দ নেই রেশমি।এখন তুমি লক্ষী মেয়ের মতো রিনা খালার কাছে যাবে।আর, তোমার বাবার কাছেও ফিরে যেতে হবে তোমাকে।অনেক তো হলো, ওনাকে আর কষ্ট দিও না। ”

রেশমি কোন কথা বললো না।চুপচাপ বাড়ি চলে গেল।

বেশ কিছুদিন পরের কথা।রেশমি তার বাবার সাথে খুব ভাল আছে।রেশমি লাল গাউনটা পরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সায়মনের জন্য।যদিও সায়মন তাকে ফোনে জানিয়েছে – তার আসতে আধঘণ্টা দেরী হবে।তবুও রেশমি দাঁড়িয়ে থাকবে।এই সুন্দর দিনগুলোর প্রতিটি ভালবাসার মুর্হূত সে আর হারাতে চায় না ; অনুভব করতে চায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত