শায়লা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ন’টা বেজে গিয়েছে।কি করে সম্ভব!! সকাল আটটায় তার এর্লাম দেয়া ছিল।তবে কি ঘুমের ঘোরে সে ওটা বন্ধ করেছে।কই মনে পড়ছে না তো, এমন কিছু! অবশ্য ঘুমের ঘোরে করলে মনে থাকবার কথাও নয়।দু-তিন ধরেই রাতে ঘুম হচ্ছে না শায়লার।আর, সকাল হলেই চোখের দুটো পাতা যেন নিমিষেই যায় এক হয়ে।
আজ ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না একদম।আর, সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল দুটো জরুরী ক্লাসের কথা।নাহ্! আজকের দিনটা ফাঁকি দেবার জন্য নয়।কিছুদিন পরেই পরীক্ষা।ঝামেলা হতে পারে।শায়লা উঠে বসে তার মোবাইলটা হাতে নিলো।এবার নিজের কান্ড দেখে তার খুব হাসি পেল।এর্লাম সেট করতে গিয়ে এ-ম এর পরিবর্তে পি-এম দিয়েছিল সে ; অর্থ্যাৎ রাত আট।
তাই আর সময় নষ্ট না করে শায়লা তৈরি হলো ইউনিভার্সিটির জন্যে।এর মাঝেই মা এলো শায়লার ঘরে।
-‘ এখনি বের হচ্ছিস তুই? ‘
-‘ হ্যা, কেন মা? ‘
– ‘ থাক তাহলে, পরে বলা যাবে। ‘
-‘ না, বলো তুমি। ‘
-‘ তোর সালাম চাচার ছেলে ডাক্তার,বুঝলি।খুব ভাল ছেলেটা। ‘
শায়লা তার মাকে আর এগোতে দিল না।
-‘ সেকি মা! তুমি জলিলের ওই বুড়ো মাকে আবার বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছো ডাক্তারের সাথে! ‘
– ‘ শায়লা জরুরী কথার সময় ঠাট্টা করবি না তুই। ‘
– ‘ এটা কোন জরুরী কথা না মা।তাছাড়া এখন আমার বিয়ের করবার সময় নয়।আগে আমি জীবনটা একটু নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে চাই। ‘
– ‘ তো এখন কিসের সময় তোর, শুনি? ‘
-‘ এখন আমার উমম…. দাঁড়াও বলছি। এখন আমার মোবাইল কেনার সময়।দেখছো না এটা পুরোনো হয়ে গেল যে! ‘
মা আর মেয়ে দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো।
– ‘ এখন যাই মা, ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে শায়লা।ছোটবেলা থেকেই শায়লার কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি তারা।আর, তাই বাবার সব ভাবনাগুলো যেন শায়লাকে ঘিরেই।তবে, মেয়ের ইচ্ছে বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবার ব্যাপারে তারা আগ্রহী নন।অথচ শায়লার মনের ভাবনাগুলো ছিল সবারই অজানা।এভাবে সম্পূর্ণ
এক অচেনা মানুষ কি করে তার মনের ভাষাগুলো পড়তে পারবে! তার ভাবনার সেই মানুষটা, সামনে এসে দাঁড়িয়েই তার না বলা কথাগুলো বুঝে নেবে।একা কাটানো সময়গুলোতেও সে যেন একা নয়।অদেখা কোন একজনের বসবাস তার হৃদয়জুড়ে।যে যাই বলুক না কেন, একদিন সেই মানুষটার সাথে তার দেখা হবেই।
শায়লার ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।তবে সে বাড়ি ফিরে মাকে দেখতে পেল না।জলিলের মা দরজা খুলে দিলো।
-‘ মা কোথায়? ‘
-‘ আপনের খালার বাসায় গেছে।হাত – মুখ ধুইয়া আসেন, আমি খাইতে দিতাছি।’
-‘না, আমি দুপুরে বাইরে খেয়ে নিয়েছি।তুমি এককাপ চা করে দাও আমাকে।’
খালার সাথে দেখা হয় না কয়েক মাস হলো।তবে, ভিডিও কল করে এক-দুদিন পরপরই কথা হয়।অথচ আমরা সবাই একই শহরে থাকি।কিছু কিছু আধুনিক মাধ্যম কাছের মানুষকেও দূরে ঠেলে দেয় – শায়লা একাকি ভাবছিল।
মোবাইলটা চার্জে দিয়ে, ল্যাপটপ নিয়ে বসলো শায়লা ; খালার সাথে একটু কথা বলতে।সেইসাথে ক’দিন হলো ফেইসবুকে বসবার সু্যোগ পাচ্ছিলো না সে।হঠাৎ ‘বাই এন্ড সেল’ গ্রুপে একটা মোবাইল নজরে পড়লো শায়লার।
ফোনটা মাত্র দুমাস ব্যবহার করা হয়েছে এবং ব্রান্ডটাও শায়লার পছন্দের।যিনি ফোনটি বিক্রয় করতে চাচ্ছেন ; তার নাম ও নাম্বার ওখানে দেয়া ছিল।শায়লা জলদি করে নাম্বারটা টুকে নিয়ে, তাকে ফোন দিল।অপরপাশ থেকে সুমিষ্ট কন্ঠ ভেসে এলো -‘এই মুর্হূতে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ‘
তবে শায়লা হাল ছেড়ে দিলো না।কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করলো।এবার অবশ্য তাকে নিরাশ হতে হলো না কারণ, দুবার রিং বাজতেই শায়লা মাহবুবের কন্ঠ শুনতে পেল।
-‘হ্যালো। ‘
শায়লা নিজের পরিচয় দিয়ে ফোনের কথা মাহবুবকে বললো।
-‘ ও আচ্ছা।কিন্ত, আমি তো ঢাকার বাইরে আছি।বন্ধুর বিয়েতে এসেছি।দুদিন পর আমি ঢাকায় ফিরবো।তারপরে আপনাকে জানাই? ‘
-‘ ঠিক আছে।’
এরপর দুদিন পর মাহবুব শায়লার সাথে যোগাযোগ করে।একটা শপিংমলের ফুডকোডে দেখা করাবার কথা শায়লা মাহবুবকে জানায়।
শায়লা বরাবরের মতোই দুঘণ্টা দেরী করে পৌছালো শপিংমলে।এদিকে বেচারা মাহবুব এতটা সময় ধরে তার জন্যে অপেক্ষা করছে।সব জায়গাতে দেরী করে যাওয়া নিয়ে বন্ধু মহলেও শায়লার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে।মাহবুবকে অদেখা হলেও খুঁজে পেতে বেশি কষ্ট হলো না তার।ফুডকোডে প্রথম যে ছেলেটির দিকে নজর পড়লো শায়লার, সেই ছিল মাহবুব।তারপরও যাতে বিব্রত হতে না হয়, তাই একবার কল দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো সে।
-‘স্যরি,আমি একটু বেশি দেরী করে ফেলছি বোধহয়। ‘
-‘ না, ঠিক আছে। ‘
কথায় কথায় মাহবুব জানতে পারলো, শায়লা এবং সে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।তবে এক ডিপার্টমেন্ট না হবার কারণে, হয়ত কখনো দেখা হয়নি।মাহবুব শায়লাকে ফোন দেবার পর, নিজেও নতুন একটা ফোন কিনে নিলো।মাহবুবের সারল্য প্রথম দেখাতেই শায়লাকে মুগ্ধ করে।যদিও সেটা সে মাহবুবকে বুঝতে দিলো না।মাহবুব খুব বেশি একটা কথা বললো না ; তবে তার বাচনভঙ্গি ছিল আসাধারণ।নতুন ফোন নিয়ে শায়লা বাড়ি ফিরলেও মনটা পড়ে রইলো মাহবুবের কাছেই।আর, কি দেখা হবার কোন সু্যোগ আছে! কোন কাজে মন বসছে না শায়লার।প্রথম দেখাতেই এমন অনুভূতি হতে পারে না।এটা হয়ত মোহ ছাড়া আর কিছুই নয় – এই বলে নিজেকে শান্ত করলো সে। তবে সত্যিই কি শুধু তাই!!
রাতে মাহবুবের ফোন এলো আবার।মাহবুব তার সিমটা ভুল করে শায়লাকে ফোনের সাথে দিয়ে দিয়েছে।আর, শায়লাও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি।ঠিক হলো আগামীকাল আবার দেখা হচ্ছে তাদের।
অবশ্য প্রথমদিনের তুলনায় মাহবুবকে এবার একটু বেশি হাসিখুশী দেখালো শায়লার কাছে।যদিও কারণটা তার অজানা।মাহবুব তার সিম ফেরত নিয়েই চলে গেল না।অনেকটা সময় শায়লার সাথে কিছু সুন্দর মুর্হূত কাটালো মাহবুব।তারপর আর কি! দেখা করবার সব বাহানা তো শেষ।
এদিকে শায়লার পরীক্ষার আর একদিন বাকি।তাই লেখাপড়া নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে গেল।মাঝে একদিন ফোন এলো মাহবুবের।দেখা করতে চাইলো শায়লার সাথে।শায়লাও মনে মনে খুব চাইছিলো আর তাই, পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও মাহবুবকে না করতে পারলো না সে।তবে সেদিন রাতের আট-ন ঘন্টাও যেন ছিল প্রায় চব্বিশ ঘন্টার-ই সমান! সকাল হতে না হতেই শায়লা যেন মাহবুবের মনের রঙেই নিজেকে রাঙালো।
কপালে লাল টিপ, সেই সাথে দুহাত ভর্তি চুড়ি শায়লার মায়েরও নজরে পড়লো।
-‘ কি রে, পরীক্ষার দিনে এত সেজেছিস কেন?! ‘
-‘ অফফ! মা কি যে বলো না। আমি তো প্রতিদিনই এমন ভাবেই তৈরি হই। ‘
শায়লার মা মিটিমিটি হাসলো একটু।এরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মা কি কিছু আঁচ করেছে তাহলে? করলে করুক, এতসব ভাববার সময় এখন কোথায়!
পরীক্ষা শেষ করে শায়লা ছুটলো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে।ওখানেই মাহবুবের অপেক্ষা করবার কথা।শায়লার আসতে যে দেরী হবে, এখন তা মাহবুবেরও অজানা নেই।
-‘ দেরী করে ফেললাম, স্যরি। ‘
-‘ না, ঠিক আছে। ‘
শায়লার চোখে যে আনন্দের ছোঁয়া মাখা ছিল, মাহবুবের চোখে সে তা খুঁজে পেল না।কিছুটা অস্থির লাগছিলো তাকে।শায়লা জানতে চাইলো হঠাৎ কেন দেখা করতে চেয়েছে সে।মাহবুব কি বলবে বুঝতে পারছিলো না,
-‘ দাঁড়াও বলছি।’
শায়লাকে বসিয়ে রেখে সে পায়চারি করতে লাগলো।এদিকে বেচারি শায়লা দুঘণ্টা ধরে কড়া রোদে বসে আছে, অথচ মাহবুব কিছুই বলছে না তাকে।
-‘ কি ব্যাপার! কিছু বলছেন না যে? ‘
এবার মাহবুব শায়লার সামনে বসলো।
-‘ আমাকে একটা বিষয়ে হেল্প করবে তুমি? ‘
-‘ জি, বলুন। ‘
-‘ আমি একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করি। কিন্ত ওকে কিছুতেই তা বলতে পারছি না।তুমি তো মেয়েদের ইমোশন ভাল বুঝবে,আমাকে কি একটু সাহায্য করবে তুমি? ‘
শায়লা মাহবুবের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে – কি বলছে এগুলো মাহবুব! এসব কথা শুনতে কি সে এখানে এসেছে?!
-‘ শায়লা, কিছু বলছো না যে? ‘
– ‘ জি, করবো। আমকে একটু যেতে হবে।একটা জরুরী কাজ আছে, এখন আসি তাহলে। ‘
-‘ ঠিক আছে। ‘
শায়লার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্ত সে মাহবুবকে তা বুঝতে দিলো না।এরপর মনের ভাবনাগুলোকে সরিয়ে, লেখাপড়ায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে শায়লা।দু-দিন পরই মাহববুব আবার ফোন করে তাকে।তবে শায়লা এবার ফোন রিসিভ করলো না।কিন্ত মাহবুব হাল ছেড়ে দিলো না।প্রায় প্রতিদিনই ফোন করতে লাগলো, যদিও তাতে শায়লার কোন সাড়া পাওয়া গেল না।এরপর একদিন ভার্সিটিতে খুঁজে পেল শায়লাকে।তবে সে মাহবুবকে দেখেও এড়িয়ে গেল।মাহবুব পিছু নিলো তার।
-‘ কি হয়েছে শায়লা! আমার ফোন ধরছো না কেন তুমি? ‘
শায়লার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দেখে মাহবুব খুব মজা পাচ্ছিলো মনে মনে।
-‘ কিছু বলছো না কেন? ‘
-‘ আপনি আমার এমন কে, যে আপনার সাথে কথা বলতে হবে? ‘
মাহবুব একথায় একটু হাসলো।
-‘ আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে চলো। ‘
-‘ আজব তো, আমি আপনার সাথে কেন যাবো? ‘
-‘ আহা!! চলো। ‘
মাহবুব এবার কিছুটা জোর করেই শায়লাকে নিয়ে রিক্সাতে উঠলো।তার প্রিয় একটি জায়গাটাতে শায়লাকে নিয়ে বললো,
-‘ আচ্ছা, তুমি কি কিছুই বুঝো না।সবই শুধু মুখে বলে দিতে হয়।আমি যে বার বার কি বোঝাতে চাচ্ছিলাম, তা কি বুঝতে পারছো না তুমি! ‘
-‘ আমি বুঝতে পারিনি। ‘
মাহবুব শায়লার হাতটা ধরলো।
-‘ এবার কি বুঝতে পেরেছেন তাহলে? ‘
শায়লা মাথা ঝাঁকালো।
অবশেষে শায়লা খুঁজে পেল তার স্বপ্নিল ভালবাসাকে ; যার সাথে কোন কারণ ছাড়াই রাগ দেখানো যায়।যদিও মান ভাঙ্গানোর বিষয়ে মাহবুব তেমন পারদর্শী নয়।তবে ইদানিং তাকে চেষ্টা করতে হচ্ছে।
এভাবেই জীবনের বাঁকে কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টির মাঝে ভাল থাকুক ওরা, সঙ্গি করে ভালবাসাকে।