সাদিয়ার গল্প

সাদিয়ার গল্প

স্কুল থেকে বেরোতেই কেউ একজন আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। প্রথমে ভাবলাম হয়ত কোন ছিনতাইকারী হবে। পেছনে ঘুরতেই আমার ভুলটা ভেঙে গেল। আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম সাদিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। একেতো স্কুল, দ্বিতীয়ত আমি একজন শিক্ষক, তার উপরে একজন মেয়ে মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। স্কুল ছুটির সময় এখন। ছাত্র ছাত্রীরা বের হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম।

সাদিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয় আরো পাঁচ বছর আগে। তখন সবেমাত্র আমার শিক্ষকতার জীবন শুরু হয়। আমি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কোন এক স্কুলে পড়াতাম। সাদিয়া সেই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।
স্কুলের প্রথম দিন যখন সবার সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম তখন মেয়েটাকে অন্যসব মেয়ের মতই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। আমার এই ভুল ধারণা ভাঙতে বেশিদিন সময় লাগেনি।
সে একটু বেশিই চঞ্চল ছিল। আমি যখন ক্লাস করাতাম তখন সে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকত। ব্যাপারটা এমন ছিল যেন সে খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছে। প্রথম প্রথম আমিও এমনটাই ভাবতাম। পরে বুঝলাম যে ডাল ম্যা কুচ কালা হ্যায়।

সাদিয়া যে খুব ভাল ছাত্রী ছিল তেমন কিন্তু না। সে ক্লাসে কখনওই সামনের বেঞ্চে বসতনা। মাঝখান থেকে আমার উপর সজাগ দৃষ্টি রাখত। পড়ানো শেষে আমি যখন জিজ্ঞাস করতাম সবাই বুঝতে পেরেছ তখন সাদিয়া বুঝুক অথবা না বুঝুক হাত তুলে বলত আমি বুঝিনি স্যার। অনেক সময় তার প্রশ্নগুলো পাঠ্যবই থেকে বাহিরে চলে যেত।
একদিন তো সে খুব অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল, যা শুনে সবাই হেসে দিল। সে বলল — হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের বিক্রিয়াই যদি পানি উৎপন্ন হয় তাহলে নারী পুরুষের বিক্রিয়ায় কি উৎপন্ন হবে স্যার? এই প্রশ্ন করার পর আমি তাকে নিষেধ করে দেই সে যেন ক্লাসে আর প্রশ্ন না করে। যদি কোন কিছু না বুঝ তাহলে আমাকে আলাদাভাবে বল। আমি বুঝিয়ে দেব। এরপর থেকে সাদিয়ার না বুঝার মাত্রাটা আরো বেড়ে গেল। সে প্রায়ই আমার কাছে চলে আসতো পড়া না বুঝার অজুহাতে। সমস্যা সেই আগেরটাই। কখনো পাঠ্যবই থেকে আবার কখনো পাঠ্যবই এর বাহিরে থেকে প্রশ্ন করত।
একদিন সে নিউটনের সূত্র নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়ে গেল।

– আজকে আবার কি সমস্যা?
– স্যার! নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা কাজ করছেনা।
– কিভাবে বুঝলে?
– এই যে আমি প্রতিদিন কোন না কোন সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে আসি, আপনিতো কখনো আমার কাছে আসেননা। তাহলে যে নিউটন বলল প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এখানে বিপরীত প্রতিক্রিয়াটা কোথায় স্যার?
– আমি যে তোমার সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছি এখানে এটাই হচ্ছে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। তাছাড়া আমি কেন তোমার কাছে যাব?

আমি বুঝতাম সে কি বলতে চাই। এই বয়সে আবেগ আসাটাই স্বাভাবিক। আমারতো আর আবেগের বয়স নেই তাই আমি কখনওই এসবের প্রশ্রয় দেইনি। আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে যেতাম।
আমার থাকা খাওয়ার অসুবিধার কথা বিবেচনা করে স্কুলের সভাপতি আমাকে তার বাড়িতেই থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। সাদিয়া ছিল স্কুলের সভাপতি সাহেবের একমাত্র মেয়ে। বাড়িতে থাকার সুবাধে সাদিয়া আমার আরো কাছে আসতে শুরু করে। আমি বিকেলবেলা প্রায়ই হাটতে বের হতাম।
এমনই এক বিকেলবেলা সাদিয়া শাড়ি পড়ে এসেছিল আমার কাছে।

– স্যার কি বাহিরে যাচ্ছেন?
– হুম!
– আমি আসি আপনার সাথে?
– তুমি কেন আসবে আমার সাথে? তাছাড়া লোকে দেখলে কি ভাববে?

সাদিয়া কিছুটা মন খারাপের ভাব করে বলল — আজ আমার জন্মদিন। অন্তত জন্মদিনের উপহার হিসেবে আমাকে আপনার সাথে আসতে দিন।
আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে বললাম — কোথায় যাবে?
সাদিয়া হাত দিয়ে ইশারা করে বলল — আমাদের গ্রামের ঐদিকে একটা বড় দীঘি আছে। খুব সুন্দর জায়গা। চারিদিকে গাছগাছালি, নিরবতা।

– নিরব জায়গাতে যাওয়ার দরকার নেই। আমরা বরং অন্য জায়গায় যায়। সাদিয়া আস্তে করে বলল — আমি আর আপনি হাতে হাত রেখে হাটব আর গল্প করব তার জন্যতো নিরব জায়গায় উত্তম।
– কিছু বলছ নাকি?
– না স্যার। চলেন দীঘির পার থেকে ঘুরে আসি।

এরকম প্রায়ই বিভিন্ন অজুহাতে সাদিয়া আমার সাথে বিকেলবেলা হাটতে বের হত। আমাদের এরকম বের হওয়াটা এলাকার মানুষ সহজভাবে নিতে পারেনি। লোকমুখে বিভিন্ন কথা রটতে লাগল। একই বাড়িতে থাকা আর আমার প্রতি সাদিয়ার দুর্বলতা, মাঝেমাঝে সাদিয়াকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া সব মিলিয়ে লোকমুখে কথাগুলো আরো বেগবান হতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে সভাপতি সাহেব নিজের সম্মান রক্ষার্থে আমাকে স্কুল আর বাড়ি উভয় জায়গা থেকে বহিষ্কৃত করলেন। তারপর আমি চলে আসি চট্রগ্রামে। এরপর সাদিয়ার সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু আজ পাঁচ বছর পর সে কোথায় থেকে হাজির হল আমি বুঝতে পারিনি। তার কাছে তো আমার ঠিকানা ছিলনা। তাহলে আমাকে খুজে পেল কি করে?

– কি করছ? ছাড়ো, লোকজন দেখছে।
– দেখলে দেখুক, আমি ছাড়বনা। ছাড়লেই আপনি পালিয়ে যাবেন।
– আচ্ছা পালাবো না। এবার ছেড়ে দাও।
– না ছাড়বনা। পাঁচ বছর আগেও কিছু না বলে পালিয়ে গেছেন। ছেড়ে দিলে আজকেও পালিয়ে যাবেন।
– এই যে দেখ কথা দিলাম। আমি আর পালাবো না। কিছুটা অভিমানের স্বরে সাদিয়া বলল — সত্যি তো??
– সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি। আমার কথা শুনে সাদিয়া হাত ছেড়ে দিয়ে ফিক করে হেসে দিল।
– তুমি এখানে কি করে এলে? একা এসেছ? আমার ঠিকানাই বা পেলে কোথায়?
– আমি সেই… কখন থেকে এখানে আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ক্ষিধায় আমার পেট চু চু করছে। কোথায় আমাকে খাওয়ার কথা বলবেন তা না করে এক বস্তা প্রশ্ন আমার দিকে ছুড়ে দিলেন।একথা শুনে আমি কিছুটা লজ্জিত হলাম আসলেই তো! দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল এখন। না জানি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে।

– সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চল যায়। আমি খেতে খেতে বললাম — তুমিতো বললেনা তুমি এখানে কি করে এলে।
– গাড়ি করে এসেছি। একথা বলেই সাদিয়া হেসে দিল।
– তুমি এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছ। সাদিয়া কিছুটা জোড় গলায় বলল — আমি মোটেও বাচ্চা না। আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। মেয়েটা এখনো আগের মতই রয়ে গেছে।
– বললে না তো তুমি কি করে এখানে এলে?
– বললাম তো গাড়ি করে এসেছি। একথা বলে সে আবার ফিক করে হেসে দিল।
– একা এসেছ নাকি কেউ এসেছে সাথে?
– একা আসিনি। বাবা মা সাথে এসেছে।
– আগে বলবেনা?
– আগে বললে কি করতেন? আমি কিছুটা রেগে বললাম — কি করতাম মানে? ওনারা খাবেনা?
– সেই চিন্তা আপনাকে করতে হবেনা। মা বাবা খেয়ে নিয়েছেন। আমাকেও বলেছিল কিন্তু আমি যায়নি।
– কেন?
– যায়নি যদি আপনি পালিয়ে যান।
– ওনারা এখন কোথায়?
– আছে হয়ত আশেপাশেই। দেখা করবেন? দাঁড়ান আমি এক্ষুণি কল দিচ্ছি।

সাদিয়ার মা বাবা আসলে তাদেরকে নিয়ে আমি আমার বাসায় চলে আসি। সাদিয়াকে বললাম তুমি ভিতরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। অনেক ক্লান্ত লাগছে তোমাকে। কিন্তু সে যেতে চায়না। তার ধারণা সে ভিতরে চলে গেলে আমি আবার পালিয়ে যাব।

– তুমি যদি এখন না যাও তাহলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি পালিয়ে যাব। একথা শুনে চুপচাপ ভিতরে চলে গেল। সাদিয়া চলে যাওয়ার পর আমি সাদিয়ার মা বাবার সাথে কথা বললাম।
– আপনারা আমার ঠিকানা পেলেন কোথায়? আর সাদিয়াকে এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন?

সাদিয়ার বাবা বলল — তুমি তো আমাদের পাশের বাড়ির খোকনরে চেন। গতকালকে সে বাড়িতে এসে বলল চট্রগ্রামে নাকি তোমার সাথে খোকনের দেখা হয়েছে। সাদিয়া যখন জানতে পারল তুমি চট্রগ্রামে আছ তখন সে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল। সাদিয়া তোমার কথা শুনামাত্রই আমাকে এসে বলল — বাবা এখনি আমি চট্রগ্রাম যাব। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা ওকে আসতে দেইনি। রাতে আমার মেয়েটা একদম ঘুমাইনি। তোমার সাথে দেখা হবে ভেবে তার চোখের পাতায় একদম ঘুম আসেনি। সকালবেলা খোকন থেকে ঠিকানাটা নিয়ে তোমার কাছে চলে আসলাম।

– বুঝলাম কিন্তু সাদিয়া এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন?
– এর কারণটা তুমি।
– আমি???
– হ্যা তুমি। তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর থেকেই সাদিয়া ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতোনা, ঠিকমত ঘুমাতোনা। এমনকি সে আর পড়াশুনাও করেনি শুধু তোমার কারণে। সাদিয়া সবসময় তোমাকেই খুঁজত। সে পড়াশুনা না করলেও দিনের পর দিন স্কুলে গিয়ে বসে থাকতো তুমি ফিরে আসবে এই আশায় কিন্তু তুমি এলেনা।
একটু থেমে সাদিয়ার বাবা আবার বলতে লাগলেন। — আমি জানি আমরা তোমাকে চাকরিচ্যুত করে, বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে অন্যায় করেছি। এখন আমাদের ভুলের মাশুল আমাদের মেয়ে দিচ্ছে। এটা বলতেই ওনার চোখ দু’টো ভিজে গেল। তারপর সাদিয়ার মা বলল — আমরা তোমাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পায়নি। আর পাবই বা কি করে তুমি তো কোন ঠিকানা রেখে যাওনি। তাদের কথাশোনার পর আমি খুবই বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে আমার মত এতিম চালচুলোহীনকে কিভাবে কেউ এত ভালবাসতে পারে। এরপর আমি তাদেরকে বললাম

– দেখেন চাচা! সাদিয়ার আচরণ দেখে আমি আগেই এগুলো আঁচ করতে পেড়েছিলাম। তখন ওর বয়স খুব কম ছিল। আর কমবয়সে আবেগে আসাটা স্বাভাবিক। তাই আমিও এটাকে আবেগ ভেবে কখনো প্রশ্রয় দেইনি। ব্যাপারটা এমন না যে সাদিয়াকে আমার ভাল লাগতো না। সাদিয়ার সাথে কথা বলতে, ঘুরতে যেতে, ওর বাচ্চাসুলভ আচরণগুলো আমার খুবই ভাল লাগতো। কিন্তু ভাল লাগলেই তো আর ভালবাসা যায়না। আমার আর সাদিয়ার মাঝে বয়সের পার্থক্যটা ছিল অনেক। তাছাড়া আমি হলাম এতিম চালচুলোহীন একটা ছেলে। এতসব ভেবে আমি সবসময় সাদিয়া থেকে একটা নিরাপদ দুরত্বে থাকতে চাইতাম। আমার এভাবে দূরে আসা তার ভালবাসাটাকে আবেগ মনে করা আমার ভুল ছিল। এমন হবে জানলে আমি কখনওই সাদিয়াকে ছেড়ে আসতাম না।

– এখন আপনারা কি চান?
– আমাদের একটাই মেয়ে। আমরা তাকে হারাতে চাইনা। তার সুখই আমাদের সুখ।
– আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন, দয়া করে খুলে বলেন।
– আমি ও সাদিয়ার মা মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর সেটা হল আমরা চাই তুমি সাদিয়ার দায়িত্ব নাও।
– আপনারা কি ভেবে বলছেন?

সাদিয়ার মা বলল আর ভাবাভাবির কিছু নাই। তোমাকে একবার হারিয়ে আমার মেয়েটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আবার যদি সাদিয়া তোমাকে হারিয়ে ফেলে তাহলে আমার মেয়েটা নির্ঘাত মারা যাবে। সাদিয়ার বাবা সাদিয়ার মায়ের কথাকে সমর্থন করে বললেন  তোমার চাচী ঠিকই বলেছে। এবার বল তোমার মতামত কি?

– আমি আর কি বলব? আপনারা যা বলবেন তাই হবে।

এর দু’দিন পরেই সাদিয়ার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ে ছাড়া যে আর উপায় ছিলনা। সাদিয়া আমাকে বিশ্বাসই করতে পারতনা। তার ধারণা আমি সুযোগ পেলেই পালাব। এ দু’দিন একটু সময়ের জন্যও সাদিয়া আমার পিছু ছাড়েনি। আমি যেখানে গিয়েছি সে ও সেখানে আমার সাথে গিয়েছে। আমি না করলেও জোড় করে এসেছে। এমনকি ওয়াশরুমে গেলেও সে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সেদিন রাতে খাওয়ার পর সাদিয়াকে বললাম এবার ঘুমাতে যাও আবার কাল সকালে দেখা হবে। কিন্তু সে কিছুতেই যাবেনা। পরে অনেক বুঝিয়ে ঘুমাতে পাঠালাম। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা আমার অভ্যাস। রুমের দরজা খুলে বেরুতেই দেখি দরজার পাশে হেলান দিয়ে সাদিয়া বসে আছে। আমি সাদিয়াকে ঘুম থেকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– এখানে ঘুমাচ্ছ কেন? ভিতরে গিয়ে ঘুমাও।
– না সমস্যা নেই। আপনি এত সকালে উঠে গেলেন যে? পালানোর মতলব আছে নাকি? আমি মৃদু হেসে বললাম যে আমাকে এত ভালবাসে তাকে ছেড়ে আমি কোথায় পালাব? সাদিয়া আমার কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাস করল বাহিরে যাচ্ছেন?
– হ্যা! আমি প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হয়। যাবে তুমি?
– যাব মানে! আপনি বললে বিশাল সাগরের মাঝে যেতেও রাজি আছি।

আমি জানি সে এখানে কেন বসেছিল। এখনো সাদিয়ার ধারণা যে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব। আমি এটাও জানি যে আমি যদি যেতে নাও বলি তাও সে আমার পিছুপিছু আসবে। আমি যেখানে শিক্ষকতা করি সাদিয়া সেখানেও চলে আসত। প্রথম প্রথম সহকর্মীরা সাদিয়াকে দেখে অনেক অবাক হয়েছিল। পরে আমি তাদেরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার তারাও সাদিয়াকে সহজভাবে দেখতে লাগল। সাদিয়ার মা বাবা মেয়ের এমন দুরবস্থা দেখে আর দেরী করতে চাইনি। তাই দ্রুতই বিয়েটা করতে হল। বাসরঘরে ঢুকেই দেখি সাদিয়া বিছানার মাঝখানে বসে আছে। আমি কাছে গিয়ে ঘোমটা উঠানোর জন্য হাত বাড়াতেই সে সরে গেল।

– কি হল?
– আমার লজ্জা লাগছে!
– হয়েছে আর লজ্জা করতে হবেনা। এবার কাছে এসো। দেখি তোমাকে একটু। সাদিয়া মৃদু হেসে বলল একটু দেখবেন, বেশি দেখবেন না??
– আচ্ছা বেশি দেখব। এবার তো কাছে আসো।

বধূ সাজে সাদিয়াকে কেমন লাগছিল সেটা না হয় নাই বা বললাম। সাদিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসেছিল। ঠোটের কোণে মুচকি হাসিটা লক্ষ্যণীয়। ইচ্ছে হচ্ছিল ইশ! সময়টা যদি এখানেই থেমে থাকত। রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে দেয়াল ঘড়ির আওয়াজ জানান দিল যে সময় থামার পাত্র না। বিয়েরদিন ছাড়াও আজকের দিনটা আরেকটা কারণে বিশেষ দিন। আর তা হল আজকে সাদিয়ার জন্মদিন। আমি সাদিয়াকে বললাম — তোমার জন্য উপহার আছে। এই বলে আমি বিছানা থেকে নেমে গিয়ে পাশে রাখা আলমারি থেকে ৪টা শাড়ি এনে সাদিয়ার হাতে দিয়ে বললাম।

– শুভ জন্মদিন সাদিয়া। সাদিয়া কিছুটা অবাক হয়ে বলল আপনি আমার জন্মদিন আজও মনে রেখেছেন??

– যাকে মনে স্থান দিয়েছি তার জন্মদিন ভুলে যাব এটা কি হতে পারে? সাদিয়া একটু অভিমানের স্বরে বলল হয়েছে হয়েছে! আর চাপা মারতে হবেনা। কতটুকু মনে রেখেছেন তা তো দেখলামই। পাঁচ বছরে একবারও আমাকে দেখতে আসেননি। পাষাণ হৃদয়ের মানুষ একটা।

– মনে না রাখলে কি তোমার জন্য উপহার কিনে রেখেছি? দেখ সবগুলো শাড়িই তোমার পছন্দের গাঢ় লাল রঙের। এই তোমার না একটু আগে লজ্জা লাগছিল। এখন লজ্জা কোথায় গেল?
– লজ্জাদের এখন ছুটি দিয়ে দিয়েছি। একথা বলেই সাদিয়া হেসে দিল।
– ৪টা শাড়ি কেন?
– ৪টা দিলাম কারণ গত চার বছরে তোমার জন্মদিন উপলক্ষে আমি এই চারটা শাড়ি কিনেছিলাম। কিন্তু তোমাকেদেওয়া হয়নি।
– ৪বছরে যদি ৪টা হয় তাহলে তো ৫বছরে ৫টা হওয়া উচিৎ। তাহলে আমার পাঁচ নম্বর উপহারটা কোথায়?
– আমিই তোমার পাঁচ নম্বর উপহার। আমার থেকে বড় উপহার আর কি চাও?

একথা শুনে সাদিয়া মনে হয় কিছুটা লজ্জা পেয়েছিল। তাই তো সে শাড়ির আচলে মুখ লুকালো। এভাবে অনেক কথার মধ্য দিয়েই বাসর রাতটা পার হয়ে যায়। সবকিছু বললাম না কারণ বাসর রাত তো। কিছু কথা গোপন থাকায় ভাল। বিয়ের পরে সাদিয়া আমার বুকটাকেই বালিশ বানিয়ে নিয়েছিল। আমার বুকে মাথা রেখেই সে ঘুমাতো। প্রায় তিন মাস যাওয়ার পর সাদিয়া অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠে। সাদিয়া আমার জীবনে না আসলে আমি কখনওই বুঝতাম না জীবনে সুখ বা ভালবাসা কি।

বছর ঘুরে আমাদের ঘরে এলো জুনিয়র সাদিয়া। এখন সাদিয়ার দায়িত্ব ও কাজ দু’টোই বেড়েছে। জুনিয়র সাদিয়াকে সামলাতে গিয়ে সাদিয়া এখন অনেক ব্যাস্ত। এখন সাদিয়া আমাকে আগের মত সময় দেইনা। জুনিয়র সাদিয়া আমার ভালবাসায় ভাগ বসিয়েছে। যদি বলি তুমি আমাকে আগের মত ভালবাসনা কেন তাহলে সে দুষ্টুমি করে বলে আপনি জানেন না বিবাহিত পুরুষদের প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ কম থাকে। আরে ভাই সবসময় কি আর মিষ্টি মিষ্টি ভালবাসা ভাল লাগে? টক ঝাল ছাড়া মিষ্টির কদর বুঝা যায়না। এটা হল টক ঝাল মিষ্টি ভালবাসা। এই বিশাল পৃথিবীর মাঝে সাদিয়া আর জুনিয়র সাদিয়াই আমার আরেক ছোট্ট পৃথিবী।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত