আমি তখন ছায়ানটের রবীন্দ্র সংগীত এর ছাত্রী ছিলাম। ও নাকি চুপি চুপি আমার সব গানের অনুষ্ঠান গুলো দেখত । যদিও এ বিষয় গুলো বিয়ের পর একটু একটু করে জেনে ছিলাম। জীবনের সুন্দর সময় গুলো চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি কখনো ।কোন দিন ভুল করে কল্পনা ও করিনি।
ও নাকি আমার উচু নাক আর নাকের সাদা ছোট ডায়ামণ্ড এর নাক ফুল টা খুব পছন্দ করত।বলতো বাঙালি মেয়েদের এ সুন্দর ব্যাপারটা ও কে খুব আকর্ষণ করে । আর তাই নাকি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগত। কাঁচের চুরির শব্দ নাকি ও কে খুব আন্দোলিত করতো ।কাঁচের চুরির শব্দ নাকি ওকে ক্লান্ত মনে ছন্দ এনে দিত। তাই বিয়ের পর প্রতি মাসে বেতন পেলেই আমার জন্য কাঁচের চুরি নিয়ে আসতো।
মেয়েদের গাড়ো করে কাজল দেয়াটাও ওর ভাল লাগা ছিল । সারাদিন কাজের শেষে আমার গভীর কাজল চোখ নাকি ওকে শান্তি দিতো ।
মেয়েদের গভীর কাজল চোখ নাকি ছেলেদের প্রশান্তময় রাখে ।অনেক ভুল থেকে দূরে রাখে। স্বপ্নময় করে রাখে।
আমি ওর জন্য প্রতিদিন কাজল পরতাম। বিয়ের পর আমাদের প্রতিটি দিন ছিল ভালবাসার কবিতার মতো । সত্যিই আমার সে জীবন টা হয়তো স্বপ্ন কে ছাড়িয়া যায় ।
আমার পঙ্গু জীবনে একটা স্বপ্ন ছিল ।যে স্বপ্নের কাছে কোন দুঃখ ছিল না । ২০০১ এর ১৪ এপ্রিল রমনা দুর্ঘটনা তে আমি পঙ্গু হয়েছিলাম । নিজের জীবন টা কে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হতো ।পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো ।আত্মীয় স্বজন এ সমাজ আমাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখত ।
বিবাহিত বড় ভাইয়ের উপর সংসারটা টানাপোড়নে চলছিল । বাবা ছিল অবসর প্রাপ্ত । বড় অসহায় একজন মানুষ । আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে এবং আমার চিকিৎসার জন্য অনেক খরচ বহন করতে হয় । কে এত সব করবে? মায়ের রাতে ঘুম হতোনা । চারপাশের লোকজন অনেক রকম কথা বলতো ।
আমার মন সব সময় খারাপ থাকতো । আমি জীবনের নানা প্রশ্নের উত্তর খুজতে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম । আমার অসহায় জীবনের নানা অব্যক্ত কথা গুলো আকাশে উড়িয়ে দিতাম । ওর ছোট বোন ছিল আমার আমার গানের ছাত্রী । ওই নাকি গান শিখতে আমার কাছে পাঠিয়ে ছিল।
ওর বোনের নাম অদিতি। ও তখন ক্লাস নাইন এর ছাত্রী। অদিতি প্রতিদিন আমার ভাল লাগা মন্দ লাগা শুনত। আর অদিতির কাছ থেকেই ও আমার খবর নিত।
এভাবেই নিতি কথা গুলো বলছিল । আমি ও নিতি কে চিনি না। মাঝে মাঝে আমি আর আম্মা রমনা পার্কে বিকেলের হাওয়া খেতে বের হতাম। নিতি কে দেখতাম হুইল চেয়ার এ করে একটি জায়গায় বসে বসে কি যেন দেখত।
আমার আম্মা বলত দেখ কি সুন্দর একটা মেয়ে হুইল চেয়ার এ বসে আছে।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমার ও কেমন যেন মায়া লাগত । একটা জানার আগ্রহ মনের মধ্যে তৈরি হল ।একদিন বিকেলে মেয়েটির কাছে গেলাম ।নিজ থেকেই পরিচিত হলাম ।এমন করে মাঝে মাঝেই টুক টাক কথা হত ।অনেক ধরনের গল্প হতো। সমাজ, সংস্কৃতি ,দেশ নিয়ে তার অনেক পড়াশুনা আছে । আমার খুব ভাল লাগত । দুই একদিন রবীন্দ্র সঙ্গীত এ আনন্দময় হয়ে উঠতো আমদের বিকেলটা । সেদিনের বিকেলটাও এমনি ছিল । হুইল চেয়ার এ করে একটি মেয়ে এগিয়ে যেত আর আমি তার পাশে পাশে হাটতাম । রমনার সেই জায়গাটা তে এসে নিতি সেদিন নিজেকে প্রথম বারের মত প্রকাশ করল । আমি অবাক আর বিস্ময় নিয়ে নিতির বেঁচে থাকার গল্প শুনছিলাম । যে রমনার বটমূলে নিতির সুন্দর জীবনের পথ টা অন্ধকার দিকে বেকে গেছে সে জায়গাটা নিতি ভুলতে পারে না । এখানে এসেই জীবন কে খুঁজে ফিরে । নিতি বলে যেতে লাগলো ।
একটি সাধারন বিয়ের ঘটনার মতই দীপ্ত আমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাল । আমদের দুই পরিবারে কোন সমস্যা ছিল না । কিন্তু এ সমাজ দীপ্ত কে নানা ভাবে বিব্রত করত পঙ্গু স্ত্রী কে নিয়ে কেমন আছে এ সব বলে । সব কিছুকে তোয়াক্কা না করে দীপ্ত আমাকে সমান্তরাল ভালবেসে গেছে । আমার প্রতি দীপ্তর সীমাহীন ভালবাসার কাছে এ সমাজের সব অদ্ভুত প্রশ্ন আটকে গেছে।সব অযৌক্তিক কৌতুহল এক বিবেকের কাছে এসে বিনীত হয়েছে।
ও তথাকথিত সমাজের প্রচলিত ধারনাকে ভেঙ্গে দিয়ে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছিল । আমি আমার পঙ্গু জীবন কে ভুলে গিয়েছিলাম । অদ্ভুত ছিল ওর ভালোবাসা ! ২০১১ এর এগার নভেম্বর রাত এগারোটা । পুরো পৃথিবী যেন এক সময়ে বাঁধা ।আমদের বিয়ের নয় বছর পূরণ হল ।ও আমাকে এগারটি লাল গোলাপ আর এগারো রঙের এগারো সেট কাঁচের চুড়ি উপহার দিয়ে অবাক করে দিল । আমার ছেলের বয়স তখন আট । আমি যেন ওর কাছে সব সময়ই নতুন ছিলাম ।ও নতুন নতুন ভাবে আমাকে ভালবাসা প্রকাশ করতো । কিন্তু জীবনের গল্পটা আবার পাল্টে গেলো । ২০১২ এর ২০ ফেব্রুয়ারি ।পরের দিন ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি । অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা । ও ব্যাংকে চাকুরী করতো । প্রতিদিনের মতো বাসায় ফিরছিল । একটা ট্রাক ওর গাড়ী চুরমার করে পালিয়ে গেলো । একটি পঙ্গু অসহায় মেয়ে সারা জীবনের জন্য আবার ও পঙ্গু হল । আমার বেঁচে থাকার জায়গাটা শূন্য হয়ে গেলো । আমাকে আর কেউ কোন দিন এগারটা গোলাপ এনে দিবে না । রবীন্দ্র সংগীত শুনতে চাইবে না। নতুন করে বেচে থাকার স্বপ্ন দেখাবে না । কেউ না ! নিতি কাণ্ণা জড়িত কণ্ঠে আমাকে প্রশ্ন করলো …বলতে পারেন যে জন্য আমি পা হারিয়ে ছিলাম ,যে দুর্ঘটনা আমার স্বামী কে কেড়ে নিলো আমরা কতো টুকু দায়ী ? কবে এ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা গুলো শেষ হবে ? নিতি কাঁদতে থাকল । ওর হাউ মাউ কান্নার শব্দ যেন আমার ভিতরটাকে ভেঙে দিচ্ছিল ।কয়েক ফোঁটা চোখের জল আমাকেও ভিজিয়ে দিল ।
নিতির প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই ।
তবে নিজ মা মাটি আর দেশ নিয়ে গভীর দুঃখ বোধ তৈরি হল । কখন যে নিতি হুইল চেয়ার এ করে অনেক দূরে চলে গেছে টেরই পায়নি । আমি আর পিছন থেকে ওকে ডাকলাম না। তবে খুব ইচেছ করছিল একবার বলি আমিই আপনাকে প্রতিদিন এগারটা করে গোলাপ দিব ।
কারণ একজন মানুষ হিসাবে কিছু না করতে পারাটা ওকে আর ডাকতে দিল না ।আমার ভেতরেও একটা ব্যর্থ হৃদয় চূরমার হতে লাগলো।
আমিও আর পিছনে তাকাতে পারলাম না ।কিংবা ওর দিকে তাকানোর সব শক্তি হারিয়ে ফেলে ছিলাম।