অফিসে বসে বসে একটা ফাইল সমাধান করার চেষ্টা করছি অনেকক্ষণ ধরে। এমন সময় মেসেঞ্জারের টুন করে বেজে উঠা শব্দটা শুনে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকালাম। দেখি পাগলি নামের একটা আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। অবশ্য নামটা আমারই দেওয়া, কারণ মেসেজকৃত মেয়েটা আর কেউ নই আমার একমাত্র বউ ছোঁয়া। এই ভরদুপুরে আবার কি মনে করে মেসেজ করলো কে জানে। বউয়ের ফোনকল বা মেসেজ আশা মানে দশ নং বিপদসংকেতের থেকে কম কিছু না। অবশ্যই কিছু না কিছু একটা কারণ থাকবেই। ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকতে আবারো আরেকটা মেসেজ আসলো। এবার ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করতেই দেখলাম একটা ৩ বছরের ছোট বাচ্চার সাথে আমার বউ সেল্ফি তুলে পাঠিয়েছে। সাথে সাথে রিপ্লে দিলাম।
—বাচ্চাটা কার? অনেক কিউট তো। ওপাশ থেকে বউ টাইপিং করছে।
—আমার ছেলে।
মেসেজটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য শরিরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো আমার। বউয়ের ছেলে মানে তো আমারই। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো আমিই চিনি না আমার বাচ্চাকে। সাথে সাথে রিপ্লে দিলাম।
—তোমার ছেলে মানে?
—ওতো মানে মানে করছো কেন?
আমার ছেলে মানে আমার। ওহ্ সরি ওটা আমাদের ছেলে, মানে আমার আর তোমার। বউয়ের দেওয়া প্রতিটা মেসেজ আমার এক কেজি করে শরিরের রক্ত কমিয়ে দিচ্ছে। কি বলে রে পাগলিটা। আমাদের ছেলে অথচ আমিই চিনি না। আমার অজান্তে আমার একটা তিনবছরে ছেলেও হয়ে গেলো দেশ কি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রে। তাহলে কি আমার সাথে বিয়ের আগে অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছিলো নাকি? হয়তো ছেলেটার কথা আমার কাছে গোপন রেখেছিলো। পরক্ষণে মনে হলো, ধুর আমাদের তো লাভ ম্যারেজ। ২য় বিয়ে আবার কোথায় করবে। প্রথম থেকেই তো আমার সাথে প্রেম করতো আবারো বউকে মেসেজ দিলাম
—ঐ ফাজলামি রেখে সত্যি করে বলো বাচ্চাটা কার? কার না কার বাচ্চা এখন আমার বলে চালায়ে দিচ্ছে।
—বাজে কথা বলো না তো। বিয়ের আগে কত কি করেছো মনে নাই। বাচ্চাটা তারই ফল।
—ঐ দেখো আমার প্রেসার উঠাবে না। তিন বছরের রিলেশনে কয়েকবার হাত ধরা ছাড়া আর কিছুই করি নি। তো বাচ্চা আসবে কোথা থেকে। (সামান্য হাত ধরলেই কি বাচ্চা হয়ে যায় দেশ কি এখন থ্রী-জি গতির উপরে চলতেছে নাকি হাত ধরলেই বাচ্চা হয়ে গেলে তো বিয়ে করে কেউ বাবা হতে পারবে না। তার আগেই সবাই রেডিমেড বাবা হয়ে থাকবে)
—আরে মনে করে দেখো, ঠিক মনে পড়বে। দেখো দেখো আমাকে কত্ত কিউট করে আম্মু বলে ডাকছে। বলেই,সাথে সাথে একটা ভয়েস ক্লিপ পাঠায়ে দিলো। ‘ওমা এতো দেখি সত্যিই বাচ্চাটা আমার বউকে আম্মু বলে ডাকছে। বিয়ের বয়স একবছর হতে না হতেই তিনবছরের একটা বাচ্চা সৌভাগ্য বলবো নাকি দুর্ভাগ্য বলবো বুঝতেছি না। তবে এখন খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে বাড়ি গিয়ে বউকে উরাধুরা মাইর লাগাই মাথা ঠান্ডা রেখে আবারো বউকে মেসেজ দিলাম।
—আচ্ছা বুঝলাম, ওটা তোমার বেবি। কিন্তু রিয়াল মা’টা কে, নাম কি তার?
—উফপপ তুমিও না। বেবিটা আমার, আমাকে আম্মু বলছে তো বেবির মা অন্যকেউ হতে যাবে কেন? তাও তো ঠিক, রাগ আমার চরম পর্যায়ে উঠে গেছে।কয়েকটা রাগের ইমোজি সেন্ড করে বললাম।
—উফপ বলো না,কে ওটা?
—আরে আমার খালাতো বোনের ছেলে।তোমার সাথে মজা করছিলাম। আজকে আম্মুদের বাসায় এসেছিলো, আমাকে ফোন করে বলাতে আমিও ডেকে নিয়ে এসেছি। বউয়ের মেসেজটা পড়ে এবার ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো।
—ওহ্ তাই বলো। সবসময় ফাজলামি করা আমার সাথে।
—কেন,তুমি কি ভেবেছিলে। হুম
—তেমন কিছু না। আচ্ছা এখন বাই কাজ পড়ে আছে অনেক।
—এই শুনো, আমারও একটা এমন কিউট বাচ্চা চাই।
—সবে মাত্র বিয়ে করেছি এখনই বেবি আচ্ছা সময় হলেই হবে।
—নাহ্ আমার আজকেই লাগবে।
কত্ত কিউট ছেলেটা। আমাকে অনেক কিউট করে আম্মু বলে ডাকছে। আমি কিছু জানি না, আমার বেবি চায়ই চাই। ‘পাগলিটা ক্ষেপেছে রে, বাচ্চা কি নিউ মার্কেটের কোনো পন্য নাকি, যে আবদার করলো আর কিনে নিয়ে আসলাম।
—আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, এখন বাই হুম।
—আচ্ছা ঠিক আছে। আজকে কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় আসার কথা ছিলো, মনে আছে তো। বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার কথা।
—হ্যাঁ,মনে আছে।
—আচ্ছা যাও কাজ সেরে সকাল করে চলে আসবা, কেমন।
—আচ্ছা ঠিক আছে বাই।
মেয়েটা সত্যি একটা পাগলি। দিয়েছিলো তো এখনি প্রেসারটা তুলে।মাঝেমাঝে এমন সব পাগলামি করে না মেয়েটা তবে আর যাই করুক আমাকে অনেক ভালোবাসে। তিন বছর রিলেশনের পর পারিবারিক ভাবেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। যাই হোক আজকে একটু সকাল করেই বাসায় ফিরতে হবে। কারণ সপ্তাহে এই একটা দিন ছোঁয়াকে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাই। ওর আবার নদীর পাড় বসে থাকা খুব পছন্দ। বিয়ের আগেও সময় পেলেই একসাথে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। হয়তো আমার অবস্থার কথা ভেবেই পাগলিটা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতে বেশি পছন্দ করে। যাতে দশ টাকার বাদাম দিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেওয়া যাই। অল্প টাকার বেতনে ছোট্ট একটা চাকুরি করি। তাই বউয়ের সব আবদার পূরণ করতে পারি না। কিন্তু এতে তার একটুও ক্ষোভ নেই আমার উপরে। বরং আমার অল্প বেতনের কথা চিন্তা করেই দামি গাড়ির বদলে রিক্সাতে চড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কাচ ঢাকা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে অযথা খরচ হওয়ার কথা ভেবেই রাস্তার ধারে অল্প টাকার ফুচকা খেতে পারলেই অনেক খুশি হয়। অল্প টাকার ভিতরেও যে সুখ আছে তা ঐ পাগলিটায় আমাকে শিখিয়েছে। একবছর পর
—এই নাও, এখানে যা যা আছে সব কিছু কিনে আনবা। ছোঁয়ার দেওয়া ফর্দটা দেখে মাথাটা আমার বন বনিয়ে চক্রর দিয়ে উঠলো।
—এটা কি ফর্দ নাকি টক দোকানের লিষ্ট। তেতুল থেকে শুরু করে জলপাই পর্যন্ত ছোট জিনিসটাও বাদ যাই নি
—ডা. কি বললো শুনো নি। এই সময় একটু বেশি করেই টক খেতে হয়।
—তাই বলে এতোগুলি।
—হুমম,
যাও তো যাও। আমার এখনি জ্বিহ্বাবাতে পানি চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি আসবা কিন্তু। বাথরুম থেকে বার হতেই দেখি বউ একবাটি আচার নিয়ে আঙ্গুল ঢুকিয়ে চেটে পুটে খাচ্ছে (হিংসা হচ্ছে আপনাদের? সমস্যা নেই আজই বিয়ে করে ফেলুন)
—এতো টক খেয়ো না। তাহলে কিন্তু আমাদের মেয়েটা অনেক দুষ্টু হবে।
—ইহ্ বললেই হলো। আমার মেয়ে টক খেতে চেয়েছে দেখেই খাচ্ছি।
—তাই না কোই দেখি দেখি। বলেই ছোঁয়ার পেটে কান পেতে বললাম।
—মা-মোনি তুমি কি টক খেতে চেয়েছো।বেশি টক খাবে না একদম। তাহলে কিন্তু তুমিও তোমার মা’য়ের মত পাগলি হয়ে যাবে।
—ঐ আমার মেয়েকে কি বলছো, যাও তো আমাকে খেতে দাও।
—না তোমার এখন এতো টক খেতে হবে না।
আর হ্যাঁ কাজ কাম করার দরকার নেই। রহিমা খালাকে রেখে দিছি, উনিই এখন সব কাজ করে দিবে। তুমি এখন শুধু রেষ্ট নিবা। আর আমার বেবিটার খেয়াল রাখবা। ছোঁয়া আমার কথা শুনে মুচকি হাসি দিয়ে বললো
—ওটা তোমার বেবি না, আমাদের বেবি। এই দেখো দেখো পিচ্চিটা কিক দিলো এইমাত্র।
—তাই নাকি..দেখি দেখি। কিছুক্ষণ পর ছোঁয়ার পেটের ভিতরে থাকা আমাদের স্বপ্নটা আবারো নাড়া দিয়ে উঠলো।
—এই বেবি বললেই আমাদের পিচ্চিটা কিক মারছে।
আমি কান পেতে যতবারই বেবি বলে ডাক দিচ্ছি ততোবারই কিক দিচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য আর কিই বা চাই। আমরা দু’জনেই অনেক খুশি। কারণ আমাদের টুনা-টুনির ছোট্ট সংসারে একটা পিচ্চি “টুনটুনি” আসতে চলেছে। যাকে ঘিরে আমাদের বাকিটা জীবন হাসতে খেলতে কাটিয়ে দিবো। অফিসে বসে আছি এমন সময় ছোঁয়ার নং থেকে কল আসলো। কাজ ফেলে রেখে ফোনটা রিসিভ করতেই ছোঁয়ার মা মানে আমার শ্বাশুড়ি কান্নাজড়িতো কণ্ঠে বলে উঠলো।
—নীল তুমি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসো।
ছোঁয়াকে আমরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ওহ্ খুব ছটফট করছে। ফোনটা কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে রওনা দিলাম। হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম, আমার মা,শ্বাশুড়ি,শ্বশুর সবাই অপেক্ষা করছে। ছুটে গিয়ে জানতে চাইলাম।
—আমার পাগলিটা কেমন আছে?
—ছোঁয়াকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ছোঁয়াকে যে রুমের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই রুমের ছোট্ট একটা কাচ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। যে মেয়েটা সামান্য হাত কাটাতেই চিৎকার করে বাড়িসহ সবাইকে মাতিয়ে তুলতো সে আজকে অসহ্য ব্যাথা সহ্য করে সুয়ে আছে। মাঝেমাঝে ছটফট করছে, কিন্তু তবুও দাতে দাত চেপে ধরে সব সহ্য করে যাচ্ছে। আধাঘন্টা পর ডা. বের হয়ে আসলো। আমার কন্যাসন্তান হয়েছে। আমি বাবা হয়েছি। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ আমি। আমাদের টুনা-টুনির সংসারে অবশেষে টুনটুনিটা চলে এসেছে। সবাই অনেক খুশি।
—ডা. আমার স্ত্রী কেমন আছে?
—সরি,
আমরা আপনার স্ত্রীকে অনেক চেষ্টার পরও বাঁচাতে পারি নি। বাচ্চাটা খুবই খারাপ অবস্থাতে ছিলো। যে কোন একজনকে বাঁচাতে পারতাম আমরা। আমরা অপারেশনের আগেই এ বিষয়ে বলেছিলাম। কিন্তু আপনার স্ত্রী ঝুঁকি নিয়ে কাজটি করতে বলেছিলো আমাদেরকে। বাচ্চা হওয়ার খুশিতে আনন্দিত সবার মুখটা মুহূর্তের ভিতরে কালো মেঘে ঢেকে নিলো ছোঁয়ার চলে যাওয়াতে। ভিতরে ঢুকে দেখলাম ছোঁয়ার পাশে চাঁদের মত ফুটফুটে একটা বাচ্চা হাত পা নাড়িয়ে খেলা করছে। কিন্তু বাচ্চাটিকে ঘিরে যার এতো স্বপ্ন সেই মানুষটা চুপটি করে সুয়ে আছে। বুকের বামপাশটা দুমড়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে। খুব খারাপ তুমি। অনেক খারাপ। কি দরকার ছিলো এমনটা করার। কাকে নিয়ে থাকবো আমি, আমি যে বড্ড একা হয়ে গেলাম।একটাবারের জন্য আমার কথা মনে হলো না তোমার খুব তো নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছো। তুমি না একদিন আমার কাছে বেবি চেয়েছিলে। তাহলে কেন আজ অভিমান করে চুপ করে আছো। চোখ খুলে দেখো আমাদের একটা ফুটফুটে বাচ্চা হয়ছে।
একদম তোমার মত। কি হলো একটা বার চোখ খুলে দেখো। ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ক্রন্দনের আওয়াজ হয়তো সেদিন তার কানকে বিদ্ধ করতে পারে নি। চার দেওয়ালের মাঝে সেদিন নতুন একটা স্বপ্নের আগমনের সাথে আমার প্রিয়জন হারিয়ে গেছিলো। হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার পাগলিটাকে। পাশে থাকা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম, নতুন করে বেঁচে থাকার অবলম্বন করে নিয়ে। নিয়তি যে বড্ড বেহায়া। কখন যে কোন দিকে মৌড় নিবে তা নিজেও জানে না। হয়তো আমার নিয়তিতে তুমি ছিলে না।তাই তো আমায় একরাশ কষ্ট উপহার দিয়ে তুমি চলে গেলে। অনেক অনেক দুরে, সত চেষ্টার করলেও সেখানে যোগাযোগ করার মত সাধ্য নেই আমার।
সমাপ্ত