সোনিয়ার বাবা ও তার দেশ

সোনিয়ার বাবা ও তার দেশ

সোনিয়াটা খুবই এলোমেলো। ঘরের কোন কিছুই গুছিয়ে রাখতে পারে না। কোন জিনিস কেথায় রাখে, কাজের সময় খুঁেজ পায় না। শুধুই কি এলোমেলো! ক্লাসের অন্য মেয়েরা যখন ক্লাস পার্টিতে আনন্দ, হুই-হুল্লা নাচে-গানে মাতিয়ে তুলে তখন সে পাশের ফুল বাগানে প্রজাপতি, ফড়িং, পোকা-মাকর আরো কতকিছু নিয়ে পড়ে থাকে। প্রজাপতি তার খুব পছন্দের। সে প্রায়ই তার বান্ধবীদে বলে প্রজাপতি হলো প্রকৃতির অলংকার। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তার এই কথা শুনে বান্ধবীরা খিল খির করে হাসে। ঘরে শতাধিক প্রজাতির প্রজাপতি সহ যেমন সম্প্রতি আবিস্কার হওয়া Purple Sapphire, Common Tinsel ও Orange Awlet. এর মতো প্রজাপতিও তার সংগ্রহে আছে। শুধুই কি প্রজাপতি তার কাছে আছে অনেক প্রজাতির পোকা-মাকর এর নাম । এত্ত. . এত্ত. . নাম পরে শেষ করা যাবে না।

ইদানিং আজব জিনিস নিয়ে গবেষনা শুরু করেছে। জীব এর সৃষ্টি কি করে হলো। মেধাবী ছাত্রী সোনিয়া। জীব বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান পরিক্ষায় ক্লাসের মধ্যে অন্যদের তুলনা সেরা নম্বর তুলে। ইতি তার বান্ধবীদের মধ্যে সেরা বান্ধবী। মাঝে মাঝে তার এই সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথার শেয়ার করে। সে যায়ই করে ইতিকে সব বলে দেয়। আজও একটা কান্ড ইতিকে বলেছে।
ইতি খুব দুষ্টু মজা করার জন্য ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছে কাউকে বলে নাই।

ক্লাস টাইমে প্রাণী বিজ্ঞান স্যারকে বলে দেবে। ব্যাপারটা তাই ঘটলো। ক্লাসের সমস্ত ছাত্রীদের সামনে ব্যাঙ্গ করে পট পট করে স্যারকে সব বলতে থাকে ..

“স্যার সোনিয়া আজকে একটা বিশাল কিছু আবিস্কার করে ফেলেছে”
ক্লাসের অন্যান্যদের চোখে কৌতুহল, গবেষক সোনিয়া কি আবিস্কার করলো। সবাই হাসাহাসি করছে।
সোনিয়া পেছন ব্যাঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে, স্যারের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে । স্যার আমি প্রাণী দেহের উৎপত্তি জীব থেকে না জর পদার্থ থেকে সেটা দেখার জন্য একটি এক্সপ্রিমেন্ট চালিয়েছি মাত্র।

কিভাবে ?
আমি কিছু গম চাল একটি ভেজা কাপড়ের মধ্যে রেখে দুই পাশে কাঠ দিয়ে চাপ দিয়ে একটি অন্ধকার স্যাঁত স্যাঁতে জায়গায় রেখে দিয়েছিলাম। কিছুদিন পরে সেই কাঠ দিয়ে চাপানো কাপড়টি খুলতেই দেখলাম সেই গম আর চাল থেকে একধরনে বড় বড় পোকা হয়েছে।
তার মানে জর পদার্থ থেকে জীবের সৃষ্টি হয়েছে।

স্যার সোনিয়ার কথা শুনে হেসে উঠে বলে : শোন তুমি মনে হয় বিজ্ঞানী ডারউনের প্রাণী বিবর্তনের মতবাদ এক্সপ্রিমেন্ট করতে গিয়েছে। শোন ঐ জর পদার্থের মধ্যে আগে থেকেই ছোট ছোট আকারে ঐ পোকগুলো ব্যকটেরিয়া আকারে ছিলো। যা তুমি অনুবিক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করলে দেখতে পাবে। প্রাণীর সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে এত জটিল বিষয়টি এখনও পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানী আবিস্কার করতে পারে না। তাছাড়া প্রাণী বিবর্তনের মতামত পর্যবেক্ষন দেখা যায় আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগের তেলাপোকার যে আকৃতি ছিলো আজও তেলাপোকার একই আকৃতি রয়েছে। তবে কিছু কিছু প্রাণীর বিলুপ্তি হয়েছে তাদের মধ্যে ডায়োনেসার অন্যতম বৃহৎ একটি প্রাণী ছিলো।

কথাগুলো শুনা মাত্রই ইতি হি :.. হি:.. করে হেসে বলে বত বড় প্রাণী হাতীর থেকেও বড়।
স্যার একটু হেসে বলে না, হাতী তো ছোট একটি প্রাণী সবচেয়ে বড় তিমি মাছের নাম শুনেছে। সেই তিমি মাছ ডাইনোসারের পায়ের সমান হবে ।

ইতির মাথায় এই সব কিছুই ডুকছে না সে শুধু জানে তার ক্লাসের রাহিম খুবই দুষ্টু। টিচার শ্রেণীকক্ষে থেকে চলে গেলেই বেঞ্চের উপর উঠে লাফালাফি শুরু করে দেয়। একদিন অবশ্য রাহিমকে সে বানর বলেছিলে। রাহিম রেগে গিয়ে তাকে ইবলিস শয়তান বলেছে। এখন আবশ্য প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এসেছে। তাই তড়িঘরি করে বলে ফেলে
“স্যার মানুষ এর পূর্ব বানর আকৃতি ছিলে, সোনিয়ার মতো এক্সপ্রিমেন্ট বানর ?
সেনিয়া : রেগেমেগে.. হোয়াট ?

মানুষের পূর্ব বানর নয়,। বন মানুষের মতো ছিলো এটা প্রাণী বিবর্তনের মতবাদ। তাছাড়া ক্লাসের সবাই শোন, ডারউনের বিবর্তনের মতাবাদ এর কথা আমরা সবাই জানি। জীব এর সৃষ্টির রহস্য। এটা একমাত্র মহান আল্লাহ্ তালা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। তবে তিনি মানুষ এবং জ¦ীন সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কাদাঁমাটি দিয়ে আর জ¦ীনকে আগুন দিয়ে। এটাই হচ্ছে জীব সৃষ্টির রহস্য। এরই মধ্যে ছুটির ঘন্টা পরতেই সকলের আনন্দ আর হই হুল্লের মধ্যে এদিক সেদিক
ছোটাছুটি করছে কেউ মাঠটির পাশেই খোলা বাগান। বাগানে বেশ বড় বড় গাছ সেখানে লুকিয়ে লুকিয়ে মোবাইলে বয় ফ্যান্ডের সাথে আলাপ ঝুরিয়ে দেয়। সোনিয়া সেখান থেকে সোজা কলেজ লাইব্রেরীতে। বই হচ্ছে তার বয় ফ্রেন্ড। নাম তার সোনিয়া কিšু‘ তার মনের ভেতর রয়েছে অন্য একটি দুনিয়া। মোবাইলে শুধু দুইটি নাম সোভ করা একটি তার বাবার অন্যটি মায়ের আর কোন নম্বর তার মোবাইলে নেই।

সোনিয়ার বাবা সহকারী হিসাব রক্ষক। সরকারী চাকুরী করে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে চাকুরীটা পেয়েছেন। শুনেছি ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় সোনিয়ার বাবা খুব ছোট ছিলেন। সোনিয়ার বাবাটা খুবই সৎ ও দেশ প্রেমিক। কলেজে গেইটে পাশে সবচেয়ে দামী গাড়ীটা সোনিয়ার বান্ধবী বিলাসীর। বিলাসী বাবা বিল্টু চৌধুরী প্রায় বিলাসীকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যায় সেই সুবাধে পরিচয়। সোনিয়াদের ফ্যামিলি খুবই হিসাবে মধ্যে চলে। বারতি খাওয়াদাওয়া, আনন্দ, শখ-আল্লাদ মেটানো কোন আয় নাই। সোনিয়ার বাবা যা বেতন পায় তাই দিয়ে সারা মাস খুবই হিসেব করে চলতে হয়।

সোনিয়াদের ফ্যামিলির সাথে বিল্টু চৌধুরী খুবই আন্তরিক রিলেশন। মাঝে মাঝে বাজার থেকে সবচেয়ে বড় মাছ কিনে নিয়ে যায় সোনিয়েদের বাসায়। আরো কত্ত কি। সোনিয়া মা বিল্টু চৌধুরীর এই আন্তরিকতা দেখা খুশি হয়ে যেতেন। এখন আর সেই আন্তরিকতা নেই। দিনটি ছিল শুকবার সোনিয়ার বাবা শামসুল হক বাসায়। বিল্টু চৌধুরী সেদিন সকাল-সকাল দ্ই আর রসগোল্লা নিয়ে হাজির। সোনিয়ার পড়ার রুমে সোনিয়াকে পড়াচ্ছিলো তার বাবা । বিল্টু চৌধুরী কি সব ফাইল/ টাকা / প্রজেক্ট ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করছিলো আর সোনিয়ার বাবাকে এক সুটকেস ভরা টাকা দেখিয়ে বলছে ” ভাই আমার কাজটা আপনিই করে দিতে পারেন।” প্লিজ আপনাকে আরো যত টাকা চান আমি দিবো।

সোনিয়া দুর থেকে টাকা গুলো দেখছে এত টাকা সে কখনো দেখে নি” ।
সোনিয়ার বাবা হঠাৎ উত্তোজিত হয়ে উঠে বলে “ আমাকে ঘুষখোর পেয়েছেন, আমাকে টাকার লোভ দেখাচ্ছেন ” নিয়ে যান আপনার টাকা। টাকা খেয়ে আমি এদেশের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি এই দেশের সাথে কোন বেইমানী করতে পারবে না। আপনি জানেন কোন পারবো না … জানেন জানেননা……

সোনিয়ার বাবার আবার অল্পতেই প্রেসার উঠে যায় । তাই সোনিয়া দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে “বাবা শান্ত হও”। সোনিয়ার বাবা বিল্টু চৌধুরীকে ভালো মানুষ বলে বিশ্বাস করতে। তাই কষ্ট পেয়েছে কন্নাজর্জরিত কন্ঠে বলে উঠে “ ৭১ এদেশের জন্য আমার বাবা ভাই বোন সবাইকে জীবন দিতে হয়েছে। তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। পাশের একটি কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে ডুব দিয়ে বেচেঁ যাই। আমি এতিম । একা একা ৪০ টি বছর নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছি আপনি বুঝবেন না। কত না খেয়ে থেকেছি, রাস্তায় ঘুমিয়েছি। কেউ আমার পাশে দাড়াঁয় নাই। আমি সংগ্রাম করে বাচঁতে জানি। আমাকে লোভ দেখাবেন না। স্বজন হারানো ব্যাথা কত ভংয়কর কষ্টের। . . . . . . . .

বিল্টু চৌধুরী এমনটি আশা করে নাই। শাসসুর হকের মতো সৎ আদর্শবার মানুষ এখন বেঁচে আছে। তরিঘরি করে দুঃখ প্রকাশ করে চলে যায় বিল্টু চৌধুরী ।

বিল্টু চৌধুরী চলে গেলেও সোনিয়ার বাবার কষ্টগুলো বৈশাখী ঝরের মতো দুমরে মুচরে যাচ্ছে। সোনিয়া আগে কখনো বাবার এই রূপ দেখে নাই। সোনিয়া জানেও না সোনিয়া দাদা দাদি চাচ্চু ফুপি সবাইকে এমন নিমর্ম ভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। সোনিয়া অনেক মহৎ ব্যক্তিদের নাম শুনেছে। বইয়ে অনেক মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পড়েছে।

কিন্তু আজ সোনিয়ার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহৎব্যক্তিটা হচ্ছে তাঁর বাবা। কথাগুলো ভাবতেই সোনিয়ার চোখ বেয়ে পানি পরতে থাকে। আবেগ আর গর্ব জড়িত এই পানি সোনিয়াকে দেশ মাতৃকায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া দাদা,দাদী ফুফু সবার প্রতি ভালোবাসার মমত্ববোধ আরো বাড়িয়ে দেয়। গরীবের সন্তান হয়েও সেনিয়া একজন আদর্শবান বাবার মেয়ে এটা তার অহংকার। সোনিয়ার মতো মেধাবী বুদ্ধিমতি মেয়ে এদেশের জন্য খুবই প্রয়োজন।

তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে একজন বড় বিজ্ঞানী হবে, দেশ ও মানুষের কল্যানে নিজেকে উৎসর্গ করবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত